আহমদ ছফার কালজয়ী স্মৃতিকথা- ঢাকায় যা দেখেছি যা শুনেছি।
এই প্রবন্ধটা আমার সর্বপ্রথম পড়া হয় মুক্তধারার এক বইতে। বইটার নাম ভুলে গেছি। গুগলে সার্চ দিলে যে নাম আসে, সেই নামে না, আরেকটা নাম ছিল। তারপর এই লেখাটি শেষ যে বইয়ে ছাপা হয়েছিল- সেই বইয়ের নাম 'আহমদ ছফা সঞ্জীবনী' লেখক সলিমুল্লাহ খান। সম্পাদক আবুল খায়ের মোহাম্মদ আতিকুজ্জামান। আগামী প্রকাশনী। প্রকাশ কাল: ফাল্গুন ১৪১৬, ফেব্রুয়ারি ২০১০। বইটা আমার শেলফে এখনো ঝলঝল করে। আমার দেখা ১৯৭১ সালের মার্চের শেষ সপ্তাহের নারকীয় গনহত্যা নিয়ে লেখা দেশীয় কোন লেখকের সেরা প্রবন্ধ। ঢাকায় কিভাবে গনহত্যা চলেছে- মানুষ মারা হয়েছে- শুরুর দিকে তার মর্মস্পর্শী বিবরন পাওয়া যাবে এতে। আমি এই প্রবন্ধটা অনেকদিন আগেই নিজে টাইপ করে লিখে রেখেছিলাম। পিসি নষ্ট হয়ে তা হারিয়ে যায় পরে একজনের নোট থেকেও সেইভ করে রেখেছিলাম বছর দুয়েক আগে। আজ হুট করেই আহমদ ছফার এই মেলায় প্রকাশিত, 'হারানো লেখা' বইটা রিভাইস দিতে বসলাম। ভাবলাম এই প্রবন্ধ থেকে কিছু লিখি, সেখান থেকেই লিখতে বসলাম এই ব্লগ। চোখে পানি, কারন এই প্রবন্ধটা পড়লেই আমার চোখে কোত্থেকে জানি পানি টপটপ করে আসে। আটকানো ভীষণ কষ্টের। লিখতে গিয়েও আশা করি এই যন্ত্রনা সইতে হবে।
ভয়াল সেই কালো রাত নিয়ে তিনি লিখছেন--
এর মধ্যে এগারোটা বেজে গেল। তারও কিছু পরে ঢাকা নগরীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সেনাবাহিনী। সৈন্যরা এল ঝাঁকে ঝাঁকে, দলে দলে ব্যারিকেড সরিয়ে ফেলল। রাস্তার ওপর দিয়ে মিলিটারি জিপগুলো ছুটে বেড়াতে লাগল। ট্যাঙ্কের প্রচণ্ড শব্দ কানে তালা লাগাবার উপক্রম করল। কামানগুলো গুড়ুম গুড়ুম গর্জন করছে, মর্টার থেকে গুলি ছুটছে। দ্রুম দ্রুম আগুনেবোমা ফুটছে আর ঠিকরে ঠিকরে লাল আগুনের লকলকে শিখা বেরিয়ে আসছে। কান পাতলে আওয়াজ- রাইফেলের, মেশিনগানের, মর্টারের, ট্যাঙ্কের। চোখ মেলে তাকানো যায় না। ঢাকার আকাশ অজস্র নিক্ষিপ্ত গুলির আগুনে লাল হয়ে উঠেছে। খৈ ফোটার মতো ফুটছে গুলি। মাঝে মধ্যে ট্যাঙ্কের গুলির প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দে মহানগরীর আনাচ-কানাচ কেঁপে কেঁপে উঠছিল। ঢাকার আকাশে শোঁ শোঁ শব্দে কেবল চলছে গুলি। লোকজন বাড়িঘরের লাইট নিভিয়ে দিয়ে আতঙ্কিত নিশা যাপন করছেন। খবর নেয়ার উপায় নেই। রাস্তায় নামার আগে সেনাবাহিনী টেলিফোন যোগাযোগ কেন্দ্রটি সম্পূর্ণভাবে অকেজো করে দিয়েছে। দরজা খুলে পাশের বাসার লোকজনের কাছে কিছু জিজ্ঞেস করার উপায় নেই। শোঁ শোঁ করে গুলি এসে প্রবেশ করে।এ রকম অবস্থার মধ্যে রাত অতীত হলো। ফুটল দিন। ফুটন্ত প্রভাতের আলোতে আমরা নগরীর চেহারা দেখলাম। চেনাই যায় না। ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত, দেয়ালগুলো ক্ষত-বিক্ষত। কালো কালো ধোঁয়ায় আকাশ ছেয়ে গেছে। গত রাতে যে সব বাড়িতে আগুনেবোমা ছুঁড়ে মারা হয়েছে, সে সকল বাড়ি এখনো জ্বলছে।
সকাল সাতটার পরে মানুষজনকে রাস্তায় বেরুবার সুযোগ দেয়া হলো। পয়লা কেউ বের হয়নি। সেনাবাহিনীর ঘোষণা বিশ্বাস করার মতো মনের অবস্থা কারো নেই। তবু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পিপীলিকার মতো পিলপিল করে মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে এল। আমরাও এলাম। শহরের অবস্থা দেখে দুই চোখ জলে ভরে গেল। হাজারে হাজারে হিংস্র পশু যেন গোটা শহরকে খামচে কামড়ে থাবা দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলেছে। শহরের ইউক্যালিপটাস গাছগুলোর চিকন সবুজ পাতাগুলো গুলির আগুনের আঁচে তামাটে হয়ে গেছে। রাস্তায় রাস্তায় ছড়িয়ে রয়েছে মেশিনগানের সংখ্যাহীন গুলির চিহ্ন। তোপখানা রোডে বাসা। বায়তুল মোকাররম পর্যন্ত যেতে দুই দুইটি লাশ দেখলাম।
একটু এগিয়ে গুলিস্তান সিনেমার সামনে গিয়ে অবস্থা দেখে মুখের কথা মুখে আটকে গেল। চিরনিদ্রায় নিদ্রিত রয়েছে অনেকগুলো মানব সন্তান। রক্ত ফুটপাথের উপর জমাট বেঁধেছে। রাতের বেলা যে সকল ফেরিওয়ালা কুলি শ্রমিক ভিখারী এবং ভিখারিণী শ্রেণীর মানুষ রোজকার অভ্যেসমতো ফুটপাথে ঘুমিয়েছিল, তাদের কেউ রেহাই পায়নি।
আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে গেলাম। যেতে যেতে দেখতে হলো অনেকগুলো মরা। কারও পিঠে লেগেছে গুলি, কারও বুকে। কারও মাথার খুলিতে খুব ছোট একটা ছিদ্র করে ঢুকেছে আর মগজ সমেত খুলির একটা বিরাট অংশ উড়িয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেছে। আমরা এলাম রেলওয়ে হাসপাতালের পাশে। একটা অতি করুণ দৃশ্য দেখতে হলো। একটি মায়ের বাঁ স্তনের পাশে গুলি লেগেছে। তার শিশুটি তখনো জীবিত। আমরা যেন জাতির গোরস্তানের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। ঢাকা হলের সামনে একটি বুড়ো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে উপুড় হয়ে। লম্বা দীর্ঘ দাড়ির দুই-এক গোছা বাতাসে একটু একটু নড়ছে। তার ওপাশে দুইজন গলাগলি করে মরে রয়েছে। চোখে মরা মাছের মতো নিথর দৃষ্টি। এই চূড়ান্ত দুঃসময়েও মনের তলা ভেদ করে একটি প্রশ্ন জেগে উঠেছে, আচ্ছা এরা দুইজন কি সহোদর ভাই ছিল?
