ফিরে ফিরে আসি, তোমাদের এই নগরে!
ঢাকা শহরের সুখ এখন ইন্টারনেট স্পিডে। ওলোতে ব্যাপক ভালো সার্ভিস দিচ্ছে। এক উইকের প্যাকেজ নিয়েছিলাম অর্ধেক একদিনেই শেষ। কাল বাসায় এসেই ব্যাপক উৎসাহে ডেক্সটপে বসে পড়লাম। কিসের জার্নির ক্লান্তি- কিসের কি? গত দুই সপ্তাহের ব্লগ- পত্রিকা- লিংক- ইউটিউব যা বাকী ছিল সব দেখলাম। দেখতে দেখতে বাজালাম দুটো। তাও আমার ঘুম আসে না। মামার সেট দিয়ে গেম খেললাম তিনটা অবধি। তারপর আমার এক স্কুল বান্ধবী আমেরিকা থেকে ফোন দিল। কি সব আনকমন শহরের নাম বলে, যেখানে বেড়াতে গিয়েছিল, নামই শুনি নাই। ফেসবুকে এড রিকোয়েষ্ট এক্সেপ্ট করতে বললো, আমি বললাম করবো না, বড়লোক বন্ধু বান্ধবের থেকে আমি দূরে থাকি। মন চাইলে ফোন দিবা, কথা বলবো। কথা হতে হতে চারটা। জানতে চাইলো আমার দেবর যাবে দেশে কিছু পাঠাবো তোমার জন্য? আমি বললাম- দরকার নাই বইদেশী আতর প্রসাধনের। তখনও ঘুম আসে না। ভাবলাম নাই হলো ঘুম। পিসিতে বসি আবার। ভাবতে ভাবতেই পরে ঘুমিয়ে পড়লাম সাড়ে চারটার দিকে। উঠলাম নয়টায়। তখন মনে হলো, ভালো ছিল রাতে কিছু না করে পোষ্ট লিখতে যদি বসতাম, লিখতে লিখতে শেষ হতে হতে দুটো বাজতো, ক্লান্তিতে এমনিতেই ঘুম আসতো। সব সময় এন্টারটেইনমেন্টের উপরে থাকা ভালো না।
ঢাকা থেকে গিয়েছিলাম- সেদিন খুব একটা আমোদে ছিলাম না। কারন মহাখালী তে গিয়ে দেখি লাখ খানেকের উপর মানুষ, বাসের ভাড়া ডাবল, বাস নাই। সে এক জঘন্য সকাল। এত ভোরে কিছু না খেয়েই আসলাম ক্যাবে করে। যাই হোক সাথে মামা ছিল তাই ভরসা। মামা খুঁজে খুঁজে ক্রাউন ডিলাক্স নামে এক বাসের টিকেট কাটলো। ভাড়া সহীহ ভাবে দ্বিগুন। উঠলাম বাসে। জামালপুরের বাস তাঁর সিট গুলোও সেই জেলার মতোই, যাই হোক। রাতে ঘুমোইনি। তাই ঘুম দেই আর উঠি বাস আর চলে না। ছয় ঘন্টা ঘুমালাম। ছয়ঘন্টায় বাস চন্দ্রা পার হলো না। বাস তেল নিতে থামলো, নেমে আর কি খাবো কিছুই ভালো লাগছিল না। দেখলাম সিঙ্গারা ভাজে। টাঙ্গাইলের সিঙ্গারা আর কোন যুতের হবে তাও খেলাম চা খাবো বলে। কিন্তু সেখানে চা নাই। এলাকাতেই চায়ের দোকান নাই। বাস এগুলো। আর ঘুমালাম না। আবার থামলো, এলেঙ্গায়, চায়ের দোকান পেলাম, ভালোই একটা রং চা বানালো। দাড়িওয়ালা দোকানদারদের চা ভালো হয় মফস্বলে, সবই আল্লাহর রহমত বরকত বাস যখন ছাড়লো তখন বিকেল। টানা চলে গেল আমিও ঘুমোলাম টানা। আটটায় পৌঁছলাম নানু বাড়ীতে। একদম