অলীক ভাবনার জগতে হারিয়ে যাওয়া - ১
নতুন কোন কিছু অনেকদিন লেখা হয় না। ২০২২ সালের শেষদিকে একটা ডায়েরি শুরু করেছিলাম। সেটা শেষ হয়ে গেছে সেই কবে। তবে তারপর আর নতুন করে কিছুই লিখি নি। মাঝে একটা গল্প লিখেছিলাম। একটা মেয়ের মনের গল্প। সবকিছুর পরও না পাওয়াগুলো যাকে মাঝে মাঝে বিদ্ধ করে। তখন সে একটা অলীক জগতের স্বপ্ন দেখে। যেখানে একটা ঠান্ডা ও নিরিবিলি কাল্পনিক শহরে হারিয়ে যায় সে।
অলীক ভাবনার জগতে এই যে হারিয়ে যাওয়া, এটা বোধহয় আমাদের সবার সঙ্গেই ঘটে। নিজের আশপাশের জীবনটাকে সরিয়ে রেখে একটু হারিয়ে যাওয়া। কিন্তু যথাসময়ে এসব ভাবনার লাগাম পরানোটাও যে জরুরি, সেটাই বোধহয় শেষ গল্পটার প্রতিপাদ্য ছিল। এভাবে প্রতিদিন কত কত স্বপ্নেরা তাদের প্রয়োজনে জেগে ওঠে আবার প্রয়োজনে ডুবে যায় আমাদের মনের মানসপটে!
কিছু কিছু অলীক স্বপ্নকে আমরা ভুল করে সত্যি বলে ধরে নিই। সেসবের মধ্য দিয়ে হোঁচট খাওয়া হয় পুরোদমে। তারপরও ভুল করা বন্ধ হয় না। আমরা একটা জিনিস যখন শিখে ফেলি, তখন আরেকটা নতুন জিনিস শেখার প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকে যাই। পুরোনো শিখে আসা বিদ্যে যদি সেখানে কাজে লেগে যায় তো সৌভাগ্য, কিন্তু সহজেই ঘটতে পারে দুর্ভাগ্যের অবতারণা। তখন নতুন উপায় শিখতে হয়। এবং কে না জানে নতুন যেকোন শিক্ষা সবসময় তার উপলক্ষকেও সঙ্গে নিয়ে আসে, যা সবসময়ই সুশ্রী হবে- এমন কোন কথা নেই।
আর এভাবেই বড় অর্থহীনভাবে আমাদের সবার জীবন একদিন শেষ হবে। এ পৃথিবীটা এত বড় যে একলা একজন ব্যক্তির পক্ষে একটা অর্থপূর্ণ জীবন যাপনের সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের ঘরে। যে কারণে বিশ্বের সব কালের সব মানুষের তুলনায় অর্থপূর্ণ জীবনযাপন করে যেতে পারা মানুষের সংখ্যাও নগন্য। তাদের মধ্যে যারা আছেন সেই আইনস্টাইন বা স্টিফেন হকিং-রা কিন্তু আসলেই হাতে গোনা। যথাযথ হিসেব করলে দেখা যাবে আনুপাতিক হারটি শূন্যের ঘরেই।
অর্থ আমি আমার শেখার কাল শেষ করে চলে যাবার পর আরেকজন আসবে আমার জায়গায়। ঠিক আমার জায়গাটিতেই আসতে হবে এমন না, কিন্তু পৃথিবীতে কোন জায়গাই বেশিদিন খালি থাকে না। আমাদের মতো আমজনতা কিংবা ইম্পেরিয়াল ড্রয়েড কিংবা স্টর্মট্রুপারদের সংখ্যা আসলেই অগণিত। আমাদের সামষ্টিক জীবনের মূল্যও অতি তুচ্ছ। কেননা আমরা আসলে পৃথিবীর জন্য কিছুই করতে পারি না, করিও না।
অথচ তারপরও নিজেকে মূল্যবান করে তোলার জন্য, নিজের ছোট্ট স্বার্থপর মনটাকে অলীক প্রবোধ দেয়ার জন্য পরের জীবনের ওপর নিজের ইচ্ছে-আকাঙ্ক্ষা আমরা চাপিয়ে দিই। সে মোতাবেক কাজ না হলে জোরজবরদস্তি করি। যদিও চলে যাবার পর সেসবের আর কোন উপযোগই নেই। এবং জীবনের বহুপ্রান্তেও সে সত্যের দেখা মেলে আমাদের। তারপরও নিজেকে প্রবোধ দিতে পারি না আমরা। রুখতে পারি না নিজেকে। নিজের ক্ষুদস্র ক্ষুদ্র আত্মকেন্দ্রিক চিন্তার জগতেও ভরে থাকে দুশ্চিন্তার বান। সুখ কিন্তু কোনকিছুতেই আমরা পাই না। মাঝখান থেকে নিশ্চিত করে যাই, অন্যরা বা প্রকৃতিও যেন কোনমতে ভুল করেও কোন সুখ পেয়ে না যায়।
আসলে যেকোন মানুষের জীবনকে সেই মানুষটির প্রেক্ষাপট থেকে দেখলেই বোঝা যায়, কতটা সামান্য একটা জায়গাজুড়ে আমাদের শক্তি, ক্ষমতা আর ইচ্ছার বিস্তার। কত সহজে সম্ভব ছিল সবকিছু সমাধান করার।
একমাত্র ভালবাসা, স্বার্থহীন-সচেতন-নিরন্তর ভালবাসাটুকু দরকার ছিল মানুষের। আর সবকিছু হাতে তুলে দিয়ে প্রকৃতি আমাদের বলেছিল, যা ছিল আমার সবই দিয়ে দিলাম। শুধু নিজেদের জন্য ভালবাসাটুকু ধরে রাখার দায়িত্ব তোমাদের।
আমাদের সবই ছিল। বোধ ছিল, জ্ঞান ছিল, ক্ষমতা ছিল, পুরো গ্রহটাই আমাদের ছিল। শুধু আমরাই আমাদের ছিলাম না। কেউ কাউকে ভালবাসতে পারি নি আমরা।
আজ হতে অনেক বছর পর যদি এ লেখা কেউ তোমরা পড়ো, তাহলে আমি একটা ছোট্ট কথাই হয়তো তোমাদের মাঝে যোগ করতে পারবো। যে ভুল আমরা করেছিলাম, সে ভুল করো না তোমরা।
---
মন্তব্য করুন