উপন্যাস : অচল পয়সার জবানবন্দি (৫)
৫.
আসিফকে আগেই বিদায় দেয়া হয়েছে। তবে এই একটা বন্ধুকে আমার কখনোই ছাড়তে ইচ্ছে করে না। ও নিজেই মিরপুরে বোনের বাসায় হাজিরা দিতে চলে গেলো। আমি জানি রাত হতে হতে সে ফিরে আসবে। আমার ডেরা তার অপরিচিত নয়।
যুথীরা চলে যাবার পর ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে আমি আবারো একা হয়ে গেলাম। একটা বিষয় ভেবে আশ্চর্য লাগলো। কেন আজ কোথাও বেশিক্ষণ বসতে পারছি না?
সেবার কক্সবাজার গিয়েছিলাম একটা অফিসিয়াল কাজে। আমাদের দেশেই কাজ করে এমন একটা বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। একদিন রাতে অফিসের কাজ-টাজ সেরে বাড়িতে ফিরে সবে গোসল দিয়ে বেরিয়েছি। চারটা ভাত খেয়ে শুয়ে পড়ার কথা ভাবছি, কারণ শরীরটা বিশেষ ভালো লাগছে না। শুয়ে শুয়ে মুভি দেখার চেষ্টা করলে ঘুমও আসবে, শরীর খারাপজনিত বিরক্তিও কেটে যাবে- এই ছিলো আমার চিন্তা। কিন্তু মোবাইল বেজে উঠলো। দেখলাম অফিসের কর্তাবাবুর ফোন। কালকে সকাল দশটায় তুই ‘অমুক’ কোম্পানীর সঙ্গে কক্সবাজার যাবি। তোকে ওরা ফোন করবে। বলেই তিনি আমার কোনো কথা না শুনে কেটে দিলেন লাইন।
বিদ্রুপের একটা সীমা থাকা উচিত।
আমি শুয়ে শুয়ে নিজের কপালকে শাপ-শাপান্ত করতে থাকলাম। সঙ্গে ফোনের জন্য অপেক্ষা। কোনো এক কোম্পানীর কোনো এক মহাজন ফোন করে আমায় উদ্ধার করবেন। ভাবতেই বিরক্তি লাগছিলো। অপেক্ষার প্রহর প্রলম্বিত হলো না। তিনি নিজের পরিচয় দিলেন আলী নামে। পরদিন সকালে যেখান থেকে গাড়ি ছাড়ার কথা সে জায়গাটার নাম বলার আগে আমার কাছ থেকে জানতে চাইলেন, আমি কোথায় থাকি। অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন আর কি। আমি যে জায়গার কথাই বলবো, তার উল্টো কোনো একটা জায়গায় গাড়ি দাঁড়ানোর কথা বলবেন উনি। তারপরে একটা দীর্ঘ ধানাই-পানাই, যার মূলকথা অতোটা পথ গাড়ি পাড়ি দিতে পারবে না। আমাকেই তাই এগিয়ে আসতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। পূর্বাভিজ্ঞতা যে সবসময় সঠিক দিকনির্দেশনা দেয় না সে কথা প্রমাণের জন্যই হয়তো; আমি নিজের এলাকা বলতেই অপরপাশ থেকে আলী সাহেব চমকে উঠলেন, আরে আমাদের গাড়ি তো ওখান থেকেই ছাড়বে!
আমিও চমৎকৃত হলাম। আমার বাড়ির মতো ব্যাকওয়ার্ড এলাকা থেকে তাদের গাড়ি ছাড়ার কোনো কারণই নেই। আমি নিশ্চিত হওয়ার জিজ্ঞেস করলাম, কেন এখান থেকে ছাড়া হবে? জানা গেল, আলী ভাইয়ের বাসাও আমার এলাকাতেই। এজন্য সেখান থেকেই হবে যাত্রা শুরু।
পরদিন সকালে সময়মতো ও জায়গামতো বান্দা দাঁড়িয়েছিলো। আলী ভাই সঠিক বান্দাকে প্রথম সুযোগেই চিনে নিয়েছিলো। দিনের সবকিছুই ঠিকঠাক ছিলো, শুধু যানজটটা ছাড়া। যানজটের পরিকল্পনা করে আমরা বাসা থেকে বের হয়েছিলাম দুই ঘন্টা আগে। কিন্তু মাত্র ১৫ মিনিটেই পৌঁছে গেলাম এয়ারপোর্টে। বাকি এক ঘন্টা ৪৫ মিনিট তাই বসে, দাঁড়িয়ে, গল্প করে এবং বিড়ি খেয়ে পার করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলো।
এর মধ্যে আলী ভাই মাঝে মাঝে তার বস্ খান ভাইএর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন। তিনিও আমাদের যাত্রাপথের সঙ্গী। কিন্তু তখনো এসে পৌঁছান নি। যানজটের কবলে বিপর্যস্ত হয়েছেন। ঢাকা শহরটা যে দিন দিন আনপ্রেডিক্টেবল হয়ে উঠছে সেটা আরো একবার টের পেলাম। আমাদের নিয়মিত জ্যামের রাস্তা ফাঁকা, অথচ ওই ভদ্রলোকের 'জ্যাম হয় না' এমন রাস্তা বন্ধ হয়ে আছে যানজটে।
