গল্প: কেন প্রতিটি দিনই একটি নতুন সম্ভাবনা
১.
রামপুরা ব্রীজ, মুগদা, মান্ডা, নর্দ্দা, নতুন বাজার, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, কুড়িল বিশ্বরোড, প্রগতি স্মরণী দিয়ে বের হয়ে এমইএস-এর সামনে হওয়া নতুন ফ্লাইওভারটার ওপর দিয়ে সেদিন মোটরসাইকেলে ঘুরছিলাম। জেসমিন আর আমি। ওকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলাম আমার বেড়ে ওঠার পর্যায়ে যে শহরটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল তার ঠাক-ঠমক এবং জারি-জুরি। যদিও ঢাকা শহরের জারি-জুরি বলতে রাস্তাঘাট ঠান্ডা থাকলে ফ্লাইওভারগুলো, রাতে হাতিরঝিলে বসানো কৃত্রিম আলোর পসরা, আর নিকুঞ্জ থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত ফাঁকা রাস্তাটাই আছে। আর মাটিকাটা এলাকায় করা নতুন রাস্তাগুলো। যার পেছনে সেনানিবাস।
জেসমিনকে আমি অবশ্য প্রমিজ করেছি অনেক কিছু। ঢাকা যেমন আমার বেড়ে ওঠার কালে অনেক অনেক ভূমিকা রেখেছিল, তেমনি রেখেছিল আরও দুইটি শহর। ২৯-৩০ বছর বয়সের পরও যে মানুষের বৃদ্ধি হয়, অন্তত চিন্তাধারায় পরিবর্তন আসে- সেটা জানা ছিল না। সেটা জানতে ভিন্ন দেশের এক ভিন্ন শহরে যেতে হয়েছিল আমাকে। সব মিলিয়ে জীবনের এ পর্যায় পর্যন্ত চারটি ছোট-বড় শহরকে আমার ধারণ করতে হয়, করতে হবে। এর মধ্যে অন্তত তিনটি আমি জেসমিনকে দেখাতে চাই, আর সঙ্গে বান্দরবান থাকবে ফাও হিসেবে।
তারই অংশ হিসেবে ঢাকার রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো। আমার মতে আমি ঢাকার রাস্তায় একটা মোটরসাইকেল সহযোগেই ফিট। অন্য কোনো বাহনে চড়ে আমার পক্ষে নিজের মতো করে উপভোগ করা সম্ভব না, সম্ভব না অন্যদেরকে আমার ভিশনটা দেখানোও। তাই রিস্ক নিই নি। ঢাকার রাস্তায় চলাচলের জন্য সবচেয়ে উপযোগী এবং বহুল ব্যবহৃত মোটরসাইকেলগুলোর একটিই জোগাড় হয়েছে। যান্ত্রিক ঝঞ্ঝাট যাতে সময় নষ্ট না করতে পারে, তাই নতুন একটি কিনেই নিয়েছি। পরে দরকার হলে নাহয় বিক্রি করে দেয়া যাবে, অথবা কাউকে হয়তো দিয়ে দিলাম। বান্দরবানের ওদিকে আমি অনেককে চিনি, একটা মোটরসাইকেল যাদের জীবনে অনাবিল খুশির উৎস হয়ে উঠতে পারে।
মোটরসাইকেলের অসুবিধাটা হচ্ছে- নগরীর বাসযাত্রীরা বাসের জানালা থেকে হেন জিনিস নেই যা নিচে ফেলে না। ভাগ্যটা ভাল যে আমাকে বা জেসমিনকে এখনও বাস থেকে ফেলা কোনোকিছু শরীর দিয়ে নিতে হয় নি। সেদিন ঠিক আমাদের দু'জনের দুই মিটার সামনে একজন বাস থেকে একটা পলিথিনের ঠোঙা ফেললো, সেটা রাস্তায় পড়ার পর মনে হলো ভাত-ডাল টাইপের খাবার বুঝি। এরকম একটা জিনিস চলন্ত একটা বাহন থেকে যে কেউ বাইরে ফেলে দিতে পারে- এটা জেসমিনের জানা ছিল না। এক পিকো-সেকেন্ডের জন্য জিনিসটা আমাদের কারও মাথায় বা গায়ে পরে নি, কিন্তু পরলে অবশ্যই সারাদিনের আনন্দটাই মাটি হয়ে যেতো। কোনো পরিকল্পনাই হয়তো বাস্তবায়ন করা হতো না। এমনকি হয়তো হতো না সেদিন সন্ধ্যায় ধানমন্ডিতে বসে চা খেতে খেতে জেসমিনকে "কেমন লাগছে" জিজ্ঞেস করা।
ও বলেছিল, সুখী সুখী।
-এটাই কি তুমি মনে মনে ভেবেছিলে আমাদের এই ট্রিপটা সম্পর্কে?
