গল্প: এক এক্লিপস্-এ আটকে পড়া কালে ব্লু মুন খুব হেল্প করেছিল
সেবার ভালো না লাগার ব্যামোটা বেশ ভালো ভাবে আমাকে পেয়ে বসেছিল। কোনোকিছু ভালো লাগে না। সকালে ঘুম থেকে উঠতে ভালো লাগে না। বিছানায় গড়াগড়ি দিতে ভালো লাগে না। কারো সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে না। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে ভালো লাগে না। ভাজা-পোড়া খেতে ভালো লাগে না। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতে ভালো লাগে না, চ্যাটিং করতে ভালো লাগে না। টরেন্ট দিয়ে মুভি নামাতে ভালো লাগে না। লাগে না তো লাগেই না। মাথাভর্তি সাইকেডেলিক জ্যাম। ঘরের স্পিকারে পিংক ফ্লয়েডের এক্লিপস্ বাজতে থাকে টানা। দিনের পর দিন কেটে যায়। আশপাশের মানুষ আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। আমি তাদের জন্য কিছুই করতে পারি না।
একসময় বাসা থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিলাম। তার কয়েক দিনের মধ্যেই অফিসের বসের অ্যাড্রেসে একটা রিজাইন লেটার লিখে ই-মেইল করে দিলাম। এই কাজটা করে অনেক দিন পর আমার একটু ভালো লেগেছিল। যদিও সেটা যৎসামান্য ভালো লাগা, তারপরও সেটুকু সেলিব্রেট করতেই কেনিয়ান কনস্যূলেটের সেলেস্তিন চাকমার কাছ থেকে এক বোতল জ্যাক অ্যান্ড ড্যানিয়েলস্ কিনে এনেছিলাম। এনে সারারাত আমার অ্যাপার্টমেন্টের ছাদে এক বালতি পানিতে পা ডুবিয়ে বসে ছিলাম। সে রাতে ব্লু মুন ছিল। মাঝে মাঝে কড়া হুইস্কির বোতলটাতে চুমুক দিচ্ছিলাম আর বিশাল চাঁদের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল চাঁদ খুব ভালো করে জানে আমার কি হয়েছে এবং আমি নিজের মুখে একটা তীব্র প্রশ্নবোধক চিহ্ন ফুটিয়ে তাকিয়ে থাকলেই, ও এক সময় এসে আমার সব সমস্যার সমাধান করে দিয়ে যাবে।
সে রাতে চাঁদ শেষ পর্যন্ত আসে নি। তবে শেষরাতের দিকে ফ্রোজেন সিনেমার নায়িকার মতো দেখতে একটা মেয়ে ছাদে এসে আমাকে দেখে ভিমড়ি খাবার জোগাড় করেছিল। সে রাতে খুব ধীরে ধীরে খাচ্ছিলাম বলে জেডি'র বোতল তখনও শেষ হয় নি। আমিও পুরোপুরি ‘আউট অব সেন্স’ হয়ে যাই নি। চাঁদটাও সঙ্গ ছাড়তে চাইছিল না। মেয়েটি যাতে ভয় পেয়ে পুরো পরিবেশটা গুবলেট না করে দেয়, সেজন্য আমি ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে শ্ শ্ শব্দে ওকে বোঝানোর চেষ্টা চালালাম, আস্তে-ধীরে-কুল-টেক ইট ইজি-কীপ কাম-নো হার্ম-কীপ কাম।
এতে কাজ হয়েছিল। মেয়েটি পা টিপে টিপে আমার কাছে এগিযে এলো। হাতের বোতলের দিকে বিস্ফোরিত চোখে ফিসফিসিয়ে জানতে চাইলো, কি করেন? আমিও ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি আমাকে চেনেন? মেয়েটি বললো, একই বিল্ডিংয়ে থাকি চিনবো না? আমি তখন মেয়েটির দিকে ভালোভাবে তাকানোর চেষ্টা করলাম। কখনও দেখেছি বলে মনে পড়লো না। অ্যাপার্টমেন্টটা ভাড়া নেবার পর অবশ্য কখনোই আশপাশের ও উপর-নিচের দরজাগুলোর পেছনে কে বা কারা থাকে জানার সুযোগ হয় নি। কেয়ারটেকার আর দারোয়ানদের চিনি। বাড়িভাড়া নিতে আসে বলে আমার অ্যাপার্টমেন্টের মালিক এবং তার ছেলেকেও চিনি। এই মেয়েটিকে কখনো লিফটে বা অন্য কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ছিলো না। মনে না পড়ার বিষয়টাকে পাশে সরিয়ে রেখে বললাম, সেলিব্রেট করি।
মেয়েটি জানতে চাইলো, কি সেলিব্রেট করেন?
