বাংলা হোক ৩৬৫ দিনের
সালাম রফিক, বরকত, সালাম...কে। সালাম আব্দুল গাফফার চৌধুরী, আব্দুল লতিফ, আলতাফ মাহমুদকে। সালাম মাহবুবুল আলম চৌধুরী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, হাসান হাফিজুর রহমানকে। এবং সালাম ১৫ কোটি বাঙালিকে। এঁরা বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এঁরা বাংলাকে লালন করছেন। এই শ্রদ্ধাঞ্জলি শুধু একদিনের জন্য নয়, ৩৬৫ দিনের জন্য।
আমি বাংলার গান গাই, আমি বাংলায় গান গাই। আমি বাংলাকে ভালোবাসি, আমি বাংলায় ভালোবাসি। ইশ্, কথাগুলো যদি দ্বিধাহীন সত্যি হতো! আমি বাঙালি- এটা আমার গর্ব, কিন্তু আমি বাংলা জানি- এটা নিয়ে যে আমি গর্ব করতে পারি না! বরং মাঝেমাঝে বিব্রত হই। বাংলার সাথে ইংরেজির কোনো সংঘর্ষ থাকার কথা ছিল না। কিন্তু আমরা একটা বিরোধ তৈরি করে নিয়েছি । ২শ বছর শাসিত ছিলাম বলেই হয়তো বা এই হীনম্মন্যতাবোধ। এরপরে অর্ধশতাব্দি পার করেও আমরা এটা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। তাই এখন আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটা এরকম- আপনি যদি ইংরেজি না জানেন, আপনি অশিক্ষিত আর আপনি যদি বাংলা না জানেন, আপনি স্মার্ট।
আমি ইংরেজি জানি না- এটা বলতে পারি না লজ্জায়। অথচ বাংলা জানি না- একথা অনেকে গর্বের সঙ্গে বলেন।
১৫ কোটি বাঙালির দেশে বাংলা জানাটা যোগ্যতা হিসাবে বিবেচিত হয় না। কোনো চাকরির বিজ্ঞাপনে কখনো এমন কোনো শর্তের কথা দেখা যায়নি। তবে কি বাংলাভাষার ব্যবহারিক উপযোগিতা একেবারেই শূন্য? নিশ্চয়ই নয়। আমরাই আসলে বাংলাকে উপযোগিতাহীন বানিয়ে রেখেছি। আমরা ধরে নিয়েছি, আমরা তো বাংলা জানিই। কী জানি আর কতটুকু জানি- তা একটু সচেতন হলেই ধরা যায়। আমাদের কথাবার্তায়, লেখালেখিতে, আমাদের অফিস আদালতে, নাটক-সিনেমায়...কেমন চেহারার বাংলা ব্যবহৃত হয়- কেউ যদি নির্মোহ তালাশ করে দেখেন, নিশ্চয়ই হতাশ হবেন। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের বিশাল গ্রাম এলাকায় শুদ্ধবাংলার তেমন চর্চাই হয় না। স্কুল-কলেজে পাঠদান চলে আঞ্চলিক ভাষায়। এর প্রভাব ওই একই- বাংলা না জেনেই আমরা ধরে নিই আমরা বাংলা জানি। আমাদের মানসিকতাও বিচিত্র। দুলাইন ইংরেজি লিখে অন্তত দুবার দেখি কোনো ভুল হলো কিনা। ভুল হলে তো মানসম্মান যায়। আর কোনোরকম সচেতনতা ছাড়া লাইনের পর লাইন বাংলা লিখে যাই অবলীলায়। ভুল হলে হোক। যেন ওটাই স্বাভাবিক।
আবার এলো ২১শে ফেব্রুয়ারি। আমরা বাংলায় মাতবো। বাংলায় জাগবো। ১ দিনের জন্য। ২২ তারিখে সব শেষ। আচ্ছা, আমরা যদি বাংলাতে না মাতি, বাংলাকে না জাগাই- কে তবে আসবে বাংলা বাঁচাতে? তাই আসুন, ১ দিনের শ্রদ্ধাঞ্জলির সঙ্গে বছরব্যাপী ভালোবাসি বাংলাকে।
প্রশ্ন হলো "শুদ্ধ" বাংলা বলতে আমরা কি বুঝি ! খেয়েছি ? খেয়েছিলুম ? খাইছি ? খাইসি ?
