গল্প: বার্লিনে প্রথমবার খুব মন খারাপ হয়েছিল
১.
বার্লিন মেইন স্টেশন থেকে বের হয়ে আনমনে হাঁটছিলাম স্প্রি নদীর পাড় ধরে ধরে। মনটি ভীষণ খারাপ হয়ে ছিল বিশেষ একটা কারণে। বেশি একটা পাত্তা দিতে চাচ্ছিলামও না, কিন্তু ঘুরে ঘুরে মনে পড়ছিল।
আহা, একজন বিদেশে আসার স্বপ্ন কত যত্নে বুকে লালন করে রেখেছিল! আর আমার কোনো ইচ্ছাই ছিল না দেশ থেকে কখনও বাইরে আসার। অথচ আমার জীবনটাই আজ মিশে গিয়েছে বিদেশের অচেনা আকাশ, অজানা বাতাসে। আজীবন পরিবারের সাথে থাকতে চাওয়া সেই আমি আজ বাবা, মা সবাইকে হারিয়ে একা। যার জন্য সবাইকে হারাতে বাধ্য হয়েছিলাম, সেও ছেড়ে চলে গেছে বহু আগে। তাই আজকাল সবকিছুর ভেতরেও ঘাপটি মেরে বসে থাকে এক অব্যক্ত শুন্যতা। কথাটি সাধারণত সবসময় মনে পড়ে না, কিন্তু যখনই মনে পড়ে তখনই আমার অনেক খারাপ লাগে। তাই ভাবলাম বিষয়টিকে একটি গল্পের রূপ দেয়া যায় কিনা।
স্প্রি নদীর একপাশে বার্লিনের প্রধান রেলস্টেশন, অপরপাশে জার্মানির সংসদ ভবন। বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বানানো সে সংসদ ভবনের ভেতর দেখার আছে অনেক কিছু। এ কারনে এলাকার ভেতর একটি ছোট পাতালরেলের স্টেশনও গড়ে তোলা হয়েছে। ট্যূরিস্টরা স্টেশনটি ব্যবহার করে একেবারে সংসদ ভবন এলাকার মাঝখানে এসে হাজির হতে পারেন বলে- আন্তর্জাতিক মহলে এটির বেশ সুনাম রয়েছে। সে কারনে স্টেশনটির ভেতরের চাকচিক্যও অন্যরকম। শহরের অন্যান্য পাতাল স্টেশনের চেয়ে দৃশ্যত অনেকগুণ বেশি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, ঝা চকচকে। একবার ভেতরে ঢুকলে মন ভাল হয়ে যেতে বাধ্য। যেসব দিন সকাল থেকে মন খারাপ লাগতে থাকে, সেসব দিন গাড়ি রেখে আমি এই স্টেশনটা দিয়ে অফিসে যাই। বাড়ি ফেরার সময় মাঝপথে নেমে পড়ি। তারপর নদীর পাড় ধরে হেঁটে চলে আসি সংসদ এলাকার ভেতর। তারপর অনেকটা সময় উদ্দেশ্যহীন হাঁটাহাটি করি।
আসলে আমি এমনিও হাঁটাহাটির সুযোগ খুঁজি। হাঁটাহাটির ভেতর দেহ ও মনের জন্য অনেক খোরাক লুকিয়ে থাকে। বেশিরভাগ দিন এর মাধ্যমেই আমার পুরো শরীর ও নার্ভ-সিস্টেম চনমনে হয়ে ওঠে। হাঁটা শেষে বাড়ি ফিরে উচ্চস্বরে জার্মান হিপ হপ গান চালিয়ে দিয়ে, কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে শাওয়ার নেয়ার জন্য ছুটতে ইচ্ছে করে। শাওয়ারের পর একটি এসপ্রেসো নিয়ে বারান্দায় বসে একটি ধূম্রশলাকায় অগ্নিসংযোগ ঘটাতে ইচ্ছে করে। প্রিয় গাছদের সাথে মাঝে মাঝে আনমনে দুটো কথাও বলে ফেলি। আসলে বেশিরভাগ দিনে আমার বৈকালিক রুটিন এটিই, কিন্তু যেসব দিন মন খারাপ থাকে সেসব দিন কিন্তু হাঁটা ছাড়া আর কিছুই করা হয় না।
সেসব দিন বাসায় ফিরে নীল আর হলুদ তোয়ালে নিয়ে গোসল করতে ছোটা হয় না। আগে আমি মাথা ও শরীর মোছার আলাদা তোয়ালের রং গুলিয়ে ফেলতাম প্রায়ই। তাই সেবার নীল রংয়ের তোয়ালে কিনেছিলাম মাথা মোছার জন্যে। নীল আকাশের রং। থাকে আমাদের উপরে। তাই মাথার জন্য নীল। আর মাটির হলুদ রংকে ঠিক করে দিয়েছিলাম শরীরের তোয়ালেটির জন্যে। মাটিতো সাধারণত আমাদের নিচেই থাকে, তাই না? অন্তত মরে যাওয়া না পর্যন্ত।
মন খারাপ দিনগুলোতে আমি বাড়ি ফিরে সরাসরি বারান্দায় চলে যাই। সন্তপর্ণে একটি সিগারেট বানাই। আশপাশে কেউ না থাকা স্বত্তেও মনে হতে থাকে আমায় সবকিছু ভীষণ নৈঃশব্দ্যের মধ্যে সারতে হবে। তখন আসলে পৃথিবীর কাউকে জানতে দিতে ইচ্ছে হয় না যে, আজও বেঁচে আছি। এখনও বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ড আর তার ভেতর প্রাণের ধুকপুকানি চলছে। খুব সীমিত আকারে হলেও চলছে। মাঝে মাঝে মনে হয় পথের ধারের অবাঞ্ছিত আগাছারও তো প্রাণ আছে। সীমিত যেন আমার মতোই। তবে কি আমায় এ পৃথিবী আগাছাদের মাঝেই ঠাঁই দিয়েছে?
ওদের টিকে থাকা, আগাছা পরিস্কার করার মেশিনে কাটা পরা, মারা যাওয়া কোনকিছুতে যেমন সেখানকার মাটি কিংবা আশপাশের গাছ-গাছালির কিছু যায়-আসে না; এমনকি পরিবেশ বা গাছের সুরক্ষায় নিয়োজিত সেবাসংস্থারগুলোরও চোখে পড়ে না- ঠিক তেমনি আমার বেঁচে থাকা না থাকাও হয়তো কোনদিন কারও চোখে পড়বে না।
হায়! এমন একটি জীবন কি আমি কখনো চেয়েছিলাম?
২.
