দিন প্রতিদিন বইমেলায়-- (৫)
এই পর্বটা লিখবো মেলায় না গিয়েই। দেখি কতদূর লেখা যায়। সব সময় সব কিছু দিব্যদৃষ্টি দিয়ে দেখেই লিখতে হবে, এমন কোনো কথা নাই। মহান লেখকদের অবশ্য জীবনকে দেখার দৃষ্টিটুকুই থাকে, যা নিয়ে লিখছে তা নিয়ে প্রত্যক্ষ কোনো অভিজ্ঞতা অনেক সময়ই থাকে না। তাও লেখা যখন শেষ হয় তখন তা পড়ে মনে হবে লেখক কত সহস্র দিন সেই লোকদের সাথে ছিলেন। আমার অবশ্য কোনো ক্ষমতাই নাই, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লিখতে বসলে নিজের কথাই শুধু বলি আর জীবনকে দেখার দৃষ্টিও তেমন প্রখর কিছু না। তাই তো আমার লেখাই হয় না। সমবয়সী ব্লগারদের বই প্রকাশনা কিংবা ব্লগে যা লেখা দেখি তাঁর ধারেকাছেও আমি নাই। আপসোস হয় না। প্রতিভার ঘাটতি ও পরিশ্রমের শক্তি দুটো জায়গাতেই আমার যথেষ্ট খামতি। তবে আমার এক বন্ধু আমাকে সব সময় বলে-- 'লেখক হবার কি দরকার? 'পাঠক হও, অনেক পড়ো। নিজেকে বড় পাঠক বানাও। লেখক হলে বই বিক্রির চিন্তা আসবে, মুল্যায়নের চিন্তা আসবে, বন্ধু বান্ধবরা কি বলে সেই ভাবনা মাথায় আসবে। পাঠক থাকো চাপ মুক্ত হয়ে শুধু ভালো ভালো বই পড়ে যাও। দেখবা তোমার পড়ার আলোয় কতজন আলোকিত হবে'। আমি অবশ্য দেশ আলোকিত করার মন্ত্র মাথায় আনি না। নিজের জন্যই পড়ি, ভালো লাগে তাই পড়ি।
তবে সমস্যা হচ্ছে এখন পড়ে মনে রাখতে পারি না। বুড়োদের রোগ এখন থেকেই শুরু। পড়ি যখন তখন পড়েই যাই, পড়া শেষে আর মনে থাকে না। কারো মুখ কিংবা ফেসবুকে যখন তা নিয়ে আলোচনা দেখি, তখন অবাক হই, আরে এতো আমার পড়া, ভুলে গেলাম কি করে? আগের মতো মনে থাকে না আর। সেই কবে যখন পাবলিক লাইব্রেরীতে পড়তাম সঙ্গে একটা লেখার খাতা নিয়ে যেতাম, যে লাইন পছন্দ হতো নোট করে রাখো। এরকম অনেক খাতাই ছিল, কিন্তু বাসা পরিবর্তন আর ব্যাচেলর জীবনের টানাটানি নোটখাতা গুলো কোথায় হারিয়ে গেছে কে জানে? তখন আরেকটা কাজ করতাম, কি কি বই পড়ছি তাঁর এক লিষ্ট বানাতাম। লাইব্রেরীর কোড পড়তে পারতাম কোনটা কোন শেলফে থাকে। অনেক দিন পর সেদিন এক বন্ধুর সাথে গেলাম, দেখি কিছুই মনে নাই। আর আমি জানতাম না পাবলিক লাইব্রেরী থেকে বই নেয়া যায়-- আমি তো শুধু সেই আমলে পড়েই আসতাম। তবে বই নিতে শত ঝক্কি এর চেয়ে সেখানে বসে পড়াই ভালো। আরাম করে পড়া যায়। অবশ্য সব আরাম বাসাতেই, বই কিনে কিংবা ধার করে এনে পড়ো, পড়তে পড়তে ঘুমাও, পিসি চালাও, টিভি দেখো আবার পড়াতেই ফেরত আসো।