খান ভাই আসার পর দেখা গেল তিনি একজন মধ্যবয়স ছুঁই ছুঁই টাক না পড়া ভদ্রলোক। সামান্য ভুড়িও আছে। ছাটানো গোঁফও আছে। তবে কোনো অসামঞ্জস্য নেই। মুখের আলাপী হাসিটা বলে দিচ্ছিলো, ইনি মজার মানুষ। তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিড়ি টানার সময় ভারতীয় নাগরিকেরা কিপটামীটাকে কিভাবে উন্নয়নশীল খাতে কাজে লাগায় তা নিয়ে বেশ একচোট আলোচনা হয়ে গেলো।
বিমান যখন রানওয়ে ছেড়ে প্রথমবার বাতাসে নিজের শরীরটা ছেড়ে দেয়, সে সময় মৃদু একটা ঝাঁকুনি মতো লাগে। ঝাঁকুনিটা ম্যাজিক কার্পেটের মতো তো নয়ই, এমনকি রোলার কোস্টারের মতোও না। তারচে'ও নিচুদরের। প্রায় টের পাওয়া যায় না, এমন। কিন্তু অনেককে দেখলাম, এই ঝাঁকুনিতেই বিড়বিড় করে দোয়া-দুরুদ পড়ে নিজের বুকে ফুঁ দিচ্ছেন। হয়তো নিজেকে ওস্তাদের হাতে ছেড়ে দিলেন। আমি ওস্তাদকে তাদের রক্ষণাবেক্ষণের পরামর্শ দিলাম মনে মনে। সঙ্গে নিজের ব্যপারেও।
আমার মজা লাগলো, বিমান-মাইকের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে এক বিমানবালার অঙ্গসঞ্চালনের অভূতপূর্ব সমন্বয় দেখতে। জরুরি বহির্গমনের দুইটি রাস্তা আছে, একটি সামনে আরেকটি পেছনে। এই কথাটা যখন মাইকে বললো, তখন সামনের সুবেশিনী মেয়েটি দু’হাত বাঁকিয়ে সেটি দেখিয়ে দিলো। যদিও এটা খুবই স্বাভাবিক একটা ঘটনা। কিন্তু কথা বলছে একজন আর কাজ করে দেখাচ্ছে আরেকজন- ব্যপারটা বেশ ফানি।
বিমান যত উপরে উঠতে লাগলো, নিচের বিল্ডিংগুলো ততই ছোট হতে লাগলো। মেঘগুলোর ওপরে উঠে মনে হচ্ছিলো হিন্দুধর্মে বর্ণিত স্বর্গে চলে এসেছি। জায়গাটার সঙ্গে মুসলমানদের বেহেশতের মিল পেলাম না। তবে হিন্দী চ্যানেলে সকালের দিকে যেসব ধর্মীয় সিরিয়ালগুলো চলে, সেগুলোতে দেখানো স্বর্গের সঙ্গে মিল পেলাম। মনে হচ্ছিলো এই বুঝি শিবঠাকুর তার উঁচু করে ধরে রাখা ডান হাত নিয়ে আসনে বসা অবস্থায় দেখা দেবেন। আমি মাঝে মাঝে একটা জিনিস ভাবি; আমরা সবাই ইসলাম ধর্ম পালন করে-টরে মারা গেলাম, আর তারপরে দেখা গেল পরকালে সবকিছুর হর্তকর্তা হয়ে বসে আছেন শিবঠাকুর, দূর্গা, কালী, মেনকা, রম্ভা, উবর্শীরা।
তখন মুসলমানরা নিশ্চই কঠিন একটা পেইন খাবে!
এইসব হাবিজাবি ঘন্টাখানেক ভাবতে না ভাবতেই প্লেন কক্সবাজারে পৌঁছে গেল। সেখানে নেমে আমার মনে যেসব ধারনা তৈরি হলো সেগুলো হচ্ছে- এই এয়ারপোর্টটা খুবই ছোট্ট, এখানে কোনো ঝুট-ঝামেলা নেই, বাংলাদেশে এমন একটা সরকারি প্রতিষ্ঠান থাকতে পারে তা প্রায় অকল্পনীয় এবং ভিনদেশি ট্যূরিস্টরা এই এয়ারপোর্টে নেমেই খুশি হয়ে যায়।
আমরা যে হোটেলে উঠলাম সেটার নাম লম্বা-সৈকত। হোটেলটার সবচেয়ে আকর্ষণীয় বস্তুটি ছিলো প্রতিরুমে একটা করে মহা আরামের বিছানা। কক্সবাজার শহরটাও লম্বাটে ধরনের। সেটা উপসাগরের শরীর ঘেঁষে লম্বালম্বি চলে গেছে একদিকে বান্দরবান, আরেকদিকে টেকনাফ পর্যন্ত। এবং এই গড়নের সুবিধাটা সরকার বুঝতে পেরেছে খুব সম্প্রতি। বুঝতে পেরে সৈকত ঘেঁষা একটা মেরিন ড্রাইভ বানিয়েছে তারা। রাস্তার একপাশে কাটা পাহাড়। পাহাড়ের কাটা অংশের রঙ হলুদ, তার ওপরে রকমারি ঘন সবুজ স্থানীয় ফ্লোরার কার্পেট; আর নিচ দিয়ে ‘নীড ফর স্পীড-২’ গেইমে দেখানো রাস্তাগুলোর মতো একটা রাস্তা। রাস্তার যে পাশে পাহাড় নেই সে পাশে পড়ে আছে দিগন্তে হারিয়ে যাওয়া একটা সাগর। রোডরাশের ফুল ভার্সনেও এমন একটা রাস্তা দেখেছিলাম আমি।
