একা একা বৃষ্টিতে ভেজার গল্প
১.
রাত্র বাজে তিনটা। প্রায় ঘন্টা দেড়েক বিছানা-বালিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তির পর, এই খানিক আগে ক্ষ্যান্ত দিয়েছি। হবে না আজ রাতে আর। ভাবলাম এরকম ভিন্ন একটা সময়ে কিছু লেখার চেষ্টা করলে সেটা কেমন দাঁড়ায় দেখা যাক।
২.
ঢাকা শহরে আমার সবচেয়ে প্রিয় রাস্তা ছিল গুলশান-২ নম্বর থেকে কূটনৈতিক পাড়ার দিকে চলে যাওয়া শুনশান রাস্তাটা। অফিস যাওয়ার পথে ওই রাস্তাটাই সাধারণত ব্যবহার করতাম। একটা চায়ের দোকান ছিল, রাস্তার মাঝামাঝি পর্যায়ে। ওরকম বড়লোকী এলাকায় ছোট্ট চায়ের টঙ দেখলে কার না চা পানের ইচ্ছে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আমি যেদিনই ওই রাস্তাটা দিয়ে অফিসে যেতাম, সেদিনই ওখানে একটা টি-ব্রেক নিতাম।
চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বসে ভাবার জন্য যতগুলো ভাবনা আছে, তারমধ্যে আমি সবচেয়ে পছন্দ করি ঝুম বৃষ্টিতে একা একা ভেজার ভাবনাটা। এমন যদি হতো, কোনো একদিন বৃষ্টি নামতে দেখে আমি স্যান্ডেল পায়ে গলিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। হেঁটে বেইলী রোড পার হয়ে অফিসার্স ক্লাবের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রাস্তার উল্টাদিকের বিলবোর্ডটার দিকে একবার তাকালাম। ওই বিলবোর্ডটাতে সবসময় দারুণ সব বিজ্ঞাপন থাকে। বিলবোর্ড দেখা শেষে ডিবি অফিস, মিন্টু রোড, রমনা পার্ক, রূপসী বাংলা হোটেল, শাহবাগ, ছবির হাট রুট ধরে হেঁটে এক সময় পৌঁছে গেলাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।
হয়তো মিন্টু রোডের ফুটপাথে ঝুম বৃষ্টিতে একটা ছেলেকে একা একা হাঁটতে দেখে কোনো এক নাম না জানা তরুণী ভেজার জন্য রিকশা ছেড়ে দিতো। তারপর দ্রুত পায়ে হেঁটে ছেলেটাকে ধরে ফেলতো পেছন থেকে। পাশাপাশি হাটঁতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করতো, অ্যাই ছেলে, এইভাবে বৃষ্টিতে ভিজছো যে, জ্বর-সর্দি-মাথাব্যাথার ভয় করে না?
আমি তখন উত্তর দিতাম, ঝুম বৃষ্টিতে ভিজলে কখনও সর্দি কিংবা মাথাব্যাথা হয় না। জ্বর হয়, তবে জ্বর অনেক দারুণ একটা অসুখ। সম্ভবত আমার সবচেয়ে প্রিয় অসুখ। আমি জ্বরকে একটুও ভয় পাই না।
মেয়েটি হয়তো বলতো, অসুখ আবার কারও প্রিয় হয় নাকি?
আমি বলতাম, হয় তো। প্রবল জ্বরের সময় একটা ভীষণ ঘোর তৈরি হয় মাথার ভেতর। মনে হয় সময় থেকে আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি। তাই আমার কথা পৃথিবীর কারও কাছে পৌঁছাচ্ছে না। সেই সময়টাকে আমি খুব এনজয় করি। মন খুলে নিজের সব কথা বলতে থাকি। কারণ আমি জানি সে সময় আমি আসলে কিছু বলি না। তবে ব্রেনে সিগন্যাল যায় যে, আমি অনেক কথা বলছি।
মেয়েটি বলতো, তুমি কি জ্বর হওয়ার জন্যই বৃষ্টিতে ভিজছো?