পুরনো বিশ্ববিদ্যালয় ভবনের সামনে দিয়ে, মেডিকেল কলেজ ছাড়িয়ে এলাম শহীদ মিনারের পাদদেশে। দেখলাম মিনারটির মাথাটা কামান দেগে উড়িয়ে দিয়েছে। তখনো তারা মিনারটি একেবারে নিশ্চিহ্ন করে ফেলেনি। মিনারের সোজা বিপরীতে বিশ্ববিদ্যালয় কম্পাউন্ডের প্রাচীরের উপর আমাদের দেশপ্রেমিক শিল্পীরা পশ্চিমা শাসকদের ধারাবাহিক অত্যাচারের যে বর্ণনা তুলি কালির মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন, মোটা তেরপলের উপর আঁকা সেই প্রাণবন্ত চিত্রমালার উপর এমনভাবে গুলি করেছে যে, মনে হচ্ছিল প্রচণ্ড ঝড়ে তা কলাপাতার মতো শতচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
দুই পা এগুতেই উচ্চৈঃস্বরে কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। নার্স হোস্টেলের বিপরীতে বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টার্স থেকে অবিশ্রাম কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। বাংলা একাডেমীর সহকারী গ্রন্থাগারিক চিৎকার করে বললেন, এই ব্লকে একজনও পুরুষ মানুষ বেঁচে নেই। আমরা ভেতরে গেলাম। দেখি নিহত হয়েছে পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ড. মুনিরুজ্জামান। ইংরেজি বিভাগের রিডার ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার ড্রাইভার এসে বলল, ড. ঠাকুরতার কাঁধে গুলি লেগেছে। তার স্ত্রী শ্রীমতী বাসন্তী গুহঠাকুরতাও আহত হয়েছেন। দেখতে গেলাম। ছাত্ররা হাসপাতালে নিয়ে গেল তাকে। সেখানে বিনা চিকিৎসায় দুই দিন পরে এই সহৃদয় প্রাণবন্ত অধ্যাপক মারা যান। কে একজন বলল, অর্থনীতির অধ্যাপক গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। ড. মফিজুল্লাহ্ কবীরের কোনো খোঁজ নেই। পদার্থবিদ্যার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অধ্যাপক ড. ইন্নাস আলীও গুলিবিদ্ধ হয়েছেন শুনতে পেলাম। বেঁচে আছেন কিনা কেউ বলতে পারল না।
শ্রদ্ধেয় অধ্যাপকবৃন্দের খুনে রাঙা কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক শ্রদ্ধেয় দার্শনিক ড. গোবিন্দচন্দ্র দেবের বাড়ির গেটে গেলাম। দেখি অনেক মানুষ জড়ো হয়েছে। কাঁদবার অবস্থাও তখন নয়। এই মানবতাবাদী অধ্যাপক কীভাবে পশুদের হাতে প্রাণ দিয়েছেন ছাত্ররা অশ্রুসিক্ত চোখে তা বর্ণনা করল। আগের রাতে বর্বর নেকড়ে বাহিনী জগন্নাথ হলের নিরীহ ছাত্রদের বেপরোয়াভাবে মেশিনগানের গুলির আঘাতে হত্যা করেছিল, এই সংবাদ ড. দেবের কানে আসা মাত্রই তিনি বেরিয়ে একদম হলে চলে এলেন। তিনি সৈন্যদের নাকি মিনতি করে বলেছিলেন- ‘বাবা, তোমরা আমার নিরপরাধ ছাত্রদের মেরো না, একান্তই যদি মারতে হয়, আমাকেই মারো।’ সৈন্যরা তাঁকে মেরেছে। তাঁর বাড়িতে গিয়ে লোকজন সবাইকে মেরেছে। এমনকি ড. দেবের লাশটাও গোপন করে ফেলেছে। তেতো হাসি হাসলাম, ইয়াহিয়া খাঁর সৈন্যরা লাশ গোপন করে অপরাধ গোপন করতে চায়। এই মহান জীবন, এই মহান মৃত্যুর সন্নিধানে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। আবার খবর এল- মৃত্যু ছাড়া খবর নেই কোনো- ঢাকা হলের ব্যাচেলার্স মেসে যে সাতজন তরুণ অধ্যাপক থাকতেন তাদের একজনও বেঁচে নেই।
ড. দেবের বাসা ছেড়ে জগন্নাথ হলের দিকে গেলাম, গেটের পাশেই একজন চেনাজানা ছাত্রের সঙ্গে দেখা হলো। সে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ল। হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে মাঠে শায়িত সারি সারি লাশ দেখাল। অনেক মৃতদেহ নাকি মাঠে গর্ত করে পুঁতে ফেলা হয়েছে। আর কক্ষে কক্ষে ঢুকে যাদের মারা হয়েছে সকলের লাশ নাকি তেমনি পড়ে রয়েছে। এই নিহত তরুণ ছাত্ররাই একদিন আগে দৃপ্তকণ্ঠে স্লোগান দিয়েছিলেন, ক্ষিপ্র পায়ে মিছিল করেছিলেন, বলিষ্ঠ আশা নিয়ে স্পন্দিত হাতে উড়িয়ে দিয়েছিলেন লোহিতে সবুজে মেশানো বাংলার নক্সা-আঁকা স্বাধীনতার নিশান। এঁদেরই মধ্য থেকে জন্ম নিত আগামী দিনের নির্ভীক গণনায়ক, প্রতিভাবান বিজ্ঞানী এবং সহৃদয় শিল্পী-সাহিত্যিক। হাতে অল্প সময়। দেড় ঘণ্টার মধ্যে ফিরতে হবে। কত প্রিয়বন্ধু সুহৃদ এবং শ্রদ্ধেয় জনের ঝলসানো মৃতদেহ দেখতে হয়েছে। দুই মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবে চোখের জল ফেলব সে সময় কই?