এই তিনদিন আমি বইমেলায় গেলাম না, এইসব আনন্দ বসন্ত, ভালোবাসা মন্দবাসা, ছ্যাবলামি কেবলামি আমার জন্য নয়! দূর থেকে বইমেলা দেখার এক আনন্দ আছে। মনেই হবে না এই শহরে একটা মেলা হচ্ছে। আমি চিনি এমন অনেক পড়াশোনা জানা লোক আছে যারা মেলায় যায় না। শেষ গিয়েছে আজ থেকে সাত আট বছর আগে। কিন্তু মেলায় গিয়ে অনেক মানুষ দেখে মনে হবে পুরো ঢাকার পড়াশোনা জানা লোকজন মেলায় হাজির। আসল কথা হলো, আমরা যেমন করে ভাবি, সেই ভাবনাই বাইরেও লাখো লাখো লোক আছে। হিন্দি ওয়ান্টেড সিনেমা কদিন আগে মুক্তি দিল। পোষ্টারটা দেখলেই আমার হাসি পেতো। ওয়ান্টেডের আসল প্রডিউসাররা মনে হয় এই কস্মিনকালেও ভাবে নাই, এই সিনেমার এমন ১৫+ পোষ্টার সম্ভব। পোষ্টারের গায়ে মোটা অক্ষরে লিখে দেয়া, ইন উইন কর্পোরেশনের আমদানীকৃত। টিভিতে কম করে হলেও দুহাজার বার সালমান খানের 'ওয়ান্টেড' দেখিয়েছে। এক হাজার বার দেখিয়েছি ডাবিং করে মহেশ বাবুর 'পুক্কুরি' ' কানাড়া 'পরকি' ,সামনেও দেখাবে। তারপরও যারা সেকেন্ডহ্যান্ড প্রিন্টে হলে দেখতে যাবেন এই সিনেমা পয়সা খরচ করে তাদের জন্য আমার করুনা হয়, আর যে শখানেক হল মালিকরা এই সিনেমা দেখাবেন তাঁদের জন্য আপসোস জাগে। সমাজ বইতে পড়েছিলাম চিত্ত বিনোদনের অভাবের কারনে আমাদের দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি হয়, আসলেই আমাদের বিনোদনের অভাব প্রচন্ড। তাও সিনেমাটা অনেক লোক হলে গিয়ে দেখলো। আমাদের চিন্তার বাইরেও সবসময় একটা জগত থাকেই। তাই যতই বইমেলায় মানুষ হোক অনেক, তার বাইরেও আরো বিশাল মানুষ আছে। যারা কাছে থেকেই মেলায় যায় না, বইও কিনে না।
তবে টিভি মিডিয়ায় মেলার মানুষ দেখানো একটা ভালো ব্যবসা। সবকটা চ্যানেলে ঘুরে ফিরে একইরকমের রিপোর্ট। মেলায় আজ ১২০ টা বই এসেছে, আজ ওমুকের জন্মবার্ষিকী নিয়ে আলোচনা হয়েছে, হরতালে উপস্থিতি কম, বেচা কেনা নাই, লেখকদের গৎবাঁধা ইন্টারভিউ। আবার ভালোবাসা দিবস কিংবা পহেলা ফাল্গুনে, মেয়েরা কি সেজেছে, এত মানুষ প্রানের মেলায় কেন, প্রেমিক প্রেমিকারা মেলায় কিভাবে আসে ইত্যকার বিষয় আষয় নিয়ে আলোচনা। বিকেলে টিভির সামনে থাকলে রিটন ভাইয়ের উপস্থাপনা দেখি। কত লেখক দেশে, শুদ্ধ ভাবে নিজের বইয়ের নামটা বলতে পারে না। কিন্তু কি সব বলে যায় ইন্টারভিউতে বই নিয়ে। কামাল ভাইয়ের এক লেখায় দেখছিলাম, যখন যা কমিউনিকেট করতে