কাটায় কাটায় বারো ঘন্টা। ঘুমিয়ে ছিলাম বলে রক্ষা। আমার সামনের সিটের যাত্রী যুগল খুব আমোদে ছিল। জামাই বঊ একজন আরেকজনের কাধে মাথা রাখে, মোবাইলে শুটআউট এট ওয়াডালা দেখে, কিক দেখে, ব্যাগ থেকে খাবার বের করে খায়, গান শুনে, মাথার চুল কান ছুয়াছুয়ি করে, আহা কি দাম্পত্য সুখ। আমার ধারনা এই হতাশাতেই আমার ঘুম আরো বেড়েছে। নানু বাড়ীতে গিয়ে মন ভালো হয়ে যায়। চির সবুজ গ্রাম, রাতের নিস্তব্ধতা ভাঙ্গে স্টার জলসার আওয়াজ, আমেরিকার শহরের পাব গুলোর মতো- এখানে চায়ের দোকান কেন্দ্রিক জীবন- সেখানেই বিশাল স্পেসে কম আলোয় তাস খেলা, লুডু,ক্যারম, ষোলো গুটি খেলছে অনেক মানুষ সব কিছুতেই বাজী, হেরে যাওয়া পক্ষ চা সিগারেট পান খাওয়াবে, টাকা পয়সার কারবার নাই। চা খেতে ইচ্ছে করলো না। সকাল নটায় ঘুম ভাঙলও। নানু বাড়ীর সব সময়ের নাস্তা সকাল বেলায় গরম ভাত আর তার সাথে ভর্তা- ভাজি- ডাল। ভালো লাগে না সকাল সকাল ভাত গিলতে। তাও গিললাম জোর করে। চাইলে এখন আমি অনেক কিছুই করতে পারি।
নিজের বাসায় চলে এলাম দুপুরেই। শান্তি পাওয়া গেল। তারপর আমার আর বাসা থেকে ঈদের নামায আর জুম্মার নামায পড়া ছাড়া একরকম বেরই হওয়া লাগে নাই। সারা দিন রাত বাসায়। আগে ফোনে খুব কথা বলতাম বন্ধুদের সাথে তাও বন্ধ। আম্মু আব্বুর সাথে কথা বলা, বাসাতেই নামায পড়া, বই নিয়ে বসা, আর খানাদানা ও টিভি দেখা। ল্যাপটপ নিয়ে যাই নি, তাই অকেজো এন্ড্রয়েড ফোনটাই ভরসা। তাতেই স্ট্যাটাস দেই, গান নামাই, বই পড়ি, পত্রিকা পড়ি, আর চার্জে ঝুলাই। টিভি এবার তেমন দেখি নাই, তাও আপনাদের চেয়ে অনেক বেশী। আব্বু টিভির সামনে আসলেই আমি উঠে বই পড়ায় মন দিতাম। পাঁচটা বই শেষ করেছি বারো দিনে। চির ভালো লাগার বই টেনিদা সমগ্র, আহমদ ছফার প্রবন্ধ আবার পড়ে পড়ে শেষ করা, আবুল মনসুর আহমদের রাজনীতিত ৫০ বছর, আবুল কাশেম ফজলুল হকের সংস্কৃতি নিয়ে একটা ঢাউস প্রবন্ধ সংকলন, সাপ্তাহিকের ঈদ সংখ্যা সব শেষ। রাত তিনটা পর্যন্ত জেগে জেগে খালি পড়েছি। টানা বারো দিন ১ কি ২ বেলা ছাড়া সব সময় গরুর মাংস খেয়েছি। চেহারাটাও গরুর মতো হচ্ছে দিনকে দিন। আম্মুর হাতের পোলাও খুব ভালো লাগে। আয়োজন ছাড়াই প্রতি বেলায় বেলায় পোলাও সাটিয়েছি সমানে। একদিন সব্জি দিয়েছিল, মুখ কালো করে বললাম, ঢাকায় খাই মুরগি- ডিম- সব্জি-- এখানে তা কিছুই খাবো না। ঈদ আসলো কাউকে তেমন ফোন দেই না, শুভেচ্ছা জানাই না, বন্ধুরা ফোন দেয় আমি শুধু রিসিভ করে কথা বলি। আর সিগনিফিকেন্ট তেমন কিছুই করি নি। যাই টিভি দেখেছি তা নিয়ে লিখবো সামনে।