সলিমুল্লাহ হলটির সামনে দাঁড়ানো মিলিটারি ভ্যান। সৈন্যরা রাস্তায় পায়চারি করছে। বুট জুতোর বিশ্রী আওয়াজ কানে আসছে। ভেতরে গিয়ে দেখার সুযোগ হলো না, চেনাজানাদের মধ্যে কে কে বাঁচতে পেরেছে। দক্ষিণের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার, প্রতিটি কক্ষে আগুন ধুঁইয়ে ধুঁইয়ে জ্বলছে। দেয়ালের এখানে সেখানে এবড়ো-থেবড়ো ভাবে গুলির আঘাত লেগেছে। এই হলটিতে কতজন মরেছে তার সংখ্যা জানা যায়নি। অনেকদিন পর্যন্ত লাশগুলো কক্ষ থেকে বের করা হয়নি।
এই শ্মশানদৃশ্য পার হয়ে প্রায় ৬০/৭০ গজের মতো হেঁটে ইকবাল হল ক্যাফেটেরিয়ার সামনে এসে দাঁড়ালাম। দেখি অস্ত্রসজ্জিত সেনাবাহিনী হলটিকে তিন দিক থেকে বেড় দিয়ে রেখেছে। সুতরাং সামনে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কল্পনা করতে কারও কষ্ট হওয়ার কথা নয়, গত রাতে এই হলটিতে কি প্রলয়কান্ড ঘটে গেছে। এই হলের ছাত্ররাই ত্যাগ-তিতিক্ষা, নিষ্ঠা-শ্রম দিয়ে অপূর্ব সাহসিকতার সঙ্গে দিনে দিনে তিল তিল করে এই আন্দোলন গড়ে তুলেছেন, সংগঠিত করেছেন- এঁরাই তো প্রথমে তথাকথিত পাকিস্তানের পতাকার বদলে বাংলাদেশের পতাকা উড্ডীন করেছিলেন।
১৯৫২ সাল থেকে এ পর্যন্ত এই হলের দেশপ্রেমিক ছাত্ররাই তো মরিয়া হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিটি সুপরিকল্পিত আক্রমণ প্রতিহত করার কাজে প্রত্যক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। প্রতিটি আন্দোলনে এই ইকবাল হলই যুগিয়েছে তেজ শক্তি এবং সাহস। অধিকন্তু এরাই তো তথাকথিত পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা কবি ইকবালের নাম বদলে হলের নতুন নাম রেখেছিলেন সার্জেন্ট জহুরুল হক হল। এই সার্জেন্ট জহুরুল হক ছিলেন আইয়ুব সরকারের বানানো মিথ্যে আগরতলা মামলার আসামী। বন্দি অবস্থায় জহুরুলকে পাকিস্তানি সৈন্য ১৯৬৯ সালে হত্যা করে। এই হলের উপর সৈন্যদের আক্রোশ বেশি থাকবে- সে তো জানা কথা। তাছাড়া প্রভাবশালী ছাত্রনেতাদের অনেকেই এই হলে থাকতেন। আক্রমণটা নৃশংস হয়েছে ধরে নেয়া যায়। কতজন মারা গেছে এবং কে কে মারা গেছে তার সংবাদ আমরা বলতে পারব না।
এবার বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে বেরিয়ে এলাম। ইডেন মহিলা কলেজের পাশ দিয়ে এসে আজিমপুর কলোনির ভেতর দিয়ে হেঁটে পিলখানার দিকে ছুটলাম। ইডেন কলেজের হোস্টেলে যে ছাত্রীরা থাকতেন তাদের কথা জিজ্ঞেস করলাম না, পাছে একটা বিশ্রী কথা শুনতে পাই। দুই দিন না যেতেই সেই বিশ্রী কথা শুনতে হয়েছে। প্রতিক্রিয়ায় বিষিয়ে উঠেছে সমস্ত অন্তরাত্মা।
যাহোক আমরা পিলখানা ই.পি.আর. হেডকোয়ার্টার্সে এলাম। অন্যান্য দিন এখানে উর্দিপরা ই.পি.আর. বাহিনীর লোকজনে ভর্তি থাকত। আজ কেউ নেই। ছাড়াছাড়াভাবে মেশিনগান হাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লোকেরা শ্যেনদৃষ্টি মেলে দাঁড়িয়ে আছে। এই ক্যাম্পে প্রায় আড়াই হাজার ই.পি.আর. সদস্য থাকত। তাদের ভাগ্যে কি ঘটল জানার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠল। মুখফুটে কারও কাছে জিজ্ঞেস করার উপায় নেই। একজন পানের দোকানদার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল, আড়াই হাজারের মধ্যে একজন মাত্র বেঁচেছে। কথাটা সত্য কিনা পরখ করে দেখিনি। হয়ত একজনের স্থলে চার পাঁচজন কিংবা তারও বেশি বাঁচাটা আশ্চর্য নয়। রাতে যখন ই.পি.আর. সদস্যরা সকলে মিলে ব্যারাকে ঘুমাচ্ছিল, তখনই প্রহরী কয়জনকে হত্যা করার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী দরজা আটকে কামান দেগে সমস্ত ঘুমন্ত মানুষগুলোকে একই সঙ্গে মেরে ফেলে।
বহুকাল আগেই আমাদের চেতনা রহিত হয়ে গেছে। শহর থেকে মানুষ পালানোর হিড়িক লেগে গেছে। সে এক অভাবনীয় করুণ দৃশ্য। চোখে না দেখলে এ দৃশ্য কি হৃদয়বিদারক তা অনুমান করার উপায় নেই। আমরা ভূতে-পাওয়া মানুষের মতো দেখে যাচ্ছি- শুধু দেখে যাচ্ছি। কে একজন বলল গতরাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পুলিশেরা অর্ধেক রাত ধরে লড়াই করেছে। পুলিশের সঙ্গে টিকতে না পেরে সৈন্যরা ট্যাঙ্ক নিয়ে আসে। ট্যাঙ্ক থেকে কামান দেগে পুলিশদের ছত্রভঙ্গ করে। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে পুলিশেরা পালায়। রাজারবাগের প্রায় হাজারখানেক পুলিশের মধ্যে নাকি শতখানেক কোনোমতে প্রাণ বাঁচাতে পেরেছে। বাকি সবাই বর্বর সেনাবাহিনীর হাতে নিষ্ঠুরভাবে নিহত হয়েছে।