পারবে না- তখন তা নিয়ে বলার কোনো দরকার নেই। চুপ থাকাই শ্রেয়। আমি টিভিতে দেখি কতিপয় সেলসম্যান টাইপ লেখক, তাঁদের বইয়ের প্রশংসায় দশমুখ হয়ে কথা বলছেন, নিজের লেখার ইতিহাসকে নিজেই গৌরবের মুকুট দিচ্ছেন। এক অদ্ভুত অবস্থা! আবার কিছু লোককে দেখলাম ফেসবুক স্ট্যাটাসকে বই বানিয়ে ফেলেছে। ফেসবুক স্ট্যাটেসে চেকইন থাকে, খাইছি- করছি- গেছি- ধরছি মার্কা আলাপ থাকে সেইসব নিয়ে কেন বই হবে না তা আমার জানা নাই! একটা দেশে অনেক বই মানসম্মত হবে না সেটাতো সত্যই, কিন্তু যুগের পর যুগ মানহীন বই লিখে নিজেকে লেখক হিসেবে জাহির করার চেয়ে এক লাইনও না লেখা ভালো।
এই অবরোধের মধ্যে চিটাগাং থেকে বন্ধু এসেছিল চাকরীর ইন্টারভিউ দিতে। হয়নি, আসাটাই বৃথা। যা হয়েছে আমাদের দুজনের আলোচনা, চিটাগাংয়ের সব পোলাপানের খোজ জানা। যে যার মতো করে ভালো আছে। জসিম সাহেবের সন্তান হয়েছে এক মাস আগে, বেতন পায় নাই তাই জানুয়ারী মাসের সন্তান হবার মিষ্টি খাওয়ালো সেদিন। গরীব মানুষ, বাসায় গিয়ে দেখি আমাদের জন্য ধোয়া চাদর, পিরিচে ঠাসাঠাসি মিষ্টি, গ্লাসে পানি। সামান্য মিষ্টি খাওয়া যে কত অসামান্য হতে পারে তা আজ রাতে উনার একরুমের ঘরে, না গেলে বুঝতাম না। উনার এক মেয়ে আছে নাম লুবনা, খুব সুইট, তার দাতে একবার সমস্যা হয়েছিল, আমার ডেন্টিষ্ট বন্ধু আকতারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। দাত একটা তুলতে হলো। আমি টাকা দিয়েছিলাম বন্ধুকে যৎসামান্য। তারপর থেকে আমাকে ওদের সবাই ভালো পায়। সামান্য উপকার করে এত ভালোবাসা এক জীবনে কেউ পায় না। বারেক সাহেবের সন্তান জুয়েলকে মাঝে মধ্যে পড়ার কথা বলি, জুয়েল শুনে না, পড়াশুনায় ওর মন নাই, তবে বারেক সাহেবের ধারনা আমার কথা শুনলে আর আমি একটূ সময় দিলে জুয়েল জজ ব্যারিষ্টার হয়ে যাবে। আসলে আদতে কিছুই না। আমি সামান্য কিছু করেই, অসামান্য ভালোবাসা পাই সবার। এরকম ভাগ্যবান লোক কম আছে দুনিয়ায়!
গুড গুড
পড়লাম
ধন্য হলাম
তুমি তো মাত্র তিনদিন যাও নাই। আর আমি এই ১৬ দিনে একবারও যেতে পারিনি বইমেলা। জীবনযাপন এত কঠিন হয়ে যায় মাঝে মাঝে!

আমি অনেকদিন থেকেই পড়ে আর মনে রাখতে পারি না। সিনেমা দেখেও নাম ভুলে যাই।
সামনেই ঘুরে আসেন!
আজকালকার জমানায় পাঠক হওয়াই মুশকিল হইয়া গেছে।
আমার দুইদিন যেয়ে মনে হল,
মেলায় পাঠকের চেয়ে লেখকের সংখ্যাই বেশি!
ওভাবে বলতে নেই!
মন্তব্য করুন