দিন প্রতিদিন বইমেলায়-- (১)
দেখতে দেখতে বছর শুরু হয়ে শেষ হয়ে গেল জানুয়ারী। আবার ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথম দিনও শেষ। এই অবরোধ আর দাঙ্গা হাঙ্গামার থমথমে দেশে সময়ই শুধু কেটে যায় এত দ্রুত। আর কিছুই কাটেনা। সময়কে যদি অবরোধ দিয়ে আটকে রাখা যেত তাহলে দারুন হতো। কিন্তু দেশের ক্রান্তিকাল হোক আর স্বর্নালী দিন হোক সময় যায় এক ভাবেই। দ্রুতগামী ট্রেনের মতোই ছুটে চলছে, আর জানিয়ে দেয় আমরা ট্রেন মিস করেছি কতবার, দুনিয়াটা কত বদলে যাচ্ছে। ট্রেন নিয়ে কথা বললেই এখন শুধু আওয়ামীলীগ বিএনপির বাগবিতণ্ডার কথা মনে আসে। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন একবার, 'বিএনপি ইলেকশন ট্রেন মিস করেছে, আবার ট্রেন আসলেই পাবে উঠার সুযোগ, তাঁর আগে ট্রেনে আসার মতো পরিস্থিতি নাই'। বিএনপির কোন বড় নেতা জানি বললেন, 'টিকেট ছাড়া যেই লোকাল ট্রেনে ভ্রমন হয়, সেই ট্রেনে বিএনপি উঠে না। আর আমরা আপসোস করবো, একটা ট্রেনে উঠা নিয়ে যে দেশে পলিটিক্যাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং নাই, সেই দেশ শুধু ট্রেন মিস করে- পিছিয়ে পড়ার উপরেই থাকবে।
তবে ফেব্রুয়ারী মাস আমার কাছে মহান একটা মাস লাগে। তা আজকে থেকে না, ঢাকায় আসার পর থেকে। ঢাকায় খুব বোরিং সময় কাটতো সেই দিনগুলো। ফেব্রুয়ারী মাসটাই একমাত্র মাস যে মাস আমার দেখা হয় নাই, এক অন্যরকম ভালোলাগার ঢাকা শহর। চিটাগাং বসে ভাবতাম, এই শহরে একটা মেলা হয় না- বইয়ের এইটা কেমন কথা। বিজয় মেলা নামের একটা মেলা হতো, সেখানে কয়েকটা স্টল ছিল বই রিলেটেড। আর বইয়ের জন্য আমাদের ধার উধার করেই চলতে হতো। এবং অনেকের বইই আবার ভাইবোন থেকে প্রাপ্ত। যেমন বাবু ভাইয়ের বোন সমরেশ পড়তো, সেই উসিলায় আমার সমরেশ পড়া হলো। আবার আমার টেনিদা ছিল ধার করা তা আরেকজনকে ধার দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের দু খানা বই। বিনিময় প্রথায় আমার তেমন জোর ছিল না, তবে আমি বই ফেরত দিতাম ঠিকঠাক। এই জন্যে বই পেতাম ভালোভাবেই। কারন বই পড়লেই শেষ, তা মেরে সংগ্রহ বাড়িয়ে লাভ নাই। আমার বন্ধু ছিল কেবল কলেজে উঠেছি, একাদশ শ্রেনীতে সে বই কিনতেই ঢাকা গেল। ৫০০০ টাকার বই কিনলো। তখন ৫০০০ টাকার অনেক দাম। বাংলা একাডেমীর বই ও হুমায়ূন আহমেদ কিনা বস্তা আকারে আনছে। আমাকে ডাকলো, প্যাকেট খুলছি। সে কি উচ্ছাস তখন আমার। মনে হয় আমি কিনে আনলাম। আমার স্মরনশক্তি তখন খারাপ ছিল না। সেই প্যাকেট খুলতে গিয়েই, কি কি বই কিনছে সাথে সাথেই তার একটা লিষ্ট, বন্ধুর পিসিতে বানিয়ে দিলাম। তখন থেকেই ভাবতাম মেলায় কবে যাবো। এরপর ঢাকায় আসলাম মেলায় গেলাম, একা একা ঘুরলাম। দিন গেল, বন্ধু হলো, আড্ডা হলো, বই কিনলাম রাশি রাশি, বড় ভাই বোন- বন্ধুরা কিনে দিল। এই করেই চলে যাচ্ছে অসাধারণ দিন। বইমেলায় তো অবশ্য বন্ধু বান্ধব না থাকলেও ভালো, একা একা অনেক বই দেখা যায়। নানান মানুষের কথা শোনা যায়। এবারও মেলায় যাবো। আর গেলেই এই সিরিজের একটা একটা পোষ্ট লিখবো ব্লগে।
