ইউজার লগইন

বিষাদনদী

হুমায়ূন আহমেদের নদীর নাম ছিল ময়ূরাক্ষী। আমার নদীর কোনও নাই নেই, আমার নদীর জেনেরিক নেইম- বিষাদনদী। ছোট শান্ত নদী। যেখানে নেই উত্তাল ঢেউ, কিংবা ব্যারেজ- বাধ- সেতু। খালি আছে স্বচ্ছ বিষাদের জলধারা। এ কুল ও কুল সব খানেই ছড়িয়ে আছে সব ঝলমলে বিষাদ। মুক্তি পাওয়া যাবে, নদীকে তিলে তিলে শেষ করে। কিন্তু ইচ্ছে করে না। টিকে থাক বিষাদ নদী, টিকে থাকুক বিষাদ গ্রস্থতায়। একদিন সময় হলে বিষাদের সমুদ্রর দেখা পাবে এই নদী। ততদিন পর্যন্ত নদীকে বাঁচিয়ে রাখবো, নদী বাঁচিয়ে রাখবে বিষাদগুলোকে।

আগে আমার মনে হতো একটা সমুদ্র সৈকতে গোটা জীবন পার করে দেয়া যাবে। ঢেউ গুনতে গুনতে চলে যাবে দিন রাত্রী সব। কিন্তু দেখলাম জীবন আসলে ঢেউ গুনতে পারে না। জীবনের জন্য দরকার শান্ত নদী। একটা স্থির শান্ত নদী দেখতে দেখতে একটা জীবন পার করা যায়। লাল টকটকে সূর্য উঠবে নামবে, দুরের তারা জ্বলবে সেসব নিয়ে ভাবতে ভাবতেই কেটে যাবে বেলা। দূরে এক নৌকাকে দেখা যাবে, মনে হবে আসছে তা আমার কাছেই, কিন্তু আসবে না। অপেক্ষাতেই চলে যাবে সময়। বর্ষা নামবে নদীর ঘুম ভাঙবে, আমিও ঘুমিয়ে যাবো সেই শব্দে। কিন্তু জীবন আসলে আমাদের সেই বিলাসিতা দেয় না। জীবন জানায় মানুষ সুন্দর, মানুষের সাথে মিশো, মানুষকে নিয়ে কারবার করো, ব্যস্ত থাকো মানুষ নিয়ে, মানুষের কাছে প্রতারিত হলেও মানুষকে হাতছাড়া করা যাবেনা। এই কারবারের মোহে আমাদের আর নদীর সাথে জীবন হয় না।

তাবলীগের এক ছেলের সাথে দেখা হলো। তার আগে আসক্তি ছিল যাবতীয় নেশায়। এখন সে সব ছেড়েছুড়ে দিয়েছে ধর্ম নেশায়। আমি মনে করিয়ে দিলাম তার নেশার জীবন, সে জানালো ভাই বেহেশতে খাবো, ভালো ভালো নেশাপানি করবো, তাড়াতাড়ি মরতে চাই। তার কথা শুনে অনেকেই হাসাহাসি করবে, আমি ভাবছিলাম ছেলেটা বুদ্ধি আছে, কল্পিত হেভেনে দিন উদযাপনের আশায় আছে। আমি তো কিছুর আশাতেই নাই, খালি জীবনের লালসায় বেঁচে আছি। ছেলেটিকে হয়তো কেউ বলেছে এখানে কি খাও, বেহেশতে আছে যা চাও সব আছে সেখানে। তাই সে তাবলীগে দ্বীনের দাওয়াতের ছদ্মবেশ ধরেছে। এরকম লোভী জীবনও হলো না আমাদের। আমাদের জীবন হলো, যায় দিন খারাপ, আসে দিন আরও খারাপ।

