টুকটুক গল্প - ১
একা থাকলেই ভাবতে থাকি, আকাশ-পাতাল ভাবনা, পুরোনো দিনের কথা, নতুন কোন স্বপ্ন নিয়ে। নির্জনতা, একাকীত্বে ডুবে যাওয়া বোধ হয় সেই ছোটবেলা থেকেই , ভাই-বোন ছাড়া একা বড় হওয়া থেকে হতে পারে। অনেক হৈ চৈ , আড্ডায়ও হঠাৎ নিজের ভাবনার ভেতর ঢুকে যাই শামুকের মতো।
কাল লিজার পোষ্ট পড়তে পড়তে হারিয়ে যাওয়া মানুষদের খুব মনে পড়তে থাকে। প্রথমেই কেন জানি না মনে পড়লো চন্দনের কথা। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী। কোঁকরা, ঘাড় পর্যন্ত নামানো চুল, জিন্স-টি শার্ট পড়ে মাথায় হেলমেট দিয়ে বাইকে করে আসতো । চুপচাপ তবে শান্ত না, কেমন একটা অস্থির, কঠিন, চাপা স্বভাবের ছেলেটা। আমরা যখন হৈ হুল্লুর করতাম, সে নিজের মনে সিগারেট খেতো আর মাঝে মাঝে হাসতো। আমরা যখন ঘুরে বেড়াতাম, সে চলে যেতো --- কোথায় যেতো কে জানে! একদিন দেখি সে নিজের মনে তার খাতায় কবিতা লিখছে, তাকে জোরাজুরি করে জানলাম সে কবিতা লিখে। তারপর থেকে ভালোই একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক হলো আমাদের সাথে, আমার সাথে। মাঝে মাঝে কবিতার খাতা পড়তে দিতো। হঠাৎ একদিন সে আর ক্লাসে আসলো না, এরকম করে অনেকদিন আসলো না। খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করেও তার কোন খোঁজ পাওয়া গেলো না।অনেকদিন পর একদিন নাকি সাবিরের সাথে দেখা হলো কল্যাণপুরে, বলেছে কিছু সমস্যায় আছে, পরে জানাবে। তারপর আর কোনদিন চন্দনের সাথে আমাদের দেখা হয়নি।পরীক্ষার সময়ে আমার সামনের সীটটা খালি থেকেছে এক সেমিষ্টার পর্যন্ত। ওকে আমরা সবাই মিস করতাম। মাঝে মাঝেই মনে হতো ছেলেটা কোথায় হারালো, কি এমন জটিলতা তাকে সরিয়ে নিলো লেখাপড়া থেকে, বন্ধুদের কাছ থেকে। গতকালের মত এমন অনেকদিনই আমার মনে হয়েছে চন্দনের সাথে কোন একদিন আর দেখা কেন হলো না? এমন করেই খুব প্রিয় না হলেও ভালোলাগার কেউ দৃষ্টির সীমানার বাইরে চলে যায়।
ক্লাস এইটে উঠার পর আমার স্কুলেরই একজন প্রাক্তন ইংরেজী শিক্ষকের বাড়ি গিয়ে ইংরেজী পড়তাম। আমাদের বাড়ির কাছেই উনাদের বাড়ি এবং পারিবারিকভাবেই খুব পরিচিত। কিছুদিন পড়ার পরে স্যার মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতেই এসেই পড়িয়ে যেতেন। আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে বাজারে যেতে হয়, তখন যাওয়া অথবা ফেরার পথে আমাদের বাড়ি আসতেন। বয়স্ক এবং শ্রদ্ধাভাজন একজন হিসেবেই আম্মা স্যারকে অনেক শ্রদ্ধা করতেন। স্যার যে আমাকে অনেক বেশীই আদর করতেন সেটা বুঝতাম তবে একটা রাগী ভাব থাকতো সবসময়, তাই ভয়ও পেতাম খুব। আম, নাড়ু, আচার খাওয়ার জন্য আমাকে প্রায়ই স্যারের বাড়ি যেতে বলতেন।উনার ছেলেমেয়েরা সবাই বয়সে আমার থেকে অনেক বড়, সবাই জানতো আমি স্যারের এক প্রিয় ছাত্রী। এত যে যত্ন করে পড়াতেন, আমার বাবা-মা সেই ছোটবেলায়ও একটা যত্ন করে আমাকে পড়িয়েছেন বলে মনে হয় না। আমি যখন এসএসসি পাশ করে কলেজে ভর্তি হলাম, দূরে চলে এলাম স্যার প্রায়ই বাজারে আসা / যাওয়ার পথে আম্মার কাছে আমার খোঁজ নিতে যেতেন। আমিও বাড়ি গেলেই পরদিন সকালে কবির স্যারের বাড়ি যেতাম দেখা করতে। এভাবে চলতেই থাকলো। লেখাপড়ার একটা পর্যায় শেষ করে চাকরীতে ঢুকলাম তবু এই নিয়ম বদলায়নি। তারপর বছর তিনেক আগে থেকে কেমন নিজের ভেতর গুটিয়ে গেলাম হঠাৎ।