গল্প: তুমি আমার কাছে তুমি যা বলবা তাই (পর্ব-৫)
সেবার বেশিদিন দেশে থাকার সুযোগ ছিল না। প্রায় বিনা নোটিশেই গিয়েছিলাম দুই সপ্তাহের চিকন একটা ছুটি নিয়ে। সেই দুই সপ্তাহের প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করেছি তাড়িয়ে তাড়িয়ে। মিসিসিপি জানতো আমি জল আর পর্বত সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি, পূর্ণিমার রাতে কাকচক্ষু দীঘির জলে পা ডুবিয়ে বসে থেকে হালকা কোন সুর আর সঙ্গীর কথার মূচ্ছর্নায় হারিয়ে যেতে পছন্দ করি।
আমরা দু'জন দু'জনের সবরকম পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কে জানতাম। এমনকি এটাও জানতাম, কার কখন কোন কাজটা কিভাবে করতে ভাল লাগে। কেন যে একজন মানুষকে এতটা বেশি জেনে ফেলেছিলাম, তা বলতে পারি না। দু'জনেরই এর পেছনে নির্জলা ভাললাগা কাজ করেছিল; সেটাই হয়তো একমাত্র কারণ। মুঠো মুঠো কথা তাই শেয়ার করেছিলাম আমরা। জেনে গিয়েছিলাম অনেক কিছুই একে অপরের সম্পর্কে।
আমাদের দেখা হওয়ার প্রথম সন্ধ্যাতেই মিসিসিপি জানাল, আর মাত্র একদিন পরই পূর্ণিমা। তাই আমরা নাকি পরদিন সকালেই সুনামগঞ্জ যাচ্ছি। টাঙুয়ার হাওড়ে পূর্ণিমা উদযাপন করতে!
শুনেই মনটা খুশি হয়ে উঠলো পুরোদস্তুর। দু'সপ্তাহের জন্য এসেছি বলে বড় কোন লাগেজ নেই সাথে। তাই আমার নড়াচড়ায় নেই কোন সমস্যাও। সেদিন সন্ধ্যাটা আমরা উপভোগ করলাম বনানীর নানান ক্যাফে আর শপিং মল ঘুরে।
মিসিসিপির বাইকের পেছনে বসে অনেকদিন পর প্রিয় শহরটাকে দেখছিলাম। একই রকম আছে। শুধু কিছু নতুন নতুন স্থাপনা হয়েছে। মানুষগুলো সেই একইরকম চিন্তাগ্রস্থ মুখে ছোটাছুটি করছে। খানিক পর পর উপচে পড়া ডাস্টবিনগুলো এখনও একই রকম দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। ১০ বছর আগে যেমনটি রেখে গিয়েছিলাম।
রাতের খানাপিনা সেরে খানিকক্ষণ আমরা হাতিরঝিলের ভেতর বাইক ছুটালাম। আমিও অনেক বছর পর, বাইক চালাতে পারি কিনা দেখার জন্য, একটু চালিয়েছিলাম। দেখলাম একেবার ভুলে যাই নি সব। শুধু অনভ্যস্ততায় ব্রেকে একটু আগেই চাপ পড়ে যাচ্ছে।
পরদিন সকালে মহাখালী থেকে লন্ডন এক্সপ্রেস পরিবহনের বাসে করে রওনা হলাম দু'জনে সুনামগঞ্জের উদ্দেশ্যে। সকাল ছয়টায় রওনা দিয়ে আমরা বেলা আড়াইটা নাগাদ পৌঁছেও গেলাম সেখানে। সুনামগঞ্জ থেকে সিএনজি নিয়ে গেলাম তাহিরপুর। আমাদের ইচ্ছে, নদীতে থাকার সময়টায় লোকালয়, কোলাহল আর নাগরিক জীবনের অন্যান্য সব উপাদান থেকে যতোটা সম্ভব দূরে থাকা।
