জাগতিক
লিটনের পজিটিভ দিক ছিল মাত্র একটা। সেটা হলো যেকোন নেশা থেকে মুক্ত হতে তার সময় লাগে না।
হয়তো কোন নেশা তাকে বশ করতে পারতো না বলেই। মাদক যতো না আগ্রাসী হয়ে তার দিকে এগুতো, সে তার চেয়ে বেশি মোটিভেশন নিয়ে মাদকের দিকে এগোতো। তাই দেখে মাদকেরা কি ভয়ই পেতো কি না কে জানে, কিন্তু কখনো মাদক না পেয়ে শরীর জুড়ে খিঁচুনি ওঠা, বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে নিজেকে ও পরিবারকে বিব্রত করার মতো ঘটনা লিটনের দ্বারা কখনও ঘটে নি। এছাড়া ছেলেটার আর তেমন কোনো পজিটিভ দিক ছিল না। না সে ছিল ভাল ছাত্র, না উঁচুদরের মাস্তান, না ছাত্রনেতা, না উঁচুমানের সুবিধাভোগী। বাদশাহ হুমায়ূনের যে পজিটিভ দিকটা সর্বোত্তম, সেটা হচ্ছে- মানুষের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা। বীরভূমের নোকরা গ্রামের লছমি বাই জীবনে একবারের জন্য হুমায়ূনের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন। একবেলা তার সেবা করেছিলেন। তিনি প্রথমে হুমায়ূনকে না চিনে তাকে পাগলও ঠাউরেছিলেন। অথচ সেই লছমি বাইকে যখন বলা হলো, যদি হুমায়ূন কোন পথে পালিয়েছে না বলো তাহলে তোমাকে হত্যা করা হবে; তখনও লছমি বাই হুমায়ূনে কোন পথে পালিয়েছে তা সেনাপতিকে বলেন নি। একজন মানুষের সাথে একবার মাত্র সাক্ষাতের মাধ্যমে তাকে এতোটা প্রভাবিত করে ফেলা, আসলে বাদশাহ হুমায়ূনদের পক্ষেই সম্ভব।
হিলিতে মোটর বাইকে চড়ে ঝটিকা অভিযানে যাওয়ার ঘটনাটা, লিটনের স্মৃতি সংগ্রহশালায় একটা কালো হীরা হয়ে আছে। তবে সেটা ছিল বগুড়া ভ্রমনের একটা সাইড স্টোরি মাত্র। এমন অনেক গুলো সাইড স্টোডি আর একটা বা দুইটা মেইন স্টোরি দিয়ে, একটা স্পেশাল সাপ্লিমেন্ট বের করা যায়। তবে সে সাপ্লিমেন্টটা হতে হবে ডেথ স্টারের কোনো একটা পত্রিকার জন্য। লাইট সাইডের গ্রহগুলোর সংবাদপত্রে এ ধরনের ডার্ক ঘটনাক্রমের উল্লেখ না থাকাই উত্তম।
ঢাকার ফেন্সি'র সমস্যা ছিল মূলত দু'টো। প্রথমত অত্যন্ত উচ্চমূল্য আর দ্বিতীয়ত নিম্ন কোয়ালিটি। বগুড়া বর্ডার এলাকা থেকে তুলনামূলক কাছে হওয়ায় এ দু'টো সমস্যার কোনটাই সেখানে ছিল না। আরও ছিল প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে এবং প্রায় অবিকৃত অবস্থায় উপভোগ অবারিত সুযোগ। ঢাকার সমস্যার ঘরে এই পয়েন্টটাও যোগ করা যায়। সেখানে আধ বোতল নকল ফেন্সিডিল সেবন করার পরও যদি 'পোস্ট-বাজ শো' ভাল হতো, তাও একটা কথা ছিল। টং চায়ের দোকানে বসে জ্বাল দেয়া গরুর দুধের চা আর ধূম্রশলাকা ধ্বংস করা ছাড়া, পরে আর বেশি কিছু করার ছিল না সেখানে।