-ভালো লাগা।
-সেটা কিরকম?
-অনেকদিন পর আজকে একটা কাজ করে ভালো লেগেছে।
-পানির বালতিতে পা ডুবিয়ে রেখেছেন কেন?
-এতে করে নদীর পাড়ে বসে থাকার অনুভূতি হচ্ছে।
-ওটা কিসের বোতল?
-হুইস্কি। খাবেন?
-না বাবা, আমি ওইসব খাই না।
-কেন খান না?
মেয়েটি খানিকক্ষণ কি জানি ভেবে বললো, কেন খাই না ঠিক জানি না। কখনো খাই নি। টিভিতে দেখেছি মানুষকে খেতে। দেখে ভালো মনে হয় নি।
-নিজে একবার খেয়ে চেক করে দেখতে পারেন ভালো নাকি খারাপ।
-যদি খারাপ হয়?
-তাহলে এরপরে কেউ যখন জিজ্ঞেস করবে কেন খান না, তখন বলতে পারবেন, এটা খেতে আপনার ভালো লাগে নি। তাই খান না।
-পয়েন্ট! দেন তো একটু ট্রাই করি।
-তাহলে এক বালতি পানি নিয়ে আসেন।
-কেন?
-যেহেতু জীবনে প্রথমবারের মতো খাচ্ছেন, একটু আয়োজন করেই খাওয়া হোক।
-বালতি কই পাবো? এখন বাসা থেকে বালতি নিয়ে আসা সম্ভব না।
-ছাদেই অনেকগুলো বালতি আছে। আমারটাও ছাদ থেকে জোগাড় করা। মনে হয় গাছে পানি দেয়ার জন্য রাখা হয়েছে। একটা নিয়ে কল থেকে পানি ভরে নেন।
মেয়েটি উঠে গেল। আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে চাঁদের দিকে আনমনে চেয়ে ছিলাম বলে খেয়াল করি নি কখন আবার ফিরে এসে পাশে বসেছে। হটাৎ ছল ছল শব্দ শুনে পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখলাম মেয়েটি নিজের বালতিতে পা ডুবিয়ে একটু দাপাদাপি করার চেষ্টা চালাচ্ছে। ফলে ওই শব্দটা হচ্ছে। শব্দটা ভালোই লাগছে শুনতে। মনে হচ্ছে নদীর স্রোত পাড়ে গিয়ে ধাক্কা খাচ্ছে। মেয়েটিকে জেডি'র বোতলটা এগিয়ে দিতে সে জিজ্ঞেস করলো, সোজা গলায় ঢেলে দেবো? আমি বললাম, সোজা গলায় ঢেলে দিন।
তারপর মেয়েটি বোতলের তরল অনেকখানি সোজাসুজি নিজের গলায় ঢেলে দিলো। অনভ্যাসে খানিকটা মুখ থেকে বেরও হয়ে গেলো। সপ্রতিভভাবে মুখ মুছে মেয়েটি বোতল আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, বাপরে, কি কড়া ড্রিংক। গলা, বুক সবকিছু মনে হচ্ছে জ্বলে যাচ্ছে। আমি বললাম, এটা এখনই ঠিক হয়ে যাবে। মেয়েটি কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ধাতস্থ হয়ে আমাকে বললো, পরিবেশটা দারুণ তাই না?
-হুম।
-ছাদের ওপরে বাতাস এত ঠান্ডা হয় আগে জানতাম না।
-রাতে শহরে গাড়ি-টাড়ি কম চলে। তাই শহরটা একটু ঠান্ডা হয়ে যায়।
-চাঁদটা অনেক বড় না আজকে?
-হ্যাঁ আজকে ব্লু মুন।
-তাই নাকি? বাহ্। আপনে তো সেলিব্রেশনের জন্য ব্যপক দিন খুজেঁ বের করসেন।
-আমি বের করি নি। দিনটা নিজে নিজে বের হয়েছে।
-ও আচ্ছা, আপনে কি করেন?
