ইউজার লগইন

অর্ধ-যোগাযোগের কুফল: একটি কেস-স্টাডি

কমিউনিকেশনের ছাত্র হিসেবে আমি প্রায়ই একটা জিনিসের মুখোমুখি হই, যেটা হচ্ছে অর্ধেক যোগাযোগ। ধরুন কেউ কিছু একটা বলা শুরু করলো কিন্তু মাঝপথে যেকোন কারণে আগ্রহ হারিয়ে জাস্ট হাত নেড়ে 'বাদ দাও' বলে শেষ করে দিলো। মনোবিজ্ঞানীদের মতে এটা অত্যন্ত ক্ষতিকর। যার সাথে আপনি অর্ধেক যোগাযোগ করে মাঝপথে ক্ষ্যান্ত দিলে তার মনের গভীরে কিন্তু আপনার সম্পর্কে ওই ধারণাটাই রয়ে গেল। তার মন পরে আর চাইলেও আপনার প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারবে না। যা দিতে পারবে তা হচ্ছে- অর্ধ মনোযোগ।

যোগাযোগ বিজ্ঞান আর মনোবিজ্ঞানের ভেতর যোগাযোগ আছে অনেক। যেমন আমরা যদি মাঝপথে একটা যোগাযোগের আগ্রহ হারিয়ে ফেলার কারণ নিয়ে ভাবি তাহলে দেখা যাবে সেখানে পুরোপুরি জেঁকে বসে আছে মনস্তত্ব। একটা উদাহরণ দেয়া যাক। নাম বলছি না, তবে এটি একটি সত্য ঘটনা। আমরা এক সময়ের বন্ধু, একদম হাইস্কুলের সময়কার, এসএসসি পাশের পর থেকেই যার জীবন আমার জীবনের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা, তার সাথে সম্প্রতি ফেসবুকে একটি পুনঃযোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মাঝখানের সময়টা ১৫ থেকে ২০ বছরের মাঝামাঝি, যখন আমাদের কোনো যোগাযোগ প্রায় ছিলই না বলা যায়। এখানে দ্রষ্টব্য একটি বিষয় হচ্ছে, আমরা ছেলেবেলার বন্ধুদেরকে বাই ডিফল্ট আজীবনের বন্ধু হিসেবে ধরে নিই। আমার মতে এর কোনো ভিত্তি নেই। ছেলেবেলার বন্ধু মানেই সারাজীবনের বন্ধু- এমন কোনো কথার প্রমাণ গবেষণায় অন্তত পাওয়া যায় নি। আর সম্পর্ক তো এমন না যে চাইলেই গড়ে তোলা যায়। সম্পর্ক গড়তে সময় লাগে, পরিশ্রম লাগে, ইচ্ছা লাগে- সবচেয়ে বড় হচ্ছে ইচ্ছা আর পরিশ্রমের দৃশ্যমান দৃষ্টান্ত স্থাপন করা লাগে। শুধু মুখে 'তোকে আমি বন্ধু মনে করি' বললেই যদি বন্ধুত্ব হয়ে যেতো, তাহলে পৃথিবীর সাত বিলিওন মানুষ অন্তত বাইরে বাইরে সবাই সবার বন্ধু হয়ে থাকতে পারতো, পারতো না?

যাহোক, যোগাযোগ পুনঃস্থাপনের পর বিভিন্ন সময় আমাদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চ্যাট হয়। এর মধ্যে একদিন তিনি আমাকে তার পেশাদার ও ব্যক্তিগত জীবনের কিছু হতাশা সম্পর্কে আলোচনার ইচ্ছা দেখালেন। আমি যদিও দ্বিধান্বিত ছিলাম কেননা বহুদিনের দেখা-সাক্ষাৎ নেই, অবশ্যই আমাদের মনের বিবর্তন ভিন্ন ভিন্ন পথে এগিয়েছে, চাইলেও খুব বেশি সাহায্য করা সম্ভব না, কেননা আমি তার মনের গভীরতাই ধরতে পারবো না। অথচ হতাশার ট্রিটমেন্ট করতে হলে একজন মানুষের মনের ভেতরে ঢোকা খুব জরুরি। হতাশার মূল কারণটা প্রশ্নের পর প্রশ্নের মাধ্যমে বের করে আনাটা জরুরি। তারপর যদি সেই কারণের যথাযুক্ত ব্যাখ্যা আপনার জানা থাকে তাহলে তো ভালোই, নাহলে বিশেষজ্ঞদের সাথে পরামর্শ করেই ট্রিটমেন্ট শুরু করা উচিত। এইসব কিছু করার সুযোগ নেই, কেননা সেই ব্যক্তিটির সাথে আমার অবস্থানগত দুরত্ব সাড়ে সাত হাজার কিলোমিটার।

যা হবার তাই হলো, এক কথা দুই কথার পর যখন আমি তাকে নিজের প্রতি বিশ্বাস না হারানোর কথাটা মনে করিয়ে দিলাম, তখন সে স্বীকার করে নিলো যে নিজের প্রতি আস্থা আছে। বললাম এটাই দরকার শুধু। নিজেকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা। প্রাপ্তিরা যথাসময়ে ধরা দেবে।