-হুম, ভেবেছিলাম যতোটুকু, তারচেয়েও বেশি হয়ে যাচ্ছে সবকিছু।
-তোমার কি এই শহরের আলো-বাতাস ভালো লেগেছে?
-হুম।
-আবহাওয়া-পরিবেশ?
-হুম।
-আমাদের যৌথ পরিবার?
-ও ইয়েস্।
-সেখানে আমাদের দু'জনের একটা ছোট্ট কক্ষ, সাথে ততোধিক ছোট্ট ব্যালকনি একটা?
-খুবই।
-তাই?
-হু তাই
-ভালবাসো জোৎস্নায় কাশবনে ছুটতে?
-কাশবন কি?
-ওহ কাশবন তো তোমাকে দেখানো হয় নি। দেখাবো'খন, এখন যদিও সত্যিকারের সময় না, তাও খুঁজে দেখা যেতে পারে। আশুলিয়ার ওদিকে হয়তো পাওয়া যাবে, দু'য়েকটা প্রকৃত কাশবন। আর নাহলে ছবি দেখাতে হবে।
-দেখিয়ো তো, আমি সব দেখতে চাই তোমাদের এই দেশের।
-তাই? ছায়াঘেরা মেঠোপথে হাঁটতে চাও?
-ছায়াঘেরা মেঠোপথ? কোথায়? এখানে তো সব বড় বড় দালানকোঠা আর কংক্রীটের রাজপথ!
-আছে। ছায়াঘেরা মেঠোপথেরা শুয়ে আছে দূর পাহাড়ের গায়ে, গোধুলীর আলো মেখে।
-তাই? ঠিক আমার দেশের বাড়ির মতো?
-হুম, ঠিক তোমার দেশের বাড়ির মতো।
-জানো, আমার না নিজের বাড়িটার চেয়েও তোমার বাড়িটা বেশি ভাল লাগছে। আমি দেশের কথা বলছি।
-এটাই তো হওয়ার কথা। তোমার বাড়িটা যে আমাকে বেশি টেনেছে, তাই প্রকৃতি তার নিজের মতো করে একটা সাম্যবস্থা নিয়ে এসেছে।
-তোমার শহরে সবাই কি দারুণ!
-কেন মনে হলো এ কথা?
-সবাই যে তোমার সাথে কথা বলে এখানে। আমার কানে অশরীরী আনন্দ হয় যখন আমি তোমাকে অন্যদের সাথে তোমাদের ভাষায় কথা বলতে শুনি। একটা বর্ণও বুঝি না কিন্তু ইচ্ছে করে সারাদিন শুধু শুনতেই থাকি, শুনতেই থাকি।
-তোমার কি কখনও বুঝতে ইচ্ছে করে আমরা কি নিয়ে কথা বলি?
-হুম, করে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়- অন্তত আমাকে নিয়ে তুমি অন্যদের সাথে যা কিছু বলো সেটার সবটা বুঝতে পারলে খুব ভালো হতো।
-আমি তো সবসময় তুমি যেন বুঝতে পারো তাই তোমার ভাষাতেই কথাগুলো বলি।
-সবই কি বলো?
-মাঝে মাঝে অবশ্য না।
-ব্যাপার না, আমি যতোটুকু পেয়েছি, তার জন্য কিভাবে কাকে কৃতজ্ঞতা জানাবো জানা নেই, জানো?
-আমাকে জানাও (হাহাহা)।
-ইহ্! তাই না?
-তাহলে? আমাদের দু'জনের মধ্যে কে প্রথম ওপেন হয়েছিল?
