দিনলিপিতে দু'হাজার বাইশ - ৭
বেশিরভাগ সময় আমার জীবন কাটে ঝড়ের গতিতে। সকাল থেকে সন্ধ্যা কোথা দিয়ে পার হয়ে যায় তার কোন হদিস থাকে না। তারপর আবার জীবনের এমন সময় আসে যখন সবকিছু চলে অত্যন্ত ধীরগতিতে। সকাল থেকে দুপুর হতে চায় না, দুপুর হয় তো বিকাল হয় না, কোনমতে একবার বিকাল হতে পারলে তারপর আর কোনকিছুই হয় না। সেসব দিনগুলোর সঙ্গে সবসময় মনের অবস্থার কোন যোগসাজশ থাকে এমন না। অমন ধীরস্থির দিনগুলো মন ভাল থাকলেও আসে, মন খারাপ থাকলেও আসে। জীবনের তাৎক্ষণিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে।
তবে এবার মনের অবস্থা নিয়ে অভিযোগ করার মতো কিছু নেই। চলছে সবই। যতোটা চলবে বলে ভেবেছিলাম, তারচেয়ে বেশিই চলছে। সেদিক থেকে আমি খুশি। প্রতিদিন ভোর ছয়টা ৪৫ মিনিটে একটা অ্যালার্ম বেজে ওঠে। তারপর আমার বিছানা ছাড়তে ছাড়তে সাতটা বাজে। কম্বল আর বিছানাটা গুছিয়ে তারপরে ছাড়ি বিছানাটাকে। রাতে যাতে আবার ফিরে ঝুপ করে ওর ভেতর ঢুকে যেতে পারি।
সাতটার সময় এখন চারিদিক অন্ধকার হয়ে থাকে, তা বলাই বাহুল্য। ২০২২ সালের নভেম্বরের এই শেষ প্রান্তে এসে মূলত শীতটাও জেঁকে বসেছে। এ বছর যে প্রচণ্ড ঠান্ডা পরবে, তা আগেও একটা পোস্টে লিখেছি। এই সিরিজেরই একটা পোস্ট ছিল সেটা। আজকাল প্রায়ই শূন্য ছোঁয়া তাপমাত্রায় রাস্তায় নেমে পকেটে হাত ঢুকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জীবনানন্দ দাশের কবিতা নিয়ে ভাবি।
চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বত্থের কাছে
একগাছা দড়ি হাতে নিয়ে গিয়েছিলে তবু একা একা,
যে জীবন ফড়িংয়ের দোয়েলের - মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা,
এই জেনে।
মৃত্যুর চিন্তা মাথায় আসা খারাপ না। তবে ঘুরঘুর করা খারাপ। আমি যেদিন এই কবিতাটা নিয়ে ভাবি, সেদিন টের পাই, অস্তিত্ব জুড়ে মৃত্যুর চিন্তা এসে ভর করেছে। ভাবি এ তেমন বড় কোন সমস্যা নয়। বরং হেঁটে হেঁটে একবার গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
গাদা গাদা কাজের ভেতর ডুবে যাবো চারপাশটা পুরোদস্তুর ভুলে গিয়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটিই হয়। অফিস ঢুকে শেয়ারপয়েন্টে ঢু দিতেই দেখি কাজ চলে এসেছে। কোম্পানির গ্লোবাল ওয়েবসাইটের একটা পেইজ জার্মানির লোকাল ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করা হবে। জার্মান সেই ওয়েবপেইজে যেসব লেখা থাকবে, সেগুলো নিয়ে বসতে হবে। গুগল, বিং-সহ সব বড় বড় সার্চ ইন্জিনের জন্য সেসব লেখা কতোটা অপটিমাইজ করা হয়েছে আর কতোটা করতে হবে তা বের করতে হবে। হেডলাইনগুলো মিলাতে হবে। মেটা-বিবরণ মিলাতে হবে। ইউআরএল চেক করতে হবে। সবমিলিয়ে