একসময় যে বাংলা শুদ্ধ বাংলা হিসেবে পরিগনিত ছিলো সেই সাধু বাংলা আজ প্রাগৈতিহাসিক বস্তু, যা চলিত ছিল তাই এখন বহুল প্রচলিত বাংলা, যাকে আমরা সাহিত্যে ব্যবহার করছি "শুদ্ধ" বাংলা নাম দিয়ে। শুদ্ধ বাংলার নামে আমরা কি বাংলা একাডেমীর প্রচলন করার চেস্টা চালিত প্রমিত বাংলাকে গ্রহন করবো নাকি আম জনতার প্রিয় ও গ্রহনযোগ্য লেখ্য এবং কথ্য রূপ কে গ্রহন করবো !
পশ্চিম বাংলার শান্তিনিকতনী বাংলাকে কি শুদ্ধ বাংলা বলবো না বাংলাদেশের বাংলাকে শুদ্ধ বাংলা বলবো !
ভাষা এমনই একটা নিত্য প্রবাহমনা জিনিস যাকে কোনো মানদন্ডে আটকে রেখে বলা যায় না যে এটাই "শেষ কথা" । এখন যে আন্চলিক বাংলাকে অশুদ্ধ বলা হচ্ছে এটাই হয়ে যাবে মুল ধারার বাংলা, সময়ে সেটাই বদলে যাবে।
ভাষা প্রবহমান। নদীর মতো। ওকে স্বাভাবিক প্রবাহে চলতে দেওয়া উচিত। দখল করে, ভরাট করে, উল্টো ঢেউ সৃষ্টি করে নদীর মতো ভাষাকেও মেরে ফেলা যায়। ফারুকী, ব্রাত্য, বাংলা ব্লগ, এফ এম রেডিও এমনটা করছে কিনা- ভেবে দেখতে দোষ কী?
সুন্দর আহ্বান ,সহমত।
বাংলা ভাষা শুদ্ধ করে শিখি, ইংরেজিও শুদ্ধ শিখি।
জোরালো সমর্থন
কথা ঠিক। ভীষণ হতাশ হয়েছি।
বাংলা ভালো জানি বলেই ইংরেজিও ভালো জানিনা আমি
বাংলা ভালো জানি বলে? বুঝলাম না।
বাংলা ভাষা শুদ্ধ করে শিখি, ইংরেজিও শুদ্ধ শিখি।
আর সাগর কাঁপানো ওলন্দাজদের ভাষা?
"বাংলাদেশের বিশাল গ্রাম এলাকায় শুদ্ধবাংলার তেমন চর্চাই হয় না। স্কুল-কলেজে পাঠদান চলে আঞ্চলিক ভাষায়।"
স্কুলে আঞ্চলিক ভাষা - তেমন সমস্যা দেখি না।
কলেজে/ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদানে বাংলা এবং ইংরেজি দুটোই ব্যবহার করা উচিত। বিশেষত স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ইংরেজি ভাষার (বিষয় ভেদে খানিকটা তারতম্য হতে পারে) প্রচলন আবশ্যক।
আঞ্চলিক ভাষার সাথে স্কুলে এবং পরিবারে শুদ্ধবাংলার চর্চা থাকলে ভাষার উভয় রূপ আয়ত্ত করতে পরবর্তীতে গলদঘর্ম হতে হয় না।
আঞ্চলিক বা প্রমিত কোনটিকেই অস্বীকার ও অবহেলা করা যাবেনা । সার্বজনীনতা না থাকলে কিছুটা হলেও সমস্যা হয় বৈকি! যে কোন ভাষা শিখলে তার শুদ্ধতাসহ শেখা বাঞ্ছনীয় । সারাটি বছর আমাদের ব্যবহারিক জীবনে বাংলা ব্যবহারে আমরা কুন্ঠিত থেকে মাত্র একদিন সেটা নিয়ে মাতামাতি করলে বাংলাকে ভালবাসা হয়না । বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশ দু'টোই আমাদের প্রিয়, অনেক মূল্যের বিনিময়ে অর্জন করেছি ।
সময়োপযোগী পোস্টের জন্য ধন্যবাদ ।
সহমত। ধন্যবাদ।
চুপচাপ পড়ে গেলাম।
আর খাওয়ার পোস্ট দিলেন না যে?
