গল্পের হিরো!
অনেক বাঙ্গালী ছেলের নাম থাকে-- হিরু। ধারনা করি হিরো থেকেই এই নাম বাঙ্গালীর ভূবনে বিচরিত হচ্ছে। তবে নামটার তেমন সিগনিফিকেন্স নাই। যেমন ধরুন, যখন নেশার জগতে হিরোইনের খুব ডিমান্ড, তখন আদর করে অনেকে ডাকতো তা হিরু বলে। সেখান থেকেই শব্দটা এসেছে, হিরোইঞ্চি। বহুল প্রচারের কারনে শব্দটা হয়ে যায় গালি। আমার এক পরিচিত লোক আছে যিনি শুধু এই কারনে এই জিনিসের নেশা বাদ দিয়েছেন, হিরোইন নেয় যারা তাদের হিরোইঞ্চি বলে। উনার পাচ বছর বয়সী সন্তান জিগ্যেস করেছিল, বাবা তুমি নাকি হিরোইঞ্চি, সবাই বলাবলি করছিল? আদরের সন্তানের মুখে এরকম কথা শুনে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন আর না এই নেশার জগতে। তবে সিনেমার মতো তিনি হুট করেই সব ছেড়ে দেন নি। আস্তে আস্তে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। হিরু তেমন লোক নয়। সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত একজন মানুষ। পান খান, সিগারেট খান, সংসার আছে, অন্য নারীদের থেকেও প্রেম খুঁজেন, ছোট চাকরী করেন, টুকটাক দালালী করেন, আরো অনেক কিছু করেন বা করতে চান।
হিরুর শখ ক্রিকেটে জুয়া খেলা। তার মতোই মানুষদের সাথে খেলেন। দেদারসে হারেন, আবার অনেক জিতেন। হারলে বলেন, গোল বলের খেলা আমার কি করার? ক্লাস সিক্স অবধি স্কুলে পড়ার কারনে তিনি একটু পড়তে পারেন। ক্রিকইনফো থেকে বের করতে পারেন, কার খেলা, কে কে আছে দলে? ফ্রি ওয়াইফাই পেলে তিনি আনন্দিত হন। তখন খেলার আপডেটের সাথে পর্ণ নামান। সময় সুযোগ পেলে হেডফোন লাগিয়ে দেখেন। এইসব দেখার জন্য তার প্রিয় জায়গা তার বসের অফিসের গ্যারেজ। হিরুর প্রিয় খাবার পরোটা। তিনি পরোটা চায়ে চুবিয়ে খেতে পছন্দ করেন। মাঝেমধ্যে তিনি দুপুরে ভাত খাওয়ার আগে সকালে ভাজা পরোটা আর দুধ চা খেয়ে নিজেকে চাঙ্গা রাখেন। তিনি ভালো সুযোগ সন্ধানী। চায়ের দোকান হোক আর মুদি দোকান চেষ্টা করেন টাকা কিছুটা হলেও মেরে দিতে। তাই তিনি শিশু দোকানীদের খুব লাইক করেন, ঝাড়িঝুরি মেরে বাকী খেয়ে চলে যান। আর মহিলা দোকানদার হলে তিনি চান্স খুঁজেন ঠাট্টা মশকারি করে হলেও গায়ের সাথে আসতে। কিছু কিছু জায়গায় তিনি সফল। যেমন এক দোকানীকে তিনি ধার দিয়েছিলেন, সেই মহিলা আবদার করেছিল, গায়ে হাত টাত দিয়ে শোধ করে ফেলতে, তিনি টাকা দিবেন না। আশাকরি তিনি ভালো এস্তেমাল করেছেন। ফাও পেলে তিনি গাঞ্জা খান, গাঞ্জা খেলে তার আসিফের গানের কথা মনে পড়ে। আসিফের ভুল করেছি, তাই কেঁদেছি গানটি গাইতে গাইতে তিনি নিজেকে ব্যর্থ প্রেমিক ভাবতে থাকেন। একটা ছেলে আছে তার মাদ্রাসায় পড়ে, স্ত্রী বাড়ীতে থাকে। ছেলের মাদ্রাসায় পড়ার কারনে হোক আর বিএনপি মনস্কতার কারনে হোক তিনি সাইয়িদীর ওয়াজ খুব লাইক করেন। সকাল সকাল নিজের উইনম্যাক্স সেটে তা বাজিয়ে তিনি অনেকের পিত্তিতে জ্বালা ধরানোর সুখ পান।
