ইউজার লগইন

এমনও তো প্রেম হয়!

খুব সকালে সিএনজি পাওয়াই যায়। তবে সেটা আপনার মন মতো হবে কিনা বলা মুশকিল। তবে আরেকটু পর সেটা পাওয়ার সম্ভাবনা আরও কম। মানিক খুঁজছে সিএনজি, তার চোখে রাজ্যের ঘুম। ঘুম চোখে থাকলেও সে পরিপাটি। মাথায় মুখে পানি দেয়া রং জ্বলে যাওয়া টিআইবির টি-শার্ট এর সাথে সাথে একটা নতুন ট্রাউজার। অপরিপক্ক ড্রাইভার তাকেই 'স্যার' ডেকে বসতে পারে। কিন্তু যাদের জীবন স্যার ডেকে ডেকে চলে যায় তাদের স্যার শুনতে খারাপ লাগে না। কিন্তু পরিপক্ক চালকরা বুঝে যায়। এই বোঝা না বোঝার ভেতরেই, মানিক ভোরের সকালকে মাথায় রেখে মৃদুস্বরে বলে, মামা যাবেন মিরপুর ১৩? বিআরটিএর সাথে? সিএনজি চালক দাত খোঁচাচ্ছিল। সকাল সকাল এদের দাতে কোন হীরে-জহরত লুকিয়ে থাকে, তাই ভাবে মানিক। সেই গুপ্তধনের সন্ধানে থাকা চালক চায় সাড়ে তিনশো। সে জানায় আড়াইশো। রাজী হয় না।
মানিক আরো সিএঞ্জির অন্বেষণে আরেকটু সামনে যায়। একটা চায়ের দোকানে এক মুসুল্লী টাইপের চেহারার সিএনজি চালক। গায়ে নেভী ব্লু কালারের পাঞ্জাবী। এটা কি বানানো নাকি সিএনজি চালকদের জন্য কোথাও কিনতে পাওয়া যায়। তাকেও সেইম প্রশ্ন, যাবেন? সেই ভদ্রলোক খাচ্ছিলেন চা তক্তা টোস্ট বিস্কুট দিয়ে। দাতে আটকে থাকা বিস্কুট আঙ্গুল দিয়ে টেনে বের করতে করতে বলে, চারশো টাকা। মানিক এই খবিশ ভদ্রলোকের সাথে দামাদামীর উৎসাহ পায়না। আরেকটা সিএনজি চালক তখন মোবাইলে আজাহারীর ওয়াজ শুনতেছিল, মায়ের সম্মান নিয়ে। সেই জিগ্যেসটা করে, আপনি কত-তে যাবেন? লোকজন তো ভাড়া চাইবেই। তখন মানিক এরকম প্রশ্নে খুশী হয়ে বলে, আড়াইশো দুইশ সত্তর। সিএনজি চালক জিগ্যেস করে কোথা থেকে পিক করতে হবে। ঐ রাস্তার ভেতর থেকে। ভেতরে যাবো, বাড়ীওয়ালাদের ২০-৩০ টাকা বাঁচানোর জন্য আপনারা এত উদ্গ্রীব কেন? বলবেন তিনশোর নীচে যায় না। মানিক সত্য প্রকাশের বিরক্তিতে বলে, না ২৭০ হলে চলেন। এত কথা শুনবো না সকাল সকাল। সিএনজি চালক চায়ের দোকানে বিল দিয়ে উঠে বসে গাড়ীতে। মানিকও বসে পেছনে।
বাড়ীর সামনে এসে দেখে মানিকের স্যার রেডি। বাচ্চাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অফ হোয়াইট শার্ট গোসল করা মুখে মানিয়েছে বেশ। বাচ্চাও ঘুম ঘুম চোখে রেডি। মানিক ভাবে স্যারের এত টাকা, তাও একটা গাড়ী কিনে না। গাড়ী কিনলে সকালে তার এই জ্বালাটা নিতে হতো না। স্যার দেরী না করে চলে যায়। মানিক ফিরে তার স্টোররুমের মত একটা ঘরে। যেখানে খাট আর একটা চেয়ার ছাড়া কিছুই নাই। এই কেয়ারটেকারের চাকরী সে করছো করোনা আসার এক বছর আগে থেকে। করোনার সময় মনে হয়েছিল এই চাকরী সে মহামারী শেষেই সে ছেড়ে দিবে। কিন্তু ক্রমশো সে এই চাকরীর যে উদাসীনতা তার মোহে পড়ছে। দারোয়ান আছে একজন বৃদ্ধ মানুষ। সেই খাটে, সব কিছু করে। মানিক খালি বাজার করে, মাঝেমধ্যে বাচ্চাকে স্কুলে নেয় আর বিল টিল দেয়। ম্যাডামের সাথে কোথাও যেতে হলে যায়। মাস গেলে ১২ হাজার টাকা বেতন সাথে খাবার। এখন এসব চাকরী তেমন পাওয়াই যায় না। স্যারের পুরোনো জামাকাপড় থেকে শুরু করে মোবাইল সেট সবই মানিক পায়। সিগারেট চা খায় না। মাস গেলে আট দশ হাজার টাকা বাড়ীতেই পাঠানো যায়। আর বাড়ী যাবার নাম নিলে ছুটি বেশি না পাওয়া গেলেও টাকা দিয়ে দেয়। দুই ঈদে সে বাড়ী যেতে পারে নাই কারন স্যার ম্যাডাম বাড়ী গেছে, বাড়ি দেখবে কে? মানিক ছাড়া এত ভদ্র ও শান্ত লোক কই?

