তক্ষক!
প্রশান্ত মৃধার এক চমৎকার বই আছে, হারানো জীবিকা ও পেশা নিয়ে। আমার মনে হয় সময় এসেছে নতুন কিছু পেশা নিয়ে লেখার। যেমন- তক্ষক কেনাবেচা। তক্ষকের নাম শুনেছি গানে। অর্ণবের বিখ্যাত গান 'হারিয়ে গিয়েছি' র ভেতর আছে, তক্ষক ডাকা নিশুতিতে/ রূপকথা শুনে শিউরে উঠে না গা। এরপর নানু বাড়ীতে মাঝেমাঝে রাতে শোনা যায়, রাতের বেলা তক তক তক করে এক সরীসৃপ, তার নাম নাকি তক্ষক, স্থানীয় ভাষায় বলে টক্কা। পৃথিবীতে প্রাণী জগত নিয়ে আমার খুব বেশী আগ্রহ নেই, তাই এই প্রাণী নিয়েও তেমন খোজ খবর জানা নাই। তবে গত তিন চার বছর ধরে আমি নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্ত অনেক মানুষের মুখে শুনি এর নাম। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত অনেক মানুষের ফ্যান্টাসী হলো এইটা জ্যান্ত বেচে কোটিপতি হবার, টাকার সাগরে ভাসার। নিজেরা খুঁজে, লোক লাগিয়ে খুঁজে, তক্ষকের খবর সংগ্রহ করে, বিক্রির পার্টি খুঁজে, ভিডিও আদান প্রদান করা, ফোনে সারা বাংলাদেশ আলাপ, কাজের বাইরে এসব করেই এদের চলে যায় দিন।
এক্সাম্পল দেই, যেমন ধরেন আকবর নামের এক লোক। পেশায় রেন্ট কার গাড়ী চালায়, উপার্জন খারাপ নয়, থাকে ঘর জামাই তাই বাসা ভাড়াও লাগে না। বাসায় বাজার খরচের জন্য দেন ২-৩ হাজার টাকা, মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে স্কুলে পড়ান না ছেলেদের। বাকী সব টাকা তিনি ব্যয় করে তক্ষকের পেছনে, উনার এক সার্কেল আছে, সেখানে সারাদিন এইসব নিয়ে আলাপ। নির্দিষ্ট সাইজের হতে হবে, ওজন থাকতে হবে আড়াইশো- তিনশো গ্রামের বেশী, তাহলেই নাকি সেটা বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা পাওয়া যাবে। দাম নাকি অনেক অনেক বেশী। সাদা চোখে এটা কারোরই বিশ্বাস হয় না, যারা এর পিছনে জীবন যৌবন দিয়ে দিলো তারা শতভাগ নিশ্চিত। নির্ধারিত মাপ ওজনের তক্ষক পেলে তারা গুলশান নিবাসী বড়লোকদের খাতায় নাম লেখাবে। আমি মোহাম্মদপুরে অনেক মানুষ দেখেছি যাদের সব গল্প এইসব কেন্দ্রিক, আর এই বড়লোক হবার ফ্যান্টাসিতে দেশ থেকেই প্রায় বিলুপ্ত টিকিটিকির মত প্রাণীটি। খালি ধরছে কিন্তু সাইজে মিলে না, আবার সাইজে মিললে ক্লায়েন্টদের সাথে দামে মিলে না, দামে মিললে দেখা যায় র্যাব ধরে ফেলেছে, কিংবা প্রানীটাই দুনিয়া ছেড়েছে। এক অদ্ভুত ফাঁদ। আমি মোহাম্মদপুরে দেখেছি ভোলা বরিশাল মাদারীপুর শরীয়তপুর এই জেলার মানুষের এই ব্যাপার নিয়ে বেশী আগ্রহ। আবার কিছু মাঝারী বড়লোক, সেনা অফিসার, বড় হুজুর এদেরও দেখি আগ্রহের কমতি নেই। সবাই খুঁজে বেড়ায়, তক্ষক পায়, বেচার পার্টিও রেডি কিন্তু আজ অবধি কাউকে দেখলাম না বড়লোক হতে। হুট করে একদিন প্রাডো গাড়ীতে এসে বলবে, শান্ত মামা দেখছেন টক্কা বিক্রি করে নিয়ে ফেললাম গাড়ীটা।