-(হাহাহা) আমাদের দু'জনের মধ্যে কে প্রথম যোগাযোগ করেছিল?
-ওহ্ সেটা ছিল একটা হিট অব মোমেন্ট। তোমার একজন কর্মচারী দরকার ছিল, তুমি আমাকে নিয়েছিলে।
-কেন তোমাকেই নিয়েছিলাম আমি, যখন আরও অনেক স্বভাষী লোকজনের অ্যাপ্লিকেশন আমার কাছে ছিল?
-তারপরে তো ছয় মাস আমি যে আশেপাশে আছি, সেটাই ভুলে গিয়েছিলে!
-মোটেও না। কিন্তু তোমাকে দেখে বোঝার কোনো উপায় ছিল না, তুমি কি-কেমন-মানে কোনোকিছুই। আমার অনেকদিন মনে হয়েছে যে তোমার বোধহয় ১৯-২০ বছরের একটা গার্লফ্রেন্ড আছে।
-(হাহাহ্) কেন?
-কেন আবার! তুমি দরকারী কথা ছাড়া আর কোনো কিছু কি কখনও সেভাবে বলেছো?
-মোস্টলি দরকারী কথার বাইরে আমার ভোকাবুলারি খুব সামান্য, সেটা হচ্ছে কারণ।
-(হাহাহা) ভেরি ফানি। তাহলে এখন কিভাবে কথা বলছো?
-বলবো, আগে বলো তুমি কি স্লীপিং ডিকশনারী সিনেমাটি দেখেছো?
-নাহ্।
-ওইটা দেখলে বুঝতে পারতে কিভাবে এখন কথা বলছি।
-নামটা থেকে অবশ্য বেশ কিছুটা বুঝতে পারছি।
-হুম, তাহলে ধন্যবাদটা কি আমারই প্রাপ্য নয়?
-নাহ্। ধন্যবাদটা আমার প্রাপ্য।
-উহু আমার প্রাপ্য।
-নোপ আমার প্রাপ্য।
-আমার তো বটেই, এমনকি পুরস্কারস্বরূপ একটা চুমুও এখন আমার প্রাপ্য।
-জি না, ধন্যবাদ, চুমু সবই আমার, সবকিছুর ওপরে তোমার কেকের চেরিটাও আমার।
আমি ওই চেরিটাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলাম সবশেষে খাবো বলে। মেয়েটি টুপ করে দুই আঙ্গুলে তুলে ওটা মুখে পুরে নিলো। নিয়ে টিস্যু পেপারে হাত মুছে ফেললো। আমি তাকিয়ে রইলাম শুধু। হঠাৎ অনেকখানি মায়া কোথা থেকে যেন এসে গ্রাস করি-করি লাগিয়ে দিয়েছিল, আমার চারপাশে। সেটাকে কাটিয়ে উঠে বললাম, চলো কাশবন খুঁজতে যাই। আর জোৎস্নাও আছে আজ রাতে।
২.
আমি বের হয়ে আসার সময় ভাবছিলাম, আমাদের যোগাযোগটা ছিল সেই কতোকাল আগে থেকে! আমি ওদের ওখানে কাজের অ্যাপ্লিকেশন দিয়ে ভুলে গিয়েছিলাম। অনেকদিন, প্রায় দুই-তিন মাস পরে জেসমিন এক বিকেলে ফোন করে নিজের পরিচয় দিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি কি এখনও আমাদের এখানে কাজ করতে চাও? আমি বলেছিলাম, হ্যাঁ। যদিও সে সময় আমার আরেকটা চাকুরী ছিল। তারপরও সেদিন কেন যে হ্যাঁ বলেছিলাম জানি না। কোনো এক মহাজাগতিক ইশারা হবে হয়তো বা। অথবা আমার গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেলরা চেষ্টা করছিলেন পথ দেখাতে। কেননা অন্য যে চাকুরীটা আমি করছিলাম, সেটা শেষ হয়ে গিয়েছিল এক সপ্তাহ পরই। এবং আমাকে জানানো হয়েছিল দুই মাস পর। ওই দুই মাস আমি বেকার বসে থাকতাম যদি ওই বিকেলে জেসমিন আমায় ফোন না করতো, এবং আমি ওকে হ্যাঁ না বলতাম। তারপরও তো দীর্ঘদিন আমরা একসাথে কাজ করেছি, কতোকিছুই না করেছি সে সময়ের ভেতর। নিশ্চিতভাবেই সে আমাকে ওই সময়ের ভেতর দুইটি আলাদা মেয়ের সাথে দেখেছে, আমিও বোধহয় ওকে একবার অন্য একটা ছেলের সাথে দেখেছি। সবকিছুর পরও আমরা যখন দু'জন দু'জনের সাথে ছোট-খাটো কোনোকিছু নিয়ে কথা বলতাম, তখন আমাদের ভাল লাগতো। আমার অসম্ভব ভাল লাগতো। সেই ভাললাগা প্রায়ই আমার ভিশনকে ব্লক করে রাখতো বলে দেখতাম না, ওরও ভাল লাগছে। কিংবা দেখলেও বিশ্বাস করার ভরসাটা পেতাম না।