-আমি কিছু করি না।
-মানে?
-একটা চাকরী করতাম। ওটা আজ ছেড়ে দিয়েছি।
-এটাই কি সেলিব্রেশনের উপলক্ষ।
-ইয়েস ইয়ং লেডি। এটাই উপলক্ষ।
-বাহ্ তাহলে দারুণ তো!
-হ্যাঁ এ সুবাদে আরেক বার চুমুক দিতে পারেন চাইলে।
-সিউর। কেন নয়? জিনিসটা আসলে খারাপ না। আপনি কখন থেকে এখানে বসে?
-বোতলের শুরু থেকে।
বলতে বলতে নিজে একটা চুমুক দিলাম এবং তারপর মেয়েটির দিকে আবার বোতলটি বাড়িয়ে দিলাম। সেই রাতে আমরা যখন বালতিতে পা ডুবিয়ে ছাদের কিনারায় বসে বোতলটা শেষ করেছি, ততক্ষণে ফজরের আজান দিয়ে দিয়েছে। ওঠার সময় দেখলাম আমাদের দু'জনেরই পা টলছে। তাই দেখে মেয়েটির একসময় হাসি শুরু হলো। হাসতে হাসতে হেঁচকি উঠে গেল। হাসি জিনিসটা খুব সংক্রামক বলে আমিও একসময় হাসতে শুরু করলাম। একেকবার হাসির একেকটা ঢেউ আসছিল আর আমাদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো। হাসির চোটে তাল সামলাতে আমাদের কষ্ট হচ্ছিলো। আর হাসিটা থামাতেও পারছিলাম না কোনোভাবে। শেষ পর্যন্ত বিকট শব্দে বোতল আছড়ে ভাঙার পর আমাদের হাসিতে ছেদ পড়লো। বুঝতে পারছিলাম, হুইস্কি তার কাজ করেছে। এখন বাকিটা সময় কেবলই ভেসে বেড়াবার।
মেয়েটিকে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় সাবধানে নামতে এবং হাসাহাসি না করতে বললাম। যদিও জানতাম না নিজে সেটা কতদূর মানতে পারবো। চারতলা পার হওয়ার পর মেয়েটি জানতে চাইলো, কি হলো আপনি বাসায় ঢুকলেন না? বুঝলাম, মেয়েটি জানে আমি কোন ফ্ল্যাটে থাকি। বললাম, না এখন খানিকক্ষণ রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবো। মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো, বাইকে করে?
-হুম বাইকে করে।
-আমিও যাবো। আপনার কোনো সমস্যা না থাকলে।
-আর ইউ সিউর?
-হ্যাঁ আমি পুরাই সিউর। আপনে এক মিনিট দাঁড়ান।
এই বলে মেয়েটি তিনতলার একটা অ্যাপার্টমেন্টের তালা চাবি দিয়ে খুলে ভেতরে ঢুকে গেল এবং এক মুহূর্ত পরেই একটা কালো রংয়ের চাদর গায়ে জড়িয়ে বের হয়ে এলো। নিচে এসে গ্যারাজ থেকে বাইক বের করলাম। মেয়েটি গুনগুন করে গান গাইছিল। ভালো করে শোনার চেষ্টা করে অবাক হয়ে গেলাম। পিংক ফ্লয়েডের এক্লিপস্। আপনমনে বলেছিলাম, কি আশ্চর্য এই এক্লিপসটা আমাকে ছাড়ছেই না। মেয়েটি শুনে ফেললো। জানতে চাইলো, তাই নাকি? আপনাকেও ছাড়ছে না? আমি বাইক চালাতে চালাতেই পেছন দিকে তাকিয়ে মাথা ডানে-বামে নাড়লাম। মেয়েটির মুখ দেখে মনে হলো, একই ঘটনা তার সঙ্গেও ঘটছে।