সবকিছু থেকে দূরে থাকা আমার। তেমন কোথাও, কারো কাছেই যাই না। কিছু কমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে, জবাব দিতে আমার একেবারেই ইচ্ছে করতো না। দুই বছর আগে স্যার খুব অসুস্থ হলেন, মাঝে মাঝে নাকি আমার কথা বলতেন। আম্মা জানালো আমাকে। যাবো ভেবে মন ঠিক করলাম কিন্তু আমি সামনে যাওয়ার আগেই তিনি চলে গেলেন। এক প্রচন্ড অপরাধবোধ আমাকে দংশন করে।এমন এক শুভাকাঙখী, আদর-স্নেহেরে এমন আশ্রয় আর কখনো ফিরে আসবে না জীবনে।
খুব প্রিয় মানুষেদের অনেকেই জীবন থেকে, পৃথিবী থেকে চলে গেছেন এক এক করে। মাথার উপড় স্নেহেরে ছায়া সরে যাচ্ছে যতই বড় হচ্ছি, বুড়ো হচ্ছি। ভালোবাসার পথ দূরে সরে যায়, হারিয়ে যেতে থাকি মুখোশদের ভীড়ে। প্রায় ১৫ বছর আগে একমাত্র হারিয়ে গেলেন। মা বলতো আমার নাক মামার নাকের মত মোটা , ঘাড়ের রগটাও নাকি তেমন ত্যাড়া। প্রায় ৬ ফুট লম্বা, সাস্থ্যাবান মানুষটাকে তাঁর ছেলেমেয়েরা প্রচন্ড ভয় পেতো। আমি যতক্ষণ দেখতাম কাছকাছি থাকতে চাইতাম। সবসময় মামাতো দুইবোন আর আমার জামা একরকমই কিনতেন মামা। নানু বাড়ির পাশে নদীতে সাঁতার শেখানোর অনেক চেষ্টা করেছেন আমাকে। আমাকে হাত ছেড়ে দিলেই দৌড়ে এসে ঝাপটে ধরতাম। মামা হো হো করে হাসতেন। বাইকে করে কোথাও গেলে ভুড়িটা জড়িয়ে ধরে বসে থাকতাম। আমার আদরের সেই মামা মারা গেলেন তখন আমি এসএসসি পরীক্ষা দিলাম কেবল, চাচার বাসায় তখন আমি। এক ভোরে বাবা এসে বললেন, রেডি হও, বাড়ি যাবো এক্ষুনি। তারপর আমাকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল থেকে মামার লাশ নিলেন, আমি লাশ সামনে আসার আগে পর্যন্ত জানতাম না যে আমার মামাটা মরে গেছে। বাবা শক্ত করে ধরলেন আমাকে। আমার খুব বেশী প্রিয় মানুষের লাশ সাথে নিয়ে গেলাম দীর্ঘ পথ, যে একটু নড়ছে না, ছুঁতে পারিনি, একটু উষ্ণতা ছিলো না পৃথিবীতে সেদিন।। এম্বুলেন্সে সারাপথ ভাবতে থাকলাম ১৫ বছরের সব কথা। সেই ছোট আমার বুকের ভেতরটা ছিঁড়ে যাচ্ছিলো। প্রায় ১৫ বছর হয়ে গেলো মানুষটা আমাদের কাছে নেই। সেই মানুষকে ঘিরে আনন্দগুলোও নেই। আমার জীবনে এমন তো আর কেউ আসবে না, যাকে ভয় পেলেই ঝাপটে ধরবো আমি।
লিখতেই পারছি না আর।
(উৎসর্গ-লিজা।)
আমার ছিলো চক্ষু নানা। তিনি চট্টগ্রাম আই হসপিটালে চোখের চিকিৎসা করাতে এসে অনেকদিন আমাদের বাসায় ছিলেন। আমার সঙ্গে থাকতেন। সেই থাকতে থাকতেই গাঢ় বন্ধুত্ব হয়ে গেল। তিনি এমনিতেও জমানোর মানুষ ছিলেন। দারুণ জমিয়ে ফেলতে পারতেন। তার হাসপাতালের ডাক্তারেরা পর্যন্ত মাঝে-মধ্যে বাসায় চলে আসতো। সেই নানা বেঁচে নেই। অনেক বছর হয়ে গেছে। আপনের লেখা পড়তে পড়তে তাঁর কথা মনে পড়ে গেল। ভালো থাকবেন জয়িতা'পু। শুভেচ্ছা নিরন্তর।
ধন্যবাদ মীর। আপনিও ভালো থাকেন।
আমার সখীও পোস্ট দিছে আজকে কি হৈল সবার!!!