সেই কাজটা ছেড়ে অস্ট্রিয়ায় পাড়ি দেয়ার আগে একদিন আমি ওকে একটা অনুরোধ করেছিলাম। বলেছিলাম, তোমাকে আমার কিছু কথা বলার আছে। তবে অফিসের এই পরিবেশে কথাটা বলা সম্ভব না। আজ যেহেতু আমার শেষ দিন, আজকের কাজ শেষে আমরা কি কাছের কফি শপটাতে একটু বসতে পারি?
আমাকে খুশির জোয়ারে পালহীন ডিঙিতে ভাসিয়ে সে বলেছিল, হ্যাঁ পারি। অবশ্যই পারি।
সেদিন সন্ধ্যায় আমরা যখন লিবার্টি নামের কফি শপটায় সামনা-সামনি দুই গ্লাস ফাস্-বিয়ার হাতে বসেছি, তখন আকাশে ভ্যানিলা আর স্ট্রবেরি মেশানো রঙয়ের মেঘদের ছড়াছড়ি। বিয়ারের পাতলা সোনালী রং-য়ে সেই আলো পড়ে রিফ্লেক্ট করছিলো জেসমিনের সোনালী চুলে। আমার এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, আজকের পৃথিবী পুরোটা ভরে আছে অতিরিক্ত ব্যাপার-স্যাপারে। অতো সুন্দর আকাশ না থাকলেও আজ চলতো, কিংবা আলোর প্রতিফলন-বিচ্ছুরণ আরেকটু স্বাভাবিক হতে পারতো, পাশের ছোট্ট লেকটায় হয়তো পানি না-ও থাকতে পারতো, পানি নাহয় থাকলো কিন্তু ফোয়ারাটা? ওটা কি একটা আস্তবড় 'এক্সট্রা' নয়?
ওইসব চিন্তা-ভাবনা আমার মনটাকে নিয়ে গিয়েছিল এক কানা গলির শেষ প্রান্তে, যেখান থেকে আর কোনো ফেরার পথ ছিল না। আমি জেসমিনকে খুলে বলেছিলাম, কিভাবে আমার জার্মান জীবনের শেষ সময়টাতে সে জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে। ইউনিভার্স আর নেচার মিলে কিভাবে প্ল্যানটা সাজিয়েছে- সবকিছু। বলেছিলাম কিভাবে আমি জীবনের ৩২ টি উত্তেজনা এবং নিশ্চয়তা-অনিশ্চয়তার দোলাচলে ভরা বসন্ত পেরিয়ে ৩৩-এর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি আমি এবং তারপরে আমার কি করার ইচ্ছা- সবকিছু। আলোচনাটাকে যতোটা বড় করা যায়, ততোটাই করার ইচ্ছা ছিল আমার। তাই সেদিন বিকেলে আমি আসলে জেসমিনকে আমার পুরো জীবনের কথাই একে একে খুলে বলেছিলাম। জন্ম, বেড়ে ওঠা, চট্টগ্রাম শহর, প্রথম স্কুল, ছেলেবেলা, জাম্বুরী মাঠ, সিএন্ডবি কলোনী, লাকি প্লাজা, তারপর আমাদের বগুড়ায় চলে যাওয়া, পুলিশ লাইন স্কুলে ভর্তি হওয়া, রহমান নগরে আড্ডা দিতে দিতে বখে যাওয়া, প্রথম অ্যালকোহল সেবনের জন্য সাইকেল-ভিডিও রেকর্ডার ইত্যাদি চুরি করা, এসএসসি-এইচএসসি পাশ করা, পুরো পরিবারসহ ঢাকায় চলে আসা, দেশের প্রায় সবগুলো সরকারী ভার্সিটিতে একবারেই চান্স পাওয়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগে ভর্তি হওয়া (প্রথমে বিভাগটার নাম ছিল উইমেন স্টাডিজ), সেখানে জীবনে প্রথমবারের মতো সিরিয়াস প্রেমে পড়া, আমার