অন্ধকারের বুকের ভেতর
আপনার নাম অবর্ণা কেন?
প্রশ্নটা শুনে অবর্ণা থতমত খায়। রাত বারোটার সময় ফোন করে, ঘুম থেকে জাগিয়ে এমন প্রশ্ন করে কেউ? মেজাজ খিঁচে যায় অবর্ণার। বিড়বিড় করে সে বলে, অপদার্থ।
কী বললেন?
যা বলার বলেছি।
আপনি আমাকে অপদার্থ বলেছেন। এটা কি ঠিক হলো?
শুনেই যখন ফেলেছেন তখন আর বেঠিক বলি কীভাবে?
দুইভাবে বেঠিক। এক-আপনার তিন বছরের সিনিয়র কাউকে আপনি এটা বলতে পারেন না। দুই-বিজ্ঞানের ছাত্রী হিসেবে আপনি নিশ্চয়ই পদার্থ আর অপদার্থের পার্থক্যটুকু বোঝেন?
ও আচ্ছা আচ্ছা। ওভাবে দেখলে আমি দুঃখিত।
আমিও দুঃখিত এত রাতে আপনাকে বিরক্ত করার জন্য।
ঠিক আছে। খোদা হাফেজ।
না না। আগে প্রশ্নটার উত্তর দিন।
ওটা জানতে হলে আপনাকে মরতে হবে।
মানে?
নামটা রেখেছেন আমার দাদি। উনি এখন স্বর্গে। আপনি বরং স্বর্গে গিয়ে উত্তরটা জেনে নিন। অবশ্য আপনি স্বর্গে যেতে পারবেন কিনা আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে।
হা হা হা। রবিন হাসতে হাসতে বলল, হাসালেন।
রবিন আর অবর্ণার সম্পর্কটা ইদানীং অনেক স্বাভাবিক। দুপুরবেলা মাঝেমাঝে তারা একসঙ্গে রেস্টুরেন্টে যায়। আড্ডা দেয়। গল্প করে। রেস্টুরেন্টে বা অফিসে কাজের ফাঁকে। কিংবা অফিস শেষে নামতে নামতে সিঁড়িতে।
এটা হয়েছে নাছোড়বান্দা রবিনের চেষ্টায়। সারাক্ষণ কথা বলার জন্য উন্মুখ থাকে রবিন। অবর্ণা চায় এড়িয়ে চলতে। এতে অবর্ণা যে সমস্যাটার মুখোমুখি হয় সেটা হচ্ছে টেনশন। সারাক্ষণ একটা উৎকণ্ঠা তার ভেতরে কাজ করে-কখন রবিনের বিরক্তিকর কথাবার্তা আবার শুরু হয়। ভাবনা-চিন্তা করে অবর্ণা অবশেষে সিদ্ধান্ত নেয়-রবিনকে কথা বলার সুযোগ দেবে। আগ্রহটা মিটিয়ে দিলে হয়তো তার বিরক্ত করার প্রবণতা কমবে।
এখন অবর্ণা রবিনের সাথে কথা বলার সময় আগ্রহভাবটা ধরে রাখে। রবিন ফোন করলে ধৈর্যের সঙ্গে কথা বলে যায়। অবশ্য অবর্ণা নিজ থেকে কখনো ফোন করেনি রবিনকে।
আগ্রহ আর ধৈর্যের ভাব ফুটিয়ে রাখলেও একটা বিষয়ে অবর্ণা খুব সচেতন থাকে- কোনো কথায় রবিন যেন সুযোগ পেয়ে না যায়। ভুলেভালে সামান্যতম দুর্বলতাও যেন প্রকাশিত না হয়ে যায়।
কিন্তু আজ এই রাত বারোটায়, মধ্যরাতে, হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে অবর্ণার সতর্কতা আলগা হয়ে যেতে থাকে। বুঝতে পারে অবর্ণা। খোদা হাফেজ বলেও তাই সে ফোনটা রাখতে পারে না। রবিনের হঠাৎ আলটপকা প্রশ্ন তার বজ্র আটুনিকে ফসকা করে দেয়।
রবিন বলে, আপনি কি শুয়ে আছেন না বসে আছেন?
দাঁড়িয়ে আছি।
দাঁড়িয়ে আছেন? এতরাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী করছেন?
আপনার সাথে কথা বলছি।
ঘুমাননি?
আমি আরও পরে ঘুমাই। মিথ্যে বলে অবর্ণা।
তার মানে আমি আপনাকে বিরক্ত করিনি। আমি তো ভয়ে ছিলাম। ভেবেছি আপনি ঘুমাচ্ছেন। আমার ফোনে জেগে উঠে আমাকে বকে টকে দেবেন।
বকেছি তো। অপদার্থ বললাম না?
ওটা ভুল বলেছেন। আমি অপদার্থ নই।
তাহলে কী?