জ্যামে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে হয়। বাসে একদিন এক মেয়েকে বলতে শুনলাম, কি জীবন আমাদের দু দুটো সিনেমা শো হলে গিয়ে দেখতে যা সময় তত সময় প্রতিদিন বাসে চলে যায়। ব্যাপারটা হতাশার। আমি ভাবছিলাম সিনেমার তো শেষ আছে। আমাদের দিন গুলো হলো ভালো পেইন্টিংয়ের মতো, যার দিকে তাকালে চোখ আর ফেরে না। শুরু শেষ মাঝখানে বলে কিছু নাই, খালি অবিরাম বয়ে নিয়ে চলা। সাহসী মানুষরা চ্যালেঞ্জ করে, তারা নিজের ইচ্ছায় হারিয়ে যায়, অনেকের রোগ শোক বাসা বাধে, আমাদের মতো যারা তারা শুধু টিকে থাকে। অনেকেই ভাবে তাই বলে কি জীবনের নিরাপত্তা দরকার নেই? প্রবর রিপনের মতো আমার বলতে ইচ্ছে করে, নিরাপত্তাই যদি শেষ করা হতো তবে মায়ের গর্ভেই তো ভালো ছিলাম, শ্রেষ্ঠ নিরাপদ স্থান। তবুও আমরা এসেছি। আমার কথা বলা হয়েছে মিলান কুন্ডেরার ভাষ্যে--'জীবন যে একটা ফাঁদ সে কথা আমরা সবসময়ই জানি। আমরা জন্ম নিতে চাই কিনা, এটা না জিজ্ঞেস করেই আমাদের জন্ম দেয়া হয়েছে, এমন একটা শরীরে আমাদের বন্দি করে রাখা হয়েছে যে শরীরটি আমরা নিজেরা পছন্দ করি নি এবং আমাদের জন্যে আবার মৃত্যু অনিবার্য করে রাখা হয়েছে।'

রনি নামের এক ট্রান্সজেন্ডার মানুষের সাথে কথা হয়েছিল। যার শখ ছিল মাতৃত্বের। পশ্চিমা দেশের নাগরিক হলে তার এই শখ পূরণ হতোই। কিন্তু বাংলাদেশ তো শখ আহলাদ স্বপ্ন- মৃত্যুর কারখানা। সে একটা কুড়িয়ে পাওয়া ছেলেকে পালতো। ছেলেটা তাকে মা ডাকতো। বড় হয়ে বস্তির ছেলেদের সাথে মিশলো, একদিন বলে ফেললো, তুমি তো আমার মা না, তুমি হিজড়া। রনির মনে হয়ে ছিলো মরে যাবে সেদিন। এতটা বিপন্ন সে আগে কখনো বোধ করে নি। কিন্তু সে মরে নি, দিব্যি করে কেটে খাচ্ছে। রনির সেদিনের বিপন্নতাকে আমি ধার নেই। এই ধার নেয়ার ব্যাপারটা ভালো। মনে মনে ধার নিয়ে সব করা যায়, আমার এক বন্ধুর বাবা খুব অসুস্থ সে হাসপাতালে ছুটছে। আমি ভাবছিলাম আমার এমন হলে কি করতাম, কি ভাবে বলতাম কথা, আমার রিএক্ট গুলো কেমন হতো এই নিয়ে ভাবতে ভাবতে দু তিন দিন অবলীলায় কাটানো যায়। কিংবা চাইলে স্মৃতি থেকেও ধার করা যায়, একবার আম্মুকে কিজানি বলেছিলাম, আম্মু কাঁদতে কাঁদতে শেষ, বলার পরেই মনে হচ্ছিলো মরে যাই। এরকম কথা আমি কিভাবে বলতে পারলাম, আত্ম অনুশোচনা করতে করতেই আমার টিকে থাকার আগ্রহ জাগ্রত হলো।

অদ্ভুত এক নতুন বাসায় আমি থাকি। আজ সন্ধ্যায় অফিস থেকে এসে শুয়ে আছি। কারেন্ট চলে গেল। দেখি কবরের মত নীরব। কোথাও শব্দ নেই একটাও। কবর কি এমন হবে, তখন আমাদের চেতনা কি এভাবে কাজ করবে? জানা নেই। আনিস মাহমুদের মতো আমার প্রয়াত হবার পর, আমাকে নিয়েও লোকজন আদিখ্যেতা করবে। মিসের ভান করবে সবাই। আসলেই আমরা কেউ কাউকে মিস করি না। মাঝেমধ্যে মনে পড়ে, তার নাম দেই- মিস। ধরেন আপনার অনেক বন্ধু ঢাকায়, আপনি এই ফালতু শহর ছেড়ে দিন, ফেসবুক মেসেঞ্জার বন্ধ রাখুন। দেখবেন হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া কেউ আপনার কথাও মনেও রাখছে না। আপনি যদি যোগাযোগে অনাগ্রহী হন তারাও ভুলে যাবে চিরতরে। এই যে ভুল ভুলাইয়া জগত। তাতে নিজেকে অমর রাখতে আমাদের সবার কি চেষ্টা। এরচেয়ে এই ভালো বিশ্বাস রাখা, আমার জন্য আমি। আমি না থাকলে কেউ আর আমার নয়। কেউ এই লুজারকে মনে রাখবে না। আমাদের কাধ প্রস্তুত প্রিয় মানুষের লাশ বহনে, প্রিয় মানুষরাও আমাদের শবযাত্রায় আসার জন্য প্রস্তুত। মাঝখানে কোনোরকমে বেঁচে থাকা তার নামই জীবন।

