ইউজার লগইন

দিনলিপিতে দু'হাজার বাইশ - ৩

আজকে আমার এই অফিসে শেষ কর্মদিবস। এরপর থেকে ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত কাগজে-কলমে আমি অফিসের কর্মচারী থাকলেও, ছুটিতে থাকবো। তারপর থেকে আর কাগজে-কলমেও আর থাকবো না এখানকার কোথাও।

আজ আমার এ অফিসে কাজ পাওয়ার স্মৃতিটা মনে পড়ছে বারবার। ২০১৮ সালের শুরুর দিকে, জানুয়ারির ২০ তারিখে আমায় জার্মানির ইলমিনাউ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তন দিয়ে দিয়েছিলো। সেদিন মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগ থেকে মাস্টার্স পাশ করে বের হতে পেরে আমার ভালও লাগছিল আবার একটু চিন্তাও হচ্ছিলো। কেননা ঠিক সেদিন থেকেই চালু হয়ে গিয়েছিল ১৮ মাসের একটা ঘড়ি। এ সময়ের ভেতর আমায় "মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন" সম্পর্কিত কোন একটা চাকুরি জোগাড় করতে হবে নয়তো ব্যাবসা দাঁড় করাতে হবে। নাহলে জার্মানি থেকে পাঠিয়ে ফেরত দেয়া হবে। অন্য কোন লাইনের চাকুরি বা ব্যাবসা হলেও হবে না।

ঘড়ির কাঁটা মাথায় নিয়েই শুরু করলাম পথচলা। হাতখরচ চালিয়ে নেয়ার জন্য কাজ নিলাম একটা সুপারশপের গুদামঘরে। সেখানে খরিদ্দারদের ফেরত আনা বোতল সাজিয়ে সাজিয়ে তুলে রাখাই ছিল আমার প্রধান কাজ। আর সুপারশপের ক্যাশ কাউন্টারে বসা ছিল দ্বিতীয় কাজ। ওই দোকানটায় কাজ করতাম সপ্তাহে ১২ ঘন্টা। কর, স্বাস্থ্যবীমা ইত্যাদি মিটিয়ে মাসে কামাই হতো সাত-আটশ' ইউরো। বাসাভাড়া দিতাম একশত ইউরো। খাওয়া-দাওয়ায় যেতো দুই বা তিনশ'। বাকিটা ছিল আমার বাস-ট্রেনের ভাড়া আর হোটেলে থাকার খরচ। সে সময় জার্মানির বিভিন্ন প্রান্তে আমি প্রতি মাসে নূন্যতম দুই বা তিনটা চাকুরির ইন্টারভিউ দিয়ে বেড়াচ্ছিলাম। কোন কোন মাসে বেশি। সেসবের জন্য একটা ভাল বাজেট সবসময় আলাদা করে রাখা লাগতো।

ইন্টারভিউগুলোতে অবশ্য কাজের কাজ কিছুই হচ্ছিলো না। ১০ মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও নিজের পড়াশোনার লাইনে কোথাও কোন চাকুরি পেলাম না। মনে মনে হতাশ হয়ে পড়ছিলাম খুবই। দেশে ফেরার টিকেট খোঁজা শুরু করবো কিনা ভাবছিলাম। যদিও হাতে আরো খানিকটা সময় ছিল কিন্তু বারংবার ব্যর্থ হওয়ার দরুণ ভেঙ্গে যাচ্ছিলো মনোবলও। আর বিদেশ-বিভুঁইয়ে একা একা যারা থাকেন, তারা জানেন, এখানে মানুষের আসলে মনোবল ছাড়া নিজের জন্য আর কিছুই থাকে না। আর সেই মনোবলে যদি কোনক্রমে একবার ভাঙ্গন ধরে তো বিরাট সমস্যা। কোনকিছুতেই আর মন বসানো সম্ভব হয় না।