সকালের ঝিরঝিরে বাতাসে ঘুরতে ভালোই লাগছিলো। বিশেষ করে জেডি'র প্রভাবটা তখনও প্রায় পুরোমাত্রায় ছিল বলে সবকিছু অন্যরকম ভাবে ধরা দিচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো আমি ঢাকার রাস্তায় বাইক চালাচ্ছি না। কোনো স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশে বরফের মধ্যে স্কি-জেট চালাচ্ছি। ভাবনাটাকে প্রশ্রয় দিচ্ছিলাম ইচ্ছে করেই। স্কান্ডিনেভিয়ান কোনো দেশে স্কি-জেট চালানোর স্বপ্ন অনেকদিন ধরেই দেখি তো, তাই। মেয়েটি হঠাৎ জানতে চাইলো, আমরা এখন কোথায় যাবো? ভাবতে শুরু করলাম কোথায় যাওয়া যায়। ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই নীলক্ষেত মোড়ে পৌঁছে গেলাম। গরম নিহারীর সুগন্ধ নাকের মধ্যে ঢোকার জন্য হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দিল। মেয়েটিকে বললাম, চলেন নাস্তা করি। মেয়েটি সায় দিয়ে বললো, চলেন। অনেক খিদে পেয়েছে।
সকালের প্রথম কাস্টমার হিসাবে আমাদেরকে দোকানের বয়-বেয়ারারা প্রায় ভিআইপি ট্রিট দিয়ে দিল। বিশাল বাটিতে প্রচুর পরিমাণ অস্থি মজ্জাসহ নিহারী, আলাদা প্লেটে কুচি করে কাটা ধনে পাতা, কাঁচামরিচ, ঝাঁঝালো দেশি পেঁয়াজ আর কাগজী লেবু এবং কড়া করে ভাজা তেল ছাড়া পরোটা। আমরা গোগ্রাসে গিললাম বলা যায়। আমি আটটা আর মেয়েটি চারটা পরোটা। নাস্তার পর আসলো আদা দিয়ে বানানো রং চা আর সিগারেট। দোকানের মামাদেরকে কিছু বলাও লাগছিল না। যখন যা দরকার নিজে থেকেই এগিয়ে দিচ্ছিল তারা।
নাস্তা শেষে মেয়েটিকে বললাম, আমার একটু বাজার যেতে হবে। বাসার ফুড সাপ্লাই শেষ। আপনাকে কি বাসায় রেখে আসবো?
-না, কেন? আমিও আপনার সঙ্গে বাজারে যাবো।
-আর ইউ সিউর?
-ইয়েস স্যার। আমি সবসময় সবকিছুতে ওভার সিউর। আপনার বারবার আমার ব্যপারে সিউর হতে হবে না।
-আচ্ছা ঠিক আছে চলেন। বাজার কিন্তু খুব ঘিঞ্জি জায়গা।
-কোনো সমস্যা নেই। আমি আগে কখনও যাই নি। আপনার সঙ্গে ছাদে দেখা হওয়াটা মনে হচ্ছে মন্দ হয় নি। জীবনের অনেকগুলো কাজ প্রথমবারের মতো করা হচ্ছে।
বাজার করতে পছন্দ করলেও এক মাসে একাধিকবার বাজারে যেতে ভালো লাগে না আমার। যে কারণে সাধারনত পুরো মাসের বাজার একসঙ্গে করি। শহরের বিভিন্ন বাজার ঘুরে, যেখানে যেটা ভাল পাওয়া খুজেঁ, বাজার করার অভ্যাস আমার। মেয়েটিকে নিয়ে প্রথমে গেলাম কাপ্তান বাজার। পাখিজাতীয় খাবারের জন্য বেস্ট জায়গা। দু্ইটা দেশি মুরগী, দুইটা হাঁস, এক হালি কবুতরের বাচ্চা এবং একহালি কোয়েল পাখি কিনে নিলাম। সবগুলো পাখি প্রসেস করে একটা বড় পলিথিনে ঢুকিয়ে ঝুলিয়ে দিলাম বাইকের পেছনের পাদানিতে। তারপর চলে গেলাম কারওয়ান বাজার। তখন সকাল সাড়ে ৭টার মতো বাজে। কারওয়ান বাজারের মাছের আড়ৎ থেকে দেখে-শুনে এবং দরদাম করে কিনতে হলো একটা মাঝারি সাইজের বোয়াল আর একটা ইলিশ। মাছগুলো কাটিয়ে নিলাম বাজারের পেছনের রেললাইন থেকে। সেখানে বটি নিয়ে মাছ কাটার লোকজন বসে থাকে। মেয়েটি জানতে চাইলো, আপনে কোথায় কি পা্ওয়া যায় সব চিনেন নাকি?
