সুন্দরবন ভ্রমন ২০১৩ (পর্ব ১)
ভোরের আলো না ফোঁটা মেঘবিহীন বৈশিষ্ট্যহীন আকাশ, শীতের আবছা কুয়াশার চাদর কেটে ট্রলার নীলচে-সবুজ পানির উপর দিয়ে ধীরগতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল, দু’ধার জুড়ে গোলপাতাসহ নাম না জানা হরেক গাছের সারি ঘন থেকে আরো ঘন হতে হতেই সামনের দূরে এগিয়ে আসা বাঁকটা যেন হারিয়ে যাওয়া কাউকে যেন তীর খুজেঁ পাবার আশায় উদ্বেল হবার হাতছানি দিয়ে যায়! টলটলে পানি, নির্মল বাতাস, গাছেরসারি, থমকে যাওয়া একঘেয়ে আকাশ, সবকিছুর মাঝ দিয়ে চলছি আমরা সমান তালে সাথে যাচ্ছে কেবল থোক থোক কুয়াশার দল! চারপাশে পাখি ডাকারও শব্দটি নেই, অভিযাত্রীদের কেবল শ্বাসের শব্দে উপস্থিতি জানান দিয়ে যায় সুন্দরবনের এই অপার সৌন্দর্যতার।
অপরুপ এই দৃশ্যটি ছিল, সুন্দরবন ভ্রমনের প্রথম প্রহরের। কোন ছবিতেই এই ভ্রমনে দেখা সৌন্দর্য্য তুলে আনা যাবে না, সে কেবলি উপভোগের একান্ত অনুভূতি।
সুন্দরবন, বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন। প্রকৃতি তার জীব-বৈচিত্রের অপার সৌন্দর্য্য ধারন করে আছে এখানে। কালের বিবর্তনে যতটুকুন টিকে রয়েছিলো, আমাদের অবহেলা নিগৃহের স্বীকার হয়ে সেসব এখন বিলুপ্ত প্রায়। এর মাঝেও রামপালে বিদুৎকেন্দ্র স্থাপন করার উন্মত্ত নেশায়, এই সুন্দরবনকে বিলীন করার আত্নঘাতী গোয়ার্তুমিতে মেতেছি! হরহামেশাই ভাবি, কূল পাই না ভেবে যে, সরকারের উর্ধ্বতন মহলে যারা পৌছায়ঁ কান্ডজ্ঞান বিবর্জিত হওয়াই কি তাদের যোগ্যতার চাবিকাঠি কিনা!
ভ্রমনের সুযোগ এলেও তাতে মেতে উঠা হয় না আমার নানান কারনেই। তাই ভ্রমনকাহিনী’র লেখকের সাজানো কথার মুক্তো জমিয়েই আমার মেতে থাকা। ফেসবুকভিত্তিক গ্রুপ ঘোরাঘুরি ডট কমে সংযুক্ত থাকা মানুষরা একে অন্যকে তথ্যউপাত্ত দিয়ে সাহায্য করে মাঝেমধ্যেই ইভেন্টের আয়োজন করে আগ্রহী অভিযাত্রীদের নিয়ে বেরিয়ে পড়েন দেশের আনাচেকানাচে। ‘গো বাংলাদেশ’ এর আয়োজনে সৌভাগ্য হলো সুন্দরবন ঘুরে আসার।
২০১৩, তুমুল উত্তেজনার, অবিস্মরণীয় জাগরণের বছর। সেই ফেব্রুয়ারী থেকে শুরু হওয়া আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ের সমাপ্তির দিন ছিলো ১২ ডিসেম্বর। কাদের মোল্লার ফাঁসির দিন। প্রায় দু’মাস আগে থেকে এই দিনটি ঠিক করা ছিলো আমাদের সুন্দরবন ভ্রমনের শুরুর দিন। এন্ট্রি ফি জমা দিয়ে নাম রেজিস্ট্রি করার ডাক দেবার তিন/চারদিনের মাঝেই ৪০জনের গ্রুপ দাড়িঁয়ে গেলো। যদিও দেশের এই সহিংসতাপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির মাঝে শেষমুহুর্তে এসে কেউ কেউ নাম প্রত্যাহার করে নেন! মোটেও দোষ দেয়া যায় না তাদের, হাজার হোক, সেইফটি কামস ফার্স্ট!!
আয়োজকরা সম্পূর্ন সতর্কতার ব্যবস্থা করেছিলেন। কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হবার সঙ্গে সঙ্গে তাদের জাতভাইরা অরাজকতা করবে এই আশঙ্কা সবার মনেই ছিলো, তাই যাত্রাসূচি কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়। ১২তারিখ রাত ১০টার পরিবর্তে আমরা ১৩তারিখ ভোর ৬টায় ঢাকা থেকে আরিচার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি।
যতই ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছি কুয়াশার চাদর বাড়তে বাড়তে রীতিমতো কম্বলে রুপান্তরিত হতে লাগলো। গড়পড়তা শীতের সকাল, আহামরি কিছুই নয়, তবে সাতসকালে খোলা রাস্তায় চললে আপনাতেই মন ভাললাগায় ভরে যায়। আগের রাতের ঘটনার ঘনঘটায় ফাঁকা রাস্তা বিধায় অনেক অল্প সময়ে পাটুরিয়া ফেরিঘাটে পৌছেঁ যাই। ফেরিঘাটের চারপাশ সম্পূর্ন খাঁ খাঁ, যা সবাইকেই অবাক করেছে, ফেরিতে প্রথম বাসই আমাদেরটা। কিছুক্ষন অপেক্ষাতেই ফেরি ছেড়ে দিয়ে ওপারে চলে এলাম আমরা মাত্র ৩৫মিনিটেই। বন্ধুদের সাথে কোথাও ভ্রমনের মতোন আমার ফেরি চড়ার অভিজ্ঞতাও এই প্রথম, তাই কিছুটা অবাকই হলাম এতো অল্পসময় ফেরিতে থেকে। শোনা কথায় জানতাম যে, নিদেনপক্ষে ঘন্টাতো লাগেই ফেরি পার হতে!