আমার চাওয়ার সাথে তার চাওয়ার কোন মিল ছিল না। আগেই বলেছি আমি দেশের বাইরে কখনও যেতে চাইতাম না। আর সে ছিল দেশের বাইরের সবকিছুতে প্রচণ্ড উৎসাহী। আমার এমনকি ক্যারিয়ার নিয়েও আমার তেমন কোনো উচ্চাশা ছিল না।
আমি ছেলেবেলা থেকে বাবাকে দেখেছি নয়টা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত অফিস করতে। তিনি অফিস করতেন পরিবারকে চালিয়ে নেয়ার জন্য, পরিবারের সকলের ভরণপোষণের খরচ জোগানোর জন্য। পাঁচটার পর চলে আসতেন বাড়িতে। তার মূল জীবনটা ছিল সেখানে। পরিবারের সাথে। আপনজনদের নিয়ে আনন্দে সময় কাটানোতেই নিহিত ছিল তার সুখ।
সুখে-শান্তি জীবন কাটানোর জন্য উপার্জন করতেন তিনি। হাত ভরে উপার্জন করার জন্য জীবন কাটাতেন না।
সেই স্বভাবটা চলে এসেছিল আমার মাঝেও। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় কোথাও খুব খারাপ ছাত্র ছিলাম না। আবার খুব ভাল বলতে যা বোঝায়, তাও ছিলাম না। শিক্ষকেরা আমার সুন্দর হাতের লেখা, ইংরেজি ব্যাকরণের যথাযথ ব্যাবহার, মার্জিত আচরণ ইত্যাদির প্রশংসা করতেন, কিন্তু কখনও বলতেন না- এই ছেলে পুরো শিক্ষা বোর্ডের জন্য সুনাম বয়ে আনবে। সেটি শোনার জন্য অন্য ভাল ছাত্রদের মতো আমার মন আকুলও হতো না। সবসময়ই জানতাম নিয়মিত একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় পড়াশোনা চালিয়ে গেলে, যে গন্তব্যে আমি পৌছুঁতে চাই- একদিন পৌছুঁবোই।
আমার ক্ষেত্রে হয়েছিলও তাই। এসএসসি, এইচএসসি যথাসময়ে পাশ দিয়ে দেশের তথাকথিত শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠে ভর্তিও হয়ে গিয়েছিলাম অনায়াসে। আশা ছিল পড়াশোনা শেষ হলে একটি সাধারণ সরকারী বা বেসরকারী চাকুরি নিয়ে আমিও বাবার মতো নয়টা-পাঁচটার জীবন শুরু করবো। আমার বাবা টানা ৩৬ বছর প্রতিদিন সকাল ন'টায় তার কর্মস্থলে হাজির হয়েছিলেন। একদিনও দেরি করেন নি!
আমাদের দেশে ঘরে ঘরে এমন বাবা রয়েছেন। যাদের সারাটা জীবন একেকটা অসাধ্য সাধনের অতিমানবীয় গল্প। আমারও একদিন তেমনি কোনকিছুতে জড়িয়ে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল।
মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক।
একসময় আমার ভেতরও ধীরে ধীরে উচ্চাভিলাষ জন্ম নেয়া শুরু হলো। ওই যে বলছিলাম, সেই মেয়েটি সবসময় দেশের বাইরের সবকিছুতে উৎসাহী ছিল। দেশের বাইরের জীবন কত চাকচিক্যময়, কত উন্নত, সহজ, জাঁকজমকপূর্ণ- এসব নিয়েই স্বপ্ন বিভোর থাকতো সে। ছড়িয়ে দিতে সমর্থ হয়েছিল আমার ভেতরেও। এতটা গভীরভাবে যে আমি একসময় আমার নিজের সব স্বপ্ন ভুলে গিয়েছিলাম।
একসময় বাবার মতো হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম, তাও ভুলে গিয়েছিলাম। আমার ছোট্ট একটা পরিবার থাকবে। সন্ধ্যায় আমার জন্য কেউ কেউ অপেক্ষা করে থাকবে। আমি ফিরলে সে বা তারা হাত বাড়িয়ে আমার দিকে দৌঁড়ে আসবে- এসব মাথায় ছিল না একদম। আমার ছেলেবেলায় বাবা বাড়ি ফিরলে বাড়িতে যে অনাবিল আনন্দের ঢেউ বয়ে যেতো- সে দৃশ্য ফিরে ফিরে মনে পড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, লম্বা একটা সময়ের জন্য।
মানুষ যখন একদিক দিয়ে হারায়, তখন তার অন্যদিক দিয়ে প্রাপ্তিলাভ ঘটে।
আমারও ধীরে ধীরে বৈষয়িক উন্নতি ঘটতে লাগলো। শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠের তকমা গায়ে থাকায় পাশ দিয়ে বেরোনোর আগেই চাকুরি জুটে গিয়েছিল। শেষবার বাড়ি গিয়েছিলাম প্রথম চাকুরিতে যোগদানের পূর্বে সকলের দোয়া নেয়ার জন্য। সেই মেয়েটি তখন আমার সদ্যপরিণীতা স্ত্রী। প্রথমবারের মতো আমাদের বাড়িতে গিয়েছিল সে। সবাই আমাদের জন্য প্রাণভরে দোয়া করেছিলেন, উৎসাহ জুগিয়েছিলেন আর বলে দিয়েছিলেন, 'সবসময় নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে আগে চিন্তা করতে। অন্য সবার কথা পরে'।
ফিরে এসে আমি বোকার মতো সেই কথাই শিরোধার্য মেনে বাঁচতে শুরু করেছিলাম। ভবিষ্যতের খোঁজে ডুবে গিয়েছিলাম নিজের ছোট্ট জগতটার ভেতরে। যেখানে শুধু সে আর আমি ছিলাম। অথবা অন্তত শুরুতে শুধু সে আর আমি ছিলাম। আর কেউ ছিল না।
সে সময় আমি মাঝে মাঝে খেয়াল করতাম, আমার পরিবার সদস্যদের সে কখনও ভালভাবে মেনে নিতে পারতো না। আমায় মা'র বা বাবা'র ফোন ধরতে হতো শোবার বা বসার ঘরের বাইরে গিয়ে। বারান্দায় কিংবা বাড়ির বাইরে রাস্তায়। এমন না যে সে কখনও কাজটি করতে বলেছিল আমায়। তবে বেশ কয়েকবার খেয়াল করেছিলাম যে যদি আমি ওর সামনে কথা বলতাম, তাহলে কথা বলার পরপরই নানান বিষয়ে ওর উকিলি জেরা শুরু হয়ে যেতো।
এভাবেই শুরু। তারপর ধীরে ধীরে বাড়ির সাথে আমার যোগাযোগ কমতে শুরু করে। বাড়তে থাকে ওর ওপর নির্ভরশীলতাও। সেই সাথে চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়তে থাকে বিদেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য চাপ।
অবশেষে উপায়ান্তর না দেখে আমি বিদেশে চাকুরি খোঁজার ভিসার জন্য আবেদন শুরু করি। জার্মানিতেই সে দফায় আমাকে ছয় মাসের জন্য চাকুরি খোঁজার ভিসা দেয়া হয়েছিল।
আমার দেশের কর্মস্থলটির বড়কর্তা অতিশয় সহৃদয় ব্যাক্তি ছিলেন। তিনি আমায় ছয় মাসের বিনাবৈতনিক ছুটির ব্যাবস্থা করে দিয়েছিলেন। সাথে ছিল প্রয়োজনে ছয় মাস ফিরে এসে আবারও চাকুরিটিতে যোগদানের আশ্বাস। আর ছিল অফুরান শুভকামনা।
সবকিছু নিয়ে মেয়েটির হাত ধরে আমি বিমানে চেপে বসেছিলাম। মনটা পড়ে ছিল গ্রামের বাড়িতে বাবা-মা'র কাছে। কত মাস যে হয়ে যাচ্ছে, তাদের সাথে দেখা করতে যেতে পারি নি। যেতে চাইলেই গিন্নি একশ'-একটা বাহানা দেখিয়েছে। "এ বছর না-সামনের বছর" করে একটা একটা বছর পার করে দিয়েছে। সবশেষে বিদেশ আসার আগে দুদিনের জন্য বাড়ি যেতে চাইলে, কেনা-কাটা আর অন্যান্য প্রস্তুতির কথা বলে এড়িয়ে গেছে সে। এমনকি আমি না থাকলে সবকিছু কিভাবে হবে- সেই অজুহাতে আমায় একলাও যেতে দেয় নি সে।
৩.