তাহিরপুরে নেমে প্রথমে ক্ষুধার্ত পেট শান্ত করে ঢু দিলাম কাঁচাবাজারে। হাওড়ের তাজা রুই, পাবদা ও গজার মাছ কিনে নিলাম অল্প অল্প করে। আশপাশের মানুষজন বলছিল, বেশি মাছ নেয়াটা সবসময়ই অপচয়ের খাতায় পড়ে যায় দিনশেষে। হাওড়ের ভেতরও অনেক ছোট ছোট মাছের আড়ত রয়েছে এবং সেখান থেকেও প্রয়োজনে টাটকা মাছ খুচরামূল্যে কেনা যায়।
মাছের সঙ্গে নিলাম শুঁটকি আর একটি দেশি হাঁস। বাজারের হাঁস জবাই এবং কাটাকুটির সুবিধাটি খুব কাজে দিয়েছিল। মিসিসিপি মাছের খুব বড় ভক্ত ছিল না। তাই হাঁস না পাওয়া গেলে হয়তো গরুর মাংস নিতাম আমি। কিন্তু গরুর মাংস হাওড়ে গিয়ে নিজেরা রান্না করে খাওয়ার বিষয়টি কেমন যেন লাগছিল মনে মনে। হাঁস পাওয়ায় সেই সমস্যাটা সহজেই মিটে গেল। আর চাল এবং তেল, আলু, পিয়াঁজ, লেবু, লবণের মতো কিছু জরুরি জিনিস কিনে নিলাম সঙ্গে। বাজারে কেনাকাটা সেরে তাহিরপুর ঘাট থেকে নৌকা নিয়ে বের হলাম আমরা দু'জনে।
ফেসবুকের এসএসসি-এইচএসসি'র ব্যাচভিত্তিক গ্রুপ থেকে সুনামগঞ্জের এক বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। সুজন নাম, তাহিরপুরে তার ট্যূরিজম বিজনেস। বন্ধু তার প্রতিষ্ঠানের একটি নৌকা এবং বিশ্বস্ত একজন মাঝি দিয়েছিল সাথে। মাঝির নাম অনুপম রায়। বন্ধু বলে দিয়েছিল, অনুপমদা'র রান্নার হাত খুব ভাল। সেটা অবশ্য টেরও পেয়েছিলাম সেই ভ্রমণে খুব ভালভাবে।
অনুপমদা'র ১০ বছরের ছেলে অনিরূদ্ধও যোগ দিয়েছিল আমাদের সঙ্গে সেই ভ্রমণে। অনিরূদ্ধ এমনিতে স্কুলে যায়। কিন্তু স্কুল বন্ধ থাকলে বাবাকে নৌকায়ও সাহায্য করে। স্কুলের পর সে সুজনের অফিসেও ফাই-ফরমাশের কাজ করে। অনুপমদা'র মতো আরও ১০ জন মাঝির জীবন-জীবিকা চলে সুজনের ব্যাবসার মাধ্যমে।
টাঙুয়ার হাওড়ে পূর্ণচন্দ্রের সৌন্দর্য নিয়ে অনেক লোককথা প্রচলিত। অনুপমদা' যেন সেসব লোককথার আধাঁর। নৌকায় বসে উনার গল্প মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলাম আমরা দু'জন। ওদিকে অনিরূদ্ধ শোল, গজার মাছগুলোকে ধুয়ে-কেটে প্রায় পরিস্কার ফেলেছিল একাই।
আমরা যতক্ষণে হাওড়ের ওয়াচ টাওয়ারের সামনে পৌঁছাই, ততক্ষণে গল্প যেমন জমে উঠেছিল নৌকায়, তেমনি রান্নার কাজও এগিয়ে গিয়েছিল অনেকখানি। অনিরূদ্ধকে একা কাজ করতে দেখে হাত লাগিয়েছিলাম আমরাও। ওয়াচ টাওয়ারের সামনে নৌকা ভিড়িয়ে অনুপমদা' হাত দিলেন রান্নায়। তখন রাত ১০টা বাজে। মুহূর্তে ভাজা মাছের গন্ধে ভরে উঠেছিল চারিদিক। ক্ষুধাটাও অনেকক্ষণ পর সেই প্রথমবারের মতো জানান দিয়েছিল সে সময়। তবে কিনা তখনও প্রায় ঘন্টাখানেক বাকি ছিল খাবার প্রস্তুত হওয়ার। তাই খাওয়ার পূর্বে খানিক পানাহারের আয়োজন করলাম আমি।