আমি বলতাম, আজ সকাল থেকে মেঘের ঘনঘটা দেখেই মনে হচ্ছিল আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি পড়তে যাচ্ছে। এমন একটা চমৎকার ঘটনাকে তো কোনমতেই ব্যর্থ হতে দেয়া যায় না, তাই মেঘের প্রথম ডাকটা শুনে আমি ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছি।
-আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি পড়াটা কিভাবে একটা চমৎকার ঘটনা হলো? সব রাস্তাঘাট ডুবে যাচ্ছে। একটা কোনো বাস, সিএনজি, রিকশা পাওয়া যাচ্ছে না। মানুষের কত্তো সমস্যা হচ্ছে। আর তুমি বলছো এটা একটা চমৎকার ঘটনা?
-রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ার দায় তো আকাশের নয়। এই বৃষ্টির জন্যই গ্রামে গ্রামে ধানক্ষেতের মাটি চিড়ে অঙ্কুর উঁকি দিচ্ছে। নদীর মাছদের মনে আনন্দের বান ডেকেছে। গাছের পাতারা খুশিতে নেচে উঠেছে। এ ব্যাপারগুলো যদি না ঘটতো, তাহলে ওই শহুরে সমস্যাগ্রস্থ মানুষেরা সুখে-শান্তিতে নিজেদের সমস্যার সাথে সংসার করতে পারতো বলে মনে করো?
-তুমি কি কবি নাকি? "নদীর মাছদের মনে আনন্দের বান ডেকেছে"- এভাবে কেউ এই শহরে কথা বলে?
-নাহ্ আমি কবি নই। হলে আরও সুন্দর করে ছবিটা ফুটিয়ে তুলতে পারতাম। আচ্ছা বলো, তুমি কেন হুট করে রিকশা ছেড়ে দিয়ে ভিজতে নেমেছো?
-তুমি দেখেছো নাকি? আসলে অনেক দূর থেকে তোমাকে বৃষ্টিতে ভিজতে দেখছিলাম, আর মনে মনে লোভ জাগছিল। আবার ভয়ও হচ্ছিল, এ শহর মেয়েদের জন্য একবিন্দুও নিরাপদ নয়। মনে হচ্ছিল, যে তোমাকে দেখে আমি বৃষ্টিতে ভিজতে নামবো, সে তুমিই পরে আমার বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এইসব অনেক রকম চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে দীর্ঘ লড়াই শেষে যখন বৃষ্টিতে ভেজার লোভটাই জিতে গেল, তখন দেখলাম আমি রিকশার ভাড়া মিটিয়ে মধ্যরাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি।
-সুপার! আসলে তোমার লোভ জয়ী হয় নি। জয়ী হয়েছে সাহস।
-কি জানি। হবে হয়তো। আমি ছেলেবেলা থেকেই এমন। যেটা করতে ইচ্ছে হয়েছে, সেটা করার একটা অজুহাত ঠিকই বের করে নিই, কোনো না কোনো ভাবে। এজন্য কম ঝামেলায় পড়তে হয় নি জীবনে। তবে সামলে উঠেছি সবসময়ই। আর ঝামেলাদেরকে মনে হয় আমার ভালও লাগে। কারণ যখন একটা ঝামেলার মধ্যে থাকি, তখন অনেক দুশ্চিন্তা হয়, অস্থির লাগে এবং উল্টা-পাল্টা অনেক কিছু করি ঠিকই; তবে যখন ঝামেলাটা পার হয়ে যায়, তখন অনেক হাসি পায় আর মজা লাগে। সামান্য একটা ঝামেলাকে কতই না বড় করে দেখেছিলাম- এরকম মনে হয়। এইটাও একটা কারণ, যা ইচ্ছা তাই করার। তবে আমি মানুষকে কষ্ট দিতে একদমই পছন্দ করি না। তুমি কি মানুষকে কষ্ট দিতে পছন্দ করো?