বিদেশের মাটিতে প্রথম দু'টি সপ্তাহ ঘুরে-ফিরে ভালোই কেটেছিল আমাদের। তারপর থেকে ধীরে ধীরে সময়গুলো খারাপ হয়ে উঠতে শুরু করে। আমার ভিসা ছিল মাত্র ছয় মাসের। শর্ত ছিল এ ছয় মাসে একটি চলনসই চাকুরি জোগাড় করতে পারলে জার্মান সরকার আমার ভিসা বাড়িয়ে দেবে। আমরা দুজনেই সেই একটি ভরসায় পড়ি দিয়েছিলাম সাড়ে সাত হাজার কিলোমিটার দূরের দেশে।
জার্মানি এসে দেখতে পাই চাকুরির বাজারে চলছে চূড়ান্ত হাহাকার! শূন্য দশকের শেষভাগের অর্থনৈতিক মন্দা তখন ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশকে আক্রান্ত করেছে। গ্রীস পথে বসে গেছে। ইতালি, স্পেন, পর্তুগালের মতো উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতিও তথৈবচ। জার্মানি কোনমতে টিকে রয়েছে। তবে সেখানে নতুন চাকুরির বাজার অত্যন্ত সীমিত। আমােদর দুজনের চোখেই ধীরে ধীরে পৃথিবীর সব আঁধার নেমে আসতে শুরু করেছিল।
দু'মাসের মাথায় পর পর দুই সপ্তাহে বাড়ি থেকে দুইটি ভয়াবহ সংবাদ এলো। প্রথমটি মা'র এবং পরেরটি বাবা'র চিরতরে চলে যাওয়ার। কোনমতেই মেনে নিতে পারছিলাম না, কিন্তু সব ছেড়েছুড়ে তখন দেশে চলে যাওয়ারও কোনো উপায় ছিল না। প্রথম খবরটি ওকে আমি প্রায় দুইদিন পরে দিয়েছিলাম। ও শুধু শুকনো একটি 'স্যরি' বলে কম্পিউটারের স্ক্রীন, যেখানে রাজ্যের চাকুরির বিজ্ঞাপন আর এককোণে ফেসবুক খোলা- সেখানে মনোযোগ দিয়েছিল।
ওর শুষ্ক প্রতিক্রিয়া দেখে দ্বিতীয়বারে বাবার খবরটি আমি ওকে দিইও নি। সে নিজেই ক'দিন পর কিভাবে যেন জানতে পেরেছিল। এই ফেসবুকের যুগে এসব খবর বড় সহজে একজনের কাছে থেকে আরেকজনের কাছে চলে যায়। সে খবরটি জানতে পেরে আমার পাশে এসে একটু বসেছিল। বলেছিল, আমি স্যরি, চিত্র। খুব স্যরি।
আমার বলার কোনো কিছু ছিল না। এককালে হয়তো আমার সবই ছিল। হাসিখুশি পরিবার, সুস্বাস্থ্যে ভরা মন, জীবনের প্রতি অনুরাগ, মানুষের প্রতি ভালবাসা- সবই। সে সবকিছু ততদিনে আমার ভেতর থেকে ধুয়ে-মুছে বের হয়ে গেছে। শুধু টিকে ছিল, ওর সাথে জার্মান দেশে থিতু হবার স্বপ্ন। সেটিকেও তখন খুব ধূসর আর প্রায় অসাধ্য লাগছে। আমি আসলেই সেদিন ওকে কিছু বলতে পারি নি। শুধু চুপচাপ শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে। টুপ করে কখন যে একফোঁটা জল চোখ দিয়ে গড়িয়ে বের হয়ে গিয়েছিল টেরই পাই নি। সেদিন শেষবারের মতো আমায় একবার বুকে জড়িয়ে ধরেছিল সে।
এরপর ছয় মাসের ভিসা দ্রুতই শেষ হয়ে আসছিল। বুঝতে পারছিলাম ভুল সময় জার্মানি এসে পড়েছি। এ সময় এ দেশে চাকুরি পাওয়া সম্ভব না আদতে। আমি যেভাবে সত্যটা মেনে নিতে পেরেছিলাম আমার স্ত্রী সেটা পারে নি। সে উদভ্রান্তের মতো প্রতিদিন একটার পর একটা চাকুরিতে আবেদন করে যাচ্ছিল। সারা জার্মানির যেখানে যে শহরে ওর লাইনের কোনো চাকুরির সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছিল, সেখানেই আবেদন পাঠাচ্ছিল। আমিও চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু কোথাও কোনো সুখবরের দেখা মিলছিল না।
ধীরে ধীরে ছয় মাস শেষ হয়ে এলো। আমার মুখে দেশে ফেরার প্রস্তুতির কথা শুনলেই চোখ আগুনে ভরে উঠতো ওর। আমি দেখতে পেতাম। তাই খুব বেশি কিছু বলতাম না। নিশ্চই কিছু একটা ভেবেছে সে- ভেবে নিয়ে চুপ করে বসে থাকতাম।
তারপর যখন মাত্র এক সপ্তাহ বাকি রয়েছে সে সময় একটি কোম্পানিতে ছয় মাসের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়ে গেল সে। সেদিন ওকে আমি সম্ভবত জীবনের সবচেয়ে বেশি খুশি হতে দেখেছিলাম। হাসতে হাসতে আমার ব্যাগ গুছিয়ে দিয়েছিল সে। টিকিটের দাম অনেক বেশি পড়েছিল কিন্তু দুজনের জন্য নয় বরং একজনের জন্য কাটতে হয়েছিল বলে কোনমতে পুষিয়ে গিয়েছিল আমার। আমি ব্যাগ-ব্যাগেজ নিয়ে বাসা থেকে বের যাওয়ার সময় সে কথা দিয়েছিল, ছয় মাস পর চাকুরি পাকা হলেই আমার জন্য ভিসা পাঠাবে। আমি যেন পরবর্তী ছয়টি মাস লক্ষী ছেলের মতো চুপটি করে বসে থাকি।
৪.