রাজারবাগ পুলিশ লাইনে গিয়েও দেখি সেই একই বীভৎস দৃশ্য। শাদা শাদা অট্টালিকাগুলোর দেয়াল গোলার আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। জলের ট্যাঙ্কটা ফেটে গেছে। পুবদিকের ঢেউটিনের ছাউনি ব্যারাকখানা জ্বালিয়ে ছাই করে দিয়েছে। রাস্তার দুই পাশের নারকেল এবং দেবদারু গাছের সবুজ পাতা আগুনে অর্ধেক পুড়ে গেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লোকেরা কড়া পাহারা বসিয়েছে। ভেতরের পথটা দিয়ে লোকের যাতায়াত বন্ধ করে দিয়েছে। এই বিরাট ধ্বংসস্তূপের মধ্যে কোনো মৃতদেহ দেখতে না পেয়ে অবাক হলাম। স্থানীয় লোকজন বলল, শেষরাতে অনেকগুলো গাড়িতে লাশ বোঝাই করে নিয়ে গেছে সৈন্যরা।
ফিরে আসার সময় খবর পেলাম একই রাতে সেনাবাহিনী ঢাকার ইংরেজি দৈনিক দি পিপল এবং প্রভাবশালী দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে। ইত্তেফাকের একজন চেনা হকারের মৃত্যুসংবাদ শুনলাম।
আরো একটি কাহিনী শুনলাম, সেটিও মৃত্যুর কাহিনী। কিন্তু কাহিনীটি অনন্য। লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুয়াজ্জম থাকতেন এলিফ্যান্ট রোডের একটি ফ্ল্যাটে। প্রায় সাতাশ দিন পরে তিনি স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদের কাছে ফিরে এসেছেন। তিনিও ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের সঙ্গে মিথ্যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি। তার বীর্যবত্তা এবং সাহসিকতার কথা বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের কাছে সুবিদিত। রাতে সৈন্যরা তাকে বাসায় ঢুকে টেনে বের করে নিচে নিয়ে আসে। তারা মুয়াজ্জমকে বলল, ‘তুমি যদি বাঁচতে চাও, আমরা দুইটি শর্ত দিচ্ছি, যদি মেনে নাও তাহলে বাঁচবে, নয়ত মরবে।’ তারা তাঁর কাছে দাবি করে, তোমাকে বলতে হবে, ‘প্রেডিসেন্ট ইয়াহিয়া জিন্দাবাদ, পাকিস্তান জিন্দাবাদ।’ তিনি পাকিস্তানি মেজরের মুখে থুতু ছুঁড়ে দিয়ে জবাব দিয়েছিলেন পরম ঘৃণায়- ‘অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমি পাকিস্তান আর ইয়াহিয়ার নামে জিন্দাবাদ ধ্বনি উচ্চারণ করব না।’ তখন পাঁচটি মেশিনগান একসঙ্গে গর্জে উঠল এবং মুয়াজ্জমের প্রাণহীন শরীর লুটিয়ে পড়ল। তারপর তারা মুয়াজ্জমের লাশ গাড়ির সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চালিয়ে নিল। বাংলার একজন বীরকে এইভাবে হত্যা করল, এইভাবে তাঁর প্রাণহীন শরীরকেও অপমান করল। ঘরে যখন ফিরে এলাম, দুই মিনিট সময়ও অবশিষ্ট নেই। মোড়ে মোড়ে সৈন্যরা দাঁড়িয়ে গেছে। রাস্তাঘাটে একজন লোকও নেই। শুধু মিলিটারি লরিগুলো রাজপথে চক্কর দিয়ে বেড়াচ্ছে। সৈন্যদের বুটের আওয়াজ বেজে উঠছে ঠক ঠক। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। কিছুক্ষণ পর দেখতে পেলাম ঢাকা শহরের চারদিক দিয়ে কালো ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে। ধূসর ধোঁয়াতে সমস্ত শহর ছেয়ে গেছে। চোখ মেলার উপায় নেই। যেদিকেই তাকাই, দেখি আগুনের শিখা দাউ দাউ করে জ্বলছে। সব মানুষ ঘরের ভেতর ঘরবন্দি হয়ে পড়ে আছে। কারও সংবাদ নেয়ার উপায় নেই। সূর্য যতই পশ্চিমে হেলছে আতঙ্কও প্রবল হয়ে বুকের কাছে দুলছে। রাতকে বিশ্বাস নেই। গত রাতে ওরা যা করেছে, আজও যদি তার পুনরাবৃত্তি হয়! সন্ধ্যের আগে কানফাটানো প্রচণ্ড আওয়াজ তুলে তোপখানা রোডের পাশ দিয়ে পাঁচখান ট্যাঙ্ক চলে গেল। উপরে ফিট করা কামান আর ভয়ঙ্কর-দর্শন একটি করে লোক দেখা গেল। বাদামি রঙের ইউনিফর্মধারী সৈন্যের মতো তারা তত আতঙ্কসঞ্চারী নয়।
সে যাই হোক, অবশেষে সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত হলো। আকাশে জেগে উঠল অসংখ্য তারা। আবার গুলিগোলার আওয়াজ আসতে লাগল। আজকের আকাশও গত দিনের মতো গুলির আগুনে লাল হয়ে উঠেছে। মেশিনগান ছোড়ার শব্দ শুনছি, রাইফেলের গুলি ছুটছে শোঁ শোঁ। মাঝে মাঝে বুম বুম আওয়াজ শুনতে পাই। ওটা ট্যাঙ্ক থেকে গোলাবিস্ফোরণের ধ্বনি। এখানে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। গতরাতের চাইতেও ওরা বেশি হারে গুলি করছে। ২৩ মার্চ তারিখে প্রতিটি ঘরে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড্ডীন করা হয়েছিল। সে পতাকা লক্ষ্য করে প্রতিটি বাড়িতেই সৈন্যরা গুলি ছুড়েছে। এই রাতও পোহাল। ভোর হলো। সোনালি রোদে চারদিক ঝলমলিয়ে উঠল।
সকাল সাতটার পর আবার পথে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে গেলাম বাংলা একাডেমীতে। ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলনের শহীদদের রক্তে গড়া বাঙালির এই জাতীয় প্রতিষ্ঠানটি কামান দেগে চুরমার করে দিয়েছে। সংস্কৃতি বিভাগের কাগজপত্র জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। তিনতলার দেয়ালের প্রায় আট গজ পরিমাণ দেয়াল ভেঙে ফেলেছে। কামান থেকে যে গোলাগুলো ছোঁড়া হয়েছে তার একটির ওজন নিয়ে দেখা হয়েছে সাড়ে সতেরো সের।