এমন সময় এক চাকুরির মেলায় দেখা হয়ে গেল আমার এই অফিসের সিইও-র সঙ্গে। তারপর তাঁর এক কথায় চারশত কিলোমিটার দুরের এক শহরে চলে আসলাম। মাসে মাত্র ছয়শ ইউরোর বিনিময়ে একটা ইন্টানর্শীপ শুরু করার উদ্দেশ্যে। কথা হলো আমার তখনকার ভিসার সেই ১৮ মাস পুরো হবার আগেই বস্ কিছু একটা করবেন আমার জন্য।

কথা রেখেছিলেন তিনি। প্রথমে আমায় তিনি নিজের নামে একটা অনলাইন মার্কেটিং এজেন্সি চালুর ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করে তোলেন। সেজন্য যতোরকম সাহায্য সহযোগিতা দরকার ছিল, সেসবও করেছিলেন। তারপর যখন এজেন্সিটা দাঁড়িয়ে গেল তখন ব্যবসায়ী হিসেবে আমি ভিসা বাড়িয়ে নিয়েছিলাম। যেদিন আমার ভিসা বাড়ানো হবে সে খবর পাই, তারপর আর মাত্র সপ্তাহখানের বাকি ছিল সেই ১৮ মাস পূর্ণ হতে!

তারপরও বস্ চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন অফিসে আমার জন্য একটা ফুল-টাইম চাকুরির ব্যাবস্থা করতে। আমাদের অফিসটা মূলত জার্মানির 'ওর্টেনাউ' নামের একটা অঞ্চলের ৫২ টি শহর এবং ১৮০ টি বড় ও মাঝারি কোম্পানির নেটওয়ার্ক। আমরা সদস্য শহর ও কোম্পানিগুলোর জন্য মার্কেটিং ও পাবলিক রিলেশনের কাজ করি। পাশাপাশি সংস্থাগুলোর জন্য ভাল ও যোগ্য কর্মকর্তা-কর্মচারী সরবরাহ করি। এ অফিসে কাউকে স্থায়ী ও পূর্ণকালীন চাকুরি দেয়ার সিদ্ধান্ত হয় এক্সিকিউটিভ বোর্ডের মাধ্যমে। আমাদের এক্সিকিউটিভ বোর্ডের সদস্যরা হচ্ছেন এলাকার মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও বিভিন্ন কোম্পানির মালিকেরা। তাদের সকলকে রাজি করিয়ে বস্ ২০২০ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে আমার জন্য একটা পূর্ণকালীন স্থায়ী চাকুরির ব্যবস্থা করে ফেললেন। ততদিনে আমার এজেন্সির ব্যবসাও বেশ এগিয়ে গিয়েছিল কিন্তু আমি চাকুরির প্রতিই বেশি টান অনুভব করছিলাম।

আজ অবশ্য বুঝতে পারছি, এর কারণ ছিল আমার চরিত্র। এজেন্সিতে আমার উপার্জন চাকুরির চেয়ে বেশি ছিল। তারপরও আমি এজেন্সি বন্ধ করে চাকুরি শুরু করার সিদ্ধান্ত নিই। সে সময় এটাকে 'অপেক্ষাকৃত নিরাপদ' মনে করে সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম। তবে এখন বুঝি নিরাপত্তার চেয়ে বেশি ছিল এখানে আমার চরিত্রের প্রভাব। যেটা সে সময় বোঝা একেবারেই সম্ভব ছিল না।

চরিত্রের প্রভাব কিভাবে? সেটা হচ্ছে, যদি চাকুরি না নিয়ে এজেন্সি চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে থাকতাম, তাহলে এতদিনে এখানে আমি নিজেই একটা অফিস দিতাম। এখানকার ব্যাবসায়ী, রাজনীতিবিদ, প্রতিভাবান ইত্যাদি মানুষদের সঙ্গে আমার স্থায়ী যোগাযোগ সাধিত হতো, কেননা তারাই তো হতেন আমার খদ্দের কোন না কোনভাবে, তাই না? আর এভাবে ধীরে ধীরে গড়ে উঠতো একটা মহীরুহ। কিন্তু, কোথাও শেকড় গড়ে তোলার ধাতটাই যে আমার চরিত্রে নেই। সেটা জানতাম না তখন। কিন্তু ইনটুইশন আমাকে আমার পথেই রেখেছিল।