-হুম।
-ভালোই। আমি ভাবছিলাম, ওই বিরাট মাছগুলো কিভাবে কাটবেন আপনে।
-দেখতেই পাচ্ছেন, নিজের ছোটখাটো সমস্যাগুলোর সমাধান আছে আমার কাছে।
-ভালো, অনেকের কাছে তো নিজের ছোটখাটো সমস্যাগুলোর সমাধানও থাকে না।
শুনে আমি মেয়েটির দিকে ভালো করে তাকানোর চেষ্টা করলাম। ওর কি কোনো সমস্যা আছে যেটার সমাধান নেই। দেখে কিছু বোঝা গেল না। পরে বিষয়টা জিজ্ঞেস করতে হবে বলে ঠিক করে বাইক চালানোয় মনোযোগ দিলাম। ফেরার পথে কথা হচ্ছিলো রান্নার রেসিপি নিয়ে। মেয়েটি বললো, সে নাকি ইলিশের দোপেঁয়াজা খুব দারুণ করে রাঁধতে পারে। জেনে আমি কথার কথা হিসাবেই বলেছিলাম, তাহলে তো একদিন আপনার রান্না খেতে হয়; আর মেয়েটি প্রত্যুত্তরে বলে বসলো, চলেন আজই আপনাকে রেঁধে খাওয়াই।
আমি নিশ্চিত হতে পারছিলাম না, মেয়েটি কি সিরিয়াসলি বললো নাকি আমার মতোই কথার কথা বললো। বাইক চালাতে চালাতেই পেছন দিকে তাকালাম এবং দেখলাম মেয়েটি সিরিয়াসলি কথাটা বলে মুখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন ফুটিয়ে বসে আছে। আমি না পেরে জিজ্ঞেস করতে বাধ্য হলাম, আর ইউ সিউর?
-ইয়েস আই আম। হোয়াট ডু য়ু সে?
-দারুণ প্রস্তাব। চলেন রান্না করি। কি আছে জীবনে?
ফিরে সোজা আমার অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে পড়লাম দু’জনে। মাছ রান্নার কথা মুখে বলা যতো সোজা, হাতে-কলমে করা ততোটা সোজা না। যে কারণে আমি সবসময় মাছ কিনি কম পরিমাণে। কাজটা যেহেতু আমাকেই করতে হয়, সেহেতু কম পরিমাণে কিনলে পরিশ্রমও কম হয়। আমি খাবারগুলো ধুয়ে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখলাম। ইলিশের কয়েক টুকরো দিলাম মেয়েটিকে। রান্নাঘরে মসলা, পেঁয়াজ-মরিচ সবই ছিল। তারপরও পাশে দাঁড়িয়ে মেয়েটিকে জিনিসগুলো এগিয়ে দিতে ভালো লাগছিলো।
হাতের কাজ দেখে ওকে নিপুণ রন্ধনশিল্পী মনে হচ্ছিলো। অল্প সময়ে পেঁয়াজ-মরিচ, মসলা ইত্যাদিকে বেশ চমৎকারভাবে ম্যানেজ করে ফেললো। আমি হলে বেশ কিছু পরিমাণ পেঁয়াজ নষ্ট করতাম। আদার ছাল ছড়াতে বিরক্ত লাগলে ছালসহই রান্নায় দিয়ে দিতাম এবং অবধারিতভাবেই আমার রান্নাটা ট্যালট্যালা হয়ে যেতো। লবণ হতো পরিমাণের চেয়ে অনেক বেশি কিংবা খানিকটা কম। সাধারণত এমনটাই ঘটে। তবে এবার যে সেসবের কিছুই হচ্ছে না, তা আমি টের পেয়ে গেলাম মূল রান্নাটা চুলায় চড়ানোর পাঁচ মিনিটের মধ্যে। ইলিশের একটা অপূর্ব সুবাস রান্নাঘরের বাতাসে ছড়িয়ে পড়লো। মেয়েটি বেশ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আপনি তো মনে হচ্ছে একটা তাজা ইলিশ কিনে এনেছেন। ব্র্যাভো ম্যান। দ্যাট’স রেয়ার।
রান্না শেষে আমি মেয়েটিকে আমার সঙ্গে লাঞ্চ করার আমন্ত্রণ জানালাম। মেয়েটি ফ্রেশ হওয়ার জন্য এক ঘন্টা সময় চেয়ে নিয়ে চলে গেল। মিনহোয়াইল আমিও গোসল ইত্যাদি সেরে ফেলার বেশ একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম। গোসল করতে করতে ভাবছিলাম, মেয়েটির মাথায় খানিকটা ছিট থাকতে পারে। যে কারণে সেও পিংক ফ্লয়েডের এক্লিপস্ গানটিতে আটকে আছে আমার মতো।
