এ ট্যুর টু রিমেম্বার!
আমার বেশীর ভাগ পোষ্টই কিছুটা উদাস উদাস ভাব থেকে লেখতে বসা শুরু হয়। অথচ আজ পোষ্ট লিখছি খুব মন ভালো থেকে। এরকম মন ভালো থাকার দিন খুব বেশী আসে না আমার জীবনযাপনে, এক ভালো সময়ের ঘোরের ভেতরে আছি। যদিও শরীরটা ভালো না, টানা জার্নির ধকলে কিছুটা টায়ার্ড, তারপর আমি আবার বাসে ঘুমাতে পারি না। তাই কেমন জানি শান্তি লাগছে না শরীরে। জ্বর আর ঠান্ডায় খুব কাহিল কাহিল লাগছে। তবুও শেষ পর্যন্ত মন যেহেতু ভালো খুব তাই এসব টুকটাক অসুবিধায় কিছু যায় আসে না। এই শরীর খারাপ নিয়ে মশার কামড় খেতে খেতে লিখছি এই লেখা। একলা অবসরে আমার ভাবনার প্রিয় বিষয় এ যাবতকালে ব্লগে ব্লগে কি লিখলাম, ভাবতে ভাবতে নানান টুকরো স্মৃতি মনে আসে। সময় যখন আরো চলে যাবে জীবন থাকে, তখন মন হবে এইসব ব্লগে লিখে রাখা টুকরো স্মৃতিগুলোই বেঁচে থাকার আশ্রয়। কারন স্মৃতিশক্তি ক্রমশ প্রতারণাপ্রবণ, সব কিছুই গুলিয়ে দেয়। মনে হয় সব কিছুই ভাসাভাসা, অথচ এই পোষ্টগুলো আমাকে মনে করায় স্পেসিফিক কি কি ভেবেছিলাম আর করেছিলাম তখন। একটা সময়ে হয়তো ভাবনা গুলোকেই মনে হবে কত দামী।
যে বন্ধুর আকদে গিয়েছিলাম, সে আমার কঠিন বন্ধু। তারচেয়েও কঠিন তার প্রেমের গল্প। তার প্রেমের গল্প যখন সুযোগ পাই তখনই বলি, কারন এরকম কমিটমেন্টের শক্তি খুব কম লোকেরই থাকে। আগেও হয়তো কোনো পোষ্টে বলেছিলাম, আজ আবার বলি। বছর সাতেক আগে এক র্যাবের কর্মকতা খুন হয়েছিলেন আমিনবাজার ইটভাটায়। সেই ভদ্রলোক ছিলেন আমার এক বন্ধুর বাবা। আকস্মিক মরনে সবাই দিশেহারা। এক রাতের ব্যাবধানে আমরা সব বন্ধু আর্মফোর্স ব্যাটেলিয়নের সদর দফতরে, সেই কড়া রোদের দিনটার কথা এখনও মনে পড়ে। আমার বিজনেস ম্যাথ মিডটার্ম, কিসের ম্যাথ কিসের কি, সোজা সিএঞ্জি চাপিয়ে ওখানে। দেখি ঢাকায়- চট্টগ্রামে যাদের পাওয়া গেছে সবাই হাজির। সবার ভেতরে হাসির ঠাট্টার আমেজ, কিন্তু বাইরে কান্নার অভিনয়। তখনও আমরা ছোটোমানুষ এইসব মৃত্যু শোক তেমন গায়ে মাখি না। জানাযা হলো, ডিজি মিজি হোম সেক্রেটারী যা আছে সব আসলো। গাড়ীতে জায়গা নাই তাই আমি ইচ্ছা সত্ত্বেও যেতে পারি নাই বরিশাল। এই দুর্দিনেই বরিশাল সফরে গিয়ে আমার বন্ধুর সেই পিতাহারা বন্ধুর কাজিনের সাথে প্রেম হয়। ফিরে আসে চট্টগ্রাম। দুজন দু শহরে ফোনে অবিরত কথা চলতে থাকে। প্রেম জমে ক্ষীর। জানাজানি হয়, মেয়ের বিয়ের তোড়জোর শুরু হয়। এদিকে ছেলের কেবল থার্ড ইয়ারেই, হুট করেই মেয়ের বিয়ে হয় এক চাকুরীজীবি ছেলের সাথে। মেয়েকে ভুলতে গিয়ে আমার বন্ধু দিনে ৫০ খানা করে গোল্ডলীফ খায়, হতাশায় কাটায় দিন, পড়াশুনায় মন দেয় না, এভাবে দিন