দেশে ফিরে তাই করেছিলাম আমি। বাড়িতে কেউ ছিল না বলে বাড়িতেও যাই নি। আমার শাহবাগ-টিএসসি'র চক্রেই কেটে যাচ্ছিল দিন। জানতাম একদিন ওর কাছ থেকে চিঠি আসবে। সেই চিঠিতে সে আমার জন্য ভিসা পাঠাবে। আমি উড়াল দেবো ওর কাছে। এই একটা ছোট্ট সামান্য স্বপ্নই শুধু বেঁচে ছিল তখন আমার। অন্যরা হারিয়ে গিয়েছিল কোন এক নাম-না-জানা গহ্বরে।
প্রায় ছয় মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও কোনো চিঠি না আসায়, আমি একটু বিচলিত হয়ে পড়ি। আমরা মাঝে মাঝে টেলিফোন আর ফেসবুক মেসেঞ্জারে কথা বলতাম। মাঝে মাঝে ভিডিও কলও হতো। সেসব পরিমাণে ছিল খুব সামান্যই। আমি জানতাম, ও নিজের কাজ নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকে। তাই যোগাযোগ করার উপায় খুব সীমিত ছিল। তবে সেবার বিচলিত হয়ে ওঠার দরুণ আমি নিজে থেকেই খোঁচাখুচি করে ওর সাথে যোগাযোগ করি। সেবার এমনকি ওকে মেসেঞ্জারে পেতেও আমার সমস্যা হচ্ছিল।
অনেক চেষ্টার পর পেলেও খুব অল্প সময়ের জন্য সে আমার সাথে কথা বলে। কথাগুলো খুব পরিস্কার বুঝতেও পারি নি আমি। দু-তিনটে বিষয় শুধু বুঝতে পেরেছিলাম। ওর চাকুরি নিয়ে ঝামেলা চলছে- কথাটা বুঝেছিলাম। সহকর্মীরা আশ্বাসের ওপর রেখেছে- তাও বুঝেছিলাম। আর আমাকে নিয়ে যে সেই মুহূর্তে ওর মাথায় কোনো চিন্তা নেই এবং কোনো চিন্তা করার কোনো সময়ও নেই- সেটি বুঝেছিলাম। শেষেরটি বুঝেছিলাম ওর না-বলা কথাগুলো থেকে।
তার প্রায় মাসখানেক পর একদিন ভোরে আমায় একটি ক্ষুদে-বার্তা পাঠিয়েছিল সে। কথা বলতে চায়। আমরা সেদিন সন্ধ্যায় ভিডিও কলের প্রতিশ্রুতি দিই একে অপরকে। সেই দিনটি আমার সারাদিন ছটফটিয়ে কেটেছিল। থেকে থেকে মনে সুখের দোলা টের পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল, হয়তো অবশেষে আমার অপেক্ষার প্রহর ফুরোতে চলেছে। আজ সন্ধ্যায়ই জানতে পাবো কবে আবার আমাদের দুজনের মিলন হবে। আবার মাঝে মাঝে সকালে আদান-প্রদান হওয়া ক্ষুদে বার্তাগুলোর বিভিন্ন শব্দ, বাক্যগঠনের ভঙ্গি মনে দুশ্চিন্তার জন্মও দিচ্ছিল। সকালের বার্তায় সে শুধু লিখেছিল, "We need to talk."
কথাটার অর্থ কি আসলে? কথা তো বলতেই হবে, কিন্তু সেটিকে এভাবে জোর দিয়ে বলার কারণ কি? তবে কি এমন কিছু রয়েছে যা নিয়ে আমাদের খুব সিরিয়াসলি আলাপ করা দরকার পড়েছে? হয়তো হ্যাঁ, হয়তো না- কে জানে।
৫.
সেদিন সন্ধ্যায় খুব অল্প কথায় আলাপ সেরেছিল সে। আলাপ শেষে আমি দুই ঘন্টা ঠায় বসেছিলাম অন্ধকারে।
মেয়েটি আপাতত একটি চাকুরি পেয়েছে কিন্তু সেটি আমার ভিসার জন্য যথেষ্ট নয়। শুধু তার নিজের জন্য যথেষ্ট। চাকুরির মেয়াদ আবারও ছয় মাসের। মেয়েটির ধারণা হয়েছে, এভাবেই তাকে একের পর এক চাকুরি পাল্টে জার্মানিতে থাকতে হবে এবং সম্ভব হলে অন্য কোনো দেশ যেমন, আমেরিকা, কানাডা ইত্যাদির জন্য চেষ্টা করতে হবে। এছাড়া আপাতত উপায় নেই। তাছাড়া বিদেশে একজনের উপার্জনে দুইজনের চলা আসলেই দুরূহ। আমাদের সম্মিলিত প্রথম ছয় মাসের অভিজ্ঞতা নির্দেশ করছে, আমার ওই দেশে চাকুরি পাওয়ার সম্ভাবনাও খুব সীমিত।
আমাকে কিছুক্ষণ বকাবকি করেছিল মেয়েটি সেদিন। "কতবার বলেছি একটু মন দিয়ে পড়াশোনাটা করো। নিজেকে বড় কোনো ক্ষেত্রের জন্য প্রস্তুত করো। তা না সবসময় তার এক কথা, পরিবার নিয়ে সুখী হবো। এবার হও পরিবার নিয়ে সুখী। আমি পারবো না শুধু তোমার জন্য জার্মানি ছেড়ে আবারও দেশে ফিরে যেতে। আমাকে যতদিন এখান থেকে বের না করে দেয়, আমি আছি।"
আমি জানতে চেয়েছিলাম, "আমাদের" কি হবে তাহলে?