ফ্রেশ হয়ে ফেরার পর ওকে দেখতে অপূর্ব লাগছিলো। আবারও একটা আকাশী রংয়ের ফ্রক পরে এসেছিল সে। সোনালী রংয়ের বয়কাট চুলগুলোর ডগায় শিশিরবিন্দুর মতো ছোট জলকণা জমে ছিল। আমি কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, য়ু লুক স্টানিং। মেয়েটি ছোট্ট করে হেসে বললো, য়ু ঠু। আমি বুঝতে পারছিলাম না, আমাকে কিভাবে কারো কাছে স্টানিং লাগতে পারে! নাকি সে কেবল কথার কথা হিসাবে ওটা আমাকে বলেছে? মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে বুঝে ফেললো, আমি কি ভাবছি। তাই সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো, ইয়েস্ আমি সিউর হয়েই বলেছি।
দুপুরের খাবারটা জম্পেশ হয়েছিল সেদিন। মেয়েটি ফ্রেশ হতে যাবার পর আমি দেশের বাড়ি থেকে পাঠানো আঠালো আলুর ভর্তা করেছিলাম, ঘানিভাঙ্গা সরিষার তেল দিয়ে। আর শসা, টমেটো ইত্যাদি কুচি করে কেটে বানিয়েছিলাম সালাদ। আমাদের মেন্যু ছিল সামান্যই কিন্তু খেতে বসে মনে হয়েছিল এত তৃপ্তি সহকারে অনেকদিন খাই নি। আর মেয়েটির ইলিশ রান্না এতটাই পারফেক্ট ছিল যে আমরা দু’জনে কড়াইয়ের শেষ বিন্দু পর্যন্ত খুঁটিয়ে খেয়েছিলাম সেদিন দুপুরে।
ভরপেট খেয়ে দু’জনে গা এলিয়ে দিলাম দুটো সোফার ওপরে। সোফাগুলো এই অ্যাপার্টমেন্টে এসেই কিনেছিলাম। এমন সাইজের যে বসে থাকাও যায় আবার চাই কি একটু ঘুমিয়ে নেয়াও যায় যেকোন সময়। স্টার মুভিজে একটা দারুণ মুভি দেখাচ্ছিল! ইন দ্য মুড ফর লাভ। দু’জন মানুষের নিজেদের স্পাউজের প্রতারণার শিকার হয়ে কাছাকাছি চলে আসা, ভালোবাসাবাসির অনেক সুযোগ তৈরি হওয়া কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নিজেদের প্রতি সৎ থাকা- সব মিলিয়ে সিনেমাটাকে বলা যায় ভালোমানুষীর একটা চূড়ান্ত উদাহরণ। আমি আগেও কয়েকবার মুভিটা দেখেছি বলে মেয়েটির সঙ্গে টুকটাক আলাপ করতে করতে সেদিন সোফার উপরেই ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুম ভাঙ্গার পর দেখি মেয়েটি ঘরে নেই। ঘড়ি দেখে বুঝলাম প্রায় দু’ঘন্টা ঘুমিয়েছি। ফ্রিজের গায়ে একটা নোট সাঁটানো আছে দেখতে পেলাম। সেখানে লেখা ছিল, সিনেমাটা সত্যিই দারুণ ছিল। বাসায় আছি। ফোন দিয়েন। নোটের নিচে একটা মোবাইল নাম্বার লেখা।