অনেকদিন চিটাগাং যাই না। জানি না প্রিয় শহরের কি অবস্থা। সেই ভোর গুলোর কথা খুব মনে পড়ে। যে ভোরে আমি একা হাটতাম। রাত শেষ হচ্ছে, ভোর আসছে, আর আমি হাঁটছি। আমাকে সঙ্গ দিচ্ছে দূর থেকে ধেয়ে আসা জাহাজের শব্দ, কখনোবা দ্রুতগামী ট্রাকের বিকট শব্দ। নামাজ শেষে চলে যাওয়া সমুদ্র সৈকতে। সেখানে গিয়ে মনে হবে সমুদ্র এসে কত প্রান নিয়ে যায়, আমাদের নেয় না কেন? ঘুম কাটাতে তিতকুটে এক চা খাবো বেলা বিস্কুট দিয়ে। এভাবে চলে যাবে সকালটা। এরকম সকাল আর আমার জীবনে আসে না। ঘুম থেকে উঠলে মনে হয় না উঠাই ভালো ছিল, বাইরে থাকলে মনে হয় বাসায় যেয়ে কি হবে? বাসায় থাকলে মনে হবে বাইরে গিয়ে কি হবে? এই যে উদ্দেশ্যহীন নির্থকতা, এইসব নিয়েই বেঁচে আছি। কাটছে দিন বিষাদ নদীতে।

পোস্টটি ১৮ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

মীর's picture


হরিষের বান ডাকুক বিষাদের নদীতে। অনন্ত শুভকামনা।

মুনীর উদ্দীন শামীম's picture


চট্রগ্রাম কিন্তু আমারও প্রিয় শহর। তবে ধারণা করি, এখন যদি ওখানে যান, কষ্ট পাবেন। একটি মনোরম শহরকে চোখের সামনে খুন করে ফেলা হয়েছে। বসানো হয়েছে ঢাকাকে চট্রগ্রামের ওপর। সেটি করতে গিয়েই শহরটা শেষ। আমি সম্প্রতি গিয়েছিলাম। খুব হতাশ হয়েছি।

লেখাটা অসম্ভব ভালো লেগেছে। ব্লগে নিয়মিত আসা হয় না। আসা হয় না বলে সব লেখা পড়া হয় না। সম্প্রতি কয়েকটা লেখা পোস্ট করে বিব্রতবোধের মধ্যে আছি। এত কম পোস্ট হয় যে, অনেক দিন ধরে সে লেখাগুলি প্রথম পাতায় ঝুলে আছে।

জীবন জানায় মানুষ সুন্দর, মানুষের সাথে মিশো, মানুষকে নিয়ে কারবার করো, ব্যস্ত থাকো মানুষ নিয়ে, মানুষের কাছে প্রতারিত হলেও মানুষকে হাতছাড়া করা যাবেনা। এই কারবারের মোহে আমাদের আর নদীর সাথে জীবন হয় না।

আমি ভাবছিলাম সিনেমার তো শেষ আছে। আমাদের দিন গুলো হলো ভালো পেইন্টিংয়ের মতো, যার দিকে তাকালে চোখ আর ফেরে না। শুরু শেষ মাঝখানে বলে কিছু নাই, খালি অবিরাম বয়ে নিয়ে চলা। সাহসী মানুষরা চ্যালেঞ্জ করে, তারা নিজের ইচ্ছায় হারিয়ে যায়

টিপ সই টিপ সই টিপ সই

তানবীরা's picture


লেখাটা বেশ অন্যরকম হয়েছে - কাব্যিক

তেলাপোকার মত টিকে থাকার নাম জীবন

নিভৃত স্বপ্নচারী's picture


বিষাদনদীতে স্নান করে গেলাম। লেখাটা খুব ভাল লেগেছে।
টিপ সই টিপ সই টিপ সই

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

আরাফাত শান্ত's picture

নিজের সম্পর্কে

দুই কলমের বিদ্যা লইয়া শরীরে আমার গরম নাই!