জার্মানিতে মাস্টার্স করার সময় হাতখরচের জন্য একটা ক্লাবে কাজ করেছিলাম অনেকদিন। সেখানে আমার ছিল বারটেন্ডারের কাজ। রকমারী ককটেল বানানোর অনেকগুলো উপায়ই আমি জানতাম। তবে জনপ্রিয় ককটেলগুলোর চাইতে আমায় বেশি টানতো, যেগুলো একটু অপ্রচলিত ককটেল- সেগুলো। নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেও ভাল লাগতো। ল্যাটিন আমেরিকার একটা জনপ্রিয় পানীয় কিউবা লিব্রা (জার্মানরা ডাকে 'কুবা লিব্রে' বলে) বানাতে গিয়ে একবার কোকা কোলার বদলে আদাজল দিয়ে ফেলেছিলাম।
আদা দিয়ে নির্মিত হালকা সোডা-টাইপ পানীয়গুলো দিয়ে অনেক রকম মজার ককটেল বানানো যায়। আমি সেদিন ক্লাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময় যেটি দিয়েছিলাম সেটির নাম ছিল জিনজার-এল। পরীক্ষা করতে করতে একসময় কিউবা লিব্রার 'রাম' আর 'কোলা'র বদলে; 'লিকার ৪৩' আর 'জিনজার-এল' দিয়ে সুমিষ্ট একটি পানীয় আবিস্কার করে ফেলেছিলাম সেদিন। যেটা পরে ওই ক্লাবটাতে বেশ জনপ্রিয়ও হয়েছিল। কিউবা লিব্রার দামেই বিক্রি হতো সেটা।
লিকার-৪৩ ব্যবহার করার কারণ ছিল। আমার অনেক বন্ধুই বলতো মদ পান করতে নাকি তাদের খুব বিশ্রি লাগে! মুখটা কটা স্বাদে ভরে যায়। বুক জ্বালাপোড়া করে। সেই কারণে আমি মিষ্টি ধরনের একটা কিছু খুঁজছিলাম, যাতে তাদের ভুল ধারণাটা ভাঙানো যায়। কিন্তু 'কনটোর' বা 'আমারেট্টো'-র মতো কোন উচ্চঘনত্বের মদ আমি চাচ্ছিলাম না। ওগুলো কিছুক্ষণের ভেতরেই জিহ্বা অসাড় করে মুখের কথা জড়িয়ে দেয়। হালকা ঘনত্বের কিছু খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যাই লিকার-৪৩।
চিনির মতো মিষ্টি কিন্তু অ্যালকোহলের পরিমাণ অতি সামান্য। ককটেলটা ঠিক কিউবা লিব্রার মতো করেই বানাতে হবে। প্রথমে একটা সুবজ লেবু মাঝ বরাবর কেটে সেটাকে চার ভাগ করে ফেলতে হবে। এবার একটা কাইপি গ্লাসে সেই লেবুর টুকরোগুলো নিতে হবে। তার ওপর দিতে হবে দুই চামচ ব্রাউন সুগার। এবার লেবুগুলোকে কিছু একটা দিয়ে গ্লাসের ভেতর হালকা পিষে নিতে হবে, যাতে লেবুর রস বের হয়ে ব্রাউন সুগারের সঙ্গে মিশে যায়। তারপর এর সঙ্গে চার থেকে আট সেন্টিলিটার লিকার-৪৩। পরিমাণের উপর নির্ভর করছে পানীয়টির হার্ডনেস্। যার যেমন পছন্দ তেমনটি দেয়াই ভাল। গ্লাসের বাকিটা জিনজার-এল ও বরফ দিয়ে ভরিয়ে ফেললেই ব্যস্- ভোয়ালা!
