প্রিয় জিল্লুর স্যার আর জাকারিয়া স্যারের জন্য ভালবাসা
বগুড়া পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের নাম শুনে প্রথমে যতোটা মুষড়ে পড়েছিলাম, ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে ওই স্কুলে আমার প্রথম বন্ধু ধ্রুব-র সাথে পরিচিত হয়ে আবার ততোটাই উৎফুল্লতা ঘিরে ধরেছিল আমায়। চট্টগ্রামের মতো বড় আর সুন্দর শহর ছেড়ে, ক্লাস ওয়ান থেকে সেভেন পর্যন্ত যে স্কুলে পড়েছি সেটিকে এবং সেখানকার সব বন্ধু-বান্ধবদেরকে পেছনে ফেলে বাবার বদলীর সুবাদে বগুড়া চলে যেতে হবে, সেটাই ছিল যথেষ্ট হৃদয়বিদারক। সাথে যখন যোগ হলো জিলা স্কুল নয়, ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক নয়, এমনকি ব্যাটেলিয়ন স্কুলও নয়- শেষমেষ গিয়ে ঠাঁই মিললো কিনা পুলিশ লাইনে- তখন আমার আসলেই কাঁদো কাঁদো অবস্থা।
সেই কঠিন অবস্থায় একটু স্বস্তি পেয়েছিলাম ভর্তি পরীক্ষার দিনেই ধ্রুব'র সাথে পরিচিত হতে পেরে। বন্ধুত্ব পরে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়েছে ঠিকই- কিন্তু সেই সময়টাতে যখন আমি ধীরে ধীরে বয়ঃসন্ধিকালে প্রবেশ করছি, চোখে রঙিন অদৃশ্য চশমার ছায়া পড়েছে, কোনো বাধানিষেধ দেখলেই সেটা ভাঙার জন্য মন আকুপাকু করে- সে সময় একজন মানুষকে ছোটখাটো দুষ্টামির সঙ্গী হিসেবে পাওয়া আসলেই অনেকটা উপকার করেছিল। তবে বন্ধু-বান্ধবদের স্মৃতিচারণ করার উদ্দেশ্যে এই লেখাটা নিয়ে আজ বসি নি। আমার কথা বলার ইচ্ছে আছে দুইজন প্রিয় শিক্ষককে নিয়ে। যাদেরকে ছাড়া আমি আমার পুলিশ লাইন স্কুলের জীবন কল্পনা করতে পারি না।
প্রথমে যার কথা বলতে চাই, তিনি আমাদের জিল্লুর স্যার। অংক আর বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয়গুলোর ক্লাস নিতেন তিনি। একজন আপাদমস্তক ভাল মানুষ। ওঁনার ছেলে তুফান পড়তো আমাদের সাথে। তুফান খুব ভাল ছাত্র ছিল। সবসময় ওর রোল হতো এক। তারপরও পড়া না পারলে মার কম পড়তো না তুফানের কপালে। তবে অন্যরাও বাদ যেতো না পড়া না পারলে। জিল্লুর স্যার কখনো নিজের ছেলেদের সাথে স্কুলের অন্য শিক্ষার্থীদের পার্থক্য করেছেন- এমন দেখি নি। জুয়াচোর, লম্পট ইত্যাদি ছিল তার বহুল ব্যবহৃত কিছু বকা।
অসাধারণ এই মানুষটি আমাকে অনেকভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন। তার বাসায় প্রাইভেট পড়তে যেতাম। তিনিও বাসায় আসতেন পড়াতে। সঙ্গে আসতো তার ছেলে এবং জিলা স্কুলের আরেক ছাত্র। আমরা তিনজনে যেমন ভাল একটা স্টাডি গ্রুপ ছিলাম, আবার একই সাথে দুষ্টের শিরোমনিও ছিলাম। বিশেষ করে আমি এবং জিলা স্কুলের অন্য ছাত্রটি। স্যারের ছেলে তুফান দুষ্টামীতে আমাদের সাথে থাকতো না কিন্তু পড়া না পারলে কপালে আমাদের সমান শাস্তিই জুটতো। আমাদের তিনজনের সেই সার্কেলের মধ্যে জিলা স্কুলের ছাত্রটির সাথে এখন আর যোগাযোগ নেই। হয়তো কোথাও খুব ভাল একটা জীবন তৈরি করে নিয়েছে সে তার নিজের জন্য। কিন্তু স্যারের ছেলের সাথে আমার এখনও যোগাযোগ আছে। আমাদের স্কুল-ব্যাচের নিজস্ব একটি মেসেঞ্জার-গ্রুপ রয়েছে। সেখানকার সদস্যরা হয়তো পুলিশ লাইনের শিক্ষকদের সম্পর্কে আমার এই স্মৃতিচারণায় অনেক মজার মজার ঘটনা সংযোজিত করতে পারবে।
