যাপিত দহনের গল্প
অসম্ভব কথাটির সাথে দ্বিমত পোষণ করা একটি জীবন কাটানো কতটা সহজ? সেই কবে কোন ছেলেবেলায় বইয়ে পড়েছিলাম ফরাসী বীর নেপোলিয়নের কথা। বলে কিনা অসম্ভব নাকি শুধু বোকাদের শব্দকোষেই পাওয়া যায়। আচ্ছা, যদি বুকের ভেতর কষ্ট হয় তবে কি সেটা বোধ না করে থাকা সম্ভব? কিংবা যদি মনের সায় না মেলে তো সে কাজ আনন্দ নিয়ে করা?
দ্বিমতের সাথে সহমত নিয়েই চলছে জীবনের সময়ঘড়ি। প্রতিটি মুহূর্ত নতুন করে লেখা হচ্ছে আর যাপিত হচ্ছে। বিরামহীন। আজকাল সকালের রুটিনে একেক দিন একেক রকম কাজ তালিকাভূক্ত হয়। ঘুম থেকে পুরোপুরি সজাগ হয়ে ওঠার পর্যায়গুলো শেষে যখন আমি বছর তিনেক আগের জ্যাকেট ও জুতা পায়ে গলিয়ে বাসা থেকে বের হই, তখন দেখি পথের ধারে অনাদরেই খুশি হয়ে ফুটে থাকা মর্নিং গ্লোরি ফুলের বাহার। ওদের বেড়ে ওঠার পথে যত্ন-আত্তি বলতে কখনো কিছু ছিল না তারপরও তারা তেড়েফুঁড়ে বেড়ে উঠেছে। সকালের প্রথম সূর্য কিরণ পাঁপড়িতে মেখে মেলে ধরেছে নিজের সামান্য তথাপি অকৃত্রিম সৌন্দর্যকে। যেন সেও চায় পৃথিবীর নজর সবকিছু থেকে একটিবার শুধু একটিবার তার 'পরে পরুক!
আমি সাধারণত সাইকেল চালিয়ে রুটি-রুজির উদ্দেশ্যে পথ পাড়ি দিই। আমার যাত্রাপথের দৈর্ঘ্য বড়জোর ১৫ মিনিট। এর মধ্যেই এমন কত যে অজানা ফুলের গাছ, ঝোপ, ঝাড় চোখে পরে তার ইয়ত্তা নেই। পথে আড়াআড়িভাবে শুয়ে থাকে একটি খাল। তার নাম কিনছিগ তাল। বহু আগে কন্সন্টাজ লেক থেকে একটি ছোট্ট জলধারা পথ ভুলে চলে এসেছিল ব্ল্যাক ফরেস্টের ভেতরে। জার্মানির ব্ল্যাক ফরেস্ট অঞ্চলে পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে এমন খাল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অজস্র। শহরের পর শহর, গ্রামের পর গ্রাম পাড়ি দিয়ে সেসব খাল গিয়ে মিশেছে রাইন নদীতে গিয়ে। নদী মিশেছে গিয়ে নর্থ সী-তে।
আমার চলার পথে আড়াআড়িভাবে শুয়ে থাকা কিনছিগ তাল তার দুই পাড়ে ধরে থাকে আরও অনেক নাম জানা ফুলের ডালি। যেন পসরা সাজিয়ে বসেছে। হাতছানি দিয়ে ডাকে পথের অমনোযোগী পথিককে। কি যেন জীবনের গোপন মন্ত্র বলতে চায় কানে কানে।
সবসময় ওদের ডাকে সাড়া দিতে নেই। জীবনটা এই পাহাড়ি এলাকায় বন্ধুরও তো কম নয়। সকালের কাজের বেলায় চাইলেই কি বসে ওদের কথা শোনার ফুসরত পাওয়া যায়? ওদিকে যে চলছে আর বড় আয়োজনে জীবনের জয়গান। চলছে অনুষ্ঠান, বৈঠক, পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ কতকিছু। হাত বাড়িয়ে দিয়ে রেখেছে যোগ দেয়ার নিমন্ত্রণ। দ্রুত পা চালিয়ে প্যাডেল দিই। একবার সে নিমন্ত্রণের টান অনুভূত হলে পথের পাশে ছড়িয়ে থাকা টুকরো টুকরো স্বর্ণখন্ডগুলোকেও খানিক একা রেখে যাওয়া যায়। আর ওরা তো সবার জন্যই ফুটে রয়েছে। আমি একা দিনভর তাদের দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলে হবে?