প্রস্তুত হয়ে গেল অতুলনীয় স্বাদের মিষ্টি একটা ককটেল। তবে যারা চিনি খেতে পারেন না, তাদের জন্য না। আবার যারা নিজের ককটেলটা খুব হার্ড পছন্দ করেন তাদের জন্যও না। তাহলে এই ককটেলটা আসলে কাদের জন্য? যারা মদ পছন্দ করে না- তাদের জন্য। ককটেলটি পান করার পর অনেককেই আমি তাদের পছন্দ পাল্টাতে দেখেছি।
এক বোতল লিকার-৪৩ আমি জার্মানি থেকেই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলাম। জিনজার-এলও ছিল দুই পেট বোতল ভর্তি। অনুপমদা'র রান্নার পাশাপাশি চললো আমাদের পানাহার। রান্না যতক্ষণে শেষ হয়, চাঁদ ততক্ষণে প্রায় মাথার উপর চলে এসেছিল। পেটে খানিক তরল গরল প্রবাহিত হওয়ায় আমার নিজেকে বেশ হালকাও লাগছিল।
পাটাতনে মাথার নিচে হাত দিয়ে শুয়ে রাতের আকাশ দেখছিলাম। মিসিসিপি মাঝে মাঝে গুনগুন করে গান গাইছিল। মনের আবেগকে গলায় ফুটিয়ে তোলার প্রাকৃতিক ক্ষমতা ছিল মেয়েটির। ওর খালি গলার গানের সঙ্গে ছোট দু'টো কাঁসার বাঁটি দিয়ে মন্দিরা বাজাচ্ছিল অনিরূদ্ধ। আর তাতেই যেন জমে গিয়েছিল পুরো পরিবেশ। নৌকায় শুয়ে অনুপমদা'র মুখে পড়া চুলার আগুনের তাকিয়ে আমি সেটাই দেখছিলাম।
সেই রাতে খাওয়া-দাওয়ার পালা সারতে সারতে আমাদের প্রায় একটা বেজে যায়। খেয়ে আবার নৌকা ছাড়েন অনুপমদা'। ঢুলু ঢুলু চোখে আমাদের সঙ্গে আরও খানিকক্ষণ গল্প করে অনিরূদ্ধ। তার স্কুলের অংক মিসের কাছে কেন সে ঘুরে-ফিরে বকা খায় তাই নিয়ে কথা বলতে বলতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো সে। ওকে নৌকার ছইয়ের ভেতর রেখে আমি মিসিসিপি গিয়ে বসি গলুইয়ে।
চারপাশে তখন নির্ঝর নৈঃশব্দ। মাঝে মাঝে শুধু অনুপমদা'র বৈঠার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। বৈঠা পড়ছিল খুব আস্তে আস্তে। যেন সন্তপর্ণে জল কেটে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের নৌকা। হাওড়ের জলে তাকিয়ে দেখলাম সামান্যই ঢেউ সৃষ্টি হচ্ছে নৌকার দ্বারা। আসলে স্রোতই ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল আমাদের নৌকাটিকে।
মাথার উপরে আকাশভর্তি ঝা চকচকে রূপালি চাঁদ আর নিচে সেটির জীবন্ত প্রতিফলন দেখতে দেখতে অবিশ্বাস্য একটা সময় পার করছিলাম আমরা দু'জন। খুব কমই কথা বলছিলাম। কথা বললেও যেন হারিয়ে যাবে কিছু একটা। এমন সময় জীবনে কয়বার আসে জানি না, যখন নিজেকে পরিপূর্ণভাবে মেলে ধরা যায় প্রকৃতির সামনে। কিচ্ছু চাওয়ার থাকে না আর। শুধু চুপটি করে সময়টাকে অনুভব করতে ইচ্ছে করে। তেমনটিই লাগছিল তখন।
সময়টা ছিল চার-পাঁচ ঘন্টা কিংবা তারও বেশি। ঘন্টা দুয়েকের ভেতর নৌকা চালিয়ে ছোট একটা চরের সামনে পৌঁছে নোঙর ফেলেছিল অনুপমদা'। তারপর ঘুমিয়ে পড়েছিল একপাশের পাটাতনে। ঘুমানোর সময় আমাদের বলেছিল, ওই চরটা নাকি নদীর বুকে কিছুদিন আগেই মাথা তুলেছে।
আমরা জানতাম আমাদের ঘুম আসবে না সে রাতে। নৌকা থেকে নেমে জনমানবশূন্য সেই চরটায় হাঁটা শুরু করি দিলাম। ছোট ছোট গুল্ম, লতা-পাতা, ঘাস আর লাল মাটি ছাড়া তেমন কিছু নেই। চরের একপাশ থেকে আরেকপাশ দেখা যায় না মাঝখানটা খানিক উঁচু বলে। তবে পুরোটাই চারপাশ থেকে ফাঁকা।