প্রথম মন ও দেহের সমসাময়িক আদান-প্রদান, ছাত্র-রাজনীতির সত্যিকার থ্রিলটা অনুভব করা, সাংবাদিকতার আনন্দ-বেদনার সাথে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা, আমার বিয়ে, আমার বিচ্ছেদ, বিদেশে চলে আসা, নতুন করে নিজেকে ভেঙ্গে গড়া, মাথার প্রত্যেকটা নিউরণকে হাতুড়ি পিটিয়ে পুনরায় মেরামত করা- পুরো গল্পটা প্রায় ঘন্টাখানেক সময় নিয়েছিল, যখন বলেছিলাম জেসমিনকে।
ও পুরোটা সময় মনোযোগ দিয়ে শুনেছিল। জার্মান যেহেতু আমার মাতৃভাষা নয়, এমনকি নয় দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় ভাষাও (শেখার ক্রমানুসারে), তাই অনেক সময় আমি বোঝাতেও পারি নি কি বলতে চাইছিলাম, কিন্তু ওটাও ছিল একটা কারণ জেসমিনকে সব কিছু বলার। ও আমার অর্ধেক বলা কথাগুলো বুঝে ফেলতো সবসময়। সেটা আমার জন্য খুবই হেল্পফুল ছিল সবসময়।
আমার গল্প শেষে বলেছিলাম, মেরামতের পর যখন আমি নতুন একটা জীবনের শুরুর জন্য আবার প্রস্তুত হয়ে উঠেছি, সেই সময় একদিন থেকে আমি নিজেকে তোমার সাথে দেখতে শুরু করেছি। প্রতিটি ভবিষ্যতের চিন্তায়, মাঝে মাঝে এমনকি স্বপ্নেও। তেমনি একটা স্বপ্নে রিসেন্টলি তোমাকে আমি অন্য একটা ছেলের সাথে দেখেছি। একটা ট্রাকের সিটের ওপর। বেশ আপত্তিকর অবস্থায়। তারপর থেকে মনের ভেতর কেমন যেন চিনচিনে একটা ব্যাথা। অথচ ওটা ছিল মাত্রই একটা স্বপ্ন! তারপরও কেন এমন হয়? তুমি কি বুঝতে পারছো জেসমিন, আমি কি বলছি?
সে মৃদু হেসে মাথা নেড়ে বলেছিলো, হুম বুঝতে পারছি।
আমি তারপরও বলে যাচ্ছিলাম, জানি না তুমি কোথায় থাকো, কিংবা তুমি একা কিনা, হয়তো সেসব জানার চেষ্টা করাটা বুদ্ধিমানের কাজ হতো, কিন্তু আমার কথাগুলো বলাও খুব জরুরি ছিল। যদি জানতাম তুমি একা নও, তাহলে হয়তো কখনও এই কথাগুলো বলাই হতো না। কিংবা তারপরও হয়তো হতো, জানি না। তবে আমি মনের ভেতর কোনো মেঘের ছায়া পড়তে দিতে রাজি ছিলাম না বলে আগে ওটা জানার চেষ্টা করি নি। তারচেয়ে চেষ্টা করেছি আমার গল্পটা তোমাকে পরিস্কার করে বলতে। জানি না কতোটুকু পেরেছি কিন্তু তুমি বুঝতে পেরেছো বলে ভাল লাগছে। নিজেকে সত্যি এখন অনেক হালকা লাগছে।
তারপর বেশ খানিকক্ষণের একটা নীরবতা আমাদের দু'জনকেই ঘিরে ধরেছিল। ততোক্ষণে সন্ধ্যা নেমে গিয়েছে। লেকের জলের ওপর ফোয়ারার শব্দে চারিদিক মুখর। এমন সময় জেসমিন ওর হাতটা টেবিলের ওপর এগিয়ে এনে আমার হাত ধরে বলেছিলো, "তুমি যে কখনও কথাগুলো বলবে সেটা আমি কখনোই বিশ্বাস করতে পারি নি। সে কারণে মাঝে মাঝে তোমার প্রতি ভাললাগা আসতে চাইলেও তাদেরকে দুরে সরিয়ে রেখেছি। ভেবেছিলাম তুমি হয়তো তেমন কিছু ভাবছোই না। হয়তো ব্যস্ত আছো জীবনের অন্যান্য জরুরি বিষয়গুলো নিয়ে। যদি জানতাম তুমিও আমাকে পছন্দ করো, তাহলে অনেককিছু অন্যরকম হতো, এবং মাঝখানে অনেকগুলো মাস আমাদের দূরে দূরে কাটাতে হতো না।"
৩.