একটা মাস, ২৮টা দিন, এই অঞ্চলের মানুষের বাংলা ভাষা প্রেম দেখানোর এক দারুন সময়। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছিলেন, আমরা সবাই ইংরেজী জানলে কবেই মুখের ভাষা বাংলা হারিয়ে যেত। এই মাস বই মেলারও সময়, তিন চার হাজার বই বের হবে, ২৫-৩০ কোটি টাকার ব্যবসা হবে, অবরোধের ভেতরেও লাখো জনতার ভীড় হবে, ধুলার সমুদ্রে গড়াগড়ি খাবো। রিটন ভাইরা বিকেল বিকেল হাজির হবে টিভিতে, চ্যানেলের সংখ্যা বেড়েছে- মিডিয়ার উপদ্রব আরো চলবে। অনেকেই আহাজারি করবেন- হুমায়ুন আহমেদ ছাড়া মেলা শুন্য শুন্য লাগে। মিলন ভাই, অনন্যায় বসে থাকবে আর সাইন মারবে, স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে আনিসুল হক সাব- সমানে দিবে অটোগ্রাফ আর তুলবে হাসোজ্জল সেলফি। ক্যামেরা নিয়ে রিপোর্টাররা খুজবে ঘুরতে আসা মুরগী। আমরা ২০ দিন যাবো, আমাদের মতো কতিপয় মানুষ মাথা নিচু করে স্টলে স্টলে বই দেখবে, বের হয়ে গরম পানি মার্কা চা খাবো, অনেক কষ্টে বাসা- ভাই ভাবী বন্ধু বান্ধবের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বই কিনবো। মাস শেষে ভাব নিবো, এবার তেমন আর কেনা হলো কই? ক্রয় করা বই এমন ভাব নিয়ে পড়বো যেন পবিত্র কোনো কিতাব পড়িতেছি।
প্রথম দিন তেমন কেউ মেলায় যায় না, ভিআইপিরা ছাড়া। আমি প্রথম দিনও যাই। ২০০৯ সালে হয়েছিল মজা। সবার আগে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, প্রাইমিনিষ্টারও তখন বের হন নাই। দাঁড়িয়ে থাকলাম, তাঁরা চলে গেল, আমি সবার আগে মেলায় ঢুকলাম। এবার অবশ্য তা হয় নাই। পকেটে ছিল ১০০ টাকা। বের হলাম টাকা না নিয়েই। হেঁটে হেঁটে গেলাম ধানমন্ডী ৫। ব্যাপক কষ্ট হলো হাঁটতে। গিয়ে বসলাম- সেখানে আড্ডা দিলাম। বের হয়ে রিকশায় গেলাম টিএসসি। ফাকা শহরে রিকশা সাই সাই করে চলে। বন্ধু জেমস আমার আশায় বসে আছে। বাংলা একাডেমীর ওখানে। অদিতি আপুকে খুঁজলাম, দেখি উনি নাই। আমরা গেলাম আসল মেলায়। লিটলম্যাগকে মেলা থেকে আলাদা করে এক আজাইরা অবস্থা বানাইছে। মেলায় ঘুরবো, লিটল ম্যাগে আড্ডা দিবো সেইদিন শেষ। মেলায় তো ধুলো বালি থাকবে তা জানার কথা। তবে এবার মাত্রায় অতিরিক্ত। যারা মুখে পট্টি বাধতে পারেন তারা মাস্ক পড়েই আসবেন। লোকজন ছিল না তাতেই এই অবস্থা, লোকজন বাড়লে কি হবে ভেবে নিন। এবারের মেলায় ব্যাপক স্পেস। মোটামুটি পাঠক প্রিয় স্টল গুলোর সামনে অনেক জায়গা। প্রথমার সামনে এত জায়গা আনিসুল হক ভাই অবলীলায় টানা বিশজনকে অটোগ্রাফ এক সাথে দিতে পারবেন। অনন্যা, অন্বেষা, মাওলা, অ্যাডর্ন, অন্য, রোদেলা, দিব্য, ইত্যাদি, পাঞ্জেরী, অবসর সবকয়টার সামনেই ভালো জায়গা। কেউ বই কিনতে চাইলে এবার ভীড় তেমন ব্যাপার না। মেলা অনেক লম্বা, প্রশস্ত। হাঁটতে হাঁটতে জান বের হয়ে যাবে। তবে মেলার গিঞ্জি ভাব- তাও বজায় আছে। অনেক নরমাল প্রকাশকরা