বেলা বাড়ছে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাসের গতি ততোধিক বাড়ছে সবার খিদে। ৫।৩০ টায় বাসস্ট্যান্ডে সবার উপস্থিত হবার কথা ছিল, তাই এলার্মের শব্দে উঠে কেবল নামাজ পড়েই দে ছুট। তাই মুখে কিছু গোঁজার সময় হয়ে উঠেনি, আর রাস্তাতেই খাবার পাবো এই আশায় ছিলাম। কিন্তু আমাদের অবাক হবার মাত্রা যেন বাড়ছেই, যতই রাস্তার কোথাও হোটেল দেখে থামছি, কোথাও এতোজনের পরিমানে খাবার নেই! নেই তো নেই! কোন কোন হোটেলেতো একেবারেই খাবার নেই!
পাশের সিটের ছোট্টমেয়েটা মোশন সিকনেসের দরুন ক্রমাগত প্লাস্টিকের ব্যাগে বমি করে চলছে, বাবা পাশে বসে আছে। অন্যসময় এমনি দেখলে হয়তো আমার নিজেরি গা গুলিয়ে বমি আসতো, কিন্তু, নিজের উপর বেশ খুশি হয়েছি এই দেখে যে আজ একটুও এমন লাগেনি, উলটো মেয়েটার কষ্ট দেখে খারাপ লাগছিল অনেক, বাবাকে বললাম যে “ওর ঘাড়ে পানি দিন ভাইয়া, আরাম পাবে”। মেয়েকে পানি দেয়া তো দূর আমার দিকে ফিরেও তাকায়নি ভদ্রলোক!!
দ্বারে দ্বারে মানে হোটেলে হোটেলে ঘুরে ঘুরে বেলা প্রায় ১১টায় মাগুরার ঢাকা রোডের এক হোটেলের খাবারে চা-নাস্তার দেখা মিললো। নাস্তা সেরে উঠতেই ট্যুর অপারেটরদের একজন আমাদের সাথে বাসে করে এসেছিলেন পথ চিনিয়ে নিতে, নাস্তা সেরে উঠতেই উনি সবাইকে দাবড়িয়ে নিয়ে বাসে তুলে নিয়ে আবার দে ছুট!
খেয়েদেয়ে সেই যে মাগুরা পার করে যশোর পৌছঁলাম, কিন্তু যশোরের পথ যেন আর ফুরায়ই না। এটা দেখি ওটা দেখি সবই ধূলোয় ধূলাময়। খেয়াল করলাম যতই মাগুরাতে পৌছেঁছি রাস্তাতে যানবাহনের ভিড় বাড়ছেই। ঢাকা শহর থেকে যতই দূরে যাচ্ছি কর্মচাঞ্চল্য যেন বেশি দেখতে পাচ্ছি! ট্রাকের সারির সাথে পাল্লা দিয়ে ধূলোর আচ্ছাদন ভেদ করে এগিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু যশোর যে আর ফুরায় নাহ! ৩।৩০ এ খুলনা লঞ্চঘাটে পৌছেঁ গেলাম, ভেবেছিলাম বাস থেকে নেমে ড্রাইভারকে একটা ধন্যবাদ জানাবো যথেষ্ট দায়িত্বশীল ভাবে বাস চালানোর জন্যে, চালনায় গতি ছিল অনেক কিন্তু আতংকিত হতে হয়নি একবারো। কিন্তু ঘাটে পৌছেঁ বাস থেকে নিজনিজ ব্যাগ নামানোর হুড়োহুড়িতে ধন্যবাদটা আর জানানোই হয়ে উঠেনি।
লঞ্চঘাট থেকে ট্রলারে করে যখন লঞ্চটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম বেশ দারুন লাগছিলো দূর থেকে ঝকঝকে লঞ্চটা দেখেই। স্বাগত জানানোর জন্যে স্টাফদের সবাই অপেক্ষায় ছিলেন। সম্পূর্ন ট্যুরটায় এই মানুষগুলোর আথিতেয়তায় অভিভূত হয়েছি বারেবার। বিরক্তির ছোয়াঁটুকু দেখিনি উনাদের হাসিমুখ ছাড়া, নিজনিজ দায়িত্বে থেকেছেন আবার হাসিঠাট্টায় আমাদের সাথেও মিশে গেছেন। আমাদের পর্যটনের সাথে থাকা মানুষগুলোর এমনিতর ব্যাবহার সব জায়গায় বজায় রইলে উন্নতি অবশ্যম্ভাবী।
অসাধারন লিখা
"এর মাঝেও রামপালে বিদুৎকেন্দ্র স্থাপন করার উন্মত্ত নেশায়, এই সুন্দরবনকে বিলীন করার আত্নঘাতী গোয়ার্তুমিতে মেতেছি"
সরকার কে মাইনাস ১০
ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্যে
আনন্দময় এক সফর দিছেন!
ঝকঝকে সুন্দর ভ্রমনকাহিনী, মনোমুগ্ধকর ছবি। এমন লেখা পড়ে পুরো সময়টা অনুভব করা যায় ।
আরে থ্যাঙ্কু দারুন মন্তব্যের জন্যে।
এতো করে বললাম সাথে চলো, আরো ভাল লাগতো
ঝরঝরে ভ্রমন কাহিনী

