ইউজার লগইন

গল্প: জানি না ক'জন জানে সেটা

মুর্শেদ সাহেব পেনশন পান ২৫ হাজার টাকা। তার গাড়ির ড্রাইভার বেতন নেন ১৭ হাজার টাকা। বাদবাকি আট হাজার টাকায় মুর্শেদ সাহেবকে প্রতি মাসে বাড়ির বাজার খরচ, বিদ্যুত বিল, পানির বিল, গ্যাসের বিল দিতে হয়।

তিনি ঢাকার উত্তরায় চার কামরার একটি ফ্ল্যাটে থাকেন। তার নিজেরই ফ্ল্যাট। খরচাও তাই বেশি। শুধু নানাবিধ "সরকারি বিল" মেটালেই হয় না। তার পাশে রয়েছে ফ্ল্যাটের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য "ইউটিলিটি" খরচ, দারোয়ানের খরচ এবং আরও নানাবিধ সংকট। এগুলো গেল মাসের নিয়মিত খরচের হিসাব। ও আচ্ছা, এর ভেতর রয়েছে ওষুধের খরচ। ষাটোর্ধ্ব মুর্শেদ সাহেবের শরীরে রোগবালাইয়ের বাসাও রয়েছে যতটুকু থাকে এমন মানুষদের। তাই রয়েছে নিয়মিত ওষুধেরও খরচ। সব নিয়ে হিমশিম খেয়ে চলার মতোই অবস্থা তার। নিয়মিত মাসিক খরচগুলোর সঙ্গে রয়েছে বার্ষিক খরচ। গাড়ির ট্যাক্স, ফিটনেস নবায়নের জন্য এক বছরে সবমিলিয়ে যা খরচ হয়, তাকে ১২ দিয়ে ভাগ করলে সেটাও তিন হাজারের উপরের চলে যায়। প্রশ্ন আসতেই পারে, তাহলে কি করে চলেন তিনি? সে প্রশ্নের উত্তর জানে না কেউ।

মুর্শেদ সাহেবের স্ত্রী মিসেস ইসলাম তার জীবনটা বিলিয়ে দিয়েছেন পরিবার পরিজনের জন্য। নিজে কিছু করেন নি। দুই ছেলে-মেয়েকে বড় করেছেন। বড় ছেলে দেশের বাইরে থাকে। মেয়ে থাকে দেশে। আজ প্রায় ষাট বছরের জীবন পাড়ি দিয়ে এসে তার মন ভরে আছে শুধু শুন্যতা দিয়ে। যাদের জন্য জীবনটা বিলিয়ে দিয়ে এসেছেন জীবনের পথে-প্রান্তরে, তারা আজ কে কোথায়! সবাই ব্যস্ত নিজের নিজের যন্ত্রণা নিয়ে। মিসেস ইসলামকে দেখার কেউ নেই আজ। থাকবেই বা কি করে? নিজের জন্য যে জীবনে কিছুই করেননি তিনি।

মানসিকভাবে ভাল থাকা আজ পৃথিবীর যে কটি দেশে বিলাসিতা হয়ে উঠেছে, তার একটি দেশে থাকেন বলে, মানসিক শান্তি নিয়ে বিশেষ ভাবেন না তিনি। কিন্তু অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বা শান্তির চিন্তা যে চাইলেও বন্ধ করে রাখতে পারেন না মিসেস ইসলাম।

স্বামীর বদান্যতায় দুটো ফ্ল্যাট হয়েছে তার নামে। সেখান থেকে হাজার পচিশেক ভাড়াও পাওয়া হয়। তাও কত যে হাঙ্গামা সে ভাড়া ওঠানো নিয়ে! নিজের কিছু খরচ তো মানুষের থাকে আজীবনই। রয়েছে ওষুধের খরচ। চিকিতসা ব্যায়ও নেহায়েত কম নয় মিসেস ইসলামের। সবকিছু মিটিয়েও তিনি কোনমতে ছেলে-মেয়েকে এটা ওটা উপহার দেয়ার চেষ্টা করেন। এছাড়া আর্থিক সঙ্গতি নেই প্রায় কোনকিছুর।

মুর্শেদ সাহেবের সঙ্গে মিসেস ইসলামের তাই অর্থকড়ি নিয়ে গন্ডগোল লেগেই থাকে। স্বামী বলেন, তোমার ফ্ল্যাটের ভাড়া দিয়ে কি করো তুমি? আর তিনি স্বামীকে বলেন, তোমার উপার্জনের টাকা দিয়ে কি করো তুমি?