আব্বু লাইনে দাঁড়িয়ে সকাল সকালে গিয়ে আমার টিকেট কেটে দেয়। আবার ফোনও দেয়, অগ্নিবীনা পাওয়া যাচ্ছে না- ব্রহ্মপুত্রে যাবি না তিস্তায় যাবি? আমি তো যেতে চাই যমুনাতে। মাঝ রাতে সেই ট্রেনটা ঢাকার উদ্দেশে ছাড়ে। দারুন সুইট এক জার্নি হয় ভোর থেকে সকাল দেখতে দেখতে। কিন্তু তাতে আব্বু আম্মুর সমস্যা। এত রাতে যাবি কি করে? জামালপুর তো আগের মতো সেইফ নাই। তাই তিস্তার টিকেটই কাটলো আব্বু। আমার আব্বু আম্মুর মতো কিউট মানুষ- আমার জীবনে বিরল। যখন যা চাই, যা বলি, সব মেনে নেয়, সব পেয়ে যাই। অথচ ছোটবেলায় কি বকাবকি আর মার খেতে খেতেই না বড় হইছি। গতকালের বিকেলের ট্রেন যাত্রাটাও হলো দারুন। এবার সব কিছুই পারফেক্ট, সঠিক সময়ে ট্রেন, জানলার পাশে দারুন প্রথম শ্রেণীর আসন, আব্বু ষ্টেশনে এসে ট্রেনে তুলে দিতে আসা, দারুন রোদেলা বিকেল। এমন বাংলাদেশই আমরা চেয়েছিলাম। তাও সুখের অসুখ থাকে। আমার সামনের যাত্রী বুড়ো, স্মার্ট মোছওয়ালা। পাঞ্জাবীতে মুক্তিযুদ্ধ সংসদের ব্যাচ। সামনে খাবার বা পেপার রাখার যে টেবিল থাকে তাতে তিনি বসালেন এক হিজাবী মেয়েকে। সেই মেয়ের বাবার সাথে শুরু করলেন আলাপ। আগের দিনের শিক্ষা ব্যাবস্থা কত ভালো ছিল তা নিয়ে। জামালপুর জেলা স্কুলের কোন স্যার কিভাবে পেটাতো তা নিয়েই আলোচনা। মারামারি যদি এডুকেশন সিষ্টেমের মাপকাঠি হয়, তাহলে তো মাদ্রাসায় সব চাইতে বেশি পড়াশুনা হয়। যা হোক তারা ময়মনসিংয়ে নামলো। সেই ভদ্রলোক জানলায় সিগারেট ফুকেন বাতাসে তা আমার নাকে আসে। মেজাজ খারাপ ছিল, কিন্তু বকা দিলাম না, কারন সত্যি যদি মুক্তিযুদ্ধ করে থাকে তবে তিনি গাজা খেলেও আমি মানা করবো না। কারন তাঁদের জন্যই আমাদের দেশের ট্রেনের নাম তিস্তা যমুনা অগ্নিবীণা। এমনিতেই ট্রেনে ভীড়, ময়মনসিং থেকে লোক এত উঠলো ট্রেনে এক ফোটা জায়গা নাই। আমার সিটের হ্যান্ডেলে বসলো একজন,সেই টি টেবিলে বসলো আরেকজন। আমি আর কি কানে হেডফোন দিলাম। তখন সন্ধ্যে নামছে। তার আগে বিকেলটা দারুন ছিল। সবুজ সব ধানক্ষেত নয়তো সাদা সাদা কাশফুল। জানের দোস্তকে টেক্সট করলাম, তুমি থাকলে মুগ্ধ হতে, ঢাকাতেই তো ঈদ করে গেলে সমানে বছরকে বছর। কি সুন্দর সবুজ রঙ্গীন অঞ্চল। ট্রেন আমার এই