কর্মস্থলে পৌঁছে প্রথমে জানালাটি খুলে দিই। এক ঝাঁক মুক্ত বাতাসে কেটে দিয়ে যায় আগের রাতের গুমোট ভাব। পিসি অন করে রান্নাঘরে যাই, একটা কফির কাপ খুঁজে বের করে তাতে খানিকটা দুধ ঢালি। কফিমেশিন থেকে যখন কালো কফি বের হয় তখন তার সুগন্ধে চারিদিক ভরে যায়। একটানা কাজ করি তারপর। বেলা ১২টা পর্যন্ত। এ সময়ে কতো যে খবর চারিদিকে ভেসে বেড়ায়। বিশ্বের নানা দেশের রাজনৈতিক নেতাদের অনৈতিক আর্থিক লেনদেনের খবর বের করতে বাঘা বাঘা কিছু সংবাদ মাধ্যমের সংবাদশিকারীরা ফাঁদ পেতেছে অনেকদিনের। সেখান থেকে খবর আসছে আফ্রিকার কোন রাজার অঢেল সম্পদ ইংল্যান্ডের ঘরে জমা হয়েছে, ইংল্যান্ডের কোন রাজা আবার অফিসের জায়গা কিনতে গিয়ে ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের অফিস কেড়ে নিয়েছে, দেশে কোন শিক্ষক কবে কাঁচি হাতে ছাত্রদের চুল কেটে দিয়েছে, দিয়ে মিথ্যাচার করেছে ঘটনা অস্বীকার করে- এমন শত শত খবর চারপাশ থেকে আসতে থাকে। আমি সেসব খবর মস্তিষ্কের তথ্যকেন্দ্রে না চাইতেও জমাই। ধীরে ধীরে মস্তিষ্ক স্বল্পমেয়াদী এইসব তথ্যে টইটম্বুর হয়ে ওঠে।
তারপর খেতে যাই। একেকদিন একেক জায়গায়। কখনো টার্কিশ দোকানের ডোনার কাবাব, কখনো ইতালিয়ান দোকানের পিৎজা আবার কখনো নেহায়েত ক্যান্টিনের জার্মান খাবার। আলু সেদ্ধ, বরবটি ভাজি, এক টুকরো মাংস আর গোলমরিচ দিয়ে বানানো ঘন ঝোল। খাবারের সময়টা আমার সবসময় খুব আনন্দে কাটে। রেস্তোরা, ক্যাফে কিংবা ক্যান্টিন যেখানেই খাওয়া হোক, আমার আশপাশের মানুষজনদের দেখতে দেখতে কখন যে খাওয়া শেষ হয়ে যায় টেরই পাই না। তারপর আবার ফিরে আসা সকালের সেই টেবিল-চেয়ারে। কোন কোন দিন হয়তো অন্য কাজ থাকে। প্রস্তুতি নিতে হয় কোন প্রশিক্ষণের কিংবা অনুষ্ঠানের। আর নাহয় বসে করতে হয় পরিকল্পনা। এভাবেই কেটে যায় সপ্তাহের দিনগুলো।
সন্ধ্যায় আবার সেই চেনা পথ ধরে চেনা ঘরটাতে ফিরে আসা। পথের পাশের নাম না জানা ফুলে ছেঁয়ে থাকা ফেরার সে পথকে বিষণ্ন মনে হয় না একটুও। শুধু পুরো মহাশূন্যের ছোঁয়াটুকু কখনো এড়িয়ে যাওয়া যায় না। এই শূন্যতাটা বোধ করি মানুষের কখনোই পূর্ণ হয় না। আমরাও তো সেই মহাশূন্যেরই অংশ, তাই না?
যদি শূন্যতা বলে কিছু না থাকতো, তাহলে জীবনের গল্পটা কি ভিন্ন হতো আমাদের? আফ্রিকা কিংবা ইংল্যান্ডের রাজাদের দুর্নীতি, নয়তো বাংলাদেশের চুল কেটে দেয়া শিক্ষকদের গল্পের বদলের কি লেখা হতো অগণিত রঙিন বাগানের গল্প? যেখানে গল্পের রাজকুমারেরা রাজকুমারীদের নিয়ে এসে চিরকাল সুখে-শান্তিতে বাস করে। মনে হয় না। কবিগুরু বহু আগেই বলে গিয়েছেন, "এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না। শুধু সুখ চলে যায়।"
অবশ্য আমি শুধু মানবপ্রেমের কথা বলতেও চাই নি। মানবকল্যাণের নিমিত্তে যে প্রেম, যে ভালবাসা, যে সহানুভূতি, যে সহনশীলতা আজ খুব প্রয়োজন তার কথা বলতে চেয়েছি। দিনের বেশিরভাগ সময় এই অভাব আমার সমসাময়িক পৃথিবীর সর্বত্র এত নগ্নভাবে ফুটে থাকতে দেখি যে, একটি সহজ সাধারণ দিনলিপিও সবশেষে এসে নতুন দিনের হাহাকারে পরিণত হয়।
আর জীবন? এইসব দেখে দেখে কেটে যায় তার অমূল্য সময়। চলে যাওয়া একটি মুহূর্তও ফিরে আসে কখনো। অথচ তারপরও কেউ বোঝে না আর একটু সহনশীলতার কি মূল্য। আর একটু ভালবাসা আমাদের সকলেরই কতখানি দরকার ছিল।
---
মীর রাকীব-উন-নবী
১১ অক্টোবর ২০২১ ইং
বাহ
অনেক দিন পর... কেমন আছেন মীর?
টুটুল ভাই! আসলেই কতদিন পর!
কেমন আছেন? আমি আছি মোটামুটি। আগামী ডিসেম্বরে দেশে আসছি।
ভাল থাকবেন। দেখা হবে ইনশাল্লাহ্।
মন্তব্য করুন