প্রথম ছবিটা দেখে মুগ্ধ !!
এই জায়গাটার ছবি অন্যান্যরা এতো সুন্দর তুলেছেন যে অবাক হয়ে যেতে হয়, কিন্তু তাও এই মুহুর্তটার সৌন্দর্য্য কোন ক্যামেরায় বন্দি সম্ভব নয়।
ঝকঝকে সুন্দর ভ্রমনকাহিনী, মনোমুগ্ধকর ছবি। এমন লেখা পড়ে পুরো সময়টা অনুভব করা যায় ।
পড়িয়া মন্তব্য করার কষ্টের জন্যে ধইন্যবাদ

আর মাইকে ধন্যবাদ এত্তো দারুন একটা ট্যুরের আয়োজন করেছেন বলে। একটা ব্যাপক কর্ম সাধন করছেন সুচারুভাবে
খুব সুন্দর, লেখাটা পড়ে ভ্রমণের প্রতিটা মুহূর্ত চোখের সমনে ভাসছে
প্রতিটা লাইন যেন এক একটা ছবি,খুব ভাল লেগেছে। পরবর্তি পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
আররে তুহিনভাই!!
ধন্যবাদ,
আসলে আমরা সবাই এত্তো ভাল ছিলাম বলেই না দারুন একটা ট্রিপ হতে পারছে, তাই মনেও আছে ভাল মতো।
তারপরও আপনার লেখাটা এত সহজ আর সরল ভাবে উপষ্থাপিত হয়েছে ভাল না লেগে উপায় নেই ।
ভাল লাগছে তোমাদের ভাল লাগা দেখে।
অনেকগুলা দিন পরে আপনার লেখা পড়লাম। দুর্দান্ত লেখা। কেন যে আরেকটু বেশি বেশি লেখেন না!
পড়ার জন্যে ধন্যবাদ মীর, আপনার কমেন্ট পেতে ভালই লাগে
আসলেই আলসে হয়ে গেছি, কিচ্ছুই করা হয়ে উঠছে না, এটাতো রাসেলের উস্কানিতে আর পরে কামালভাইয়ের দাবড়ানিতে লিখতে বসা, তবে ভাল লাগছে লিখতে।
প্রথম ছবিটা অসাধারন।
পরের পর্ব দেন তাড়াতাড়ি।
বর্ণ, তোমার না এখন ফ্রি টাইম, তাহলেও কম কম কেন দেখা যায়? ছবি কিন্তু তেমন তোলাই হয়নি, গড়পড়তা কমই তুলেছি, দেখার ভাবে, আবার না পারার ভয়ে।
২য়পর্ব দিয়ে দিসি
থ্যাঙ্কুস!
বাসায় নেট নাই। টাচসেট থিকা টাইপ করা সিরাম পেইন লাগে, তাই।
চুপচাপ দেখে গেলাম
কমেন্টে যে জানান দিছেন তাও কি কম নাই!!

উদ্রাজি'ভাইকে সব্বার মনে জাগ্রত করে রাখবে যুগে যুগে এইরকমের কিছু বানী!
মাথায় একরাশ না পড়ে লাইক দেয়ার অপবাদ নিয়ে অনেক আগেই পড়েছিলাম। আজকে জানিয়ে গেলাম
আমি মিছে কথা কই না, সেদিন সত্যই না পড়িয়া লাইক দিয়েছিলেন জনাব!

ধন্যবাদ পড়ছেন এবং তা জানান দিয়েছেন বিধায়
ছবি কম হইসে কিনতু লেখা ভাল হইসে
এইটুকুন লেখাতে দুইখানা ছবি দিলাম তাও বলেন কম!!

কমেন্টের জন্যে থ্যাঙ্কু, পড়ে জানান দিছেন ভাল লাগছে
প্রথম ছবিটা অদ্ভূত মন কারা, আর পোস্ট নিয়ে কিছু লিখলাম না। সবাই সব বলে দিয়েছে মন্তব্যে
মন্তব্য করুন