যারা এক সন্তান তাদেরকে আমার খুব মজা লাগে, কত আরাম, বাবা-মা দুজনের আদরই একা একা উপভোগ করে।
সেরা লাইন।
মজা নাকি? একা বেড়ে উঠা। ভাগাভাগির আনন্দ নেই। আবার কোন গভীর কষ্টে, সুখে বাবা-মা কে সব শেয়ার করা যায় না, তখন মনে হয় বোন থাকলে ভালো হতো।
কাল রাত থেকেই মামাকে মনে পড়ছে খুব। অকারণেই চোখ ভরে যাচ্ছে। ঘুমাতেও পারিনি সারারাত।
নদীর এপাড় কহে ছাড়িয়া নি:শ্বাষ
ওপাড়েতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস
সমবেদনা। ওটি ছাড়া বন্ধুর আর কিছু নেই
বন্ধু তুমি একটু হেসো , একটু কথা বলো, বন্ধু আমার বন্ধু তুমি, বন্ধু মোরা কজন.....
মন'টা অনেক খারাপ হয়ে গেলো
জীবনটা এমনই রে আপু। অনেক হারিয়ে তবু আমরা থাকি, কিছু তো পাই ও। ভালো থাকো।
একলা আছি, একলা থাকছি - বোধটাই দম বন্ধ করা।
অনেক আগে দেখা হওয়া এক কাকা বাসায় এলেন, যার দেখা আবার পাবো আশাই করিনি, উনি ঘুরে যাবার পর এই বেশক'দিন যাবত ভাবছিলাম আরো কত কতজনকে এমনি করে হারিয়েছি, অথবা আর দকেহতে পাবো না... লিষ্টি দেখি ভালোই বড়... চোখ বুজেঁ ভরসা করার মানুষগুলা নাই হয়ে যাচ্ছে পাশে থেকে...
দুর এই সব মন খারাপ করা ব্যাপারগুলো দুরে থাক
সবাই ভাল থাক
সবাই মিলে কি শুরু করছেন? শুধু মন খারাপ করা লেখা...
আজকে সব মন খারাপ করা লেখা। তবু ভালো লাগলো। আনন্দ ভাগাভাগি করলে বাড়ে, দুঃখ ভাগাভাগি করলে কমে। শেয়ার করেছেন, আশা করছি মন খারাপ ভাবটা দূর হয়ে যাবে! মানে, বেদনাগুলো তো আর দূর হবে না, তবে সবার সামনে হাসিমুখে থাকার মতো অবস্থা হবে বলে আশা করি।
আমার বড় মামার কথা মনে পড়লো । চলে গিয়েছিলেন খুব কম বয়েসে । ছোট ছোট দুইটা ছেলের চোখের সামনে থেকে । জীবন বড় কঠিন, আপু । এক জীবনে কত কিছু যে দেখতে হয়!!
মন ভালো হয়ে যাক, এই দোয়া করি ।
আমার ছোট খালা, আমার বয়সী। আমার মার আরও ৬ বোন আছে। সবাই আছেন, অথচ সবচেয়ে ছোটটাই নেই। আমরা এক সঙ্গে পড়তাম। সীমু খালার কথা মনে পড়লো
জেবীন, বৃত্ত, মেসবাহ ভাই, কামাল ভাই, লিজা, মাসুম ভাই... সবাইকে পোষ্ট পড়ার জন্য ধন্যবাদ। আর মন খারাপ করানোর জন্য আমাকে
জয়িতা, মানুষগুলো হারিয়ে যায় সাথে আনন্দগুলো থাকে শুধু স্মৃতি।
এই যে ভদ্রমহিলা, জানতে চেয়েচি- খবরাখবর কি?
খবর নাই। কখনো শুধু বেঁচে থাকাই জীবন। আপনি কেমন?
(
সিরিজ পড়া শুরু করলাম আর প্রথমটা পড়েই মনটা বিষন্ন হলো!
মন্তব্য করুন