সে বলেছিল, আসলে এখন আমাদের সামনে একটি পথই খোলা আছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। ভেবে দ্যাখো। তুমি আর আমি দুইজন থাকি দুই মহাদেশে। আগামী দুই কিংবা তিন বছরে দুইজনের একত্রিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও নাই, নিশ্চয়তা তো বহু দূরের কথা। এরচেয়ে কি দুজন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াই ভাল নয়?
কথাগুলো শুনতে শুনতে বুকে একপ্রকার চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করছিলাম আমি। যদিও চেনা-জানা অনেকের জীবনের সাথেই ঘটনাপ্রবাহের মিল খুঁজে পাচ্ছিলাম। আমি একা দেশে ফিরে আসার পর এমন কেউ নেই যে আমায় এ ধরনের একটা ভবিষ্যতবাণী না শুনিয়ে ছেড়েছিল। আজ মনে হচ্ছে, সবাই আসলে ঠিকই বলেছিল। আমিই শুধু অন্ধের মতো চোখ বন্ধ করে ভাবছিলাম আমার ঘরে প্রলয়ের আঘাত আসবে না। কিন্তু তাই কি হয়?
মেয়েটির কথায় আমার রাজি হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। শুধু একবার বলেছিলাম, এখনই এমন কিছু না করে বছরখানেক পরে করলে হয় না? তাতেও সে রাজি হয় নি। তার নাকি নতুন চাকুরির কাগজ-পত্র, ভিসার আবেদনের কাগজ-পত্র ইত্যাদিতে "সিঙ্গেল" কথাটি লেখা থাকলে অনেক রকমের সুবিধা হয়। বিবাহিত লেখা থাকলে অনেকে অনেক রকম প্রশ্ন করে। ভিসা অফিসারের স্বামী কোথায়, কবে আসবে ইত্যাদি বলে খুব জ্বালাতন করে। সে তাই নতুন চাকুরি আর ভিসার কাগজপত্র যথাযথ দপ্তরে জমা দেবার পূর্বেই বিচ্ছেদ চায়। যাতে নতুন কাগজপত্র "ঝামেলামুক্ত" হয়।
মাসখানেকের ভেতর তার কাগজপত্র এবং সে নিজেও ঝামেলামুক্ত হয়ে গিয়েছিল। অর্থ আমাদের বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল।
তারপর প্রথম ক'টা মাস বিভীষিকার মতো কাটে আমার। প্রতিরাতে দুঃস্বপ্ন দেখতাম। মাঝরাতে জেগে উঠে বসে থাকতাম। সারারাত আর ঘুম আসতো না। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এক বন্ধু আমার পাশে এগিয়ে এসেছিল সেই সময়। আমি পুরোপুরি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ার আগেই আমায় জোর করে একজন মনোবিদের কাছে নিয়ে গিয়েছিল সে।
আমার সব কথা শুনে মনোবিদ প্রথম দিনই হাই পাওয়ারের 'জানাক্স' দিয়ে বলেছিল, আপনাকে প্রথম প্রথম প্রতিদিনই এর একটা করে নিতে হবে। এ সময়টা আপনি একপ্রকার নেশাগ্রস্থ অবস্থায় পার করবেন। ক্ষুধা, নিদ্রা, সুখানুভূতি, দুঃখের কথা- এসবের কিছুই প্রায় মনে থাকবে না। তবে ধীরে ধীরে আপনার মনোজগতে পরিবর্তন আসবে। আবারও জীবনে হাসিখুশিভাবে বেঁচে থাকতে পারার মাহাত্ম্য বুঝতে পারবেন। এবং সেটি যদি কখনও হয়, তাহলে এভাবে নিজের সবকিছু অন্য কারও জন্য ভেসে যেতে দেবেন না দয়া করে। দ্বিতীয়বার এমন হলে এ ওষুধ আপনাকে দেয়া যাবে না। এ ওষুধ দীর্ঘমেয়াদে ব্যাবহারের উপযোগীও না। মূল কথা, দ্বিতীয়বার এমন হওয়া মানে স্বাভাবিক জীবনের সম্ভাবনা আপনার জন্য সুদূর পরাহত।
৬.
ছেলেবেলা থেকে আমার সুনাম লক্ষী ছেলে হিসেবে। ডাক্তারের কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলার ফলে মাস তিনেকের মাথায় আমি কষ্টে-সৃষ্টে ঘুরে দাঁড়ালাম। ওই মেয়েটির সাথে এরপর আর কোনো যোগাযোগ হয় নি। কোন খবর কোনো মাধ্যমেও পাই নি। সেটি হয়তো একটি বড় কারণ ছিল উন্নতির পেছনে।
সেবার জার্মানি থেকে দেশে ফিরেই আমি পুরোনো চাকুরিতে আবার যোগ দিয়েছিলাম, যেটি শত ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতরও টিকে ছিল। আমার বসের বদান্যতাই ছিল যার একমাত্র কারণ। মানুষটি ওভাবে সকলকেই সাহায্য করতে ভালবাসতেন।
মনোবিদের সাথে দেখা করে আসার তিন মাস পর যখন আমার মানসিক অবস্থায় খানিকটা স্থিতিশীলতা এসেছিল, তখন তিনি একদিন আমায় জিজ্ঞেস করেছিলেন- তুমি কি আবার বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছো?