তাইতো সে সময় চাকুরির পক্ষে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আজ সেই চাকুরিটার একটা শেষ কর্মদিবসও চলে এসেছে দেখতে দেখতে। আগামী মাস থেকে নতুন এক অফিসে, নতুন এক শহরে শুরু হবে পথচলা।

যাক নতুন কর্মস্থল, শহর ইত্যাদি নিয়ে কথা হবে আরেকদিন। আমার এই চাকুরিটা পাওয়ার যে গল্প, তা এখানে অনেক সংক্ষেপে লিখেছি। আমার ব্লগে এ বিষয়ে ২০২১ সালে একটা বিস্তারিত পোস্ট দিয়েছিলাম। গুগলে "জীবনের যে সৌন্দর্য দেখার জন্য সৎ-সাহস অপরিহার্য" লিখে খুঁজলে সেই লেখাটা পাওয়া যায়।

২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসের তিন তারিখ এ অফিসে প্রথমদিন কাজ করতে আসি। আজ ২০২২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর শেষদিন কাজ করে চলে যাচ্ছি। মাঝের সময়টা ছিল দূর্দান্ত। এখানে আমি যেমন অনলাইন মার্কেটিং জগতের অজস্র গলি-ঘুপচি চিনতে শিখেছি, তেমনি শিখেছি জীবনের চলার পথকে চার বছর আগের চেয়ে অনেক বেশি ভাল করে বুঝতে। এই সবকিছু সঙ্গে নিয়ে এবার পা বাড়াতে যাচ্ছি জীবনেরই আরেকটি নতুন পর্যায়ের পথে।

অদ্ভুত, তাই না? কে জানতো যে ছেলেটা একবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে গণপিটুনিতে প্রায় প্রাণ হারাতে বসেছিল, সে এতোটা পথ কোনভাবে পাড়ি দিয়ে ফেলবে? আমার গণপিটুনি খাওয়ার অভিজ্ঞতাগুলো নিয়েও আমি একটা সত্যবচন-ব্লগ লিখেছি। গুগলে "আমার আপন আঁধার- গণধোলাই খাওয়ার অভিজ্ঞতাগুলো" লিখে খুঁজলে সেই লেখাটাও পাওয়া যায়।

যাহোক, পাড়ি দেয়ার বাকি অনেকটা এখনও পথই। তবে এখন আর আগের মতো করে ভাবি না যে, "সেই পথ পাড়ি দিতেই হবে, নাহলে জীবন ব্যর্থ"। এখন জানি যে, জীবন আসলে তার পথ নিজেই তৈরি করে নেয়। আমাদের কাজ কিছুই না, শুধু নৌকার হাল ধরে বসে থাকা। যাতে নৌকাটা ডুবে না যায়।

এটা আমার বর্তমান কালের উপলব্ধি। যদি ভবিষ্যতে তা কখনো পরিবর্তিত হয়ে যায়, তখন আবার কথাটা নতুন করে লিখবো। তার আগ পযর্ন্ত হাল ধরে বসে থাকি। দেখা যাক কি হয়। সবাইকে শুভেচ্ছা।

---

পোস্টটি ৩ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

মীর's picture

নিজের সম্পর্কে

স্বাগতম। আমার নাম মীর রাকীব-উন-নবী। জীবিকার তাগিদে পরবাসী। মাঝে মাঝে টুকটাক গল্প-কবিতা-আত্মজীবনী ইত্যাদি লিখি। সেসব প্রধানত এই ব্লগেই প্রকাশ করে থাকি। এই ব্লগে আমার সব লেখার কপিরাইট আমার নিজেরই। অনুগ্রহ করে সূ্ত্র উল্লেখ না করে লেখাগুলো কেউ ব্যবহার করবেন না। যেকোন যোগাযোগের জন্য ই-মেইল করুন: bd.mir13@gmail.com.
ধন্যবাদ। হ্যাপি রিডিং!