সেই দিক থেকে বগুড়া ছিল এগিয়ে। বন্ধু তপনের সাথে মহাস্থান গড় এলাকায় গিয়ে দুইজন দুইটা বোতল অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সাবাড় করে দেয়ার পর, গ্রামের মেঠোপথ ধরে হেঁটে হেঁটে ফেরা শুরু হওয়ার সাথে সাথে মস্তিষ্কে শুরু হয়ে যেতো শরীরে ছড়িয়ে পড়া অনিয়মিত পরিমাণের কেমিকেলের প্রতিক্রিয়া। হঠাৎ যেনো এক জগৎ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন আরেক জগতে ঢুকে যাওয়া। দি রিং মুভির ভিডিও ক্যাসেটটার মতো। ভিসিআর-এ চালিয়ে দেয়ার সাথে সাথে যেটার ভেতর থেকে উঠে আসে এক অন্যজগৎ।
মহাস্থানের পুরো এলাকা গ্রামাঞ্চল হওয়ায় বেশিরভাগ রাস্তাই থাকতো অন্ধকারাচ্ছন্ন। আর উঁচু-নিচু। ওই অঞ্চলের ভূমি বহুদিন পূর্বে গঠিত বলেই কিনা কে জানে, সেখানকার মাটির এক অন্য রকমের জোর। পা ফেললে মাটিও যেন উল্টোদিক থেকে ধাক্কা দেয়। জানান দিতে চায় নিজের বৈশিষ্ট্য।
আর হেঁটে হেঁটে গড়ের কোনো দেয়ালের ওপর গিয়ে পা দুলিয়ে বসে আশপাশে তাকালে, সে যতো অন্ধকার রাতই হোক না কেন; চোখে এক অনন্য সুন্দর দৃশ্য ধরা পড়ে। হয়তো অতোটা ডার্কনেস কেউ কেউ নিজের জীবনে নিতে চাইবে না; তবে মহাস্থান গড়ের দেয়ালে বসে পূর্ণচন্দ্রে আলোকিত নিচু চরাচর দেখতে দেখতে রাতজাগা ডাহুকের ডাকে মন্ত্রাহত হয়ে পড়া যুবকদের আমি দেখেছি। তারা ওয়াকিং ডেডদের মতোই দুলে দুলে রাস্তায় হাঁটে।
তপনের কাজ ছিল মূলত ফেন্সি বিক্রেতার সাথে যোগাযোগ করা। বেশির ভাগ সময় বাহন ছিল মোটর বাইক। এক সকালে তাতে চেপেই ওরা রওনা হয়েছিল হিলির পথে। উদ্দেশ্য অবৈধভাবে বর্ডার ক্রস করে ভারতে ঢুকে ফান্টু খেয়ে আসা। ছেলেমহলে জিনিসটার নাম সামান্য পাল্টে ডাকা হতো ফান্টু। যদিও তার খুব বেশি দরকার ছিল না। ছেলে-বুড়ো সবাই-ই জানে কিংবা শুনলে বুঝতে পারে, কিসের কথা বলা হচ্ছে।
মোটর বাইক যন্ত্রটা অসামান্য। লিটনের ছিল একটা শহুরে মোটর বাইক জীবন। শহুরে মোটর বাইক জীবন হলো একটা জীবন যার সাথে জড়িয়ে থাকে একটা মোটর বাইক আর একটা ব্যস্ত শহর। দুইটা মাত্রা। মোটর বাইকের প্রধান শাখা মাত্রা হতে পারে যান্ত্রিক সুবিধা। যেমন, মোটর বাইক থাকলে কোথাও যাওয়ার জন্য খুব বেশি কিছু মুখোমুখি হতে হয় না। মধ্যবিত্ত হলে এই সাব-ক্যাটেগরিটা বুঝতে একটু সুবিধা হয়। সকালে বাসা থেকে বের হয়ে রিকশা পাওয়া, যদি সেটা হয় যাত্রাবাড়ী মোড় পেরিয়ে কাজলা ব্রীজের মতো একটা হাইওয়ে সংযোগ রোডের মাঝামাঝি কোনো একটা জায়গা থেকে, তাহলে বিষয়টার সাথে জীবনের ঝুঁকিও যোগ হয়ে যায়। সে সময় সাথে একটা যন্ত্র থাকা মানে, লড়াইয়ের সুযোগ সব সময়ই বেড়ে যাওয়া।