পড়ন্ত বিকালে আপনি যখন এই রাস্তা দিয়ে যাবেন, তখন আপনার চোখ থাকবে ঠান্ডা লাল রংয়ের সূর্যটার দিকে। কারণ ওই জিনিসটা খুব দ্রুত নিচের দিকে নামবে এবং আপনি চাবেন, ও যেন আরো একটু সময় ঝুলে থাকে। এই সূর্য-মানুষের টানাটানিটাই সম্ভবত এই রাস্তার সবচেয়ে বড় মজা। পাহাড় কেটে বের করা জমিতে বানানো চিংড়ির ঘেরগুলোও মনোমুগ্ধকর। পাশাপাশি এগুলোর অনেক সমালোচনাও শুনতে হবে আপনাকে। খান ভাই এই এলাকায় মধ্য আশি থেকে মধ্য নব্বুই পর্যন্ত টানা পাঁচ বছর কাজ করে গেছেন। তখন নিজের হাতে পাঁচ লাখ গাছ লাগিয়েছেন তিনি, পুরো কক্সবাজার-বান্দরবান জোনে। সে সময় মেরিন ড্রাইভ বা আর কিছু ছিলো না। বীচ বলতে ছিলো কেবল, এখন যে জায়গাটা কলাতলী নামে পরিচিত সেটা।
আমি গাড়িতে বসে এসব শুনছিলাম আর কল্পনা করছিলাম, পাহাড়গুলোকে কেটে ফেলার আগে নিশ্চই সেগুলো সরাসরি সমুদ্রে গিয়ে পড়তো। যাকে বলে ডাইরেক্ট বীচ। এরকম একটা দুর্গম ডাইরেক্ট বীচ থেকে লাফ দিয়ে মরে যাওয়ার একটা প্রবল ইচ্ছা মাঝে মাঝেই আমাকে গ্রাস করে। শুনেছি হাতের কাছে বেশ ভালো কিছু ডাইরেক্ট বীচ আছে পটুয়াখালীতে। দেখা যাক, মারা যাবার প্রয়োজনটা খুব পড়ে গেলে নাহয় সেসব এলাকায় গিয়ে ঘুরাঘুরি করা যাবে’খন। আমার মাথায় এলো, বাংলাদেশটা একটা উন্নত দেশ হলে, মেরিন ড্রাইভ তৈরির জন্য পাহাড় না কেটে তার ওপর দিয়েই রাস্তা তৈরি করা হতো। তখন আমি বর্ষাকালে পাহাড়ের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের ওপর বৃষ্টি পড়া দেখতে পারতাম।
বৃষ্টির মৌসুমটা কাটানোর জন্য তখন হয়তো আমি প্রতি বছরই একবার করে কক্সবাজার যেতাম। আমার সঙ্গে থাকতো ল্যাপটপ ভর্তি মুভি। রুদার্বার্গ, আর সেটার কর্কের ছিপি খোলার যন্ত্র।
আমি গাড়ির ভেতরে এসব কথা ভাবতে ভাবতে অবিশ্বাস্য বিস্ময়সহ প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য দেখার চেষ্টা করতে থাকি। এ ধরনের কোনো মুগ্ধতাই হয়তো লর্ড বায়রন’কে দিয়ে লিখিয়ে গেছে,
দেয়ার ইজ আ প্লেজার ইন দ্য পাথলেস উডস্
দেয়ার ইজ আ রাপচার অন দ্য লোনলি শোর,
দেয়ার ইজ সোসাইটি, হোয়ার নান ইন্ট্রুডস্,
বাই দ্য ডীপ সী, এন্ড মিউজিক ইন ইটস্ রোর:
আই লাভ ম্যান নট লেস, বাট নেচার মোর।
আমার তাঁর মতো কাব্যপ্রতিভা কেন নেই, ভেবে একবার বেশ মন খারাপও হলো।
প্রথম দিনটা গাড়িতে করে ইনানী বীচ, কলাতলী, মেরিন ড্রাইভ, বার্মিজ মার্কেট ইত্যাদি এলাকায় ঘুরে ঘুরে কাটলো। স্বাভাবিক ট্যূরিস্ট শিডিউল। বার্মিজ মার্কেটে গিয়ে মনে হলো, শুধু শুধু সময় নষ্ট। না এলেই ভালো হতো। আরো ভালো হতো যদি সেখানকার দোকানীরা মেয়ে না হয়ে ছেলে হতো। মেয়েগুলো ট্যূরিস্ট ঠকানোতে বেশি পটু। মেয়ে বলে তাদের সঙ্গে বেশি দর-দামও করা যায় না। আবার নিশ্চিত ঠকছি জানলে খুব বেশি জিনিসপাতিও কেনা যায় না।
আসলে বার্মিজ মার্কেটের ব্যবসায়ীরা ব্যবসা কিভাবে করে সেটাই ঠিকমতো জানে না। মানুষ ধরে ধরে গলা কাটাটা কখনোই ব্যবসার উপায় হতে পারে না। এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে, এখানকার ব্যবসাটা একটা জমজমাট ব্যবসা হয়ে উঠতে বাধ্য।
পরদিনের পরিকল্পনাকারী ছিলেন খান ভাই। আমাদের কাউকে কিছু জানানো হলো না। কেবলমাত্র সূর্য ওঠার আগে ঘুম থেকে উঠতে হলো। এটার জন্য আমি পরিকল্পনাকারীর ওপর যথেষ্টই ক্ষিপ্ত হলাম। শুধু প্রকাশ করলাম না। আমরা একটা মাইক্রোতেই সবাই এঁটে যাই। তাও দুইটা মাইক্রোর ব্যবস্থা হলো। আমরা একটার নাম দিলাম স্মোকার্স বাস, আরেকটার নাম দিলাম নন-স্মোকার্স বাস। একটার নেতৃত্বে ড্রাইভার রহিম (সে আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ঝানু লোক)। আরেকটার নেতৃত্বে খান ভাই। তিনি ড্রাইভিং কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলোয় ততোখানি ঝানু নন। কিন্তু অভিজ্ঞ বটে।