এটাই ছিল মেয়েটির সঙ্গে আমার প্রথমবার দেখা হওয়া। মাঝের এক ঘন্টা ব্রেক ছাড়া প্রায় ১২-১৩ ঘন্টা আমরা একসঙ্গে কাটিয়েছিলাম। ঘোরাঘুরি, রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়া, মুভি দেখা- সবকিছু করেছিলাম। সাধারণত কারো সঙ্গে প্রথম দেখাতেই এতগুলো কাজ একসঙ্গে করা হয় না আমার। এতগুলো ঘন্টাও একসঙ্গে কাটানো হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রথম দেখার পালাটা কেটে যায় কিছু ফর্মাল কথা-বার্তা বিনিময় আর একটু একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়ার মধ্য দিয়েই। ওই মেয়েটি ছিল চূড়ান্ত ব্যতিক্রম। হয়তো আমিও ছিলাম তাই। যে কারণে আমদেরকে একে অপরের নামটাও জানতে হয় নি কিন্তু কাটিয়ে দিয়েছিলাম দারুণ কিছু সময়।
এবং পুরো ঘটনার বেস্ট পার্টটা ছিল, আমার ভালো না লাগাজনিত সমস্যাটা ওই মেয়েটির সঙ্গে দেখা হওয়ার পর পুরোপুরি কেটে গিয়েছিল। যে কারণে পরদিন অফিসে গিয়ে বসকে বলেছিলাম, আজকে আবার জয়েন করলাম। রিজাইন লেটার ক্যানসেল। বস কিছু না বলে কেবল একটু মুচকি হাসি দিয়েছিল।
দু’তিন দিন পর খেয়াল করে দেখি আমার স্পীকারে বেশ কয়েকটা গান ঘুরে ঘুরে বাজছে। এমনকি একটা রবীন্দ্র সঙ্গীতও কিভাবে কিভাবে যেন প্লে-লিস্টে ঢুকে পড়েছে। সাধারণত আমি খুব কাস্টমাইজড্ মুডে না থাকলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান শুনি না। তার প্রতি আমার ভক্তি অগাধ, সে কারণে। অথচ সেদিন অনেকগুলো ইংরেজি-বাংলা-কাওয়ালির ভিড়ে যখন ‘আমি কি কথা স্মরিয়া, এ তনু ভরিয়া/ পুলক রাখিতে নারি’ শুনছিলাম তখন আমার আলাদা করে ভালো লাগছিল।
বিষয়টা জানানোর জন্য মেয়েটিকে ফোন করলাম। করে কোনো সম্ভাষণের মধ্য দিয়ে না গিয়ে সরাসরি বললাম, আমি এক্লিপসের লুপ কাটিয়ে উঠেছি। এখন দিনের যেকোন সময় যেকোন গান শুনতে আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না। মেয়েটি অবাক ও উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো, আমারও তো একই অবস্থা! সেদিনের পর একটা নতুন প্লেলিস্ট তৈরি হয়েছে। পিংক, স্টারস্, ডোরস্, এডি ভেডার, কৈলাশ, সুমন, অঞ্জন, অর্ণব সবকিছু চলছে একসঙ্গে। অঞ্জনের ‘তোমার জংলা পাড়ের ঢাকেশ্বরী শাড়ি’ শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে আবেগাপ্লুতও হয়ে পড়ছি। কি কাহিনী বলেন তো? আমি খানিকক্ষণ ভেবেচিন্তে বললাম, মনে হয় ব্লু মুন আমাদেরকে হেল্প করেছে।
তারপর মেয়েটির সঙ্গে পরিচয় আরও গভীর হয়েছে আমার। এখন আমরা মাঝে মাঝেই ছাদের ওপর বালতিতে পা ডুবিয়ে চাঁদ দেখি আর জেডি খাই। শব্দটা আসলে খাই হবে না, হবে পান করি কিন্তু খাই বলতেই কেন যেন ভালো লাগে। এখন অবশ্য আমার আরও অনেক কিছুই ভালো লাগে। ফেসবুকে নোট লিখতে, শহরজুড়ে চলমান কন্সট্রাকশনের কাজ দেখতে, ধুলোভরা রাস্তায় বাইক চালাতে, এমনকি মাঝে মাঝে রাস্তার জ্যামে আটকে থাকতেও ভালো লাগে।
পরিবর্তন যে মানুষের জীবনে কখন কিভাবে আসে, সেটা আগে থেকে কখনোই বলা যায় না। সম্ভবত সে কারণেই মানুষের কখনও তার জীবনের দরজা-জানালা বন্ধ রাখা উচিত না।
---
লেখা- মীর রাকীব-উন-নবী
(এই গল্পটি প্রথম ১৬ মার্চ ২০২১ ইং তারিখে আমার ফেসবুক ওয়ালে প্রকাশিত হয়।)
মন্তব্য করুন