আমি আকাশ থেকে পড়েছিলাম প্রশ্নটি শুনে। না তো, কি করে আমি আবার চেষ্টা করবো? আমি অসুস্থই ছিলাম এতদিন। বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করতে যেটুকু মানসিক স্থিরতা লাগে- তাও তো নেই আমার।
বস্ তখন আমায় একটি ই-মেইলের কপি দিয়ে বলেছিলেন, তুমি তোমার সিভিতে রেফারি হিসেবে আমার নাম দিয়েছিলে। জার্মানির একটি কোম্পানি আমার কাছে তোমার ব্যাপারে খোঁজখবর করছে। চাইলে দেখতে পারো।
আমি হাত বাড়িয়ে ই-মেইলের কপিটি নিয়ে নিজের সিটে ফিরে এসেছিলাম। আসলেই আমার ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয়েছে। খুব উৎসাহ সহকারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই বন্ধুকে ফোন করে সবকিছু খুলে বললাম। ওদিকে আমার বস্-ও সেই ই-মেইলের উত্তরে ভাল ভাল কথা লিখে পাঠিয়ে দিয়েছিল। ভদ্রলোক মন থেকেই চাইতো আমি যেন তার অফিসের চেয়েও ভাল কোনো জায়গায় পৌঁছুতে পারি।
বন্ধুর পরামর্শে যখন আমি সেই কোম্পানিটির সাথে যোগাযোগ করি, তখন জানতে পারি যে ওদের ওখানে প্রায় বছরখানেকেরও বেশি সময় আগে আমি আবেদন করেছিলাম। সে সময় ওরা আমায় নিতে চেয়েছিল, কিন্তু মন্দার কারণে পারে নি। এখন সময় পাল্টেছে তাই ওরাও আবার যোগাযোগ করছে আমার সাথে। জানার জন্য যে আমার কি তখনও ওদের সাথে কাজ করার আগ্রহ আছে কিনা।
আমি জানিয়ে দিলাম, আছে।
তারপর খুব দ্রুতই সব ব্যবস্থা হয়ে গেল। এক কাকডাকা ভোরে ইতিহাদ এয়ারলাইন্সের বিমানে করে আমি আবারও জার্মানির উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালাম। এবারের যাত্রাটা ভিন্ন ছিল। মন ভরা অনিশ্চয়তা ছিল না আগের মতো। তবে খারাপলাগা বোধেরা ছিল আশপাশেই। আমার এ খবরে নিঃস্বার্থভাবে খুশি হতে পারতেন যে দু'জন মানুষ, তাদের কেউই আজ আর নেই। যতোবার ভাবছিলাম, চোখ দু'টো জলে ভরে যাচ্ছিল।
যে সকল ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে আমি সেদিনের অবস্থায় পড়েছিলাম, তার কোনকিছুই ঘটতো না, যদি আমি ছেলেবেলায় যে নিঃস্বার্থভাবে বেড়ে ওঠা শিখেছিলাম- সেটি ধরে রাখতে পারতাম। উচ্চাভিলাষ আমায় ধীরে ধীরে সবার থেকে আলাদা করে দিয়েছিল। আমি এমনকি আদতে উচ্চাভিলাষী ছিলামও না। আমার ভেতর জিনিসটির বীজ যে বপন করে খোঁড়াখুড়ির দ্বারা আধাখেঁচড়া এক আগাছা জন্ম দিয়েছিল, তারও কোনো দেখা ছিল না সেদিন আশেপাশে।
কিসের আশায় আসলে আমি আবারও বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছি- পরিস্কার দেখতে পাচ্ছিলাম না সে সময় আমি। তারপরও স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মতো পাড়ি দিয়ে যাচ্ছিলাম বিমানবন্দরের চেক পয়েন্টগুলো। কোন একদিন সবকিছুর সমাপ্তি ঘটবে আর আমি আবারও আমার ফেলে আসা স্বপ্নময় দিনগুলি ফিরে পাবো সেই আশাতে।
৭.
দ্বিতীয়বার জার্মানির মাটিতে পা দেয়ার অভিজ্ঞতা প্রথমবারের থেকে একদমই ভিন্ন ছিল। এবার আমার সবই প্রায় চেনাজানা। সেই একই শহরের একই বিমানবন্দরে নেমেছি। সেবার ছিল মনের আনাচ-কানাচ ভরা দুশ্চিন্তা। এবার প্রায় কিছুই নেই। না ভাল লাগা, না খারাপ লাগা। শুধুই কোনমতে পাড়ি দেয়ার আশা। কি যে পাড়ি দেবো তাও জানি না।
অল্প কিছুদিনের মধ্যে অবশ্য আমার অবস্থায় বেশ খানিকটা পরিবর্তন আসলো। নতুন চাকুরি, সেখানকার দায়িত্ব, সহকর্মী সবাই মিলে আমার সে পরিবর্তন ঘটিয়ে দিল। সে কারণেই হয়তো ধীরে ধীরে আমি নিজের প্রতি বেশ যত্নশীল হয়ে উঠছিলাম। নিয়ম করে বাজার করতাম নিজের জন্য। সকালের নাশতা বাদ দিতাম না কখনও। দুপুরে সহকর্মীদের সাথে খেতে যেতাম। রাতেও ঘরে ফিরে খাবার চড়াতাম চুলায়। অথচ মাঝের ভীষণ খারাপ দিনগুলোতে হয়তো তিন দিনে একবার কিংবা দুই দিনে একবার খেতাম আমি।
আমি ধীরে ধীরে খেলাধূলাতেও মনোযোগ দিলাম। অফিসের সহকর্মীদের মাধ্যমেই স্থানীয় ব্যাডমিন্টন ক্লাব, ফুটবল ক্লাব, টেবিল টেনিস ক্লাব, সুইমিং ক্লাব ইত্যাদিতে নিবন্ধন করে ফেললাম। সপ্তাহে তিন-চারদিনই অফিস শেষে একেক ক্লাবে একেক খেলার চর্চাতে অংশ নেয়ার তাগাদা থাকে। বাকি দিনগুলোতে বই পড়ি, বাগান করি, গান শুনি, সিনেমা কিংবা নাটক দেখি- সময় মোটামুটি কেটেই যায়।
মনে হচ্ছিল জীবনটায় আবারও ছন্দ ফিরে আসতে লেগেছে। সে সময় আমার ভাল লাগতো অফিস থেকে ফেরার পথে কাজ না থাকলে, জার্মান সংসদ ভবন এলাকার ভেতর দিয়ে খানিকটা সময় হাঁটতে এবং স্প্রি নদীর বাঁধানো পাড়ে পা দুলিয়ে বসে আশপাশের নিরিবিলি, শান্ত আর গোছানো পরিবেশটাকে চোখ ভরে দেখতে। এমনকি সুযোগ পেলে অচেনা পথচারীদের সাথে বিশ্বব্যাপী চলমান ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে আলাপ জুড়ে দিতেও ভাল লাগতো আমার।
শুধু মাঝে মাঝে আমার প্রিয় মানুষদের পাশে তাদের বিদায়বেলায় থাকতে না পারার দুঃখ আমায় ভীষণভাবে গ্রাস করে ফেলতো। আমি কখনোই তাদের সাথে একটি শেষ দেখা করার সুযোগ পাই নি। দুই দিনের জন্য দেখা করে আসতে যেতে চেয়েও একসময় যেতে পারি নি। যার কারণে যেতে পারি নি- সেই মানুষটিও তার প্রয়োজন শেষে আমাকে জীবন থেকে একপ্রকার তাড়িয়েই দিয়েছে।
কথাগুলো যেসব দিন মনে পড়তো, সেসব দিন কোনকিছু ভাল লাগতো না আমার। কোন সমাধানও পাচ্ছিলাম না সে সমস্যার। অনেকে বলছিল, আবারও কারও সাথে মন আদান-প্রদানের চেষ্টা করে দেখতে। কোনরকম আগ্রহ পাচ্ছিলাম না আমি তাতে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই বন্ধুটি যোগাযোগ রাখতো নিয়মিত। আমি ওকে বলতাম জার্মানি চলে আসতে। জানতাম বলা যতো সহজ, করা ততো সহজ না। বিশেষ করে মধ্য ত্রিশের পর এতবড় চ্যালেঞ্জ নেয়া আসলেই মুখের কথা না। বন্ধুও বুঝতো, আমিও বুঝতাম। তারপরও আমরা বিভিন্ন সম্ভাবনা নিয়ে একে অপরের সঙ্গে নিয়ম করে আলাপচারিতা চালিয়ে যেতাম।
৮.
