এইসব হারিয়ে ফেলা গ্রীষ্মদিন!
কথাটা বলার পর কেউ আমাকে পাগল ভাববেন, কেউ মনে করবেন এটেনশন সিকার কিন্তু কথাটা প্রাণ থেকে আসা, আমার প্রিয় ঋতু গ্রীষ্মকাল। ব্লগে এটা অনেকবার বলেছি আজ আবার বললাম। শুরুর জন্য লেখা আর কি, কিছু একটা বলে লেখা শুরু করতে হবে। লিখতে ইচ্ছে করে খুব, কিন্তু সেই একই রকম লেখা বারবার লিখে যেতে যেতে ক্লান্ত। নিজের লেখা ব্লগে দেখতেও ক্লান্ত লাগে। এমনই এখন মৃতপ্রায় এই ব্লগ যে চারমাস আগে লেখা পোষ্ট এখনও ঝুলে আছে বেহায়ার মতো। তবুও তো টিকে আছে। নয়তো ব্লগ জিনিসটাই এখন প্রাচীনপন্থী। অথচ সব সময় শুনি দুনিয়ায় ব্লগের বিপ্লব হয়েছে, ইনবাউন্ড মার্কেটিং টূল হিসাবে ব্লগ নাকি টপ মাধ্যম। কিন্তু কমিউনিটি ব্লগের দিন বোধহয় শেষ, এখন সবাইকে দেখি ব্লগ পোষ্ট অজস্র অনলাইন নিউজ আছে সেগুলাতে দেয়। কিন্তু ব্লগের যে চার্ম সেখানে আর তা নাই। ফেসবুক আপনার দোস্ত বন্ধু বেশী থাকলে আপনার লেখা পড়বে ব্যস এতটুকুই। সেই অচেনা অজানা বাংলাভাষী পাঠক আপনার ব্লগ দেখে মুগ্ধ হবে, নিজেও লিখবে, সেই দিন শেষ। যা বলছিলাম আগেও বলেছি গরমের দিনে আমার সব ভালো স্মৃতি শৈশব কৈশোরের। শীতকালের স্মৃতি যে নাই তেমন না। কিন্তু লম্বা গরমের ছুটি, সারাদিন বাইরে, রোদে পুড়ে ঝলসে যাওয়া, খেলাধুলা, হাসি আড্ডা গান, কি দিন গুলো ছিল। ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন গাছের নীচে একদিন ঘুমিয়ে পড়েছি, দেখি লাল পিপড়া পা এ কামড় মেরে ফুলিয়ে ফেলেছে। এক আন্টি বিচার দিয়েছে শান্তর কি বাসা নাই, সেইসব দিন আর আসবে না!
তবে কারোরই গ্রীষ্মকাল ভালো লাগে না। গরম সহ্য হয় না। অনেকে হয়তো ফলের কারনে ভালোবাসে, তাও সেটা গরম থেকে রক্ষা পেতেই হয়তো। কিন্তু আমি আম বাদে আর কোনও ফলই লাইক করি না। অবশ্য আম এমন এক ফল যা সবাই পচ্ছন্দ করে। আমার আম্মু পছন্দ করে তরমুজ বাঙ্গি এইসব। আব্বুর পছন্দ কাঠাল। বারেকের পছন্দ কদবেল। কদবেল কারো পছন্দ হতে পারে তা ভাবি না। তবে খুলনায় যখন ছিলাম কদবেল খাওয়ার ভেতরে ভাব ছিলো। নিজের ভারিক্কি ভাব আনতে লোকজন খুব মন দিয়ে কদবেল খেত। তখন বাসা কলোনীতে। আমি ক্লাস ফোরে পড়ি। কারো বাসায় বাবা মা ছাড়া ভাত খাওয়া মানে ফকির, এই ছিল বাধ্যতামূলক শিক্ষা। হুজুরের কাছে পড়তে গিয়ে ভাত খেয়ে আসি নাই। সেই বাসায় সেদিন রান্না হয়েছে আলু ভর্তা আর ডাল, আমাকে সেধেছে আমি না করতে গিয়ে বলে ফেলেছি- খাবো কিন্তু কাউকে জানায়েন না। খেয়েছি