যতক্ষণে পুরো ওয়েবপেইজটা সার্চ ইন্জিন-বান্ধব হয়ে উঠবে, ততক্ষণে সম্ভবত বেলা গড়িয়ে যাবে। মাঝখানে একটা ঘন্টাখানেকের বিরতিতে কেন্টিনে গিয়ে নির্ঘাত নিষিদ্ধ মাংসের কোন একটা প্রিপারেশন দিয়ে লাঞ্চ করে আসবো। কিংবা ব্রাসেলস্ স্প্রাউট, সাওয়ারক্রাউট আর আলুপেষা দিয়ে বানানো স্বাস্থ্যবটিকা খাবো। ওটাও লাঞ্চেরই একটা মেনু। সপ্তাহে একদিন ওসব খাওয়ার অলিখিত নিয়ম রয়েছে আমার নতুন কর্মস্থলে। কেন্টিনে সেদিন শুধু ওই ধরনের খাবারই পাওয়া যায়। নতুন কর্মস্থল নিয়ে কথা হবে আর একদিন। আজ বরং বিষণ্নতার কথাই আরও লিখি।
বাড়ির ধোঁয়া ওঠা ভাত, ঢেড়স বা করলা ভাজি, আলু দিয়ে রান্না করা রুই মাছের ঝোল আর শেষপাতে ডালের স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে দিয়েছি আমি সাত বছর আগে। মাঝে মাঝে অবশ্য রাতের বেলা ঘরের রাস্তা ধরে অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে শুন্যের দিকে তাকিয়ে ভাবি, এটাই ছিল অপেক্ষায়। আমার জন্য। রাতের খাবার হিসেবে বাসায় যদিও দেশি কই রান্না করা আছে। তারপরও নিজেকে দুঃখী-দুঃখী ভাবতে কেন ভাল লাগে- কে জানে! সেই ভাবনার জগতে বিচরণ করতে করতেই একসময় পৌঁছে যাই এসেন শহরে ভাড়া নেয়া বাসাটার বাইরের দরজার সামনে। চাবি ঘুরিয়ে সেই দরজাটা খোলার সময়ই মনে মনে ঠিক করে নিই, কি কি কাজ করতে হবে বিছানায় যাওয়ার আগে।
জুতা খোলা, কাপড় খোলা, ঘরের কাপড় পরিধান করা, খাবার গরম করা, মনিটরে ফ্রেন্ডস্ সিরিজটা চালিয়ে দেয়া, তারপর খেয়ে উঠে এঁটো বাসন-কোসন ধোয়ার যন্ত্রে ঢুকিয়ে দেয়া। এই কয়টা কাজ আমাকে করতেই হবে। একবার কাজের তালিকা তৈরি হয়ে গেলে তারপর আর চিন্তা করতে হয় না। যেসব দিন চিন্তাভাবনাকে সরলরেখার মতো চালিয়ে আনতে পারি না, সেসব দিন কিন্তু কাজের তালিকা তৈরির চেষ্টা করলেও হয় না। আমাদের মস্তিষ্ক খুব সক্রিয়ভাবেই আমাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে। আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটা বুঝি না।
সব শেষে একটা টেট্রা-হাইড্রো ক্যানাবিনল মেশানো ধুম্রশলাকায় অগ্নিসংযোগ করে ঘরের সব আলোর উৎস নিভিয়ে দিই। অন্ধকারের পানে চেয়ে থাকতে থাকতে একসময় চোখ উপচে ঘুম আসে। ঘুমিয়ে পড়ি। প্রতিটা দিন এভাবেই শুরু থেকে শেষের পানে এগিয়ে যায়। আর ঘুমিয়ে পড়ার আগে প্রতিটি রাতে জীবনানন্দ দাশের সেই কবিতাটা, যেদিন যেটার কথা সকালে আমি হাঁটতে হাঁটতে ভাবি, মনে পড়ে যায়!
'কোনদিন জাগিবে না আর
জানিবার গাঢ় বেদনার
অবিরাম অবিরাম ভার
সহিবে না আর -'
এই কথা বলেছিল তারে,
চাঁদ ডুবে গেলে - অদ্ভুত আঁধারে
যেন তার জানালার ধারে
উটের গ্রীবার মত কোন এক নিস্তব্ধতা এসে।"
মন্তব্য করুন