বাংলা একাডেমীর সামনেই রমনার কালীবাড়ি। দুইটি কালীমন্দির প্রায় শ হাতের ব্যবধানে। কালীবাড়ির এক একটি কম্পাউন্ডের মধ্যে কম করে হলেও এক হাজার মানুষ থাকত। সকালবেলার পুকুরে স্নানার্থীর ভিড় দেখে থাকলে আসল সংখ্যাটা অনুমান করতে কারও কষ্ট হওয়ার কথা নয়। কাছে যাবার উপায় নেই। একটু দূর থেকেই দেখলাম পায়রার খোপের মতো ছোট্ট ছোট্ট ঘরগুলো জ্বালিয়ে ছাই করে ফেলেছে।
নিঃসঙ্গ মন্দির আকাশে চূড়া তুলে দাঁড়িয়ে আছে। পাথরের গায়ে গোলার আঘাতের চিহ্ন। প্রতিমা ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে। মনে স্বভাবতই প্রশ্ন আসেঃ এতসব মানুষ, এরা গেল কোথায়? চারিদিকে সৈন্য। তার মধ্যেও একজন কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল, পেট্রোল দিয়ে পয়লা আগুন ধরিয়ে দেয় ঘরবাড়িগুলোতে। প্রাণের ভয়ে শিশু-বৃদ্ধ-যুবক-যুবতী-নারী-পুরুষ যখনই বাইরে আসার চেষ্টা করেছে, তাদের গুলি করে মেরেছে। দুটি মন্দিরের এতগুলো মানুষের ভাগ্যে এই ভয়ঙ্কর পরিণতি ঘটেছে। গোটা রমনা এলাকাতে পোড়া গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। বাতাসে নিঃশ্বাস টানা দায়। বমি হয়ে পেটের নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসতে চায়।
আমরা কেন যে হাঁটছি, কেন এসব ধ্বংসস্তূপ দেখছি তার কারণ ভেবে দেখিনি। শুধু নেশাগ্রস্তের মতো দেখে যাচ্ছি।
আবার এলাম শহীদ মিনারের পাদদেশে। রাতে তারা গোটা মিনারটাকে কামানের আঘাতে ধরাশায়ী করে ফেলেছে। বুক ভেদ করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। এখানেই ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বরকত সালাম রফিক জব্বার মুসলিম লীগের গুলিতে প্রাণ দিয়েছেন। তাঁদেরই শরীরের ক্ষরিত রক্তধারার উপর গড়ে উঠেছে এ মিনার- বাঙালি জাতির আশা-আকাক্সক্ষা আনন্দ-বেদনার প্রতীক। পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শোষণবিরোধী প্রতিটি আন্দোলনে আমাদের রাজনৈতিক কর্মী এবং নেতৃবৃন্দ এই মিনারের পাশে শপথ গ্রহণ করেছেন। গত দুই মাস ধরে এখানে প্রতিদিন একটা না একটা সভা হয়েছে। শ্রমিক এসেছেন, কৃষক এসেছেন, ছাত্র এসেছেন, এসেছে নানা রাজনৈতিক দল। তুলি-শিল্পীরা প্রদর্শনী করেছেন, গণনাট্য দল নাটকে অভিনয় করেছেন, গায়কেরা সাত দিনব্যাপী গানের আসর করেছেন। কবি-সাহিত্যিকরা কবিতা-গল্প পাঠ করেছেন। বাঙালি জাতির এই মহামিলনক্ষেত্র কেন্দ্রীয় মিনারটি গুঁড়িয়ে দিয়েছে সেনাবাহিনী।
এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়াবার উপায় নেই। বাসা ভাঙা পাখির মতো লক্ষ লক্ষ মানুষ পথে নেমে এসেছে। সকলেরই চোখেমুখে অনিশ্চয়তা। কে কোথায় যাবে তার ঠিক নেই। কেউ কারও মুখের পানে তাকিয়ে দুটো সহানুভূতির বাণী প্রকাশ করবে তেমন অবকাশ নেই। ভিড়ের মধ্যেই পা চালিয়ে দিলাম। আমরা প্রায় মাইলখানেক হেঁটে নয়াবাজার এলাম। গোটা বাজারটি একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। বিদ্যুতের তার সব ছিঁড়ে গেছে। বড় বড় আড়ত এবং গুদামঘরের পোড়া আধপোড়া রাশি রাশি টিন ছড়িয়ে রয়েছে ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে। সারারাত আগুন জ্বেলেছে আর গুলিগোলা ছুঁড়েছে। মানুষ কত মরেছে তার হিসেব করেছে কে?
নওয়াবপুর ক্রসিংয়ের কাছে এসে সবচেয়ে ভয়াবহ দৃশ্য দেখতে হলো। তেজগাঁও থেকে কমলাপুর রেল স্টেশন প্রায় আট দশ মাইল হবে। রেল লাইনের দুই পাশে গত তেইশ বছর ধরে অভাবের টানে গ্রামবাংলার মানুষ এসে ডেরা পেতেছিল। কেউ রিক্সা চালাত, কেউ মোট বইত, আবার কেউ বা করত ফেরিওয়ালার কাজ। গত দিন দুপুর থেকে সেনাবাহিনী এই বস্তি এলাকা জ্বালানোর কাজ শুরু করেছে। একটি ঘরও সোজা নেই। পোড়া স্তূপের মধ্যে দেখা গেল কয়টি বীভৎস করোটি। গন্ধ ছুটছে ভুরভুর করে। সেখানেই খবর পেলাম ডেমরা নারায়ণগঞ্জ প্রভৃতি শিল্পাঞ্চলে সেনাবাহিনী দিনে রাতে হরদম গোলাবর্ষণ করেছে। বাঙালি অফিসারদের সপরিবারে টেনে এনে বেয়নেট দিয়ে গুঁতিয়ে গুঁতিয়ে হত্যা করেছে।
দেখারও সীমা আছে, শোনারও সীমা আছে। কিন্তু নতুন অত্যাচারের দৃশ্য চোখকে পীড়া দেয়। রাস্তাঘাটে পড়ে থাকা মৃতদেহ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়া মুশকিল। নতুন মৃত্যু, নতুন জ্বালানো পোড়ানোর সংবাদ শ্রুতিতে রূঢ় আঘাত করে। না শুনে উপায় নেই। সময়টা যে অস্বাভাবিক। বাঙালি জাতির যা কিছু গর্বের আনন্দের আকাক্সক্ষার সবকিছু ধ্বংস করে দিচ্ছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। আমরা কি নিয়ে বেঁচে থাকব?