উদরাজী ভাই, মাঝেমাঝে শব্দ করে পড়লে বহুত ফায়দা হবে।
ভালো পোস্ট।
প্রসঙ্গ উলটচণ্ডালের মন্তব্য: স্কুল পর্যায়ের শুরু থেকে আঞ্চলিক ভাষার চরম নেতিবাচক প্রভাব বানান ও শব্দগঠনে কীভাবে পড়ে, এটা না দেখলে অনুমান করা কঠিন। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক সহপাঠী, যার রেজাল্ট খুব ভালো ছিলো, বাবাকে চিঠির শুরুতে লিখতো- 'শ্রব্দে (শ্রদ্ধেয়) বাবা' । শুধু বাংলা না, তার ইংরেজির ওপরেও এই প্র্যাকটিসের প্রভাব দেখতাম। পরীক্ষার খাতায় সবসময় Transfer payment কে প্রথমে transper fayment লিখে তারপর আবার কেটে ঠিক করতো।
আঞ্চলিক প্রভাবের কারণে হস্বি, দীর্গী, বর্গীজ্জ, তালিবশ্শ, মধিনষ্ষ, দন্তিঅন্ন, অন্তস্তিঅ, অনুষ্কার-- গোড়াতে বর্ণের উচ্চারণই দুরবস্থায় পড়ে যায়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ভুল শেখার ও শেখানোর পারম্পর্য চলতে থাকে।
এভাবেই ভাষার বানান রীতিইবদলে যায়। প্রাচীন পূঁথিতে বা তুলট লাগজে লেখা কিছু লেখা পড়েছিলাম রাজশাহীর বরেন্দ্র যাদুঘরের পাঠাগারে। ওখানকার বাংলা বুঝতে সেই রকম সমস্যা হয়েছিলো, অনেকতো বুঝতে বা পড়তেই পারি নাই। সে সময়ে যে বানান রীতি অনুসরন করা হতো তার বেশিরভাগই এখন ব্যবহার করা হয় না। এটা কি "আঞ্চলিক" প্রভাব না সময়ের প্রভাব। আমার মনে হয় ভাষার বানানরীতিকে এখন যে শুদ্ধ বলা হয় সেটা পরে বদলে যাবে। রবিন্দ্রনাথা "বাড়ী" লিখলেও এখন "বাড়ি" কে অশুদ্ধ বলা যায় না, অনেকেই লিখছেন। ইংরেজীর ক্ষেত্রের এরকমটি ঘটেছে। দেখা যাবে, আমরা লুট-এস কামালের উচ্চারনকে অনুসরন করতে গিয়ে ম্যানগ্রোভ কে ম্যাংগো ফরেস্ট বলছি
, বা ময়মনসিঙা স্টাইলে লিখছি যেটাকে শুদ্ধ বানান রীতি বলা হবে ( হাফ মমেসিঙা বলে উদিকে হালকা টান আছে আমার )
মাহবুুব সুমন, চিন্তাটা যতটা বানানরীতি নিয়ে, ভাষার রূপ নিয়ে তার চেয়ে বেশি। শুদ্ধ, আঞ্চলিক, কথ্য- সবই ঠিক আছে; কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে একটা জগাখিঁচুড়ি বানিয়ে সেটা দিয়ে আর সব তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা বা বাতিল করার প্রবণতা কেন?