ম্যাডাম তাকে খুব পছন্দ করে। সবসময় ম্যাডাম ডাকলেও বাসায় স্যার না থাকলে সে ডাকে, আপা। যদিও একটা সময় আপাও ডাকতে হতো না। ডাকতো নীলুফার বলে। রিলেশনে তারা খালাতো ভাইবোন ও সমবয়সী। ছোটবেলা থেকেই এক সাথে বড় হয়েছে। নীলুফারকে পছন্দ করতো মানিক, কিন্তু মানুষ কি বলবে আর জেলা শহর বলে কেউই আর কিছু বলে নাই। কিশোরবেলায় নীলুফারের চাহনীতে মনে হতো মানিককে সে পছন্দ করে। আবার ভালো রেজাল্ট করা কিংবা নীলুফারের বাবা বাড়িতে আসলে মনে হতো, কই মানিক কই নীলুফার। এসএসসিতে গোল্ডেন পাওয়ার আগ পর্যন্ত দুজনের একটা ভালো বন্ধুত্ব ছিল। নীলুফারের সব কথা মানিক জানতো। কলেজে সে চলে ঢাকায়, মানিক পরে রইলো। শহরে থেকে নীলুফার হয়ে গেল নীলা। মানিক মানিকই থাকলো। ইন্টারে এ মাইনাস পেয়ে মানিক বিদেশ যাওয়ার ট্রাই করলো। আর নীলুফার ইয়াসমীন নীলা ভর্তি হলো এক প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে। অনার্স শেষ হবার আগেই নীলুফারের বিয়ে এক কাষ্ট্মসের অফিসারের সাথে। আর মানিক বাড়ীর টাকা নষ্ট করে প্রতারিত হয়ে বিদেশ থেকে ফিরলো। কিছুদিন সে কোরিয়ান ভাষা শেখার চেষ্টা করলো। কিন্তু লটারীতে নাম আসে না বারবার। ২০১৯ সালে নাম এসেছিল কিন্তু সময় কম পাওয়ার কারণে পাশ করতে পারে নাই টেস্টে। এখনও তার বাসায় বই বলতে কোরিয়ান ভাষার শিক্ষার মডিউল। সে পড়ে না। যেমন সে পড়ে না খবরের কাগজ। পেপার দেখলে তার মনে পড়ে, দুই আড়াই কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে মহসীন ভাইয়ের দোকানে যাবার স্মৃতি। মহসীন ভাই মারা গেছে রোড এক্সিডেন্টে করোনার আগেই। বাড়িতে গেলে সে মহসীন ভাইয়ের ছেলের জন্য কিছু নিয়ে যায়। পেপার দেখলেই তার মহসীন ভাইয়ের চিরুনীটার কথা মনে পড়ে। একটা চিরুনী সবসময় থাকতোই তার কাছে, দেখার মতো করে চুল আঁচড়াত। কেউ মানিকের আগামীর পরিকল্পনা নিয়ে জিগ্যেস করলে খালি বলে চেষ্টা করতেছে, কোরিয়ার জন্য। নীলুফারের আত্মীয় হিসাবে এই আরামের চাকরীটাই তার আছে আর আছে দুই জিবি র‍্যামের স্যারের ব্যবহার করা পুরোনো সেট। তাতেই লক করা তার আগের নাম্বার দিয়ে, যে নাম্বারে নীলুফার মাঝেমধ্যে ফোন দিয়ে জানতে চাইতো, 'মানুষ এত বেইমান কেবা করে হয়?' একটা কল দিতে কি খুব কষ্ট। সে অনেক অনেক দিন আগের কথা, তখন নীলুফারের শব্দভান্ডারে এসব ছিল। এখন বাড়ীর ফ্রি ওয়াইফাইতে সে দেখে নীলুফারের পোষ্ট, গত মাসের ছবি আবার আপলোড দিলো। কাষ্মীর ছিলো তারা। লেখা, সেলিব্রেটিং টুগেদারনেস।

পোস্টটি ৩ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

বিষণ্ণ বাউন্ডুলে's picture


ভাল্লাগছে গল্প। অবশ্য তোমার গল্প ভালো না হওয়ার আসলে কোন কারন নাই, তুমি অনেক আগে থেকেই গল্প লেখার জন্য রেডি।

আরাফাত শান্ত's picture


কি সুন্দর কমেন্ট। ধন্যবাদ বর্ণ!

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

আরাফাত শান্ত's picture

নিজের সম্পর্কে

দুই কলমের বিদ্যা লইয়া শরীরে আমার গরম নাই!