পাড়া মহল্লার মতো গায়ে গায়ে লাগানো দোকান। তবে সবচেয়ে খারাপ স্টল পজিশন দেখলাম সংহতির। গত দু তিন বছর ধরে তাঁরা মোটামুটি ভালো বই আনে বাজারে, তাঁদের স্টল এক চিপায়। ফিরোজ ভাই নাই। কৌশিককে পেলাম। দেখি পুরা বিপ্লবী চেহারা হয়ে গেছে। যেদিকেই যাই মনে হয়-ধুলোবালির সাগরে আসিলাম, লোকজন খুব কম, পুরাই ফকফকা অপ্রস্তুত. কাচা রংয়ের গন্ধ ওয়ালা মেলা প্রান্তর! নতুন বই তেমন দেখলাম না এখনো। দিব্যপ্রকাশের সামনে জেমস আমাকে জিগেষ করছে, সাবের ভাই কেমন লিখে। আমি বললাম অসাধারণ, তবে কিনে পড়ি না, ধারে পড়ি। দেখি সাবের ভাই আমার দিকে তাকিয়ে হাসে। জিকোর সাথে দেখা হলো, কথা বলি নাই। কেউ আড্ডায় থাকলে আমি যেচে কথা বলতে যাই না। জেমসের এক বন্ধুর সাথে জেমসের দেখা হলো। তাঁরা নাকি স্কুলে এক সাথে ক্লাস করতো। একজন হিন্দুর একজন বুদ্ধ, মেলায় কোন প্রকাশনীতে নাকি সেলসম্যানের চাকরি করছে। তবে অনেক প্রকাশনীর অনেক বইই দেখি আর মনে হয় পড়াশেষ কিংবা বাসায় আছে। তখন খুব শান্তি লাগে। অনেক কিছু নিয়েই শিউর শট কথা বলতে পারি। কোথায় কোন স্টল তা এখনো ম্যাপিং হয় নাই। আরো চার পাচবার গেলে ম্যাপিং কমপ্লিট হবে। জেমস খালি নোট করে, কি কি বই কিনবে? আমার তরীকা অবশ্য উল্টা। ওতো বেছে কিনে কি হবে, অনেক বইতো কামালভাই- লীনাপু কিনে দেয়ই। সাথে জ্যোতি আপু, মাসুম ভাই, পারভীন আপুও আছে। আর আমি টাকা তো পাই ই, যেদিন কিনবো, মন যা চায়। টাকায় কুলালে যা পারা যায় সব কিনবো। চায়ের খুব তেষ্টা পেয়েছিল। বের হলাম। পুলক আসলো কোর্ট থেকে। চা খেলাম টিএসসিতে। টিএসসিতেও আমাদের বাঁধা দোকান আছে। আশ্চর্য হলো উনার নামও বারেক। উনাকে খুঁজে পেলাম না। আরেক দোকানে চা খেলাম। পুলকের উসিলায় রিকশা দিয়ে ডাইরেক্ট চায়ের দোকান। রিকশাওয়ালা কিছুটা পরিশ্রান্ত মনে হয়। পোনে এক ঘন্টা লাগলো আসতে। বাসায় আসলাম। ভাত খেয়েই ঘুম। শরীরে এক ফোটা শক্তি নেই, ধুলোতে হেঁটে।
যাক, আমার নাম নেই। বাঁচলাম।
অনবদ্য।
থ্যাংকু।
আপনারা হলেন হরতালে ঝটিকা মিছিলের মতো। দেখা মাত্র হামলা করা হবে, নাম এমনিতে থাকবে না।
থ্যাঙ্কস ভাইয়া। আপনিও লিখতেন আগে , আপনার সিরিজ কত জোশ!
থ্যাঙ্কস ভাইয়া। চলবে
তোমাদের কত মজা!! পুরা মাস জুড়ে বই মেলা, যখন মন চায়, তখনই যেতে পারবা।



২০১২ 'র পর আর বই মেলায় যাওয়া হয়নি। চট্টগ্রামের বই মেলা গুলা এত বেশি বিভক্ত যে গেলেই মলিন দশা চোখ এড়ায় না।
তোমার লেখা পড়ে আরও অনেক বেশি মিস করছি বই মেলাকে। টিভি তে বই মেলার অনুষ্ঠান গুলা দেখেই তুষ্ট থাকতে হবে ।
আর পাশাপাশি ব্লগে তোমার বই মেলার সিরিজ পড়ব।
ভালো থেকো।
ধন্যবাদ আপু। নিয়মিত আসবেন। জাইফা কেমন আছে?
আহ!! শেষবার হই মেলায় গেছিলাম মনে হয় ১০ বছর আগে
একসময় হলে থাকার কারনে প্রায় ডেইলিই বই মেলায় যাওয়া হত।
সেই দিন কি আর আছে নাতি
খাবলায় খাবলায় কত কি খাতি!
আমি রোজ এসে পড়ে যাবো
ভেরী গুড। আপনারা না পড়লে পড়বে কারা?
মন্তব্য করুন