পেট ভরে, বাসায় এসে আর খেতে পারি না ভাত। আম্মুর মনে সন্দেহ, আমি হোটেল থেকে পরোটা টরোটা খেয়েছি কিনা। পরে কাজের বুয়া জানায় দেয় আমার কীর্তি। আম্মু ঘোষনা দেয় আলু ভর্তা আর ডাল আমাকে সারাজীবন খাওয়াবে। আমি তো মহাখুশি। কিন্তু খুশীতে থাকা আর হলো না। আম্মু ভুলে গিয়েছে এর পরের বেলাতেই। তখন খুলনা শহর অনেক ফাকা, মুড়ির টিন বাস চলে, রিকশা তে শহর ঘুরে আসা যায়, আমরা সকালে হাটতাম। হেঁটে হেঁটে অনেক দূর চলে যেতাম। কিন্তু যেখানেই যাই আশেপাশে স্কুলের বড়ভাই ছোটভাই কারোর না কারোর বাসা থাকবেই। দেখা হতো, গল্প করতাম, অনেক কিছুতেই চাপা মারতাম, ধরা খেতাম, সেই ছিল নির্বুদ্ধিতার দিন। ক্লাস ফাইভ সিক্সে হাতে এক রহস্য পত্রিকা থাকলে তো কথাই ছিল না, আমার ভাইয়া রহস্য পত্রিকায় লিখতো, প্রতিমাসে আসতো, হরর গল্প আমার ভালো লাগতো না, ভালো লাগতো কিশোর গল্প, জীবন থেকে নেয়া গল্প আর অনুবাদ ছোট গল্প। তখন তাদের আরেকটা পত্রিকা ছিল কিশোর পত্রিকা। সেখানে একটা বিভাগ ছিল ব্যাক্তিগত প্রোফাইল। একটা ছবি দিয়ে র্যান্ডম কোনও কিশোরের নাম বৃত্তান্ত পছন্দ অপছন্দের খাবার খেলাধুলা, সিনেমা এইসব নিয়ে থাকতো। আমি পাঠাই নি কখনো, কিন্তু লেখা প্রস্তুত করেছিলাম, কিন্তু হলো না। তবে তখন সব চাইতে মজা ছিল চিঠি লিখতে। প্রচুর ঠিকানা থাকতো চিঠি পাঠাতাম, রিপ্লাই আসতো না। তবে মেয়ে নাম দিয়ে লিখলে আর মেয়েটার মত গোটা গোটা অক্ষরে লাল নীল কলম দিয়ে লিখলে জবাব আসতোই। সেসব নিয়ে হাসি ঠাট্টা করাও আমাদের মজার কাজ ছিল। আর সব থেকে ভাবে থাকতো যারা কমিকসের মালিক বন্ধুরা, আমি ছিলাম ফকির পার্টি মানে আমাদের মাসে নতুন কমিকস নাই। আমরা পড়তাম ধারে। ধারের আবার নিয়ম ছিল পড়ে বাসায় গিয়ে দিয়ে আসতে হবে। এইজন্য আমি কমিকস পড়াই বাদ দেই। আবার আরেক ব্যাপার ছিল মজার, ধরেন আপনার বাসায় কোনও সমস্যা তা কমপ্লেইন বুকে লিখতে পারেন। তাও জোরে সোরে পড়ে আমরা মজা নিতাম। যেমন ধরুন, কেউ লিখেছে দুটো ফ্যান নষ্ট, মেরামত জরুরী। ফ্যানকে বানিয়ে দিতাম কান, দুটো কান নষ্ট। আরেক কাজ ছিল ভয়াবহ, রাস্তায় ক্রিকেট খেলতে গিয়ে জানলার কাচ ভাঙ্গা। একবার আপনি ধরা খেলে সারা বছর কালার থাকবেন। এনুয়াল রাউন্ডের সময় তা লাগিয়ে দিবে লোক। আমি ছিলাম এক ব্যাটের মালিক, টেকসইও ছিল ব্যাটটা, ক্লাসের সব ম্যাচ খেলতাম এক ব্যাটের উসিলায়। তখন থেকেই আমি অলস, ভাবতাম একদিন গায়েবী প্রতিভা আসবে, ময়েজ ভাই ইমরান ভাইয়ের বল সীমানা ছাড় করবো, কিন্তু সেই দিন আর আসে না।