রিক্সা থেকে নেমে একজন লোক খবর দিল, গত রাতে সমস্ত শান্তিনগর বাজারটা জ্বালিয়ে দিয়েছে। উহ্, জ্বালানো ছাড়া আর কথা নেই, হত্যা করা ছাড়া পাকিস্তান সৈন্যের আর কর্ম নেই। এই চরম দুঃখের দিনেও হাত নিশপিশ করে ওঠে। আজ যদি আমাদের হাতে অস্ত্র থাকত! মারি কিংবা মরি ব্রত নিয়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়তাম। অসহায়ের মতো বসে বসে স্বজনহত্যা দেখা আর কাঁহাতক সহ্য করা যায়। ঘুরবার সময় শেষ হয়ে এসেছে। একটু পরেই কারফিউ নামবে। জানালার বাইরে দুটি কৌতূহলী চোখও যদি দেখা যায়, সেনাবাহিনী নিশানা করে গুলি ছুঁড়বে। শ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরে এলাম।
ঢাকা শহরের রাস্তায় মিলিটারি জিপ ছুটে বেড়াচ্ছে। এখানে সেখানে গুলি ছুঁড়ছে। সারারাত ধরে তারা গুলি করে করে আমাদের জাতীয় নিশানগুলো পেড়ে ফেলেছে। ঘরের ছাদে ছাদে বাঁশের কঞ্চিগুলো দাঁড়িয়ে। যে সময়টুকু খোলা ছিল বানের জলের মতো অর্ধেক মানুষ সরে গেছে শহর থেকে। সারা শহরে প্লেগের মতো আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বেলা ঢলে পড়েছে। একটু পরে সন্ধ্যে নামবে। রাতের অন্ধকারে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নির্মমভাবে শিকার করবে বাংলাদেশের মানুষ, ঘর জ্বালাবে, মেয়েদের ধরে নিয়ে যাবে। সৈন্যরা দুই দিনে যে আচরণ করেছে তাতে করে প্রমাণিত হয়ে গেছে মানুষে সামান্যতম গুণও তাদের নেই।
আশ্চর্য, এই নরপশুরা আলোকে ভয় করে। অন্ধকারের আড়ালেই তারা জঘন্যতম নৃশংসতম দুষ্কর্মের অনুষ্ঠান করে। সন্ধ্যে হওয়ার একটু আগেই সৈন্যরা মাইক দিয়ে ঘোষণা করল, নামিয়ে ফেলো জাতীয় পতাকা। বায়তুল মোকাররমের পাশে ইসলামিক একাডেমীর একজন হৃষ্টপুষ্ট দারোয়ান পতাকা নামিয়ে নেবার জন্য যেই হাত দিয়েছে, অমনি তাঁর বুকে গিয়ে গুলি বেঁধে। বেচারা ঘুরে ঘুরে নিচে পড়ে গেল। ঝলকে ঝলকে রক্ত বেরিয়ে কালো রাজপথ লাল হয়ে এল। এই মৃত্যুর দৃশ্যটি খুবই হৃদয়বিদারক।
সন্ধের পরে বিচ্ছিন্নভাবে এদিক ওদিক গুলি চলল। ঘড় ঘড় আওয়াজ তুলে চার চারখানা ট্যাঙ্ক নারায়ণগঞ্জের দিক থেকে ফিরে এল। চোখের ঘুম উধাও। বুকের ভেতরটা ভারি জ্বলছে। গুলি থামছে না। মেশিনগানের ইতস্তত আওয়াজ, ক্ষণে ক্ষণে একটা দুটো করে গর্জে উঠছে রাইফেল। সম্ভবত সৈন্যরা ঘরে ঢুকে হত্যা করছে। রাত যতই গভীর হচ্ছে আওয়াজ ততই ঘন হচ্ছে।
ছাদের উপর উঠে দেখলাম ঢাকা শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ আগুনের আভায় লাল হয়ে উঠেছে। আজ রাতেও তারা জ্বালাচ্ছে। এমনিভাবে আগুন দেখতে দেখতে রাত কাটালাম। রাত ভোর হলো। দেখি নওয়াবপুরের বাঙালি দোকানগুলো জ্বলছে। আগের দিন নাকি অবাঙালি অধিবাসীরা দোকানে মালপত্তর লুটে নিয়েছে। যে দেরাজ, বাক্সগুলোতে ভরে থাকত বাঙালি ব্যবসায়ীর আশা-আকাক্সক্ষা এখন সেখানে গাদা গাদা ছাই এবং অঙ্গার। সকলে শাঁখারীবাজারের কথা বলাবলি করছিল। এই ছোট্ট গলিটিতেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরা ঘেঁষাঘেঁষি করে বাস করত। ঢাকা শহরের আর কোনো অঞ্চলে এত হিন্দুর বাস ছিল না।
গলিতে ঢুকবার আগেই নমুনা দেখলাম। জগন্নাথ কলেজের পাশের একটা ঘরে চারজন মানুষ পাশাপাশি পড়ে আছে। গলি দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করার উপায় নেই। পোড়া আধপোড়া মানুষ আগুনের আঁচে বেঁকে গেছে। প্রতিটি ঘর তারা আগুন দিয়ে জ্বালিয়েছে। প্রতিটি ঘরে ঢুকে হত্যা করেছে। কেউ রেহাই পায়নি। শিশু বৃদ্ধ নারী সকলেই মরেছে। কে একজন বলল, চন্দন শূরের ঘরে একত্রিশটি লাশ রয়েছে। তিনি ছিলেন প্রভাবশালী এবং ধনবান মানুষ। গত নির্বাচনের সময় শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী মুসলিম লীগ সমর্থক নবাববাড়ির খাজা খয়েরুদ্দীন তাকে দলে টানতে চেষ্টা করলে তিনি কড়া কথা শুনিয়েছিলেন। লোককে বলাবলি করতে শুনেছি খাজা নিজেই নাকি সৈন্যদের তার বাড়িতে নিয়ে এসেছিল।
শাঁখারীবাজারে অত্যাচার নির্যাতন হত্যা অগ্নিসংযোগ এবং নারী ধর্ষণ কিভাবে চলেছে চোখে না দেখলে তার বর্ণনা দেয়া যাবে না। দেখছি শয়ে শয়ে বিকৃত পোড়া আধপোড়া মৃতদেহ। এর একটি দেখলেও অন্য সময় পেটের ক্ষিধে এবং চোখের ঘুম চলে যেত। তবু সেই খুনি পশুপালের দৃষ্টি এড়িয়ে অসংখ্য মৃতদেহ ঠেলে ঠেলে পথ চলেছি। ভাবতে নিজেরই অবাক লাগে।
দুপুরে বাসায় আসতে হলো। দেখতে হলো সামরিক কর্তৃপক্ষের কঠোর নির্দেশ উর্দুতে লেখা ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ এবং সে জাতীয় শ্লোগান বাড়িতে দোকানে সেঁটে রাখছে। সমস্ত ঢাকা শহর খুঁজে বেড়ালেও কোনো বাঙালির দোকানে বাংলা ছাড়া সাইনবোর্ড পাওয়া দায় হতো। জনগণ স্বেচ্ছায় বাংলাতে সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছিল। কেউ তাদের বাধ্য করেনি। অথচ আজ তারা বুলেট এবং বেয়নেটের মুখে বাধ্য হয়ে আপনাপন বাড়িঘর দোকানপাটে উর্দু লেখা সেঁটে রাখছে। এর চাইতে অপমানজনক আর কি হতে পারে। সৈন্যবাহিনী আমাদের অনেক কিছু ধ্বংস করেছে, সে সঙ্গে তারা আমাদের বর্ণমালাও ধ্বংস করে দিতে চায় নাকি?