সাহিত্যে পাহাড়কে সবসময় মুনী-ঋষিদের সঙ্গে তুলনা দেয়া হয়েছে। ধ্যানমগ্ন থাকার জন্যই যেন তাদের সৃষ্টি। আর আমার কাছে পাহাড়ের গাএ শুয়ে থাকা রাস্তাগুলোকেও ধ্যানী পুরুষ বলে মনে হলো। তাদের মধ্যে কোনো চপলতা নেই, কোনো অনিশ্চয়তার ছোঁয়া নেই। যেন একেকজন চুপ করে বসে পড়েছে দশ হাজার বছরের ধ্যান করার জন্য। সময় শেষ হলেই চোখ মেলে চাইবে ওরা সবাই। চুপচাপ উঠে তল্পিতল্পা গুটিয়ে হেঁটে চলে যাবে লোকচক্ষুর আড়ালে।
যা বলছিলাম- দেখা গেল রাস্তাগুলো প্রচুর এঁকেবেকে এগিয়েছে। কখনো উঠেছে খাড়া, কখনো দীর্ঘ দুরত্ব একই উচ্চতায় এগিয়েছে আবার কখনো দুম করে নিচে নেমে গেছে কাউকে কিছু না বলেই। কিন্তু এই পথে চলার সময় একবারও মনে হবে না, রাস্তাগুলোর মধ্যে গন্তব্য সম্পর্কে কোনো দ্বিধা রয়েছে। আমি সেই অটল, স্থির পাহাড়ী পথ ধরে চলতে চলতে একসময় প্রকৃতির কাছে নিজেকে সঁপে দিলাম।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধাতবনির্মিত গাড়ির ভেতরটা গরম হয়ে, ফুটতে শুরু করলো। সমুদ্রস্তর থেকে কিছুটা ওপরে থাকার জন্যই হয়তো গাড়ির শীতাতপ নিয়ন্ত্রকটা ঠিক পেরে উঠছিলো না। আর আমরা ধূমপায়ীরা যন্ত্রটাকে খুব ভালোভাবে চলতেও দিচ্ছিলাম না। ঝাঁকুনির চোটটা মাঝে মাঝেই বেশি হয়ে যাচ্ছিলো। তখন বুঝতে পারছিলাম, কেন দুইটা বাহন নেয়া হয়েছে। এই ঝাঁকুনিতে কাউকে যদি পেছনের সীটে বসতে হতো, তাহলে তার খবরই ছিলো।
ঝাঁকুনি বা গরম ছিলো তাদের নিজ নিজ জায়গায়, আর অনুভূতিগুলো উড়ছিলো বাতাসে। পাহাড়ী রাস্তা এক অসামান্য ব্যপার। যে কারণে আমি মেরিন ড্রাইভটাকেও পাহাড়ের ওপরে চাচ্ছিলাম। রাস্তা থেকে বাইরে তাকালে বারো-তেরশ’ ফুট নিচ পর্যন্ত দেখা যায়। পুরোটা সবুজে আবৃত। এটা আপনি যে পাহাড়ের ওপর দিয়ে যাচ্ছেন, সে পাহাড়েরই ঢাল। এরপরে আবার আরেকটা সবুজ বিশালাকায় পাহাড়কে দেখা যাবে একইভাবে উঠে যেতে। দূরে ঠিক আপনার চোখের স্তর পর্যন্ত উঠে সে দাঁড়িয়ে পড়েছে। আশপাশে যেদিকে তাকাবেন নানা অ্যঙ্গেল থেকে শুধু এই এক দৃশ্যই আপনি দেখতে পাবেন। আর একটু কান পাতলে শুনতে পাবেন ওদের সদম্ভ ঘোষণা, জায়গাটা পাহাড়মুনীদেরই চারণভূমি।
দেখলাম পাহাড়ের গায়ে কোথাও একটু সবুজের ঘনত্ব কম। ভালো করে ঠাহর করে দেখা যায়, সেখানে চাষ হয়েছে তামাকের। কোথাও আবার সবুজ রংটা কালো হয়ে গেছে ঘন হতে হতে। সেখানে কলাগাছের সমাহার। হাজার হাজার কলাগাছ। স্থানীয়রা এ কলাকে ‘বাংলা কলা’ নামে ডাকে। অসম্ভব মিষ্টি আর ছোট আকারের। পাতলা চামড়া, অনেকটাই আমাদের বিচি কলার মতো। পার্থক্য শুধু বিচি কলার দুই অপরিহার্য অনুষঙ্গ এর মধ্যে নেই।
আলোচনায় আলোচনায় জানতে পারলাম, এই কলা গাছসহ খেয়ে ফেলে হাতির পাল। হাতি চলাচলের জন্য পাহাড়ের মধ্যে মধ্যে রয়েছে ডেঞ্জার জোন। লামায় ঢোকার সময় পুলিশ চেকপোস্টে জানিয়ে যেতে হলো কতক্ষণ ভেতরে থাকবো। তার একটু সামনে গিয়েই দেখলাম একটা ভাঙা ব্রীজ। রাস্তা থেকে খানিকটা দূরে। লামার ভেতর দিয়ে আলীকদম পর্যন্ত চলে যাওয়া এই রাস্তাটা তৈরির সময় ঐ ব্রীজটা নাকি একদিন এসে ভেঙ্গে দিয়ে যায় এক পাল বুনো হাতি। এরপরে স্থানীয়দের পরামর্শে সরকারী প্রকল্পের রাস্তাটাকেই মূল নকশা থেকে ঘুরিয়ে কিছুদূর সরিয়ে আনা হয়েছে। হাতি নাকি সবসময় একই রাস্তা ধরে চলাচল করে। সেখানে অন্য কোনো অবকাঠামো পছন্দ করে না তারা।
পাহাড় দিয়ে চলার সময় আমার বারবার গ্লাইডার হয়ে যেতে মন চাচ্ছিলো। ট্রান্সফর্মার্স-৩ সিনেমায় বিশেষ একধরনের কাপড় পরে ছেলেগুলোকে গ্লাইডিং করতে দেখেছিলাম। ওদের দু’হাত থেকে শরীরের ঊর্ধ্বাঙ্গ পর্যন্ত আর দু’পাএর মধ্যের জায়গাটা কাপড় দিয়ে আটকে দেয়া হয়েছিলো। এই কাপড় পরে ওরা অনেক উঁচু ভবন থেকে শূন্যে লাফ দেয় আর ভাসতে ভাসতে, যেখানে যেতে চায় সেখানে গিয়ে পৌঁছে যায়। আমার যদি এমন সুযোগ থাকতো, তাহলে আমি অবশ্যই পাহাড়ের ওপর থেকে ঝাপ দিতাম। ভাসতে ভাসতে গিয়ে দেখে আসতাম দূরের পাহাড়গুলোকেও, আরেকটু কাছ থেকে।