সে আলাপচারিতা যে কোনদিন ফলপ্রসূ হয়ে উঠবে- তা আমার কল্পনায় প্রায় ছিল না বললেই চলে। সেটিও একদিন ঘটে গেলো!
আমরা দুই বন্ধু মিলে খুঁজে বের করে ফেললাম জার্মানিতে কিভাবে ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করতে হয়। জানা গেল, পৃথিবীর যে কেউ জার্মানিতে ছয় মাসের জন্য ব্যবসা শুরুর উদ্দেশ্যে চলে আসতে পারে। সফলভাবে ব্যবসা দাঁড় করিয়ে ফেলতে পারলে সেখানেও প্রচুর উন্নতির সুযোগ রয়েছে।
আমরা দুজনে মিলে একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা চালু করলাম। স্থানীয় বাঙালি কমিউনিটির সহায়তায় সংস্থাটি এক সময় দাঁড়িয়েও গেল। আমরা স্থানীয় বাঙালিদের মধ্যে যারা ব্যবসায়ী যেমন হোটেল মালিক, রেস্টুরেন্ট মালিক, আমদানি কিংবা রপ্তানিকারক, পোশাক ব্যাবসায়ী- এমন সব মানুষদের কাছে আমাদের সংস্থার সেবা নিয়ে এগিয়ে গেলাম।
বিজ্ঞাপন, যোগাযোগ, লিয়াঁজো- যতো রকম সম্ভাব্য ক্ষেত্র রয়েছে সবক্ষেত্রে আমরা নিজেদের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান আর কর্মস্পৃহা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। অল্পদিনের মধ্যেই পুরো জার্মানির বাঙালি কমিউনিটিতে আমাদের বিজ্ঞাপনী সংস্থার সুনাম ছড়িয়ে পড়লো। দেশ থেকে কেউ জার্মানির যেকোন খাতে বিনিয়োগ করতে চাইলেও, প্রথমে আমাদের সাথে যোগাযোগ করা শুরু করলো। ভুত থেকে ভুতে ছড়িয়ে পড়লো আমাদের সংস্থার সুনাম।
ইতোমধ্যে আমার বন্ধুর ভিসাও পাকা হয়ে গিয়েছিল জার্মানিতে। আমরা দুইজনে মিলে ব্যবসা সম্প্রসারণের কথা ভাবা শুরু করলাম। সেই চিন্তার অংশ হিসেবে নাইজেরিয়ার একজন উঠতি ব্যবসায়ীকে আমাদের অংশীদার করে নিলাম। নাইজেরিয়ার সেই ব্যক্তি নিজ দেশে মোটিভেশনাল স্পীকার হিসেবে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। আমাদের বিজনেস্ মডেল ভাল লেগে যাওয়ায় কোনো শর্ত ছাড়াই আমাদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন। তার হাত ধরে পুরো আফ্রিকা মহাদেশে আমাদের সংস্থার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। আমরা দুজন পাই আরেকজন অকৃত্রিম বন্ধুর খোঁজ।
তারপর আর আমাদের পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। একই সূত্র ধরে আমরা ব্যবসা বিস্তৃত করি পূর্ব এশিয়ায়, দক্ষিণ আমেরিকায় এবং সবশেষে উত্তর আমেরিকায়। অল্প সময়ের ভেতর আমরা নিউ ইয়র্কের ব্যাস্ততম এলাকা ম্যানহাটন-এ আমাদের সংস্থার প্রধান কার্যালয় স্থানান্তর করি। বাংলাদেশ থেকে কাজপাগল এক যুবক আর নাাইজেরিয়া থেকে এক যুবতীকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে সে কার্যালয়ের দুই প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিই। আজ প্রায় পাঁচ বছর ধরে তারা দুজন অসাধারণভাবে, ক্ষেত্রবিশেষে আমি ও আমার দুই বন্ধুর চেয়েও ভালভাবে বিজ্ঞাপনী সংস্থাটিকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
আমরা বন্ধুরাও বেশ ভাল আছি। নাইজেরিয়ান বন্ধুটি লস এঞ্জেলেসের রকি বিচের তীরে প্রাসাদোপম একটি বাড়ি কিনে থিতু হয়েছে। আজকাল নাকি সে শুধুই অনলাইন-ভিডিও প্রস্তুত করে। তার সেসব ভিডিও সারা দুনিয়ায় জনপ্রিয়। সেগুলো পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ উঠতি বয়সী বাচ্চা-কাচ্চাকে নিজের মন ও হৃদয়কে অনুসরণ করতে অনুপ্রাণিত করে। আমি সময় পেলে অনলাইনে ঢু মেরে ওর ভিডিওগুলো দেখি। দারুণ সব ভিডিও বানায় সে!
বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুটি ফিরে গিয়েছে দেশে। তার পূর্বপুরুষের ভিটেবাড়িতে আজ চাঁদের হাট। তার নিজের বাচ্চারা বড় হচ্ছে। বাবা-মা বুড়ো হচ্ছে। তাদের বাবা-মায়েরা আরও বুড়ো হচ্ছে। সবাইকে নিয়ে মাঝখানটিতে বসে জীবন যাপন করছে আমার বন্ধুটি।
পরিবারকে নিয়ে শান্তিতে বাঁচতে পারার সুখের কাছে পৃথিবীর আর সব সুখ যে তুচ্ছ, তা আমার এই মানুষের প্রতি প্রচণ্ড সহানুভূতিশীল এবং চাকুরি ও ব্যবসা দুই ক্ষেত্রেই সফল বন্ধুটির দিকে এক ঝলক তাকালেই বোঝা যায়। আমি মাঝে মাঝে মধ্যরাত্রে তার পূর্বপুরুষের ভিটেবাড়ির মূলফটকের সামনের ব্যাকপ্যাক কাঁধে হাজির হয়ে যাই। প্রথম প্রথম বন্ধু অবাক হতো। আজকাল ওর ওসব সয়ে গেছে।
আর আমি? নিউ ইয়র্কের দায়িত্ব নতুন চেয়ারম্যান ও সিইও'র হাতে তুলে দেয়ার পরও কিছুদিন অফিস করেছিলাম। তারপর প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণ করে ফেলি। আমাদের সংস্থাটি এমনভাবে গড়ে তোলা যাতে প্রেসিডেন্টের হাতে কোনো ক্ষমতা নেই, শুধুমাত্র একটি ক্ষমতা ছাড়া। যেটি হচ্ছে আবার নিতান্ত প্রয়োজনে সংস্থার সব ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নেয়ার অধিকার!