চলতে থাকে। যার সাথে মেয়েটার বিয়ে হয় সেই ছেলেটা বহুমাত্রায় খাটাশ প্রকৃতির, দুই বছর অনেক কষ্ট সহ্য করেও সংসার আর টিকে না। মেয়ে বাপের বাড়ীতে ফিরে। নতুন উদ্যোমে আবারও প্রেম শুরু হয়। আস্তে আস্তে দুইজনই আগের মতো নরমাল হয়ে যায়। আমার বন্ধু টিউশনী করে যা পেত টাকা সব দিয়ে সারাদিন সেই মেয়েটার সাথে কথা বলতো। মাঝে মাঝে টাকা পয়সা জমিয়ে একদিনের জন্য চলে যেত বরিশাল। চাকরী পেল একটা চবি থেকে মাস্টার্স করে, বাবা মাকে রাজী করালো অনেক কষ্টে। আর অনেক কিছুর পর আনুষ্ঠানিক ভাবে আকদ হয়ে গেল। ওর ভাই লিভারপুল থেকে আসলে সামনেই অনুষ্ঠান। আর আমি কি ভাগ্যবান, যে চারপাচজন দাওয়াত পেয়েছে বরযাত্রী হবার আমি তাঁদের ভেতরে আছি। আমার জন্য গাড়ী পাঠানো হয়েছে যদি না যেতাম তাহলে নাকি আমার বাসার নীচে দাঁড়িয়ে থাকতো তাঁরা গাড়ী নিয়ে। এরকম ভালোবাসা আর কজনের কপালে জোটে? সকাল বেলা নামলাম বন্ধুর বাসায়। সন্ধ্যেতে তাপানুকুল ঢাউস মাইক্রোবাস আমাদের নিয়ে রওনা দিবে। এক ফোটা ঘুমাই নাই, এসেই ম্যারাথন আড্ডা। আমার জন্য অফিসে যায় নাই দুই জানের বন্ধু।
বন্ধুর বাবা মা চাচা আর আমরা ছয় বন্ধু-- এরকম অসাধারন ট্রিপ আগে কখনো দেই নাই। মন চাচ্ছে গাড়ী থামাচ্ছি, খাচ্ছি, সিগারেট চায়ের ব্রেক দিচ্ছি সব কিছুই আমাদের ইচ্ছায়। আর আমাদের প্রিয় খেলা পারস্পারিক পচানী পচানী খেলা তা চললো দারুন। অনেক লম্বা সফর তাই খাবার দাবার আর ব্যাগ ব্যাগেজে ঠাসাঠাসি অবস্থা। ড্রাইভার ভালো চালায় কিন্তু বেশী সতর্ক তাই আমরা চাঁদপুরের হরিনাঘাটে গিয়ে দেখি ফেরী নাই, আসতে সময় লাগবে দুই ঘন্টা। নদীর পাশে ফেরীর ছাওনিতে বসা, শীতল বাতাস, মাঝ রাত থেকে ভোর হচ্ছে, ধুমায়িত চা, দারুন এক সময় বন্ধুদের সাথে। কত কিছু নিয়ে অবিরাম বকছি সবাই তা নিজেরাই জানি না। এমন সময় এলো এক লাশবাহী গাড়ী। এক বিজিবির জোয়ান, ম্যালেরিয়ায় মারা গেছে খাগড়াছড়িতে, বাড়ি বরগুনায়, আত্মীয় স্বজন কেউ আসে নাই, এক তাগড়া লোক আর ড্রাইভার নিয়ে এসে সিরিয়ালে দাড়ালো। এত বন্ধু আড্ডা গান হাসি তামাশা সব কত ঠুনকো, তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে ভোর নামলো। ফেরী আসলো, ছোট্ট একটা ফেরী, রঙ চা খেলাম আর সেখানকার স্টাফদের সাথে খাজুরে আলাপ জূড়ে দিলাম। মাদারীপুর আর শরীয়তপুরের ফাকা ফাকা রাস্তা দিয়ে এগুচ্ছি কিন্তু পথ আর ফুরোয় না। আরেকটা ফেরী আসলো সেইটা ছোট ও কম সময়ের। দুপুর দেড়টায় অবশেষে আসলাম কাঙ্ক্ষিত বাড়ীতে। শুরু হলো আপয়্যনের বহর। আমাদের জন্য রুম দেয়া হলো, গোসল করলাম। বরযাত্রীদের যে এরকম ঢাসায় খাওয়ানো হয়, তা আমার জানা ছিল না। দারুন