ব্যস্ত শহরের অসংখ্য সাব-ক্যটেগরি আছে। এই লেখাটা সেইসব ক্যটেগরির ব্যাখ্যা দাবি করে কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত ছিল না লেখক। আর ঠিক সে সময় লিটন তাকিয়ে ছিল- নাম না জানা এক গ্রামের মধ্য দিয়ে চলে যাওয়া হাইওয়ের পিচ কার্পেটিং এর দিকে। অনেক ক্ষণ ধরে। চোখের ক্যামেরার শাটার খোলা আর বাইকের তীব্র গতি, সুযোগটা কাজে লাগিয়ে একটা স্থিরচিত্রকে রুপ দিচ্ছিলো চলচ্চিত্রে। লিটন ভাবছিল শুধু যদি মানুষের চোখে একটা রেকর্ডিং এর প্লাগ ইন থাকতো, আর যদি থাকতো পরে সেই ফাইলটা সেভ করে রাখার জন্য ব্রেইনে পাঠানোর কোনো ব্যবস্থা! তাহলে মানুষ তার মাথাতেই বানিয়ে ফেলতে পারতো সিনেমা। একটা দৃশ্যের সাথে আরেকটা দৃশ্য জোড়া দিয়ে।
হিলি যাওয়ার দিন সকালে মোটরবাইক নিয়ে বের হয়ে প্রথম যে কাজটা করা হয়েছিল সেটা হচ্ছে এক হাজার টাকার তেল উত্তোলন। তারপর তিনজন তিনটি হেলমেট মাথায় চাপিয়ে ওরা বেরিয়ে পড়েছিল রাস্তায়। কানের হেডফোনগুলোতে চলছিল রকমারি গান। লিটন শুনছিল কড়া বাংলা লোকগীতি, বাউল শীতালং শাহের সুয়া উড়িলো রে। আর তপন শুনছিল পশ্চিম বঙ্গীয় বিহারি লোকসঙ্গীত। বিষয়টা ছিল, অনেকটা নিজেদেরকে অটো মোডে সেট করে দেয়ার মতো। এরপর শুধু মটর সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে রাস্তার দিকে শ্যোন দৃষ্টি দিয়ে বসে থাকা। গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার বাকি কাজটা করেছিল ইঞ্জিন।
আর ইন্দ্রিয়ের সব জাগতিক সুখ নিশ্চিত করেছিল প্রকৃতি। আকাশ, সূর্য্য, মাটি, রোদ, ছায়া, উড়ে যাওয়া বকপাখি, পেতে রাখা মাছ ধরার জাল, ধানের গোড়াসহ ফেলে রাখা উজ্জল হলুদ রঙা মাঠ। একরের পর একর জুড়ে বিরাজমান ঘন সবুজ দিগন্ত, সামনের দিক থেকে আসা একটা সার্বক্ষণিক বাতাসের চাপ, আর ভেতরকার একটা আকুল হাঁসফাঁস, যেটার কারণ জানা যায় নি শত চেষ্টায়ও; সবকিছু একসাথে, নিশ্চিত করেছিল ভিন্ন জগতের গড়া ওঠা।
ভারত সীমান্ত পার হওয়াটা সম্পন্ন হয়েছিল স্থানীয় এক যুবকের সহযোগিতায়। তাকে বোধহয় কোনো টাকাও দেয়া হয় নি। অন্য কোনো বিষয় ছিল, যেটা সচেতনভাবে এড়িয়েছিল লিটন। কাজের ক্ষেত্রে ওকে এ ধরনের ঘটনা দেখলেই, সজাগ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে হতো। তাই যেখানেই প্রফেশন-অ্যালার্ট দেখছিল, সেখান থেকেই দূরে থাকছিল ছেলেটা।
ভারতে ঢুকে প্রথম যে ব্যক্তিটির সাথে ওর পরিচয় হয় তার নাম ইরা। ষোল কিংবা সতেরোর বেশি বয়স নয়। বেশি বড় নয় তার স্বপ্নও। কোনো একদিন কোনো এক সরকারি অফিসের কেরানি কিংবা খুব ভাগ্যবতী হলে বর্ডার গার্ডের কোনো মাঠপর্যায়ের সৈনিকের সাথে বিয়ে হবে তার। সেই বিয়েটা কবে যে হয়ে যাবে, সেই ভাবনায় ভেতরে ভেতরে বিভোর সুবজ শাপলার কলির মতো সজীব মেয়েটি ভোক্তাদের নিজের ঘরে বসিয়ে ফেন্সিডিল সেবা দেয়। সাধারণত কারো সাথে কথা বলে না। কিছু জরুরি প্রশ্ন আর উত্তর বিনিময় ছাড়া।