আজ অবধি তার কোনো প্রয়োজন পড়ে নি। দূরতম সম্ভাবনাও দেখা দেয় নি। কখনো দেখা দেবে বলেও মনে হচ্ছে না।
সম্প্রতি আমাদের প্রতিষ্ঠিত সে বিজ্ঞাপনী সংস্থাটি; আমার কিংবা এর অন্য প্রতিষ্ঠাতা আমার বন্ধুর, কিংবা এর বিকাশে অন্যতম ভূমিকা পালন করা অপর বন্ধুর সকল আশা-আকাঙ্ক্ষা ও লক্ষ্য তো পূরণ করেছেই, এগিয়ে যাচ্ছে আরও দুর্বার গতিতে। কোথায় গিয়ে যে থামবে কে জানে!
অচিরেই ফোর্বস্ কিংবা বিজনেস্ ইনসাইডারের মতো কোনো পত্রিকার সেরা দশ বিজ্ঞাপনী সংস্থার তালিকায় যে সেটির নাম ঢুকে যাবে- তা আমরা জানি। সেসব নিয়ে কেউই খুব একটা মাথা ঘামাই না। আমেরিকান বা ইউরোপিয়ান কোনো সংস্থা হলে এতদিনে ঘটনাটা ঘটেও যেতো। শুধু এশিয়ার ছোট্ট একটি দেশের নাগরিকরা এর কর্ণধার বলেই হয়তো খানিকটা বেশি সময় লাগছে। আমরা সেটিকে ইতিবাচকভাবেই দেখি। লাইমলাইটে চলে আসার পূর্বে যতবেশি অগ্রগতি অর্জন সম্ভব আমরা করতে চাই। আমাদের সংস্থার তরুণ নেতৃত্ব সে কাজকে বেশ ভালভাবেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
প্রেসিডেন্ট পদ নিয়ে নেয়ার পর অবশ্য বেশিদিন আমি নিউ ইয়র্ক থাকি নি। তবে মাঝে-মধ্যে কাজের জন্য সেখানে ফিরতে হয় বলে অ্যাপার্টমেন্টটা রেখে দিয়েছি। বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় যাওয়া যে কেউ আমার সাথে যোগাযোগ করে প্রথম দু-একসপ্তাহ চাইলে সেখানে থাকতে পারে। তারপর নিজের একটা ব্যবস্থা করে তাদেরকে নিজ শহরে কিংবা নিজ গন্তব্যে চলে যেতে হয়। আর যখন আমি যাই, তখন আমি নিজেই থাকি। তবে আমার যাওয়া হয় কালে-ভদ্রে। কারণ আজকাল আমার বেশিরভাগ সময় কাটে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ানোতে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে অনুন্নত দেশের দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখা ইদানীং আমার নেশায় পরিণত হয়েছে। সদ্যই জানজিবার থেকে কেনিয়া, উগান্ডা, রুয়ান্ডা আর বুরুন্ডি ঘুরে তিন মাসের লম্বা সফর শেষে বাড়ি ফিরেছি।
আমার নিজের পূর্বপুরুষের বাড়িতে। যেখান থেকে একদিন বের হয়ে যাবার সময় আমার সবচেয়ে প্রিয় দুজন মানুষকে আবারও দেখা হবে সে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বের হয়েছিলাম। ইহজীবনে সে প্রতিশ্রুতি রাখা সম্ভব হয় নাই।
তবে তাদের রেখে যাওয়া বাড়িটিতে ফিরতে পেরে আমার অশান্ত মন অনেকটাই শান্ত হয়েছে। বাড়িটির সর্বত্রই যেন এখনও তাদের ছোঁয়া লেগে আছে বাড়িটিতে। যখনই বাড়িটিতে ফিরে আসি, আমি সেই ছোঁয়া টের পাই। মাঝে মাঝে দিব্যদৃষ্টিতে দেখতেও পাই, উঠানে মেলে দেয়া কাপড় তুলছেন মা। বাবা বাড়ি ফিরছেন বাজারের ব্যাগ হাতে। আর আমি চৌকিতে বসে হোমওয়ার্ক করছি। মসজিদের মাইক থেকে মাগরিবের আযান ভেসে আসছে।
অমন দৃশ্য যখন দেখতে পাই, মনের ভেতর এমন অনাবিল প্রশান্তি নেমে আসে, যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এককালে আমি স্বপ্ন দেখতাম এই বাড়িটিতে আমার সন্তানেরা তাদের পূর্বপুরুষদের কোলে-পিঠে চড়ে বড় হবে। সে স্বপ্ন পূরণ হয় নাই। আর কখনও হওয়ার উপায়ও নাই। তবে আমি নিজে বাড়িটিতে বুড়ো হওয়ার সুযোগ পেয়েছি সেজন্য আমি কোনকিছুর চাইতে কম কৃতজ্ঞ নই।
আর সেই মেয়েটি? আমি জীবনে কখনও তার কোনো খবর পাই নি আর। কখনও ইচ্ছাও করে নি কোনো খবর নিতে।
মাঝে মাঝে আমাদের জীবনে ভুল মানুষ চলে আসে। তারা হয়তো সবার জন্য ভুল না। অন্য কারও জন্য হয়তো দেখা যাবে একদম পারফেক্ট! কিন্তু আমাদের জন্য নয়। এটা স্বাভাবিক। এ ধরনের মানুষ জীবনে চলে আসলে, সময় থাকতে তাদের কাছ থেকে দুরে সরে আসতে হয়। নাহলে সেটি অনেক সময় আমাদের জন্য চিরস্থায়ী কষ্টের কারণ হয়ে উঠতে পারে।
শিক্ষাটি আমায় বড় মূল্য চুকিয়ে পেতে হয়েছে। এ লেখার শুরুতে বলেছিলাম, আমার মন খারাপ লাগার বিষয়টিকে একটি গল্পের রূপ দেয়ার চেষ্টার কথা। এর মূল উদ্দেশ্য আসলে সকলের সাথে উল্লিখিত শিক্ষাটি ভাগ করে নেয়া। আশা করি সে উদ্দেশ্যে খানিকটা সফল হয়েছি, তাই না?
---
মন্তব্য করুন