আপনাদের বারান্দা থেকে কি আকাশ দেখা যায়?
কী কথার কী জবাব?
বলুন না।
যায়। কেন?
যাবেন একটু?
কেন?
যান না। এমনি।
আচ্ছা।
অবর্ণা রুম-লাগোয়া বারান্দার দিকে হাঁটতে থাকে। সামান্য কয়েক পা। তবু তার দুই হাঁটু কেঁপে কেঁপে ওঠে। টলতে টলতে সে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।
রবিন ওপাশ থেকে বলে, এসেছেন?
অবর্ণা একটা ঢোক গিলে কাঁপা গলায় বলে, হ্যাঁ। এসেছি।
আকাশের দিকে তাকান।
তাকালাম।
কী দেখা যায়?
চাঁদ।
আর?
আকাশ। অনেক আকাশ।
রবিন সময় নেয়।
অবর্ণা বলে, এত বড় চাঁদ আকাশে! বহুদিন দেখা হয় না।
অবর্ণার ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়। গ্রামেই কেটেছে তার ছোটবেলা। ছোটবেলার রাতগুলোতে, যখন আকাশ পরিষ্কার থাকত, অবর্ণা সময় কাটাত জোছনার সঙ্গে। সে সব পাগল করা জোছনার রাত ছিল। বিশেষ করে শরৎ-হেমন্তে। শরতে দুর্গাপূজার সময়, লক্ষ্মীপূজার সময় বাধভাঙা জোছনার জোয়ার থাকত গ্রামে। দূরগ্রাম থেকে ভেসে আসত পটকা-বাজির শব্দ। কেমন যেন উৎসব উৎসব লাগত অবর্ণার কাছে। আর হেমন্তে হালকা হালকা শীতে বাড়িতে চলত আমন ধানের উৎসব। নবান্ন। জোছনাকে কিছুটা ভারী করে দিত হালকা কুয়াশা। যখন সে খোলা উঠোনে এসে দাঁড়াত, দূর আকাশের কুয়াশার সতূপ কালো হয়ে যেন থমকে থাকত গাছগাছালির মগডালে। সেই স্বচ্ছ আর ভারী জোছনার রাতগুলোতে মাঝেমাঝে অবর্ণার বুকটা খালি খালি লাগত। তার ভালোলাগার অনুভূতিগুলো অন্য কারও সঙ্গে মেলাতে চাইত সে। পারত না বলে তার কেবল দীর্ঘশ্বাস বেরুত। মনে পড়ত দূরে বাজি ফোটানো হিন্দুপাড়ার শিউলির কথা, কখনও বা ওই থমকে থাকা কুয়াশার নিচে নারকেল গাছঘেরা মিয়াবাড়ির নাম না জানা ছেলেটি এসে দোলা দিয়ে যেত অবর্ণার মনে।
আজ বহুদিন পর সে রকম একটা রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে অবর্ণা উতলা হয়। জোছনার জন্য। শিউলি নামের বন্ধুটির জন্য। কিংবা মিয়াবাড়ির ছেলেটির জন্য। অথবা রবিনের জন্য।
একটা দীর্ঘশ্বাসকে গলায় আটকে রাখতে চায় অবর্ণা। কিন্তু আজ আর পারে না। বেরিয়ে যায়।
ফোনটা তার ধরাই থাকে। দীর্ঘশ্বাসটা ওপাশ থেকে শুনে ফেলে রবিন। সে আর্ত গলায় বলে, মন খারাপ আপনার?
না। মন ভালো।
তাহলে দীর্ঘশ্বাস কেন?
ওটা ভালোলাগার দীর্ঘশ্বাস।
কেমন ভালোলাগা?
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ এমন সুন্দর জোছনার খোঁজ দেওয়ার জন্য।
শুধু ধন্যবাদেই শেষ?
আর?
আরও কিছু বলুন।
অবর্ণা কিছুক্ষণ ভেবে বলে, আচ্ছা একটা গল্প বলি। জোছনার গল্প।
বেশ বলুন।
এক দেশে ছিল এক জোছনা...
এক দেশে ছিল এক জোছনা? রূপকথার গল্প?
শুনুন না। ভালো লাগবে।
আচ্ছা বলুন।
এক দেশে ছিল এক জোছনা। সে একা একা জোছনা দেখে। জোছনা দেখে সে অবাক হয়। অবাক হয়ে স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখে তার পেট গুলিয়ে আসে।
ওমা। স্বপ্ন দেখে পেট গুলিয়ে আসবে কেন? সে কি বমি করে?
না। বমি করে না। সে যখন অবাক হয়, সে যখন স্বপ্ন দেখে, তখন সে অন্য কারও হাত ধরতে চায়। হাত ধরে স্বপ্ন দেখতে চায়। স্বপ্ন দেখে অবাক হতে চায় । জোছনায়।
ধরলেই পারে।
একদিন সে হাতটা খুঁজে পায়।
তাহলে?