আবার তক্ষকের নাম করে বিভিন্ন সাইট বিজনেসও খোলা হয়েছে। এক শ্রেনীর দালালরা প্রানীর খবর দেয়ার নামে লোকজনের কাছ থেকে এডভান্স নেয় তা দিয়ে সংসার চালায়। তাদের কথা হলো এরকম, মাল ধরছি- মাল আসতেছে, এখন ওমুক খানে, তখন ওমুক খানে এইসব সংবাদ দিয়ে টাকা কামানো। আবার কিছু কিছু লোক আছে যারা একটা সিন্ডিকেট বানায়, এক সিন্ডিকেট তক্ষক খুঁজে আরেক দল ক্রেতাদের সাথে আলোচনা করে। এভাবেই তাদের চলে যায় দিন। কেউ কেউ হয়তো অন্য কিছু করে কিন্তু শয়নে স্বপ্নে কাজ একটাই। কিছু লোক বউ পুলাপান বাড়ীতে রেখে এসে ইলেক্ট্রিশিয়ান, স্যানিটারী রাজ মিস্ত্রির কাজ করে, যৎসামান্য টাকা পাঠায় বাড়ীতে আর সব এইসব কিছুর জন্য মেহনত করে। এদের কেউ কেউ আবার ট্যুরে বিভিন্ন জেলা ঘুরে, তক্ষক দেখে, বেশীর ভাগ সময় ব্যর্থ মনোরথে ফেরত আসে। ট্যুরের খরচ অবশ্য একার না, ভাগে ভাগে। কারো পরিচিত সেনাবাহিনীর লোকজন থাকলে তাদেরকে দিয়েও তথ্য টথ্য নেয়। এক নাকি মেজর সাব আছে তিনি নাকি টাকা দিয়ে তক্ষক খোজান, কেউ খুঁজে পেলে প্রভাব খাটিয়ে দখল করেন।
আবার আরেক গ্রুপ আছে তারা আমার ফেভারিট। তারা হলো চিটিং এর উপরে চিটিং। খবর দেয়, লোকজন যায়, তক্ষক পছন্দ হয়। তারপর যখন টাকা নিয়ে কিনতে যায় তখন তাদেরকে বেঁধে রেখে টাকা পয়সা মোবাইল সব নিয়ে যায়। তাদের কিছু ডেমো বাড়ীঘর আছে, সেখানে কয়েকদিন আটকে রাখার পর খালি পকেটে ছেড়ে দেয়। পুলিশে কমপ্লেইন করতে পারেনা কারন ব্যাপারটাই ইলিগ্যাল। এভাবেই তারা অন্য দল খুঁজে সর্বস্বান্ত করার জন্য। আবার অনেক সময় তক্ষক ঢাকায় আনার সময় র্যাব পুলিশের হাতে পরে, জেল টেল কিছুদিন খেটে, লাখ দেড়েক টাকা খরচ করে বের হতে হয়। অনেক সময় এমন হয় ক্রেতা বিক্রেতা দামে মিলেনা, তখন কেউ পুলিশে খবর দেয়। আর আগেই যা বলেছিলাম অনেক সময় সংবেদনশীল তক্ষক মরেই যায় এই মনুষ্যরুপী জানোয়ারদের সাথে থেকে থেকে।
আমি জানি না তক্ষকে মুল্যবান কিছু আছে কিনা। নয়তো এরা বেচাকেনার জন্য এত পাগল কেন? আমি সার্চ দিয়ে তেমন কিছু পায় নাই। হয়তো লোকজনও পায় নাই। তাও খুঁজছে, একদিন শত কোটি টাকার মালিক হবে এইজন্য সব বাদ দিয়ে তক্ষকের পেছনে পড়ে আছে। এতে অবশ্য তক্ষকের কোনো উপকার নাই, বরং দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে তক্ষক- মানুষের লোভের আগুনে। অবশ্য সরকারের এইসব নিয়ে ভাবার সময় কই, যেদেশে মানুষেরই দাম নেই সে দেশে তক্ষকরাই মুকুটহীন বাদশা। মিশুক তারেক মাসুদের হত্যাকারীর যাবজ্জীবন দেয়ার আগের একদিনে আমি পত্রিকা নিয়ে হিসাব করলাম প্রায় ৭৭ জন মারা গিয়েছেন সড়ক এক্সিডেণ্টে। অন্তত এই একটা প্রানী খুঁজতে লোকজন দিশেহারা, মানুষ তো আর মানুষকে এভাবে খুঁজে না কখনো।
তক্ষক, কালো বিড়াল, কি সব দামি পাথরের র্মূতি এইগুলো খোঁজার কথা আমিও শুনছি অনেক। তবে আমি কোনদিন শুনি না কেউ এগুলো বেঁচে বড়লোক হইছে কিংবা খুঁজে পেতে। আমারো সবচেয়ে বেশি আগ্রহ এইটাই যে, লোকে এইগুলো দিয়ে আসলে করেটা কী? অদ্ভুত কান্ড কারখানা!
শান্ত, বিসমিল্লাহ করে ফেলো, তক্ষক নিয়ে লেখা দিয়ে শুরু করো -- বেস্ট উইশেস
দেখি আপা কতদুর কি করা যায়!
মন্তব্য করুন