হিরু তার জীবনে এক সপ্তাহ জেলে ছিলেন। আরেকজনের হয়ে মারপিট করার জন্য। জেলে তার অভিজ্ঞতা শোচনীয়। ফর্সা ছেলে হবার কারনে সে এবিউসড হয়েছে দু চার বার। তাতে তিনি অবসন্ন ছিলেন। যখন জানলেন জোর করে কেউ করলে গুনাহ হয় না, তখন তিনি মানসিক ভাবে খুশী হন। তার জীবনের সব চাইতে বড় এডভেঞ্চার ছিল যখন তিনি তার প্রিয় বন্ধুর স্ত্রীর সাথে প্রেমে মত্ত হন। ধরা পড়েন কিছুদিন পর। বন্ধু তাকে পিটিয়ে চেহারার নকশা বদলে দেয়। বন্ধুটি চালাক, বউ এর সাথে রিলেশনটা ছাপিয়ে সে দোষারোপ করে টাকা নিয়ে টাকা দেয় না। সবার প্রত্যাশা ছিল হিরু মার খেয়ে ভদ্র হবে, কিন্তু মার খেয়ে কেউ লাইনে আসে না। হিরুও আসে নাই। এরকম লোকের সাথে আমার পরিচয় থাকার কথা না? কিন্তু পরিচয় অনেক আগের চায়েরদোকান সুত্রে, সেই সুত্রেই জলে স্থলে রাস্তাঘাটে যখনই দেখা হয় তখনই তিনি জানতে চান আমি কেমন আছি? নিজের আপডেট জানান। কোনো অদ্ভুত কারনে নিজের সব কীর্তিকলাপ আমাকে জানান, আমি ভাবতাম সত্য অসত্যের মিশ্রন। পরে খোজ নিয়ে জেনেছি উনি আমাকে যা বলেন সত্য। অকপটভাবে তিনি বলে যান। আমি জানতে চাইতাম আমাকে কেন বলছেন? তিনি জানাতেন এমনিতেই। কারন চেনাজানা ছাড়া আপনার সাথে আমার আর কোনো পরিচয় নাই। নিজের কথা তো সবাই বলতে চায়। আমার কথাও জানতে চাইতো। আমি বলতাম না কিছুই। কি বলার আছে? তবে উনি আমার সাথে মিশতে মিশতে ধরে ফেলেছিল, কখন আবার সাংঘাতিক মুড অফ থাকে। তখন তিনি আর নিজের কথা বলতেন না। একজন মানুষ যেমন আরেকজনকে নিজের মতো করে, তিনিও মাপামাপি করে সাজেশন করতেন। শান্তভাই আপনি ডেইট মেইট করেন, সব হতাশা কেটে যাবে।সিরিয়াস মেজাজ খারাপ হয়ে আমি জানাতাম তার মতো লোকের কাছ থেকে আমি উপদেশ আশা করছি না। আমার রুঢ় আচরণেও তিনি ফ্যালফ্যাল করে হাসতেন।
হিরুর বাড়ী বাগেরহাটে। কথায় কথায় তিনি সুন্দরবনের কথা বলে ভালোবাসেন। তার সব চেয়ে ভালো লাগে আমার এটাই। লোকজন সাহিত্যিকদের বলে কথাশিল্পী। সত্যিকারের কথার যাদুকর তো এইসব নিম্নবিত্ত মানুষ। তবে হিরু জীব জন্তুর গল্প বলেন না। বলেন অভাবের কথা। এক বেলা খেয়ে থাকা জীবনের কথা কিংবা মেলায় কিছু কিনতে না পারার হতাশা কিংবা নিজেদের ঘেড়ের মাছ নিজেদেরই খেতে না পারার বেদনা। এইসব আমাকে স্পর্শ করে, মন চায় হিরুকে নিয়ে গল্প লিখি। কিন্তু আমি ভালো গল্প লিখতে পারি না। আনন্দের কথা বলে হিরু, দিনের পর দিন বাংলা সিনেমা দেখার স্মৃতি তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে তা জানায়। তার প্রিয় নায়ক মান্নার কোন ডায়লগ তাকে আলোড়িত করেছিল তার বর্ণনা দেয়। ড্রাইভিং জীবনে তার কোন বস পরকীয়া করতো, তার কোন ম্যাডাম বেশী এট্রাক্টীভ তার রগরগে ফিনিশিং টানে। ঐসব গল্প বলার সময় আমি তার চেহারায় দেখি সেরকম বস হবার তীব্র বাসনা। অনেক দিন হয় হিরুর সাথে দেখা হয় না, শনির আখড়া না কই থাকে। মাঝেমধ্যে আমি হিরুকে মিস করি। লোকটা যাতা লেভেলের হিপোক্রেট হোক কিছু গল্প তো শোনা যেত। আমার আর গল্প শোনা হয় না। কাইফি আজমীর এক দারুণ শায়রী আছে, যে ভবিষ্যৎ আমি দেখি নি তা ভেবে কি করবো, বর্তমানটাও চলে গেল, অতীত ছাড়া আমার চিন্তা করার সম্ভল কি? তাই আমিও বসে থাকি কোনো এক রাত্রে হিরুর সাথে দেখা হবে, আর আমাকে জিগ্যেস করবেন, কি নিয়ে এত ভাবেন? নারীর শরীরে ডুবেন সব ভাবনা চলে যাবে। আমি শুনে বলবো, এই সব আজাইরা ফিলোসফি আপনাকে কোন অসভ্য লোক শিখাইছে, তারে বলবেন আমার সাথে যোগাযোগ করতে?
চায়ের দোকান জিনিসটা ভাল - কত রকম চরিত্রের সাথে পরিচয় হয়। অবশ্য যদি দেখার চোখ থাকে আর কি
হ আপা। এখন কম বসা হয়, মিস করি দোজ ডেইজ!
মন্তব্য করুন