বলে মেয়েটি কেন যে বড় বড় চোখ তুলে আমার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল সেই বলতে পারবে! অমন টানা টানা গভীর কালো চোখে প্রশ্ন নিয়ে কোন ছেলের পানে যখন কোন মেয়ে তাকায়, তখন ছেলেদের বুকে যে একসঙ্গে কতগুলো দামামা বেজে ওঠে; তা কি মেয়েরা জানে?
যাহোক আলোচনার সেই পর্যায়ে আমরা দু'জন হাঁটতে হাঁটতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান তথা উবায়েদ ভাইয়ের দোকানের সামনে পৌঁছে গিয়েছিলাম। বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য উনি দোকানের ওপর তেরপল লাগিয়েছেন। তার নিচে বেশ বড়সড় একটা ভিড় জমেছে। আমি ভিড় ঠেলেঠুলে উবায়েদ ভাইয়ের কাছাকাছি পৌঁছে যাবার পর মনে পড়লো, মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করা হয় নি, সে চা পান করতে চায় কিনা। দেখলাম ভিড়ের ভেতর সে ঢোকে নি, তবে দূরে থেকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
ইশারায় জানতে চাইলাম, চায়ের কথা। মাথা নেড়ে সায় দিলো। দুই কাপ চা হাতে ভিড় থেকে একটু সরে আমরা দু'জন মুখোমুখি দাঁড়ালাম। তেরপলের বাইরেই দাঁড়ানো যেত, তবে বৃষ্টির কারণে চা'টা মুহূর্তের মধ্যে ঠান্ডা হয়ে যেত বলে চা পান পর্ব তেরপলের নিচেই সারার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল।
চায়ের কাপে প্রথম চুমুকটি দিয়ে মেয়েটির শেষ প্রশ্নের উত্তরে বলি, আসলে মানুষকে কষ্ট দিতে চাই না আমিও, তবে বিষয়টা অনেক সময় এত বড় হয়ে যায় যে সেটা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা মানুষের থাকে না। সেরকম পরিস্থিতিগুলোতে না চাওয়া সত্বেও মানুষকে কষ্ট দেয়া হয়েই যায়।
-হ্যাঁ, সেই পরিস্থিতিগুলো আসলেই বিপজ্জনক। আমি ওই ধরনের সিচুয়েশনকে হেইট করি।
-আমিও হেইট করি।
বলে মেয়েটির চোখে চোখ পড়তেই মনে হলো, আমাদের এই মিলটা সে লক্ষ্য করেছে এবং খুশি হয়েছে। অনেকেই কথা বলার সময় অন্যরা কি বলছে, সেটা খেয়ালই করে না। শুধু নিজেই বলতে চায়। এই মেয়েটি সেই অনেকের মতো না। দেখে ভাল লাগলো। বাম হাতটা উঁচু করে বললাম, হাই ফাইভ।
আমার সাথে হাই ফাইভ করে সে হেসে বললো, তোমার সাথে কথা বলে ভালো লাগলো। কি নাম তোমার?
-বৃত্ত। তোমার?
-বৃষ্টি।
-তাই নাকি? দারুণ তো। আজ তাহলে বৃষ্টির সাথেই বৃষ্টিতে ভেজা হলো।
-হ্যাঁ, আরও মজা কি দেখেছো? আমাদের দু'জনের নামই শুরু হয়েছে বৃ দিয়ে।
-হুম। বৃষ্টি আর বৃত্ত। বৃত্ত আর বৃষ্টি। ভালোই।
-আচ্ছা, আমি চলি এখন। বৃষ্টি থেমেছে। দেখি শেষতক অফিসে পৌঁছানো যায় কিনা।
-আচ্ছা। আবার কোনো এক ঝুম বৃষ্টিতে দেখা হবে। আজকেই মতোই হুট করে।
শুনে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে মেয়েটি চলে গেল।
৩.