আমরা দেড় হাজার ফুট উচুঁতে বিশ্রামের জন্য একটা জায়গায় দাঁড়ালাম। একটা ছোট্ট ইকোপার্ক। সেখানে দর্শনার্থীদেরকে টিকেট কেটে ঢুকতে হয়। আমরা ভেতরে ঢুকে অনেক জোড়া কপোত-কপোতীকে বসে থাকতে দেখলাম। হয়তো তারা খুঁজে ফিরছিলো একটু পাহাড়ী নীরবতার সন্ধান। পার্কটার ভেতরে কয়েকটা পাকা গম্বুজ বানিয়ে রাখা আছে। চাইলে সেগুলোর উপরে উঠে একটু উঁচু থেকে আশপাশের পুরো চরাচরটার ওপর একদফা চোখ ঘুরিয়ে আনা যায়।
দুপুরের আগে আগে আমরা পৌঁছে গেলাম খান ভাইদের প্রজেক্টের ভেতরে। উনারা স্থানীয় কৃষকদের নানাবিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন। আমরা দেখলাম তাদের বন্দোবস্তগুলো। খেলাম তাদের রেস্টহাউসে। বাবুর্চিটার রান্নার হাত ছিলো দারুণ! রূপচাঁদার তরকারীটা পেয়াজ দিয়ে ঘন করে রান্না করা হয়েছিলো। আমি পেল্লায় সাইজের দু'টো মাছ খেয়ে ফেললাম। ঝাল ঝাল লইট্টা মাছের ভাজা টুকরাগুলোও জমজমাট হয়েছিলো। সেগুলো মুখে পুরে দিতেই রন্ধ্রে রন্ধ্রে সামুদ্রিক ঝাল ছড়িয়ে গলে যাচ্ছিলো। চোখ বন্ধ করে অনুভব করার মতো স্বাদ সে খাবারের। পাহাড়ে ঘুরাঘুরির জন্যই সম্ভবত সেদিন খিদেটা চেপেছিলোও ভীষণ। পাকস্থলীকে যতটা টাইট করে ফোলানো যায়, ফুলিয়ে নিলাম। নিয়ে গাড়িতে উঠে চোখ বন্ধ করে দিয়ে ফেললাম ১০ মিনিটের একটা ‘কুইকি’। সোজা বাংলায় ভাতঘুম।
১০ মিনিটের মাথায় লামা শহরে পৌঁছে যাওয়ায় ঘুমটাকে টেনে লম্বা করা গেল না। তাতে অবশ্য আমার কোনো আক্ষেপ ছিলো না। একটা টং দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে সবাই মিলে হইচই করে চা খেলাম। সেদিন হাটের দিন ছিলো। মার্মা মেয়েরা ওদের হাতে বোনা ঝুড়ি নিয়ে এসে রাস্তার দুই ধারে বসেছিলো। মুফতে ওদের তাঁতে বোনা থামি, ওড়না, বাঁশের চাটাইএর পাপোশ- এরকম আরো অনেক স্থানীয় সামগ্রীর প্রদর্শনী ঘুরে ঘুরে দেখার সুযোগ হয়ে গেল। তারপর আবার পথচলা।
শহর ছাড়িয়ে মাতামুহুরী নদী পেরিয়ে আমরা এগোতে থাকলাম মিয়ানমার সীমান্তের দিকে। গন্তব্য 'বোমের মুখ' নামের একটা গ্রাম। আমার মাতামুহুরী নদীটাকে ভালো লেগে গেল। নদীর দুই পাশে সমুদ্র সৈকতের মতো বিস্তৃত বালুচর। আমরা যে ব্রীজটার ওপর দিয়ে পার হলাম, সেখান থেকে দু'দিকেই অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। নদীতীরের বালুচরে জেলেরা জাল শুকোতে দিয়েছে। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে বালুর রংই বুঝি অমন কালো। কিন্তু পরে বুঝলাম বালুতে কালো রংএর জাল ফেলে রাখায় চোখ দু'টো ধোঁকা খেয়েছে। নদীর পাড়ে বাশ পুঁতে বেঁধে রাখা হয়েছে ডিঙিনৌকা। আমি ছবি-টবি আঁকতে পারি না তেমন। আঁকতে বসলে আমার হাত দিয়ে একটি ছবিই বেরোয় শুধু। সেটাতে দিগন্ত থেকে নেমে আসে একটা নদী। শেষ হয় কাগজের শেষ প্রান্তে গিয়ে। সেই নদীর দুই পাশে কিছু থাকে না। কেবল, কোনো এক বাঁকের মুখে একটা লম্বা করে পুঁতে রাখা বাঁশ আর তার সঙ্গে বেঁধে রাখা একটা ডিঙিনৌকা ছাড়া।
মাতামুহুরী পেরোনোর সময় আমার কল্পনার সেই ছবিটাকে হঠাৎ জীবন্ত চোখের সামনে ফুটে উঠতে দেখে শরীরে শিহরণ জাগলো। বাসের ভেতরে হই-চইরত পরিষদবর্গ সেটা টের পায় নি।