আমরা মাঝের উঁচু টিলামতো চূড়ায় উঠে দু'জন মুখোমুখি বসলাম। সাধারণত মিসিসিপির সঙ্গে কখনো সামনা-সামনি বসে কথা বলতে হলেই আমার নিউরণেরা অচল হয়ে পড়ে। এবারও সেটি হয়ে যাচ্ছিল। তাই তাড়াতাড়ি পকেটে করে নিয়ে আসা জয়েন্টের প্যাকেটটা বের করলাম। নেদারল্যান্ডস-এর জনপ্রিয় নর্দান লাইটস গাঁজা দিয়ে বানানো জাম্বো সাইজের একেকটা জয়েন্ট। আমি বিমানে করেই এক প্যাকেট সঙ্গে নিয়ে এসেছি। সাধারণ সিগারেটের মতো প্যাকেট ছিল বলে কেউ সন্দেহ করে নি।
জয়েন্টটা বের করে একটু বাড়ি-টাড়ি দিয়ে রেডি করতে করতে মিসিসিপির চোখে চোখ পড়লো। দেখলাম চোখভরা বিস্ময় মেয়েটির। সে এর আগে লিকার-৪৩ আর জিনজার-এল'র বোতল দেখেও যথেষ্ট অবাক হয়েছিল। এবার আবার চোখগুলো বড় বড় হয়ে গেল আমাকে পকেট থেকে ডাচ-গাঁজায় ভরা জয়েন্টের প্যাকেট বের করতে দেখে।
তবে ওর চোখে চোখ পড়ায় আমি আবার একবার বুঝতে পারলাম, মেয়েটি যে আসলেই কী স্নিগ্ধ, তা আমার দ্বারা লিখে বোঝানো সম্ভব না। আমার চোখ দু'টো যেন আরামে বুজে আসতে চাইছিল, মেয়েটির দিকে তাকালেই। কিন্তু বেশিক্ষণ চোখ বুজেও রাখা যায় না। তাকিয়ে থাকতেও ইচ্ছে করে। আবার বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই চোখ দু'টো পোড়াতে শুরু করে। কি এক মুশকিল!
ওর কথাতেই সম্বিত ফিরলো। বলছিল, তুমি তো সারপ্রাইজে ভর্তি হয়ে এসেছো দেখছি। আমি মৃদু হাসলাম। জীবনে এমন একটা রাত হয়তো একবারই আসবে- কিংবা আসবেই না, কে জানে? সারপ্রাইজ দেয়া যদি সম্ভব হয়, তাহলে এমন সময়গুলোতই সেগুলো দিতে হয়, তাই না?
জয়েন্টটা ধরিয়ে আধশোয়া শরীরে আবারো আকাশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম আমরা। সেই রাতে আকাশে বেশি তারা ছিল না। পূর্নিমার আলো প্রায় সবক'টি নক্ষত্রের আলোকেই ছাপিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গোল ওই চাঁদটার ভেতর যে কত রহস্য- তা গুনে শেষ করতে পারছিলাম না কেউই। আর তার আগেই শেষ হয়ে গেল সেই জয়েন্টটা!
টেট্রা-হাইড্রো ক্যানাবিনল রক্তে মিশে গেলে আমাদের খানিকটা অন্যরকম লাগা শুরু হলো। স্কুল-কলেজের কমন বন্ধুদের নিয়ে অনেক গল্প করলাম আমরা। ছেলেবেলায় রোমেল আর আমি কি করে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম তা নিয়ে অনেক হাসাহাসি হলো। মিসিসিপিও গল্প করলো। বেশিরভাগ ওর পরিবারের মানুষদের গল্প। হাসি-ঠাট্টা আর গল্প-গুজবে সময় পার হয়ে যাচ্ছিল খুব দ্রুত গতিতে।
তারপর দূরে যখন অনুপমদা'র নৌকার টিমটিমে আলোটা ভোরের আলোর কাছে আস্তে আস্তে উজ্জলতা হারাতে শুরু করেছিল, তখন সেখানেই খোলা আকাশের নিচে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমরা। হঠাৎ দমকা হাওয়া মতো ঘুম এসে জুড়ে বসেছিল আমাদের চোখে। ঘুমিয়ে পড়ার আগে মিসিসিপি কেবল বলতে পেরেছিল, অ্যাই ছেলে, অনেকদিন পর আমার এমনভাবে ঘুম আসছে জানো? মনে হচ্ছে জগতের চারিদিকে শুধু শান্তি আর শান্তি।
বলতে বলতে মেয়েটি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে চিকন বাঁশির মতো শব্দও আসতে থাকলো ওর নাসিকারন্ধ্র থেকে। শুনতে শুনতে আমার চোখও বুজে এলো কয়েক মিনিটের ভেতরে। আমিও খানিকক্ষণ পর মাথার নিচে হাত দিয়ে ঘুমের রাজ্যে ধীরপায়ে হেঁটে গিয়ে ঢুকে পড়লাম।
---
মন্তব্য করুন