আমার কথাটা কিন্তু ধোপে টিকলো না। আলোচ্য ব্যক্তি খানিক বিরক্তি নিয়েই 'বাদ দাও' বলে চ্যাট থেকে বের হয়ে গেলেন। বিরক্তি প্রকাশের এ সুযোগটি আমি তাকে দিলাম কেননা আমি জানি পৃথিবীর সবাই আমার মতে করে ভাবে না। তবে তিনি বের হয়ে যাওয়া পর আমি বসে রইলাম বেকুব হয়ে। সাহায্য করার চেষ্টাটাও সমাপ্ত করার সুযোগ পেলাম না। তার আগেই তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণপূর্বক সিদ্ধান্তে পৌঁছে গিয়েছেন তিনি।

এখন এ সমস্যাটিকে যদি আমরা অন্য একটি কোণ থেকে দেখি তাহলে যেটা দৃশ্যমান হয়, তা হলো- উনি আসলে কি চান সেটি পরিস্কার নয়। হতাশায় আছেন। সেখান থেকে মুক্তির জন্য সাহায্য দরকার। এটা মোটা দাগে পরিস্কার। সমস্যা হলো, পৃথিবীর কেউ কারো জীবন তো গড়ে দিতে পারে না। নিজের জীবনটা আমরা নিজ হাতেই গড়ি। সে কারণেই আমরা সবাই নিজের নিজের কাজের জন্য দায়ী। যে সাহায্যটা আমরা সবাই একে অপরকে করতে পারি সেটা হচ্ছে- তথ্য ও সাহস দেয়া, অনুপ্রেরণা যোগানো, উৎসাহিত করা; যাতে সংগ্রামরত মানুষটির মনে তার নিজের সংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালবাসা জন্মে। আর কে না জানে যখন আমরা ভালবেসে কিছু করি, তা সংগ্রাম কিংবা যেকোন কাজই হোক, সেটার একটা সুন্দর পরিসমাপ্তি ঘটেই। দেশকে ভালবেসে আমাদের পূর্বপুরুষরা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল বলেই তো আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি, তাই না?

ফিরে আসি একে অপরকে যে সাহায্য আমরা করতে পারি সেই আলোচনায়। সাহস, উৎসাহ ইত্যাদি জোগানোর পর কিন্তু শেষে গিয়ে নিজেকে সাহায্য করাটা ব্যক্তির নিজেকেই করতে হয়। এখানে একটা জিনিস খেয়াল করা দরকার। আজকাল তথ্যের দ্বারও পৃথিবীর সবার জন্য কমবেশি অবারিত। সাহায্যপ্রার্থীর কিন্তু সাহস আর উৎসাহই শুধু দরকার। অথচ সাহায্যপ্রার্থী কিন্তু জানেন না সেটা। তাকে সাহস আর উৎসাহ জোগানোর পূর্বে তাই সেগুলোর প্রয়োজনীয়তা মনে করিয়ে দেয়াটা আমারই জরুরি ছিল। নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখতে বলার আগে সেটার আক্ষরিক আর রূপক অর্থগুলির বিস্তারিত ব্যাখ্যার দরকার ছিল। এগুলো কিছু না করার জন্য মাঝপথে আমাদের যোগাযোগটি কেটে যায়। সংঘটিত হয় একটি অর্ধ-যোগাযোগ, যা সুফলদায়ক নয় কোনো পক্ষের জন্যই।

এ কারণেই বলছিলাম যখন আপনি কোনো একটি যোগাযোগের মধ্যে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন, একটু থেমে ভাবুন তো আপনি কি আসলেই সেই যোগাযোগটি সম্পূর্ণ করতে চান কিনা, যদি চান তাহলে আপনার প্রস্তুতি নেয়া আছে কিনা সে ব্যপারে। যদি দু'টো প্রশ্নের উত্তরই ইতিবাচক হয়, তাহলে কেবল যোগাযোগটির ভেতর প্রবেশ করুন। অন্যথায় সেটি আপনার এবং যার সাথে যোগাযোগ করতে যাচ্ছেন- উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর ছাড়া লাভজনক হবে না।

হ্যাপি কমিউনিকেটিং!

---

পোস্টটি ১১ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

মীর's picture

নিজের সম্পর্কে

স্বাগতম। আমার নাম মীর রাকীব-উন-নবী। জীবিকার তাগিদে পরবাসী। মাঝে মাঝে টুকটাক গল্প-কবিতা-আত্মজীবনী ইত্যাদি লিখি। সেসব প্রধানত এই ব্লগেই প্রকাশ করে থাকি। এই ব্লগে আমার সব লেখার কপিরাইট আমার নিজেরই। অনুগ্রহ করে সূ্ত্র উল্লেখ না করে লেখাগুলো কেউ ব্যবহার করবেন না। যেকোন যোগাযোগের জন্য ই-মেইল করুন: bd.mir13@gmail.com.
ধন্যবাদ। হ্যাপি রিডিং!