চিটাগাং আসার পর দেখলাম এখানে লোকজন তিনগুন বেশী। সবাই গ্রুপ ভিত্তিক, শুরুতে আমি কোনও গ্রুপে ছিলাম না। লোকজন ক্রিকেট খেলতো, আমি বল টূকে আনতাম। এর পরের দানে চান্স পেতাম খেলায়। ক্লাস বন্ধুদের ভেতর ছিল কোয়ালিশন, আমি এক দলে ঢুকলাম, দেখলাম আমি জনপ্রিয়। আমার জনপ্রিয় হবার সাধ জাগলো,সবার সাথে মিশতাম। মিশে মিশে আমরা সবাই এক হয়ে গেলাম। বিশাল সার্কেল তখন আমাদের। প্রতিদিন ৪০ জন ফোন ছাড়াই বের হতাম। যে আসতো ডেকে আনতাম। নিজেদের ভেতরেই টুর্নামেন্ট হতো। পুরষ্কার মোটে ২০০ টাকা। তার জন্য যে লড়াই। ফুটবলে গোলকিপিং ছাড়া আমি আর কিছুই পারতাম না। একবার আমার বীরত্বে আমরা জিতি। ভাগে ৪০ টাকা পাই। ৪০ টাকা মানে তখন আমার কাছে অনেক টাকা। আম্মুকে দিয়ে দেই। আম্মু আরো ৬০টাকা মিলিয়ে ১০০ করে। বাসার যত ১০০ টাকা সব আমি আমার টাকা ভাবা শুরু করি। ক্লাস নাইন থেকে আসে বড় হবার দিন, তাও আমরা ছোট মানুষই। এক সন্ধ্যায় হালিম খেলে নিজেকে প্রিন্স চার্লস ভাবি। নয়তো সন্ধ্যায় কিমাপুরি আর চা খেলেও মন্দ হয় না। কেউ আইসক্রিম খাওয়ালে ভাবি ওর চেয়ে ইয়ারের দোস্ত আর নাই। আর প্রত্যাশায় থাকি সার্টিফিকেটের, কেউ ভালো কিছু বললে মুগ্ধ হই, বড়রা কি পড়ে না পড়ে তাদের দেখি, বাসায় ছুটিতে ভাইয়া কম্পিউটার আনলে গানের রাজ্যে হারিয়ে যায়। শিল্পীর বিষণ্ণতা, না পাওয়ার হতাশা গ্রাস করে। টিভিতে কাভি হা কাভি না দেখে সুচিত্রা কৃষ্ণমূর্তি নামের এক নায়িকার প্রেমে পড়ি। এই নায়িকার নাম বের করতে গিয়ে গাংচিল ভিডিও দোকানের এক ছেলেকে আমার চা বিস্কুট খাওয়াতে হয়। তখন সিডির সাথে ভিসিয়ারও চলে, দেয়ালে নায়িকাদের পোষ্টার ঝুলে,কম্পিউটারে নতুন নতুন সিনেমা দেখি অবাক হই। হূট করেই তখন বইয়ের দিকে চলে যাই। বড়দের মুখে শুনি এইসব কিশোর সাহিত্য পড়লে হবে না, হুমায়ূনেও হবে না, পড়তে হবে সমরেশ সুনীল শীর্ষেন্দু। পড়া শুরু করি। মানিক শরৎ পেলেও ছাড়ি না, সব পড়ি।
কলেজে উঠে প্রথমে শুনি পড়তে হবে বিদেশী বই। ইংরেজী বই। তখন ক্লাসিক পাওয়া যেত খুব সস্তায় তা পড়ি। খেলাধুলা তখন আর আমাকে টানে না। এরচেয়ে আড্ডা ভালো। ইরাক যুদ্ধ নিয়ে কথা বলা ভালো। রাজনীতি নিয়ে জানা ভালো, আওয়ামীলীগ, ইতিহাস, ধর্ম এইসব নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগে। ভালো লাগে বান্ধবীর সঙ্গ, ভালো লাগে বীচে একা বসে থাকতে, ভালো