অবশ্য আমাদের দূরে দূরে থাকা এরপরও পুরোপুরি কাটে নি। কিছুদিন পরই আমি ওই চাকুরীটা ছেড়ে চলে আসি। এখন দুইজন দুই ভিন্ন দেশে থাকি। উইকেন্ডে দেখা করাটাও কঠিন হয়ে যায় মাঝে মাঝে আমাদের জন্য। এবার দেশে আসার সময় জিজ্ঞেস করেছিলাম- আমার ঘনবসতিপূর্ণ, সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা, সকল দেশের রাণীটিকে দেখতে আসতে চায় কিনা? সে এককথায় রাজি হয়ে গিয়েছিল। সে কারণে সেদিন মধ্যরাতের কাছাকাছি সময়ে আমাদের বাইক ছুটছিল ঢাকা-আশুলিয়া মহাসড়ক ধরে ঘন্টায় প্রায় একশত বিশ কিলোমিটার গতিতে। কাশবনের খোঁজে। আমাকে জড়িয়ে ধরে বসে ছিল ও। ঘাড়ের কাছাকাছি আমি ওর নাক আর ঠোঁটের অবস্থান টের পাচ্ছিলাম। জোৎস্না ফেটে পড়ছিল চারিদিকে। হেড-লাইট বন্ধ করে দিয়েছিলাম তাই। এই নিয়ে অবশ্য প্রায়ই জেসমিন আপত্তি জানাচ্ছিল। কিন্তু আমি পাত্তা দিচ্ছিলাম না। ওকে বলেছিলাম, আমার সাথে জীবনটা সবসময়ই একটু রাফ। যে কারণে সবাই সাথে থাকতে পারে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি সবকিছু ঠিকঠাক করেই ফেলি, এটা যে বুঝতে পারে তার জন্য ব্যাপারটা কঠিন না।
আমার শেষ কথাগুলো শুনে ঘাড়ে হালকা একটা কামড় দিয়ে সে বলেছিল, মোটরসাইকেলটা পড়লে মাইর যে একটাও মাটিতে পড়বে না, সেইটা মনে রাইখো। জেসমিন নতুন নতুন বাংলা শিখছে। আমি তাকে বাগধারা আর প্রবাদ শিখিয়ে সবচেয়ে মজা পাই। প্রায়ই ভুলভাল প্রবাদ বলে, কিন্তু সেদিন রাতেরটা ঠিক ঠিক ছিল বলে আমি ঘাড় ঘুরিয়ে ওর ঠোঁটে একই রকম হালকা একটা কামড় দেয়ার চেষ্টা করেছিলাম। চলন্ত অবস্থায়ই। সে সময় উল্টো দিক থেকে একটা ট্রাক খুব কাছাকাছি চলে এসেছিল। জেসমিনের চিৎকার শুনে দ্রুত বাইকটাকে লাইনে নিতে গিয়ে চুমুটা সেই মুহূর্তে মিস্ হয়ে গিয়েছিল।
ভাল লেগেছিল বিষয়টা ব্যাপক!
---
মন্তব্য করুন