আরেকজন যার কথা আমার সবসময় মনে থাকবে তিনি জাকারিয়া স্যার। আমাদের ইংরেজি পড়াতেন। ক্লাসে খুবই সদাশয়, হাসিখুশি এই মানুষটির একটি বিশেষ গুণ ছিল ছাত্র-ছাত্রীদের মুহূর্তেই আপন করে নেয়া। ক্লাস এইটে যখন আমি স্কুলটিতে ভর্তি হই, তার পরপরই অল্প কিছুদিনের মধ্যে স্যারের সাথে আমার একটা ভাল পরিচয় তৈরি হয়ে যায়। আমি যে সদ্যই অনেক দূরের এক জেলা থেকে বগুড়ায় পাড়ি দিয়েছি, ছোটবেলার সব বন্ধু-বান্ধবদেরকে পেছনে ফেলে এক সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে এসে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করছি, ক্ষেত্রবিশেষে সেই চেষ্টায় খুব খারাপভাবে ব্যর্থ হচ্ছি, এবং সর্বোপরি পুরো বিষয়টা অনুধাবনেও খুব একটা সফল হতে পারছি না- এটা প্রথম বুঝতে পরেছিলেন সম্ভবত জাকারিয়া স্যারই। ক্লাস নাইন থেকে এসএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত উনি যতোটা পেরেছিলেন আমায় ওই কঠিন সময়টা পাড়ি দেয়ার কাজে যথাসাধ্য সাহায্য করেছিলেন।
জাকারিয়া স্যারের বাসায় পড়তে যাওয়াটা সবসময় একটা সুখের অভিজ্ঞতা ছিল। শুধু পুলিশ লাইনই নয়, বগুড়ার আরও অনেক স্কুলের শিক্ষার্থীরা ওঁনার কাছে পড়তে যেতেন। প্রতিদিন স্কুল শুরুর আগে আগে উনার বাসায় বেশ প্রতিযোগিতামূলক একটা প্রাইভেট-ক্লাস হতো। লেখার প্রথম যে বন্ধুর কথা উল্লেখ করেছিলাম, ধ্রুব, সেও পড়তে আসতো ওই প্রাইভেট-ক্লাসে। ছিল আরও অন্যান্য বন্ধুরাও।
আমার জীবনের বিভিন্ন সময়ে, শিক্ষকেরা বড় বড় ভূমিকা রেখেছেন। কখনো আদর করে, কখনো বুঝিয়ে, আর কখনোবা শাসন করে তারা দেখিয়েছেন আমাদের বেড়ে ওঠার পথের নিত্যদিনের চোরা খানা-খন্দগুলি। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার পরও অনেক খানা-খন্দ এড়ানো সম্ভব হয় নি। বয়ঃসন্ধিকালের অদৃশ্য রঙিন চশমাও সেজন্য অনেকাংশে দায়ী। আজকাল বুঝি, আর কোনোদিন কোনো স্যার বাসায় এসে "অ্যাই র্যাকিব" বলে ডাক দেবেন না।
জীবনে এক সময় স্যারের পড়া করাটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল। আর কোনকিছু নিয়ে কখনো চিন্তা করতে হতো না। মাসশেষে সহস্র ইউরো বাসাভাড়া, স্বাস্থ্যবীমা, বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল ইত্যাদি যথাসময়ে পরিশোধিত না হলে পরের মাসে কতো সুদ যোগ হতে পারে- সেসব নিয়ে ভাবতে হতো না। বছরশেষে ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর জন্য কতো রকমের হ্যাপা পোহাতে হবে- তার কোনো চিন্তা ছিল না।
তখন জীবনটা এত সহজ ছিল যে, শৃংখলা, নিয়ম-কানুন ইত্যাদি না মানলেও খুব বেশি অসুবিধা হতো না। আজকাল প্রতি পদে পদে চিন্তা করতে হয়। অথচ সেই যে উচ্ছৃঙ্খলতার বীজ একবার ভেতরে বপন করা হয়ে গেছে- তাকে কি এত সহজে উপড়ানো যায়?
তারপরেও যতোটুকু স্বাভাবিকতা, শৃংখলা ইত্যাদির ভরসায় মাঝসাগরে নৌকার হাল ধরে বসে আছি- তার পেছনে আমার জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষকদের অনেক অবদান। জিল্লুর স্যার আর জাকারিয়া স্যারদের মতো মানুষ আরও আছেন। এমন অনেকের টুকরো টুকরো শ্রমের বিনিময়ে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছি আমি। পৃথিবীর অনেকেই দু'বেলা খাবার, ভাল স্কুলের যাওয়ার সুযোগ কিংবা ভাল দিক-নির্দেশনা পান না। তাদের চেয়ে তো অন্তত ভাল আছি।
এইবা কম কিসে? প্রিয় শিক্ষকদের প্রতি অপার শ্রদ্ধা, অগাধ ভালবাসা আর চিরকৃতজ্ঞতা। শিক্ষকতা হয়তো তাদের পেশা, কিন্তু সেটির বদৌলতে আমি যে জীবনের ভাল-মন্দটি আরেকটু ভাল করে বুঝতে শিখেছি- তা কখনোই অস্বীকার করা যাবে না।
---
মন্তব্য করুন