সেটাই তো গল্প।
বলুন।
জোছনা দেখতে দেখতে তার বুকটা কেঁপেও ওঠে। জোছনা থাকতে থাকতে হাতটা সে ধরতে পারবে তো?
তারপর?
তাকে কে বোঝাবে জোছনা শেষ হয় না। আজকে শেষ হলে কাল আবার আসবে।
আচ্ছা!
একদিন সে হাতটা খুঁজে পায়। আজ রাতের জোছনায় সে হাতটা ধরবে। সে অবাক হয়, স্বপ্ন দেখে। আজ রাতে সে অবাকজোছনা দেখবে। অবাকস্বপ্ন দেখবে।
তারপর?
কিন্তু তখনই খবর আসে, আজ থেকে আর আকাশে চাঁদ উঠবে না। কোনও দিনও উঠবে না।
আজব খবর! কে দিল এই খবর?
জানি না। তবে এটা জানি, জোছনার আকাশে আর কখনো চাঁদ ওঠেনি।
গলাটা ধরে আসে অবর্ণার। বুকের ভেতর থেকে কান্না উথলে উঠতে চায়।
রবিন বলে, মনটা খারাপ করে দিলেন।
দুঃখিত।
অবর্ণা রবিনের কাছ থেকে কিছু শুনতে চায়। এই গল্প শুনে রবিন কী বুঝল কে জানে?
কিন্তু রবিন চুপ করে থাকে।
অবর্ণা বলে, আপনিও একটা গল্প বলুন না। এমন মন খারাপ করা গল্প। শোধবাদ।
আচ্ছা শুনুন। এক দেশে ছিল এক শিকারি।
আপনিও? রূপকথার গল্প?
শুনুন না। শিকারি সারাদিন হন্যে হয়ে ছোটে এক পাখির পেছনে। ক্লান্ত-বিপর্যস্ত শিকারি হাল ছেড়েই দিয়েছিল প্রায়। সূর্যটাও ডুবুডুবু। আবছা সিঁদুর ছড়িয়েছিল পশ্চিমের আকাশে। সিঁদুর রঙে পরাজিত শিকারির মুখ-আশ্চর্য প্রাগৈতিহাসিক রূপ পেয়েছিল।
আচ্ছা!
সিঁদুর ঝকঝকে হলো আরও। সূর্য ডুবে গেল। হঠাৎই যেন পাখিটা এসে বসল শিকারির নাগালের মাঝে।
বাহ। বেশ তো!
গুলিটাও লাগল। সারদিনের ক্লান্তি দূর হয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠল শিকারির মুখ। পাখিটা তাহলে শেষ পর্যন্ত ধরা দিল। কিন্তু না, হলো না।
কেন? কী হলো?
ডানাভাঙা পাখি ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে পড়ল বিশাল দীঘির মাঝখানে। তখন সন্ধ্যার ছায়া নেমে এসেছে। চারদিকে অন্ধকার। পাখিটা শিকার হলো ঠিকই কিন্তু পাওয়া হলো না তাকে। ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে শিকারি তাকিয়ে রইল অন্ধকারের বুকের ভেতর। কিছুই দেখা যায় না যেখানে, শুধু ডানা ঝাপটানির শব্দ শোনা যায়।
এক সময় সেই শব্দও থেমে আসে?
হ্যাঁ থেমে যায়।
পাখিটা কি দীঘির জলে ভেসে থাকে? নাকি ডুবে যায়?
বোধহয় ভেসে থাকে।
কেন ভেসে থাকবে?
পাগল শিকারিকে কষ্ট দেওয়ার জন্য।
মানে কী?
পাগল শিকারি হয়তো বা ঠায় বসে থাকবে দীঘির ধারে। সারারাত। ভোরের আলো ফুটতেই আবার খুঁজতে থাকবে পাখিটাকে।
তারপর?
শিকারি পাখিটাকে পাবে। মৃত পাখিটা তুলে নিয়ে বুকে চেপে ধরে কাঁদবে।
তাহলে তো পাখিটার ডুবে যাওয়াই ভালো ছিল।
না ভালো ছিল না। শিকারি বেচারা শুধু ক্ষ্যাপা নয়, দুঃখবিলাসিও। পাখিটা ডুবে গেলে তো শিকারির ষোল আনা দুঃখ পাওয়া হবে না। দুঃখ পেয়ে তার ভালো থাকা হবে না।
শিকারি তবে ভালো আছে এখন?
জানি না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রবিন ফোন রেখে দেয়।
দারুন ।
ভাল লাগল গল্প। লেখার চেয়েও বেশি ভাল লাগল লেখকের লেখনী।
অসাধারণ গল্প আর লেখনী
বলতেই হল -- চমৎকার
দারুণ! বলা যায় চ্রম!
ঝাক্কাস।।
মন্তব্য করুন