লাগে বৃষ্টি দিনে কোনও রেস্টুরেন্টে বসে থাকতে, গরমের দিনে মাঠে বসে থাকতে। সেকেন্ড ইয়ার থেকে আসলো কলেজে না যাবার নেশা, প্রতিদিন বৃষ্টিতে ভেজা, বন্ধুর বাসার ছাদে গিয়ে বসে থাকা। কেউ কেউ তখন সিগারেট খাচ্ছে, কেউ খাচ্ছে গাজা সব কিছুকে স্বাভাবিক হিসাবে নেয়া। তখনই জীবনের মস্ত বড় ভুলটা করি- ঢাকায় এসে পড়া। ঢাকা আমার কাছে বিরক্তিকর লাগতো তখন। ভার্সিটি যেতাম একা একা থাকতো। হাত খরচের টাকা দিয়ে বই কিনে ফাটিয়ে ফেলতাম। এত বই পড়েছি তখন। ভার্সিটি বাদ দিয়ে পাবলিক লাইব্রেরী বসে থাকতাম। বন্ধু হলো তাও পড়া থামলো না। অনলাইনে পড়লাম, ব্লগে আসলাম। লোকজনের লেখা পড়ে খুব ভালো লাগতো। নিজে কখনও লেখার চেষ্টা করি নি। অথচ কলেজে ভার্সিটির স্মরনিকায় আমার লেখা ছাপা হতো। সবার মতো কবিতা লিখতাম। কবি শামসুর রাহমান মাথার ভেতরে তখন। ব্লগে খালি পড়লাম কমেন্ট করলাম। গ্রাজুয়েশন শেষে মনে হলো এবার থাকি বাইরে বাইরে। সারাদিন বিনা কারনে চায়ের দোকানে থাকা শুরু করলাম। মানুষের সাথে মিশলাম। দেখলাম বইয়ের মতোই মানুষ ইন্টারেস্টিং। বসে থাকার আলসেমিতেই মাস্টার্স শেষ করলাম লম্বা সময় ধরে। আমরা বন্ধুতে লিখতাম সমানে। কত কিছু নিয়ে লিখলাম। নানান ঘাত প্রতিঘাতে জীবন চললো। এখন হুট করেই মনে হয় আর তরুণ থাকা গেল না। এখনও রাত জাগি, বই পড়ি সিনেমা দেখি, তাও তারুণ্যময় জীবন আর নাই। বন্ধুরা বিয়ে করছে সমানে, দেশে বিদেশে চষে বেড়াচ্ছে, উন্নতি করছে টাকা পয়সায়। এইসব কিছুই আমাকে টানে না,আমাকে টানে আড্ডা, আমাকে টানে রাশি রাশি বই পড়া, আমাকে টানে প্রিয় মানুষদের সাথে সময় কাটানো, জামালপুর বা চিটাগাং চুপচাপ গিয়ে বসে থাকা। কিন্তু বড় হবার চক্করে এইসবই গেল হারিয়ে। তাও খুব চেষ্টা করি এসবে থাকার আসল কাজ বাদ দিয়ে, কারন আমি জেনে গেছি বেশী কিছু আশা করার কিছু নাই। লাইফ অলওয়েজ ওভাররেটেড। কাল আমি কিংবা আমরা না থাকলেও কারো কিছু যায় আসে না।
শান্ত, বড় হচ্ছো - আমাদের বুড়োদের মত ছোটবেলা ভেবে নস্টালজিক হচ্ছো
তোমার লেখায় আজকে অনেক বেশি যেনো নিজের লেখার প্রতিচ্ছবি দেখলাম
ভাল লেগেছে পড়তে
একমাত্র আপনি যিনি ব্লগ ছেড়ে দিলেও কমেন্ট করেন। আপনার এই কমেন্টেই ভীষন অনুপ্রেরনা পাই। ভালো থাকবেন আপু। দিন যাপন আনন্দের হোক।
আমি ব্লগের দিনগুলি খুব মিস করি।
সবাই বড় হয়ে যায়, সময় মানুষকে বড় করে দেয়, একটা স্বতন্ত্র মানুষকে গড়পড়তা মানুষ বানিয়ে দেয়।
মন্তব্য করুন