বিবিধ প্রসঙ্গ
ডিসেম্বর মাস আমার জন্য সব সময়ই বিরক্তকর। একটা বছর চলে গেল সিগনিফিকেন্স কিছুই করা হলো না এই জিনিসটা ভাবতে ভাবতে একটা মাস চলে যায় সাথে সাথে চলে যায় আরো একটা বছর। তবে আজ মন ভালো কারন অনেকদিন পর এক প্রিয়বন্ধুর সাথে অনেকক্ষণ কথা হলো। তার প্রায় ধ্বস হওয়া জীবন থেকে সে ঘুরে দাঁড়িয়েছে একা একাই। এতেই শেষ না, সে চাচ্ছে আরো এগিয়ে যেতে। এই যে মানুষের উদ্যম, ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা এইসব কথা শুনতে ভালো লাগে। মুটিভেশন স্পিকারদের মত না, নিজের মত নিজের। ফিরে এসে আমার বন্ধুটির যে উচ্ছাস, তা অসাধারণ। আমার দেখা হয় নাই। আমি একা একাই কল্পনা করেছি তার হাসোজ্জল মুখ খানা। আরেকটা মন ভালোর খবর ১০ তারিখ ছিল আমার আদরের ছোট ভাতিজি মৌনিয়া তার জন্মদিন। যদিও সে সেই দূর পরদেশে। তবুও মামনির কথা ভেবে মন ভালো রাখার চেষ্টা করেছি এই দু তিন দিন। আরেক ভালো খবর হলো, আবার ফেসবুক থেকে বিরতি নিয়েছি, এত সময় নষ্ট করে, তাই এই চেষ্টা। আশাকরি এবার আরো দেরীতে ফিরবো।
শুক্রবার দীপনপুরে এক অনুষ্ঠান চলছিল। আমি গিয়েছি আমার বন্ধুদের সাথে এমনিতেই ঘুরতে, তাও আমার যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না কারন গায়ে জ্বর। আবার এমন আড্ডা ছুটির দিন মিস করাও কেমন, তাই যাওয়া। তো যাই হোক, সেখানে সেই অনুষ্ঠানে এক বক্তা বলছে, হাজার বছরের বাঙ্গালী কালচারে নাকি খুনাখুনি ছিল না, এসব নাকি নতুন যুগের আমদানী। এরকম রাবিশ টক শুনে বিরক্ত। বাঙ্গালী পৃথিবীর সব চাইতে সভ্য জাতি, এখন গ্লোবালাইজেশনের কারনে নাকি এইসবের সুত্রপাত, এই কথাটা বলাই এদের মেইন এজেন্ডা। এইসব এজেন্ডাবাজদের থেকে দূরে থাকাই ভালো। প্রথম কথা, গোটা দুনিয়াটাই এমন। রক্তপাত যুদ্ধ হানাহানি আন্দোলন সংগ্রামের ভেতর দিয়েই একটা সভ্যজাতির জন্ম হয়। তাও একদিনে না তা, হাজার হাজার মাসের পর। এখানে কেউই তুলসীপাতার মত পবিত্র নয়। আর হুট করেই কোনো গিভেন ডেতে সমস্যার শুরু হয় না। প্রতিটা নতুন সমস্যা অতীতের সমস্যা আর অবহেলারই অন্যরকম রূপ। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল একুশে টিভির এক বড় সাংবাদিক। তার ভক্ত মুরীদরা সেলফি খিচতে খিচতে বইয়ের দোকানকে পুরো শপিং মল বানিয়ে ছাড়লো। তখন আমার মনে হলো, দাও ফিরিয়ে আমার সাধারণ বইয়ের দোকান, নাও এই রেস্টুরেন্ট কাম বইয়ের জলসাঘর। এখন বইয়ের দোকান থেকে ফিরে এলে লোকজন জিগ্যেস করে কফি কেমন ছিল? তবে এই শহরে বই না পড়ে যারা বই বই ফিলিং নিয়ে ছবি তুলে আড্ডাবাজি হ্যাংআউট করতে যায়, তাদের জন্য এইসব জায়গা দারুণ।