এক একটা সংবাদ চেতনায় কামানের বলের মতো আছড়ে পড়ে। এতকাল মানুষ সম্পর্কে জীবন সম্পর্কে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি সব যেন মিথ্যে হয়ে গেল। হত্যা লুণ্ঠন অগ্নিসংযোগ ধর্ষণই এই কয়দিনে স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা প্রেতছায়া বনে গেছি। পথেঘাটে বন্ধুবান্ধবের সাথে দেখা হলে করমর্দন করে বলি, ‘আসি এখন ভাই, বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে।’ ধরতে গেলে আমাদের যেন কোনোই অস্তিত্ব নেই। তবু কি করে বেড়াচ্ছিলাম তার বিশ্লেষণ তখনো পাইনি। এখনো পাচ্ছি না। খাওয়ার কোনো রকম প্রবৃত্তি নেই। একটি দোকানে পাউরুটির দুটো স্লাইস খেয়ে গলায় জল ঢেলে সদরঘাটের দিকে গেলাম। ফুটপাতে ইতস্তত ছড়ানো লাশ পড়ে রয়েছে। বড় বড় মাছি ভন ভন করছে। বাংলাদেশে মানুষের লাশ শকুনেও খায় না। শেয়াল-কুকুরেও ছোঁয় না।
প্রতিদিন সদরঘাটে লোকের হাট থাকত। প্রদেশের অনেকগুলো জেলা থেকে মানুষ লঞ্চে করে ঢাকায় আসত, ঢাকা থেকে বিভিন্ন জেলায় যেত। অসংখ্য মানুষের মধুচক্রের মতো অবিরাম গুঞ্জরণ রাত বারোটার পরেও থামত না। সেই সদরঘাট খালি। একদম খালি। আই. ডব্লিউ. টি-এর জেটিগুলোর দিকে তাকালেই বুক ছম ছম করে। এতসব মানুষ, এত নৌকা লঞ্চ হৈ-হল্লা চিৎকার এসব কোথায় গেল? এই যে রাস্তার দুই পাশে বসত রাশি রাশি ফেরিওয়ালা, বেচাকেনা সেরে রাস্তার উপর শুয়ে থাকত- তাদের কি হলো? কানের কাছে কে একজন বলল, সকলেই গেছে। বিরাট গুদামঘরটি জ্বালায়ে দিয়েছে। ঢাকা শহরের বসন খুলে নিয়ে একেবারে উলঙ্গ করে রেখেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী।
তারপর আর এক ব্যাপার দেখলাম। সদরঘাট এবং ইসলামপুর রোডের সংযোগস্থলে একটি জুতার দোকান আছে। নাম বি. আই. এস.। খুব বড় দোকান। সৈন্যরা দোকানের তালা ভেঙে ফেলে প্রথম অবাঙালিদের ডেকে এনে একদফা লুট করাল। তারপর কিছু বাঙালিকে ডেকে এনে বলল, যা আছে লুটেপুটে নিয়ে যা। যারা লুট করতে চায়নি সঙ্গীনের গুঁতো দিয়ে তাদের ঠাণ্ডা করে দিয়েছে। অনেকেই বাধ্য হয়ে জিনিসপত্র নিয়েছে। তারা নিজেদের কামেরাম্যান দিয়ে ছবি তুলিয়েছে এই পরবর্তী লুটের দৃশ্যের। তারপর মেশিনগান দিয়ে গুলি করে মেরেছে। শুধু বি.আই.এস. দোকানের সামনেই বিশ পঁচিশটি মৃতদেহ চার পাঁচ দিন ধরে পড়ে ছিল। ইসলামপুরেও এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।
পরদিন বীভৎসতম হত্যাকাণ্ডের সংবাদ শুনতে পেলাম। রাতের অন্ধকারে শত্রুর ঘুমন্তপুরী আক্রমণ করার মতো যখন বর্বর সেনাবাহিনী শহরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, তার পরের দিন থেকেই নিরাপত্তার আশায় হাজার হাজার মানুষ স্রোতের মতো এসে জিঞ্জিরা বাজারে আশ্রয় গ্রহণ করে। সেই জিঞ্জিরাবাজার পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করার এবং কামান দেগে গণহত্যার খবর পেলাম। সন্ধ্যের সময় থেকে মেশিনগানে সজ্জিত মিলিটারি জিপগুলো সদরঘাটে জড়ো করে রাখে একদিকে। আবার অন্যদিকে বাজারের তিন দিকে তারের ঘেরা দেয় এবং তাতে বিদ্যুৎপ্রবাহ চালিয়ে দেয়। রাত হলে নৌকা করে নদী পার হয় সৈন্যরা এবং তাদের জিপগাড়িগুলোও পার করানো হয়। এরোপ্লেন থেকে আলো দেখিয়ে জিপগুলোকে বাজারে নিয়ে যাওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় বেপরোয়া গুলিবর্ষণ। ঢাকা শহেরর উপকণ্ঠের সুবৃহৎ বাণিজ্যকেন্দ্রটিতে রাতের অন্ধকারে রাইফেলের নল থেকে, মেশিনগানের নল থেকে অবিরাম ঝলসাতে থাকে মৃত্যু। যারা আশ্রয় নিয়েছিল কেউ বাঁচতে পারেনি। যারা গুলি থেকে বাঁচবার জন্য পিছন দিকে পালাতে চেয়েছে তারা শখ খেয়ে মরেছে। একরাতে তারা জিঞ্জিরাবাজার কমসে কম পাঁচ হাজার মানুষ হত্যা করেছে। দূর-দূরান্তের মানুষও দূরপাল্লার মেশিনগানের গুলি থেকে বাঁচতে পারেনি। এক রাতের মধ্যে জিঞ্জিরাবাজার বিলকুল সাফ করে দিল।
শুনলাম, বংশাল রোডের দৈনিক সংবাদ পত্রিকার অফিসটি জ্বালিয়ে দিয়েছে। দেখতে গেলাম। কামানের ঘায়ে সমস্ত অট্টালিকাই উড়িয়ে দিয়েছে। কিছুই অবিশষ্ট নেই। কে একজন বলল, শহিদ সাবেরের লাশ। হ্যাঁ, তাই তো একটা বিকৃত মৃতদেহ তালগোল পাকিয়ে পড়ে আছে। ইনিই কি এককালের প্রতিশ্রুতিশীল কথাসাহিত্যিক বর্তমানের বিকৃতমস্তিষ্ক শহিদ সাবের? নাকের উপর বসানো চশমাজোড়া এখনো তেমনি আছে। শনাক্ত করতে অসুবিধে হলো না। মাথা খারাপ হওয়ার পর থেকে শহিদ সাবের এখানেই পড়ে থাকতেন রাতের বেলায়। দুই বেলা প্রেসক্লাবে গিয়ে খেয়ে আসতেন। বন্ধুরা বিকৃতমস্তিষ্ক সাবেরের জন্য এই ব্যবস্থাই করে দিয়েছিলেন পঁচিশ তারিখের রাতে প্রেসক্লাব ভেঙে দিয়েছে। তার পরের এক দিন নিশ্চয়ই তাকে উপোস করতে হয়েছে। তারপর তো বর্বর সৈন্যদের হাতে প্রাণই দিতে হলো।
ঢাকা শহরে আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে উঠেছে। প্রতিটি জিপের শব্দে মনে হয় মৃত্যু এগিয়ে আসছে দ্রুত পায়ে। প্রতিটি গুলির শব্দে মনে হয় নিজের বুকটা ফুটো হয়েছে। অথচ গুলি লাগেনি নিজের বুকে। অন্য কারও বুকে লেগেছে। আমার বুকেও লাগতে পারে কিন্তু সে সময়টি কখন আসবে? স্থির হয়ে বসে থাকার উপায় নেই। ঘুর ঘুর করে হেঁটে বেড়াই। পরদিন ওয়ারীতে গিয়ে জানতে পারলাম কলাবাগান, ফার্মগেট এবং তেজগাঁও এলাকা থেকে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কমসে কম আটশ ছাত্র ধরে সৈন্যরা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গেছে। তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে খবর পাইনি। সৈন্যরা ওসব অঞ্চলের ঘরে ঘরে গিয়ে মা-বাবাদের কাছে জিজ্ঞেস করেছে তোমার ছেলে কয়টি? তাদের বয়স কত? এখন কোথায়? আমাদের হাতে দিয়ে দাও। নইলে সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেব।