কারনেই ভালো লাগে, যতই ভীড় থাকুক। এক ছন্দময় গতিতে বাংলাদেশ যে কত সুন্দর তা দেখতে দেখতে যাওয়া যায়। ট্রেনের স্পিডও ছিল খুব ভালো। মাত্র চার ঘন্টাতেই ঢাকা এয়ারপোর্ট। তাও শ্রীপুরে আউটার ক্রসিংয়ে দাঁড়িয়ে ছিল কত সময়, লোকজন সেই সময় চা সিগারেট পরোটা পান কতো কি নেমে খেলো, আমি কিছুই খাই নি। কারন বাসা থেকে আসার সময় গরুর মাংস, পোলাও, রুই মাছ ভাজা, বেগুন ভাজা, ডাল দিয়ে খেয়ে আসছি। সেই স্বাদ ভুলতে চাচ্ছি না। ক্যাবে সরাসরি এসে পড়লাম চায়ের দোকানে। দেখি ভাংচুরে একাকার। ওয়াসা নতুন পাম্প বসাছে তাই দেয়াল টেয়াল ভেঙ্গে, পাইলিং টাইলিং করে এক অদ্ভুত জায়গা বানিয়েছে। ভাগ্যিস দুটো ইলেক্ট্রিকের খাম্বা ছিল সেই ফাকে বারেকের দোকান, তাই বারেকের দোকান সাময়িক ভাবে ফুটপাতে বসলেও টিকে যাবে। চা খেলাম। পুলকের সাথে আলাপ হলো। দশটায় বাসা ফিরলাম। দেখি টিভিতে ছবি আসে না, খালি নীল রং আর সাউন্ড। পুরাই রেডিও। জানি না সমাধান কি। অনেক চেষ্টা করলাম ঠিক হয় না। ফিরে আসলাম তোমাদের নগরে!
ওয়েলকাম ব্যাক আমাদের নগরে .... পোষট দারুন হয়েছে
বেশ হাসলাম
ওয়েলকাম টু ডার্টি এ্যান্ড জ্যামেস্টিক বাট লাভলি ঢাকা শহর।
হ তোমাদের শহরে আসিলাম আর জানিলাম তোমরা ভালোই আছো ফাকা ফাকা ঢাকায়!
আমি এখনো সবুজ গ্রাম থেকে ফিরে যাইনি
শোন, বান্ধবীদের দেবর হয়ে গেলো, তোমার শালী না হোক বউ হোক শীঘ্্রই। তাইলে আর বাসের সামনের সিটের দাম্পত্য সুখ দেখে উদাস হতে হবে না, ঢাকায় শুধু ডিম, সবজিও খেতে হবে না
দারুন একটা ভ্রমন দিলেন। কিন্তু কোরবানীর মাংস যারা খায় না তারা ভ্রমন দিয়েই বা লাভ টাকি?
আমি এখনো সবুজ গ্রাম থেকে ফিরে যাইনি
শোন, বান্ধবীদের দেবর হয়ে গেলো, তোমার শালী না হোক বউ হোক শীঘ্্রই। তাইলে আর বাসের সামনের সিটের দাম্পত্য সুখ দেখে উদাস হতে হবে না, ঢাকায় শুধু ডিম, সবজিও খেতে হবে না
আমার আম্মুর নানু বাড়িও জামালপুর
তাই নাকি? দারুন তো
আমার বাবা মা দুইজন বাড়ীই জামালপুর তাঁদের কারনে আমার বাড়ীও জামালপুর, তাই আমাকে জামালপুরে যেতেই হয়!
এই জটের শহরের বড় মায়া! একে ছেড়ে যাওয়া হয়না আর। বেড়াতে গেলেও দু-এক দিনের জন্য। সেই কবে গ্রামে ঈদ করেছি মনে নেই।
তোমার লেখাটা খুব ভাল লাগলো।
তারচেয়ে আমার ভালো লাগছে অনেকদিন পরে আপনাকে ব্লগে পেয়ে।
রিয়াসা ও তাঁর মা কেমন আছে?
ঢাকা একটা নেশা!
বাজে নেশা!
মন্তব্য করুন