সমস্যা হচ্ছে, কি করলে দুইজনের যা আছে এবং তা দিয়ে দুইজন মিলে ভাল থাকতে পারেন, তা তারা কখনও একে অপরের কাছে জানতে চান নি। তাদের ছেলেটা মাঝে মাঝে বাবা-মাকে বো‌ঝানোর চেষ্টা করেছিল, মিলেমিশে থাকার জন্য। সেটা সম্ভব হয় নি। জীবনের শুরু থেকে পুষে রেখে আসা ছোট ছো্ট সংকটের আবর্ত থেকে বের হতে পারেন নি দুজনের কেউই। অথচ দুজনের জীবনের লক্ষ্য এক ও অভিন্ন। আখেরাতের রাস্তা পরিস্কার করা আর দুনিয়ায় ছেলে-মেয়েকে যতোটা সম্ভব সাহায্য করে যাওয়া।

যেহেতু লক্ষ্য এক হলেও তাদের দুজনের ভেতর পার্থক্য ছিল অসংখ্য, কোনমতেই অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারছিলেন না তারা। এমন সময় বিদেশ থেকে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো খবর এলো ছেলের ক্যান্সার হয়েছে।

সেবার সব অমিল ভুলে মুর্শেদ সাহেব আর মিসেস ইসলাম খুব চেষ্টা করেছিলেন মরে যাওয়ার আগে তাদের ছেলেটাকে একবার দেখে আসবার। দীর্ঘদিনের অমিলের কারণে নিজেদের মধ্যে এটির বোঝাপড়াও বড় সহজ ছিল না। তারপর তো ভিসার আবেদন, কাগজপাতি জমা দেয়া, দৌড়াদৌড়ি ইত্যাদির ফাঁড়া ‌ছিলই।

যেদিন ভিসা পেয়েছিলেন, সেদিনই ছেলের মৃত্যুর খবরও পেয়েছিলেন তারা। বছরখানেক আগেও যে ছেলে বাবা আর মাকে তার আবাসস্থলে ঘুরে যাবার জন্য স্পন্সরশিপ লেটার পাঠিয়েছিল, বছর না ঘুরতে সে ছেলের মরদেহ ফেরত এসেছিল দেশে কোন ভিসা, স্পন্সরশিপ ছাড়াই।

সব খারাপেরই একটা ভাল দিক থাকে। ছেলের মৃত্যুর পর মুর্শেদ সাহেব ও মিসেস ইসলামের ভেতরের গন্ডগোল আপনাআপনি মিটে যাওয়াতে, সেটাই আরেকবার প্রমাণিত হয়েছিল সেবার।

সময় থাকতে যারা নিজেদের সমস্যা সমাধানে মনোযোগ দিতে পারেন নি, ইগোর কাছে পরাস্ত হয়ে দুরে ঠেলে দিয়েছেন নিজের রক্তের সম্পর্কের আপনজনকে, তাদের জন্য এ গল্পে শিক্ষার কিছু নেই।

যারা সময় থাকতে সমস্যা সমাধান করে নিতে পেরেছিলেন, তাদের জন্য একটা সুসংবাদ আছে। আপনাদের সন্তান অন্তত বিদেশ-বিভুইয়ে একা একা রোগে-শোকে মরবে না। তার তখন মরতে যাওয়ার জন্য অন্তত একটা জায়গা থাকবে।

পোড়া জীবন- যে আমাদের কাউকেই কখনো কোন চিরস্থায়ী সুখ দেয় না, সে জীবনও আমাদেরকে একটা স্থায়ী সুখের দিশা দেখায়। সেটা হলো একটি সুষম পরিবার। তবে সেটা বিনামুল্যে কখনোই পাওয়া যায় না। নিরন্তর সংগ্রাম করে যেতে হয়।

জানি না আমাদের ক'জন জানে সেটা।

---

পোস্টটি ২ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

মীর's picture

নিজের সম্পর্কে

স্বাগতম। আমার নাম মীর রাকীব-উন-নবী। জীবিকার তাগিদে পরবাসী। মাঝে মাঝে টুকটাক গল্প-কবিতা-আত্মজীবনী ইত্যাদি লিখি। সেসব প্রধানত এই ব্লগেই প্রকাশ করে থাকি। এই ব্লগে আমার সব লেখার কপিরাইট আমার নিজেরই। অনুগ্রহ করে সূ্ত্র উল্লেখ না করে লেখাগুলো কেউ ব্যবহার করবেন না। যেকোন যোগাযোগের জন্য ই-মেইল করুন: bd.mir13@gmail.com.
ধন্যবাদ। হ্যাপি রিডিং!