বোমের মুখে কিছু চাষী আমাদের জানালো তাদের স্বপ্নের কথা। স্বপ্নজয়ের কথা। কিভাবে দুর্গম পাহাড়ে বসতি স্থাপন করে আজ তারা স্বচ্ছল জীবনের দোরগোড়ায় পৌঁছেছে- সেসবের বৃত্তান্ত। আমি একটু তফাতে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, বিস্তীর্ণ পাহাড় কেটে বের করা হয়েছে আবাদী জমি। মানুষ প্রকৃতিকে সবসময় নিজের মতো ব্যবহার করেছে। প্রকৃতিও মা হয়ে সন্তানদের জন্য বিলিয়ে দিয়েছে নিজের সবকিছু। অথচ আমরা কয়জন তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে পেরেছি? অন্যদের কথা বাদ দিই। আমি নিজেই বা কতটুকু পেরেছি, প্রকৃতির প্রতি আমি কতখানি কৃতজ্ঞ তা বোঝাতে? মাঝে মাঝে মনে হয়, নিজের মা’কেও তো জানাতে পারি নি তাকে কতটা ভালবাসি; সারা পৃথিবীর মা’কে কিভাবে জানাবো? নিজের সীমিত ক্ষমতা আবারো আমাকে পীড়িত করে তোলে।
ঠিক সেই সময় পাশে এসে ফস করে একটা বেনসন লাইট ধরালেন খান ভাই। আমার দিকে ছুঁড়ে দিলেন একটা তীর্যক মন্তব্য, 'এতক্ষণ এমন একটা জায়গায় দাঁড়ায় আছেন আর একটাও বিড়ি জ্বালান নাই? হে ভগবান। হাউ আনরোম্যান্টিক!'
গ্রাম পরিদর্শন শেষে আবারো সেই সকালের রাস্তাগুলো ধরে ধরে ফিরে আসা। আবারো নিবিড় প্রকৃতির কোলের ভেতর ঢুকে যাওয়া। আশ্রয় নেয়া চিরশান্তির পরশবলয়ে। তবে খুব বেশি সময়ের জন্য না। যাওয়ার সময় একবেলা আর আসার সময় একবেলা- সেই দফায় সাকুল্যে আমার প্রকৃতির কোলে আশ্রয় নেয়া হয়েছিলো মাত্র এই দুই বেলা।
কক্সবাজার শহরে ফিরে আসতে আসতে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলো। লম্বা-সৈকতের আরামদায়ক বিছানা দেহ-মনকে টানছিলো খুব করে। কিন্তু খান ভাই ফরমান জারি করলেন, দ্রুত কাপড়-চোপড় ছেড়ে একটু হালকা হয়েই বের হয়ে আসার। বিছানায় গা এলিয়ে না দেয়ার। কেন সেটা খুলে বললেন না।
চটজলদি হালকা হয়ে বেরিয়ে এসে দেখি খান-আলী দুই ভাই ছাড়া দলের অন্যরা কেউ আশপাশে নেই। তারা গেছেন শুঁটকি কিনতে। অগত্যা কি আর করা! তিনজনে হোটেলের লবিতে বসে বসে মেয়ে দেখতে থাকলাম। সুন্দরী মেয়েদের আনাগোনা আমাদের মুগ্ধ করছিলো। ফাইভ স্টার হোটেল বলে কথা। সুন্দরী মেয়ে তো এ ধরনের হোটেলের একটা জরুরি অনুষঙ্গ।
আমি আর খান ভাই একটা মেয়েকে বেশ ক্ষাণিকক্ষণ চোখে চোখে রেখেছিলাম। পরে দেখলাম হোটেলের এক বিদেশি বোর্ডার তাকে টুপ করে পটিয়ে ধুমধাড়াক্কা আওয়াজ সম্বলিত ডিসকো সেন্টারের দিকে নিয়ে গেলো। ‘ধুর ভেতো বাঙালির আসলে কোনো কালেই কিছু হবে না’- এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে আমরা দু'জন মেয়ে দেখা বাদ দিলাম। অতিশয় সজ্জন আলী ভাই তখন লবি'র টেবিলে রাখা কোনো এক বিদেশি ম্যাগাজিন কোলে তুলে নিয়ে সেটার পাতায় ডুবে আছেন। আমাদের কীর্তি-কলাপের দিকে মনোযোগ নেই তার।
অপেক্ষার প্রলম্বিত প্রহর পার হলো শুঁটকি খাতকেরা ফিরে এলে। আমরা সবাই মিলে শহরের একমাত্র নিবন্ধিত বিদেশী পানীয়ের দোকানটিতে গেলাম। এটা স্থানীয় একটি বড় হোটেলের মধ্যেই অবস্থিত। দেখা গেল আমি আর খান ভাই ছাড়া আরেকজন আছেন যিনি কড়া পানীয় পানে আগ্রহী। অন্যরা মুখে কুলুপ এঁটেছেন। আমরা তিনজনে বাকীদের প্রচুর জবরদস্তি করলাম। কিন্তু খুব বেশি লাভ হলো না। তারা কেবলই খানিকটা করে ভাল্লুক পান করলেন। আমরা নিজেদের প্রসিদ্ধ ইওরোপীয়ান হুইস্কির পেগগুলো শেষ করে তাদের অবশিষ্টাংশগুলোও নষ্ট করা উচিত হবে না মনে করে, সেগুলো গলধঃকরণ করে ফেললাম। এই পানাহার যজ্ঞের নেতৃত্বেও ছিলেন যথারীতি ম্যান অন ফায়ার-ওয়ান’ন ওনলি খান ভাই। আমরা পান শেষে পউষী নামের এক ভাতের হোটেলে গিয়ে হামলা চালালাম। সেখানে মেন্যু ছিলো অজস্র রকমে সামুদ্রিক মাছ, শুঁটকি, ঝাল ঝাল সালাদ এবং আরো অনেক কিছু। আমরা কে যে কত পরিমাণে খেলাম তার কোনো ইয়ত্তা ছিলো না। আমি অবশ্য ভাত খেলাম না। কেন যেন পান করার পর ভাত খেতে ইচ্ছে করে না।