ইরার ছই দেয়া সেই ঘরটা ছিল খুব অদ্ভুত। একটা মাত্র সড়ক মুখী দরজা। আর তার ঠিক উল্টো দিকে প্রায় মাথার সমান লেভেলে একটা চৌকোনা জানালা। একটা করে চৌকি, টেবিল আর চেয়ার। চেয়ারের ড্রয়ারে লাগানো একটা ছোট্ট তালা। যেন অফিসরুম এক। সে রুমের পরিবেশকে একশত দিয়ে গুণ করলে, মতিঝিলের জনতা ভবনের ব্যাংকগুলোর এমডি'দের অফিস রুমের পরিবেশের সমান মান পাওয়া যায়। জনতা ভবনে বসে যেমন আমরা অর্থের বিনিময়ে সেবা কিনি, ইরার ঘরেও ঠিক একই ঘটনা ঘটে।
সেই ঘরে কেটে গেল একটা গোটা বিকেল। শুয়ে, বসে, হেসে, খেলে, অনেক অনেক কিছু করে। প্রথম বোতল ফেন্সিডিলটা ছিল শুধুই আইস-ব্রেকার। একবার আলোচনার গতিপথ ঠিক হয়ে গেলে তারপর সময়টা পার হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বোঝা যায় না যে সময়টা পার হয়ে গেছে। আর মাঝে মাঝে অন্যান্য উপাদান তাদের নিজেদের পথ খুঁজে নিচ্ছিল ওদের উদ্দেশ্যে। সে এক ভিন্ন জগত। এক কালো সময়।
সেখান থেকে বের হয়ে ওরা গিয়েছিল শরীরের চাহিদা মেটাতে। সহজ ছিল না। বিশেষত যে মাত্রায় মাদক সেবন হয়েছিল সারাদিন, তাতে লিটনের কানে প্রস্তাবটা যাওয়ার পর, মূলত সেটা বুঝে উঠতে ওর সময় লেগেছিল প্রায় মিনিটখানেক। তপন ছিল সে এলাকার নিয়মিত যাত্রি। তার জানা ছিল বিষয়টা। তাই সম্পূরক যে সমাধানটা সে এলাকায় ব্যবহার হয়, নীল রংয়ের একটা বটিকা, সেটা যখন তপন জোগাড় করে ফেললো ইরার ঘরে বসে বসেই, তখন লিটনের সেটাও বুঝে উঠতে সময় লেগেছিল মিনিটখানেক। বিদায়বেলায় ইরা খুব হাসছিল লিটনকে দেখিয়ে দেখিয়ে।
হাসিটা কিসের ছিল সেটা ছেলেটা বুঝতে পারে নি অনেক ভেবেও। হাসিটা ওর ভেতর কিছুটা লজ্জা, কিছুটা অবিশ্বাস, এবং কিছুটা ভয়ের পাশাপাশি একটা জেদও যেন কোথা থেকে ভাসিয়ে নিয়ে আসছিল। সাথে যারা ছিল তাদের কাছে ওসব ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। লিটনের কাছে বিষয়টা ছিল ভিন্ন। ইরা সেটা বুঝে ফেলেছিল কোনো এক উপায়ে।
নীল রংয়ের বটিকা যখন চোখের মনির পুরো প্রস্তজুড়ে অপসৃয়মানতার ইল্যূশন তৈরি করেছিল, তখন লিটন আসলে দেখতে পাচ্ছিল না কিছুই। তলপেটের নিম্নাংশের কাছাকাছি কিছু জায়গা নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করে উৎসব করছিলো। সেখান থেকে ভেসে আসা উৎসবের আঁচ ছুঁয়ে দিচ্ছিল ভ্রু'র নিচের অংশও, অনেক সময়। আর চোখের কোণে ফুটছিল লাল-নীল আতশবাজি।
তারপর গভীর রাতে আরও একবার হাইওয়েতে নামা। আবারও তিনজন মিলে এক মোটর সাইকেলে সওয়ার হওয়া। আরও একবার পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়া তিন হাজার সিসি ইঞ্জিন আর পাঁচ টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন শত কিলো ছুঁই ছুঁই বেগে ছুটে চলা ট্রাকের সাথে পাল্লা দেড়শত সিসি'র মোটর বাইকের। বাইক চালক হিসেবে তপনের সুনাম ছিল বগুড়া শহরের সর্বত্র।
সেই একবারই সেটা চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছিল লিটনের।
---
মন্তব্য করুন