ভাষাতত্ব বা পড়াশোনার বিষয় হিসেবে বাংলায় আমার তেমন পড়াশোনা নেই বলে তেমন গভীরে যেতে পারছি না বলে ক্ষমাপ্রার্থী।
আমার মনে হয় ,ভাষা এমনই একটা জিনিস যাকে কোনো বাঁধনে আটকে রাখা যায় না। আমরা না চাইলেও জগাখিচুরী লেগে যায়। নিজেকেই উদাহরন হিসেবে আনলে দেখতে পাই, আমার উচ্চারন রীতিতে উত্তরবংগীয় অনেক টান রয়েছে জীবনের অনেকটুকু সেখানে বাস করাতে, ময়মনসিংহের টান রয়েছে শব্দ বিশেষে পিতৃ-মাতৃ সূত্রে, ঢাকার টান রয়েছে কিশোর সময় থেকে থাকার কারনে, আবার উর্দু শব্দের ব্যবহার হয়ে যায় কথা বলার সময় সৈয়দপুর ও পুরান ঢাকায় থাকার কারনে। আমি না চাইলেও এটা চলে আসে। আবার অর্ধযুগ বিদেশে থাকা ও দেশে- বিদেশে ইংলিশ মাধ্যমে পড়াশোনা করায় কিছু ইংলিশ শব্দ চলে আসতে চায়; তবে বাংলিশ বলি না সচেতন ভাবেই ও চেস্টা করতে।
তবে, আপনার সাথে একমত শুদ্ধতার ব্যপারে। আমিও চেস্টা করি একটা নির্দিস্ট শুদ্ধতা বজায় রাখতে। তবে এ ক্ষেত্রে কোনো 'মানদন্ড' বেঁধে দেয়ার চেস্টা অসাধ্য বলেই মনে হয় ভাষার সেই দুর্বার ও প্রতিনিয়ত বাঁক নেবার প্রবনতার জন্য।
আঞ্চলিক প্রভাবের কারণে হস্বি, দীর্গী, বর্গীজ্জ, তালিবশ্শ, মধিনষ্ষ, দন্তিঅন্ন, অন্তস্তিঅ, অনুষ্কার-- গোড়াতে বর্ণের উচ্চারণই দুরবস্থায় পড়ে যায়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ভুল শেখার ও শেখানোর পারম্পর্য চলতে থাকে।
একটা ভালো প্রসঙ্গ তুললেন নুশেরা। আমার মেয়ের স্কুলের টিচার নাকি এভাবে পড়ান- এ্যা, ঐ, অ, আও।
আও, আমি তো অবাক! চট্টগ্রাম অঞ্চলে এ-কে এ্যা উচ্চারণ করা হয় ( যদিও ক্ষেত্রবিশেষে এ্যা উচ্চারণই শুদ্ধ। সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ)।
নোয়াখালীতে ঙ-কে বলে উম্ম, ঞ-কে নিঅ!
নুশেরাপু, আপনার বন্ধুর কথা শুনে মন খারাপ হল। এটা ঠিক যে অনেকেই আঞ্চলিক ভাষার প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন না। ব্যক্তিগত পত্র আঞ্চলিক ভাষায় লেখা হলে আপত্তি নেই, কিন্তু পরীক্ষার খাতায় ছাপটুকু স্পষ্ট থাকলে তো বিপদ।
একমতের উপরে সহমত।
অ.ট: সিরাজী বৃহত্তর নোয়াখালীর লেখকদের নিয়ে বেরুনো বইটি পড়লাম, আপনার, আপনার ভাই এর অংশটুকু দেখে খুব ভালো লাগলো। অভিনন্দন নিন ।।
ধন্যবাদ লীনা। বইটা এখনো আমার হাতে আসেনি। তবে শুনেছি।
খুবই ভালো একটি লেখা। এতো সুন্দর লেখা আমি মিস করতে চাই না। একটানে পড়ে গেলাম। সেসাথে মন্তব্যগুলো পড়েও অনেককিছু শিখলাম।
আমাদের সকলের বোধোদয় হোক।
মন্তব্য করুন