তারপরে গেলাম সমুদ্র সৈকতে। আটচল্লিশ ঘন্টার টানা দৌঁড়-ঝাপ সেরে আমরা তখন কেবল একটু নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পেয়েছি। আগের দিন রাতেও বার্মিজ মার্কেট থেকে ফিরে বসেছিলাম তিন তাসের জুয়ায়। সারারাত তাস পিটিয়ে ভোরে বিছানায় গিয়ে শোয়ার পর, যেই না ঝিমুনিটা একটু ভালোমতো ধরেছে; অমনি সারারাত দান মেরে যাওয়া খান ভাই সবাইকে টেনে টেনে মাইক্রোতে পুরেছিলেন, পাহাড়ে যাবেন বলে। তার বোধহয় পাঁচ অংকের লাভ হয়ে গিয়েছিলো ওই এক রাতের জুয়াতেই।
সৈকতে ফেলে রাখা ছাউনিগুলোতে শরীর এলিয়ে দিয়ে নিজেকে খানিকটা পরিশ্রান্ত মনে হচ্ছিলো। আমরা তখন শুরু করলাম সবাই মিলে হেঁড়ে গলায় গান গেয়ে যাওয়া। আর সঙ্গে ছিলো অফুরন্ত সিগারেট। একের পর এক ধরাচ্ছিলাম। বার থেকে বের হয়ে আসার আগে কেনা স্কচের বোতলটা হাতে হাতে ঘুরছিলো। যারা বারে বসে এ জিনিস মুখে তোলেন নি, তারাও দেখলাম লাজুক লাজুকভাবে দু’এক চুমুক দিচ্ছিলেন। প্রথম দিকে বোধহয় জন ডেনভার, কনওয়ে টুইটি, হুটার, ব্রায়ান অ্যাডামস্ ইত্যাদির কলি আওড়ানো হচ্ছিলো। শেষে দেখা গেলো তাতে সবার কমন পড়ে না। বরং সুমন-অঞ্জন-নচিকেতা শুরু হওয়ায় সবাই প্রাণখুলে গাইতে শুরু করলো ভুল সুরে ভুল কথায় নানা জাতের গান। রুনা লায়লা, আলমগীর, কনকচাঁপাদের গানও খুব গাইলাম। কেউ কেউ নিজের স্টক থেকে স্পেশাল গান শোনালো। খান ভাই গোটা দুই শ্লীলতা পরিপন্থী আঞ্চলিক গান পরিবেশন করে যখন পুরো এলাকাটাকে গরম করে তুললেন, তখন রাত বেজেছে আড়াইটা। আস্তে আস্তে কমে আসতে থাকলো প্রত্যেকের গলার জোর। হাঁটি হাঁটি পা পা করে কেউ কেউ এগিয়ে গেলেন হোটেলের পথে।
আমি শুয়েছিলাম ছাউনির নিচেই। উঠতে ইচ্ছে করছিলো না। শুয়ে শুয়ে সৈকতে ঢেউএর আছড়ে পড়া দেখতে ভালো লাগছিলো। ঢেউএর ফেনাগুলোতে মনে হয় কোনো রাসায়নিক দ্রব্য মিশে থাকে। নাহলে নিশ্ছিদ্র অন্ধকারেও ওদেরকে এক উজ্জল দেখায় কেন? রাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ওপরে উঠছিলো সমুদ্রসঙ্গীতের তাল। একসময় খেয়াল হলো আর কিছুক্ষণ পরেই উঁকি দেবেন সূর্য্যিমামা। তিনি এসে আমাকে এমন আলুথালু অবস্থায় দেখে ফেলার আগেই কেটে পড়াটা ভালো হবে বলে মনে হলো। হোটেলে ফিরে গেলাম অল্প পরিচিত সৈকত ঘেঁষা রাস্তাটি ধরে ধরে। রুমে ঢুকে স্যান্ডেল ছাড়া আর কোনোকিছুই খুলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না। তবুও একটা নতুন সিগারেটের প্যাকেট খুললাম। সেখান থেকে একটা শলাকা বের করে তাতে অগ্নিসংযোগ করে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমাতে ঘুমাতে আধখানা সিগারেট খেয়েছিলাম। পরদিন অ্যাশ-ট্রে’তে পড়ে থাকতে দেখেছিলাম বাকী আধখানা অংশকে।
পরদিন দুপুরে রওনা দিয়ে বিকালে যখন ঢাকায় পৌঁছাই, তখন মাত্র দু'দিনেই হৃদয়ের বন্ধু হয়ে যাওয়া আলী আর খান ভাইয়ের জন্য খারাপ লাগছিলো কিছুটা।
তারপর কয়েকবার ফোনে কথা হওয়া ছাড়া আর তেমন কিছুই হয় নি সেই বন্ধুদের সঙ্গে। সেদিন সন্ধ্যায় ‘কেন আজ কোথাও বেশিক্ষণ বসতে পারছি না’ ভাবতে ভাবতে ক্যম্পাস এলাকা পেরিয়ে কখন যে হোটেল রূপসী বাংলার সামনের সিগন্যালে এসে আটকে পড়েছি খেয়াল করি নি। হঠাৎ রাস্তা দিয়ে ঝট করে পার হয়ে যেতে দেখলাম পরিচিত এক গুঁফে ভদ্রলোককে। আরে এ যে খান ভাই! কিন্তু পদব্রজে কেন? এয়ারপোর্ট থেকে যতদূর মনে পড়ে, একটা প্রাদো’তে চড়ে বিদায় নিয়েছিলেন ভদ্রলোক।
(চলবে)
---
এত দিন পরে?