রান্না আর জোর জবরদস্তি করে সবাইকে খাওয়ানো। বিকেলে বিয়ে হলো। ওজু করে বসলাম, মিস্টির বন্যা বয়ে গেল। আমার মিষ্টি ওতো ভালো লাগে না, কিন্তু তা বলার সুযোগ কই? বরিশালে আমাদের এক বন্ধু আছে বিরির বিজ্ঞানী,সে আসলো। আমাদের আড্ডায় এলাকা মুখরিত। সবাই জেনে গেছে আমরা জামাইয়ের দোস্ত বন্ধু। সন্ধ্যা বেলায় নাস্তার যা বহর তা আরো অবাকের। এত আইটেম মনে হয় ব্যুফে খেতে আসছি। তবে ব্যুফে তে এত টানাহেঁচড়া চলে না খাওয়ানোর জন্য। আমরা আমাদের রুমে গেলাম, কার্ড খেলতে বসে গেলাম সবাই। আমার চোখে ঘুম, তাই দু ঘন্টা ঘুমিয়ে নিলাম। এবার শুরু রাতের খাবার, রাতে খেতে কি যে কষ্ট হইছে সবার কারন রাশি রাশি আইটেম, সব গুলাই অসাধারণ কিন্তু পেটে জায়গা নাই আর জোরাজুরি তো চলছেই তুমুল গতিতে। ঘুম দিলাম সবাই। আহ কি শান্তি। সকালে দুনিয়া সেরা খিচুরী খেয়ে, বরিশাল শহর দেখলাম, সুন্দর ছিমছাম শহর, ফাকা ফাকা রাস্তা ঘাট, আর এত সবুজ মাঠ আর খাল দেখতে অসাধারণ। এত অসাধারণ জায়গা ছেড়ে কেন সবাই এরা ঢাকায় আসে তা আমি বুঝলাম না। একটা পার্ক আছে খুব সুন্দর নামটা মনে নাই, ব্যাপক ব্যায়বহুল নির্মাণ সেন্টুর মসজিদটা দেখলাম। মসজিদকেও বাঙ্গালী ডেটিং স্পট বানিয়ে ছেড়েছে। আসলাম বাড়ীতে, চললে ডাব উৎসব, এত টেস্ট ডাবের পানিতে পুরাই ফিদা। দুপুরেও খেতে হলো বাধ্যতামুলক এত এত রান্না। ভাবী তো আমাদের আগে থেকেই চিরদিনের চেনা মানুষ, সেরকম হাসি তামাশা আর করা গেল কই? যার কাজিন সেও তো আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু তাঁকে সাথে নিয়ে এলাকাটা চক্কর মারলাম। মৃত বন্দরের আশপাশটা দেখে মনে হলো ছবির মতো সুন্দর। যাবার সময় হয়ে গেল, বিদায় নিলাম, আমার বন্ধুর বাবা মা একদিনের ব্যবধানে ছেলে বউয়ের সাথে এত নিবিড় সম্পর্ক করে ফেললেন, খুব বিস্মিত হলাম। আংকেল আন্টি কাঁদে, ভাবীও কাঁদে সে এক সিন। বাবা মা আসলে সন্তানকে কি ভালোবাসে তা আবার বুঝলাম। গাড়ী ছুটে চললো মাওয়ার দিকে।
মাওয়ায় এসে ফেরী পার হতে হতে চলে গেল তিন ঘন্টা। ফেরীর ছাদে শন শন বাতাসে অন্ধকার নদী দেখলাম আর আড্ডা জমালাম। দুই সুন্দরী তরুনীর আবির্ভাব, সবার চোখ সেখানে। বন্ধুরা দেখলাম যার যার মতো করে এক্সপার্ট ওপিনিয়ন দিলো। আমার কোনো মতামত নাই, এইসব মেয়ে- মোহ- ভালোবাসাবাসি সব ফ্রিজে জমা রেখে যে চলি তা নিয়ে বয়ান দিলো। আমার নাম সাথে সাথে হয়ে গেল- আয়রন ম্যান। ভাবীরা আসার সময় বিরিয়ানীর প্যাকেট দিয়েছিল, খেলাম ফেরীর ক্যান্টিনে, ফেরীর চা সব সময়ই ভালো হয় এবারো ব্যাতিক্রম না। গাড়ী ছুটে চললো। আমার ইচ্ছে ছিল যাত্রাবাড়ীতে নেমে যাবো, কিন্তু সবার জোরালো