তারুণ্যের মেধা আমাকে মুগ্ধ করে। আমার বন্ধুর জুনিয়র কলিগ যে চমৎকার আবৃত্তি করেছে হাটতে হাটতে, চা খেতে খেতে খেতে, জ্যামে বসে থাকার সময়, আমি খালি চেয়ে ছিলাম। হুমায়ুন আজাদ থেকে শুরু করে সলিল- রবি ঠাকুর- শক্তি কত কবিতা বলে গেল। আমি ভাবছিলাম আর কি চাই জীবনে। কবিতার এই অনুভূতির স্পোন্টেনিয়াস বিস্ফোরন আমাকে অবাক করে বারবার। আগে এইসব কবিতার আবৃত্তির খুব সুদিন ছিল। আমরা আজিজ থেকে ক্যাসেট কিনতাম। টিএসসিতে টেবিল নিয়ে বসে থাকতো লোকজন, সবাইকে প্রমিত বাংলার মাষ্টার বানাবে। আমিও গিয়েছিলাম শিখতে, কিন্তু প্রশিক্ষকদের সুন্দরী তরুণীদের নাম্বারের প্রতি বেশী উদ্দীপনা আর রোজার দিনে সকাল সকাল যাওয়া হতো না বলে করা হলো না। এখন মনে হয় করলেই পারতাম। অন্তত দু একজন বন্ধুকে কবিতা শুনানো যেত। তবে টিএসসিও এখন গজব। ওখানে বসা যাবে না, ওখানে যাওয়া যাবে না, সন্ধ্যার পর এই এই জায়গায় থাকা যাবে না কত নিয়মকানুন। ভাগ্য ভালো আমি টিএসসিতে আড্ডা মারতে যাই না আর। এদের চেয়ে বারেক সাহেব ভালো। রাত তিনটা অবধি দোকান খোলা রাখে। চা ভালো না হলে মুখের উপর বলা যায়, চা বানাইছেন নাকি গরম পানির মধ্যে চিনি দুধ চামচ দিয়ে নাড়ছেন? সত্যজিতের এক বই পড়ছিলাম পুরোনো। তিনি সাময়িকী ম্যাগাজিন পত্রিকার সমালোচনাকে খুবই সিরিআসলি নিতেন। যুক্তি কষে বুঝাতেন, সমালোচকের গলদ কোথায়। আমি ভাবছিলাম তিনি কত সময় অপচয় করেছেন। কারন কাজ গুলোই আসলে থেকে যায় ও যাবে।
বাংলা সিনেমার সুদিন চলছে, সবাই দলবেঁধে সিনেমা দেখতে যায়। আমার যাওয়া হয় না। আমার বন্ধু মাশুক চিটাগাংয়ের এক হলে 'হালদা' দেখছিলো। দর্শকদের আগ্রহপূর্ণ গালিগালাজে সে বিরক্ত হয়ে এসে পড়ছে। আর 'আলমাস; হল নাকি ঘোলা, স্ক্রীন বাকা আর অন্ধকার তাতে তার আরো হতাশা। আমি ভাবছিলাম সবকিছুই কেন ঢাকাতে, কেন অনান্য বিভাগীয় শহরে ভালো সিনেপ্লেক্স হবে না। তবে এইসব বারোয়ারি আর্ট কালচার নিয়ে ভাবনা অযথাই। কারন নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মানুষদের ফেরার আশায় বসে থাকা স্বজনদের চেয়ে বড় দুশ্চিন্তায় আর কেইবা আছে? এই যেমন সাংবাদিক উৎপল, ছেলেটার মুখ দেখলেই ভাবি আমার বন্ধুর মুখ। ছেলেটা দুমাস ধরে নেই কোথাও। তার নিয়োগকর্তারাও সরকারের কাছের মানুষই, চেষ্টা করছে পাচ্ছে না। এত বড় স্তাবকেরাও যেখানে নিরুপায়, সেখানে আমাদের উপায় কি? আবার বছর বছর ঘুরে মানবাধিকার দিবস আসে, চলে যায়। ভারতের এক সাংবাদিকের সাক্ষাৎকার পড়ছিলাম, তিনি বলছিলেন ৪৩ বছরের ক্যারিয়ারে তাঁর অনেক কাছের লোকজন ক্ষমতায় ছিল, তাও তিনি সব সরকারের ব্যাপারে কখনো নমনীয় হন নি, ভালো সাংবাদিকের কাজ সিস্টেমের ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠান তার সমালোচনা অব্যহত রাখা। হাসতে হাসতে বলছিলেন, ইন্দিরাগান্ধীর ইমারজেন্সি আমলের মতোই এখন দেশের অবস্থা, খালি নতুন করে ধর্ম বড় হয়ে আসছে। ভাগ্যিস উনি বাংলাদেশে জন্মান নি, হয় গুম হতেন, নয় বিশাল পদ পদবী পেতেন নয়তো প্রাইভেট ভার্সিটি খুলে ইংলিশ কপচাতেন। এখানে কথা বলতে পারা বিদেশী রোবটের অনেক দাম, কিন্তু সত্য কথা বলা মানুষের ঠাই নাই।
ফেসবুক বন্ধ থাকুক - বিবিধ প্রসঙ্গ চালু থাকুক
ব্লগ চালু থাকবে। খেলা থুক্কু লেখা চলবেই!
মন্তব্য করুন