দলে দলে তরুণ না খেয়ে না ঘুমিয়ে পায়ে হেঁটে ঢাকার বাইরে চলে এসেছে। পথে যে সকল দলের সঙ্গে মিলিটারির দেখা হয়েছে তাদেরকে মেশিনগানের গুলিতে হত্যা করা হয়েছে। ঢাকা শহর জনশূন্য হতে চলল। সন্ধ্যের পরপরই কোনো না কোনো বাড়িতে আগুন জ্বলে ওঠে। কোথাও গুলির শব্দ শোনা যায়। গাড়ি ঘোড়া সাইকেল রিক্সা কিছুই চলে না। শুধু মিলিটারি জিপগুলো বাতাসে পেট্রোলের গন্ধ ছড়িয়ে এ-রাস্তা ও-রাস্তায় ছুটোছুটি করে। আর গর গর গর বিকট আওয়াজ তুলে মাঝে মাঝে ট্যাঙ্ক যায়। বাজারে খাবার মেলে না। তরিতরকারির বাজার সব আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। রেশনের দোকানের চাল আটা গম সব লুট করে নিয়ে গেছে। বাঙালি ব্যবসায়ীদের দোকানগুলো একের পর এক লুট করে যাচ্ছে অবাঙালিরা। মিরপুর, মোহাম্মদপুর অঞ্চলের অবাঙালিরা এসে বাঙালিদের পরিত্যক্ত ঘরবাড়িতে তালা লাগিয়ে দিয়ে দখল প্রতিষ্ঠা করছে।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে চিহ্নিত করার কাজ তখনো পুরোদমে চালু হয়নি। অনতিবিলম্বে সে কাজটি শুরু হলো। দিনের বেলা চরদের সহযোগে হিন্দু অধিবাসীদের বাড়িতে গিয়ে চিহ্ন দিয়ে আসে। রাতের বেলা গিয়ে চারদিক দিয়ে ঘিরে ধরে গুলি করে হত্যা করে। শহর থেকে পালিয়ে যাবার কোনো পথ নেই। চারদিকে কড়া পাহারা বসিয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীর কাছে শুনেছি, একজন মাঝি দুজন হিন্দু ভদ্রলোককে বুড়িগঙ্গা পার করে দেয়। সৈন্যরা এ কথা জানতে পারে। তারা পার করে দেয়া মাঝিটির খোঁজ করতে থাকে। মাঝি ওপার থেকে দুজন তরকারি বিক্রেতা এপারে নিয়ে এসে আবার চলে যায়। সে কথা জানতে পেরে মাঝিকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। কিন্তু মাঝি ওপারে গুলির রেঞ্জের বাইরে গিয়ে আত্মরক্ষা করে। তারা তখন সে তরকারি বিক্রেতা দুজনকে ধরে ফেলে। হুকুম করে বুড়িগঙ্গায় ডুব দিতে। যেই ডুব দিয়েছে জলের ভেতরেই মেশিনগানের গুলি চালায়। গুলিবিদ্ধ মানুষ দুই জন মরা মাছের মতো ভেসে ওঠে।
নিজের চোখে দেখেছি, সৈন্যরা কিভাবে নারিন্দার গৌড়ীয় মঠের উপর আক্রমণ করেছে। সেদিন মার্চ মাসের একত্রিশ তারিখ হবে। দুপুর থেকেই তারা মঠটা ঘিরে রাখে। তাদের দালালেরা বলতে থাকে মঠের মধ্যে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ এবং একটি শক্তিশালী ট্রান্সমিটার পাওয়া গেছে। কথাটা কি কেউ বিশ্বাস করেছে? মনে তো হয় না। সন্ধ্যে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মন্দিরের চূড়ো লক্ষ্য করে কামানোর গোলা ছুড়তে থাকে। আশ্চর্য শক্তি পাথুরে মন্দিরের। গোলার আঘাতেও একটুও ভেঙ্গে পড়েনি। তারপর তারা আগুন লাগাতে চেষ্টা করল। দাউদাউ করে জ্বলেও উঠল। সে সময় এল বৃষ্টি। আগুন জ্বলল না। তারপর রাইফেলের আওয়াজ শোনা যেতে লাগল। পরদিন দেখা গেল চার পাঁচটি গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ পড়ে রয়েছে।
অত্যাচার সাম্প্রদায়িক খাতে প্রবাহিত হলো। সংখ্যালঘুদের ধনসম্পদ লুট করতে অবাঙালিদের লেলিয়ে দেয়া হলো। তাদের সঙ্গে যোগ দিল জামাতে ইসলাম এবং মুসলিম লীগের গুণ্ডাবাহিনী। এই লুণ্ঠনকর্ম শক্তিশালী করার জন্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের দাগি আসামীদের ছেড়ে দেয়া হলো।
অন্যদিকে অত্যাচারের সাধারণ চেহারাটিও কম ভয়ঙ্কর নয়। ঘোষণা করেছে সরকারি কর্মচারীদের মাইনে দেয়া হবে। মাইনে দিয়েছেও। অফিসের ফটকের কাছে আবার সে মাইনে কেড়ে রেখেছে। ঢাকা শহরের প্রায় প্রতিটি অফিসেই এ রকম ঘটেছে। পথেঘাটে হাঁটেঘাটে হাঁটবার উপায় নেই। তালাসি করার নামে মানুষের হাত থেকে ঘড়ি আংটি টাকা পয়সা সব ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। শুনলে গল্প মনে হবে কিন্তু ঢাকাতে এসব সত্যি সত্যিই ঘটেছে।
ঢাকা শহর তরুণ ছাত্র যুবকদের আশ্রয় দিতে অক্ষম হয়ে পড়েছে। দেখলেই গুলি করে, ধরে নিয়ে যায়। গুলি করে মারতে মারতে সৈন্যরাও বোধ হয় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ধরে নিয়ে কোথায় যে রাখে, কি করে, ঠিকমতো খবর পাই না। নানারকম গুজব ছড়িয়ে পড়ে। কেউ বলে নারায়ণগঞ্জের কাছে শীতলক্ষ্যার পাশে একটি ঘেরা জায়গায় নিয়ে গুলি করে। আবার কেউ বলে সিরিঞ্জ দিয়ে শরীরের সব রক্ত টেনে নিয়ে মেরে ফেলে। তার দুই তিন দিনের মধ্যে কমলাপুরে, ধানমণ্ডিতে রক্ত বের করে নেওয়া যুবকের লাশ দেখা গেল।
সৈন্যরা শহরের ‘জ্বালানো, পোড়ানো, হত্যা, ধর্ষণ, এক রকম শেষ করেই গ্রামের দিকে যাত্রা করল। প্রতিদিন খবর আসছে নানাস্থান থেকে জালের মতো বেড় দিয়ে মানুষ খুন করে যাচ্ছে। অবলা তরুণীদের ধরে ব্যারাকে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের ঢাকায় থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ল। ঢাকা ছেড়ে চলে এলাম।
লক্ষ প্রাণের মূল্যে পেয়েছি সোনার বাংলাদেশ -------- কিন্তু রাত কি ভোর হয়েছে?
মন্তব্য করুন