চাপাচাপিতে নামা আর গেল না। সকালে গিয়ে নামলাম চট্টগ্রাম। সবাই ঘুমিয়েছে, আমার ঘুম আসে না, অন্ধকার রাস্তা আর গাড়ী দেখতে দেখতে এতোটা পথ পেরুলাম। কুমিল্লায় ছান্দু মিয়ার হোটেল আছে, খুব দারুন রান্না, রেন্ট কার ড্রাইভারদের খুব প্রিয়। সবাই গরম গরম পরোটা খেল, আমার খাওয়ার মুড ছিল না, চা নিলাম এ যাবত কালের খাওয়া অন্যতম জঘন্য চা। চিটাগাংয়ে ছিলাম তিনদিন। দিনের বেলা সীবিচে গিয়ে বসে থাকা, আর সন্ধ্যায় 'মায়ের দোয়া হ্যাভেন ফুডসে'র আড্ডা। সব বন্ধুরা আসে শহরের নানান প্রান্ত থেকে, আড্ডা জমে প্রতিদিন। কাটলেট, টিকিয়া, কিমাপুরী, নুডুলস, রোল কত কি খেতে হয় আর সাথে তো তাঁদের খুব ভালো চা আছেই। রাতে থাকি আরেক বন্ধুর বাসায়, দুটো তিনটা বাজে কথা বলতে বলতে। এত কথা তাও কথা ফুরোয় না। তার রুমটা ছোট, বাইরের আলো আসে না, কিন্তু দারুন লাগে। গাদাগাদি বই পিসি খাট টেবিল তার ভেতরে অবিরাম সেই আগের মতো নিজেদের যত আলাপ আছে সব বলে ফেলা, কে এখন কেমন আর আগে কি ছিল তা নিয়ে মুল্যায়ণ। নেভীর অফিসার বন্ধুরা আড্ডায় আসে তাঁদের প্রেসিডেন্ট প্রটোকলের গল্প শুনি, সাধারণ নাবিক বন্ধুরা আসে তাঁদের কষ্টের গল্প শুনি, গার্মেন্টস, ইপিজেড আর টেক্সটাইলের কর্মরত দ্বায়িত্বশীল বন্ধুরা আসে তাঁদের এক্সপিরিয়েন্স, বেকার বন্ধুদের হতাশার কথা শুনি, রাত হলেই পনেরো নাম্বারে যাই, কাকড়া পিয়াজু খাই দলবেঁধে, দারুন মজা। সবাই বলে সাগর আর পাহাড় কোনটা ভালো, আমি দুইয়ের ভেতরেই ছিলাম শৈশব কালে। নদী আর সাগরের বিপুল সুন্দরের সাথে পাহাড়ের তুলনাই চলে না। ঢাকায় আসি, নন এসি বাসে করে, একরাশ মন খারাপ নিয়ে, এত রাতেও বন্ধুরা আসে বিদায় দিতে,আপ্লুত হই। আমার চোখ ছলছল করে, চাইলেই কাঁদা যায় কিন্তু আর হয়ে উঠে না। মেঘনা ব্রীজে দেরী তাই আসতে আসতে নটা বাজে। সিএঞ্জি নিয়ে সোজা বাসায় নামি, মামাকে দেখি, বারেকের দোকানে যাই, সবাই আসে আমার খোজ নিতে, আমার ঢাকা প্রেম আবার তরতাজা হয়। সব ভুলে গেলেও এই অসাধারণ সফরের স্মৃতি কখনোই মুছে যাবে না মন থাকে
এই পোষ্ট নিবেদন করলাম তানবীরা আপুকে। দুনিয়ার এত চমৎকার সব জায়গায় উনি ঘুরেছেন মেঘ আর দুলাভাইকে নিয়ে, খালি হিংসে হয়।
আহ, লাইফ ইজ বিউটিফুল..
মাঝে মাঝেই এরকম চমত্কার সব দিন ফিরে আসুক আপনের পথচলায়..
তোমার জন্যেও অনেক অনেক শুভকামনা। মন দিয়ে পড়ো।
আপনার পথচলাটাও আনন্দের হোক ভাই!
চমৎকার শান্ত। এমনি ঘুরে বেড়াও আর তোমার চোখ দিয়ে আমরাও এই ভ্রমণের আনন্দ ভোগ করি।
থ্যাঙ্কস আপু। আপনারা পড়েন তাতেই খুশী।
আরে আমিতো জানিই না। পোষ্ট পেয়ে সবসময় ভাল লাগে, আজোও তাই
থ্যাঙ্কস আপু!
মন্তব্য করুন