এই পর্বটা পড়ে বান্দরবন-কক্সবাজার যাওয়ার ইচ্ছাটা প্রবল হলো আরো।
শুধু বান্দরবান-কক্সবাজার যাইতেই ইচ্ছা হইলো? আর কিছুই হইলো না??
এ মজার সময় কাটাতে পারব কিনা তা তো জানিনা, তাই ইচ্ছাগুলোও হিসেবি।
আমি বলতেসিলাম লেখাটার কথা। একটা লেখা পড়ে আপনের শুধু দুইটা জায়গায় যাইতে ইচ্ছা করলো। লেখাটা কেমন হইসে বা কি সমাচার, সেই সব কিছু বলতেই ইচ্ছা হইলো না। দুক্ষে-কষ্টে আমার চৌক্ষে পানি আয়া পর্লো রে ভাই
আমি পড়তেছি। আলাদা আলাদা করে সবগুলাই ভালো লাগতেছে।
শুনেন, একটা গল্প/ বর্ণনা পড়ে কারো যদি সেটা কল্পনা করতে অথবা সেইরকম কিছু করার ইচ্ছা জাগে তার মানে কি এটা ভালোলাগা থেকে তৈরী হওয়া নয়?
থাক। দিলে দাগা দিয়ে পরে ড্যামেজ কন্ট্রোল করে কি লাভ?
কেন জানি লোকজন আমার কথাকে গুরুত্ব দেয় না। কোপাল
কোপাল্রে দুষ দিয়া আর কি লাভ। তারচে' চলেন খেলি
আগেরগুলো পড়ে আসি
শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করি...
আচ্ছা। আমিও করি...
আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছে এই লাইনগুলো,
বাবা-মা'র প্রতি আপনার বিশেষ টান রয়েছে। আপনার লেখা পড়লেও বোঝা যায়; আবার এই এত বড় লেখা থেকে যে অংশটা আপনি কোট করেছেন, সেটা দেখলেও বোঝা যায়।
ভালো থাকেন। বাবা-মা'র সঙ্গে সুখী জীবন দীর্ঘায়িত হোক।
চলুক
আরে শাতিল ভাই যে, আপনে কেমন আছেন?
যাক মীর ভাইয়ের পোস্টের কল্যানে শাতিল্রে দেখা গেল
পোস্ট কিন্তু নিয়মিত পড়ি.... জনাইয়া গেলাম
আমি জানি যে আপনি নিয়মিত আমার পোস্ট পড়েন। আপনে হচ্ছেন গিয়া এবি ব্লগের কাপ্তান। ব্লগারদের পোস্ট আপনে না পড়লে কেমনে হপে?
শুধু নিবন্ধিত দোকানের পানাহার ছাড়া প্রায় সবগুলো জায়গাতেই আমার পদচারনা ছিল এবং এখনো মাঝে-মধ্যে হয়। পড়ছিলাম... আসলে পড়ছিলাম না, আপনাদের সাথে ঘুরছিলাম... এরকম জলজ্যান্ত লেখা আপনার কি-বোর্ড থেকেই বেরুনো সম্ভব ...। এ পর্বটা অন্য পর্বের চেয়ে একটু আলাদা ধরনের ভাল লেগেছে... হয়ত জায়গাগুলো ইঞ্চি ইঞ্চি চিনি বলেই... কিংবা হয়ত শুধুমাত্র আপনার লেখনির গুনে...
কনফ্যূশনে থাইকেন্না বস্। ইঞ্চি ইঞ্চি চিনেন বলেই আলাদাভাবে ভালো লাগছে। আমি নিশ্চিত..
আর ইয়ে পানাহারে দোকানে আপনে বিচরণ করেন নাই?? আয়হায় তাইলে তো এরপরের পর্বে আপনে ঢুকতেই পার্বেন্না।
মুগ্ধপাঠ!
থ্যাংকুশ আপুমনি। আপনে কই ছিলেন এ কয়দিন? আপনাকে অনেকানেক প্রচুর লট অভ মিসাইসি। থ্যাংকুশ ভ্রি ভ্রি ভ্রি সো মাচ্ দেখা দেয়ার লাগি।
মন্তব্য করুন