মেয়েটি চলে যেতেই আমার ভাবনার ডালপালারা গুটিয়ে আসে। ততক্ষণে হাতের কাপও শূন্য হয়ে গিয়েছে। আমি তাই ধীরপায়ে উঠে কাপটা দোকানীর কাছে ফিরিয়ে দিই। পয়সা মিটিয়ে ফিরে যাই আমার মোটরসাইকেলের কাছে। গুলশান থেকে আমার অফিস বেশি দূরে না। সেই সংক্ষিপ্ত পথটুকু পাড়ি দিতে দিতে ভাবি, ভাবনাটা সত্য হলে মন্দ হতো না।
---
লেখাটা আজকের বার্থডে বয় বর্ণকে উৎসর্গিত। ভাল থাকেন, হাসিখুশি থাকেন। শুভেচ্ছা নিরন্তর
প্রথম লাইনটা পড়ে মাথায দুষ্টামী বুদ্ধিটা জাগে... " রাত্র বাজে তিনটা। প্রায় ঘন্টা দেড়েক বিছানা-বালিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তির পর, এই খানিক আগে ক্ষ্যান্ত দিয়েছি। হবে না আজ রাতে আর । "
পুরোটা পড়ে মনটা দারুন ভালো লাগায় ভরে গেলো। এমন কল্পনা করা আপনার পক্ষেই মানায়... দারুন। চমৎকার। ধন্যবাদ ব্রাদার
আপনে বলে দেয়ার পর দুষ্টুমী বুদ্ধিটা আমার মাথায় ট্রান্সফার হয়ে গেছে
থ্যাংকস্, আপনাদের ভাললাগাই আমার লেখালেখির অপচেষ্টার একমাত্র জ্বালানি।
কি ভাবে এত্তো কল্পনার রং ছড়াতে পারেন?!! মাঝে মাঝে অবাক হই!! ভালো থাকেন, আনন্দে থাকেন।
খুব বেশি রং ছড়াতে পারি নি, তারপরও আপনে উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় ভাসিয়ে দিলেন। এইটাই মনে হয় কারণ
থ্যাংকিউ উচ্ছল ভাই।
চমৎকার এই গিফটের জন্য অনেকগুলি ধইন্যাপাতা।
আমি অবশ্য ঝুম বৃষ্টিতে গ্লাসভর্তি গরম চা আকাশের নিচে দাড়িয়ে হাতের আড়ালে সামলেসুমলে খেতেই বেশি ভালোবাসি। ^_^
আপনের ভাল লাগলেই পোস্ট সার্থক। জন্মদিনে কি কি করলেন সবিস্তারে লিখবেন আশা করি। আবারও শুভকামনা
একটা কলম, একটা টিশার্ট, কিছু চমৎকার উইশ। দুইটা 'ডেডিকেটেড টু মি' ব্লগ পোষ্ট, একখানা জরজিয়াস কফি কাপ সেট। দিনের শেষে হুটহাট কেক্কুক আর সন্ধ্যা রাতের সারপ্রাইজ ফ্রি চা। আর আরো কিছু পেন্ডিং গিফটো প্রাপ্তির সম্ভাবনা!
নট ব্যাড, নট ব্যাড; নট ব্যাড এট অল!!
*এই ছিল আমার দিন, আর কিছু মাথায় আসে নাই।
নট ব্যাড ওনলি???
আমি হইলে তো এটাকে আমার ফেভারিট বার্থ ডে হিসেবে ঘোষণা দিতাম
তুষারপাতের মাঝে আইসক্রিম খেয়েছি কিন্তু ঝুম বৃষ্টিতে চা খাওয়া হয়নি
হয়ে যাবে একদিন। টেনশন নিয়েন্না
হ্যাপি বার্থ ডে বর্ণ
লেখা অসাধারন হয়েছে
ধইন্যা, তানবীরা'পু।
থ্যাংকিউ তানবীরা'প্পু
চেষ্টার ফল যে আমাদের জন্য বেশ সুখকর হলো তা তো স্পষ্ট। ভালো , ভা্লো..।
বার্থ ডে বয় বর্ণকে লেট বার্থ ডে শুভেচ্ছা...।
হাহাহা ধন্যবাদ ঝর্ণাপু
মন্তব্য করুন