ধ্বংসের জয়গান
ছন্নচ্ছাড়া দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে ছিলো কালো লোকটি। বয়সের দাগ কপালের ভাজে লেগে থাকলেও দু বাহুতে ঘোষনা দেয় অসুরতম শক্তির। কাঠিন্যে ভরা মুখের কাটা দাগে লেখা আছে নির্যাতিত অতীতের গল্পগুলো। হাতে একটা চিঠি বাতাসে পত পত করে উড়ছে। প্রচন্ড ঠান্ডায় যেখানে আমার দাতের দোপাটি কাপছিলো তার উদাস চোখের উষ্ঞতায় মনে হলো প্রকৃতির এই শৈত্য স্পর্শ তাকে কাবু করতে পারেনি। হঠাৎ সজাগ হয়ে যায় পকেটে থাকা মোবাইলের কাপুনিতে। নিজের ভাষায় কি যেনো বলে খুশি হয়ে গেলো আর চোখ দিয়ে পড়তে থাকলো অশ্রু। ফোনে কথা শেষ হলে এগিয়ে যাই," বন্ধু, তোমার অশ্রু মাখা হাসি মুখ দেখতে ভালো লাগছে। বলবে খুশীর খবর?"
: বন্ধু, চলো কোথাও বসি যদি তাড়া না থাকে।
দু 'জনে মিলে ওয়েইনস কফিশপে ঢুকলাম। কড়কড়ে ব্লাক কফি হাতে নিয়ে বসলো আমার সামনে। আমি আমার অতি প্রিয় লাট্টে। চুমুক দিয়ে বলতে থাকলো,"ইথিওপিয়া থেকে এসেছিলাম। কি কাজ করিনি বলো? কালো বলে সবচেয়ে কষ্টকর কাজ করতাম, টাকা তো পেতামই না, সবার দৃষ্টি ছিলো অন্য দিকে। তবুও দাড়িয়ে যাই, ভয় ছিলো আমার ছেলেটা যেন আমার মতো কষ্ট না করে অথবা অন্যান্য আফ্রিকান ছেলেদের মতো গোল্লায় যায়। ছেলেও আমার কথা বুঝে। দেখতে দেখতে টেকনিস্কা হোগাসকোলানে ভর্তি হয়। রাতে রেকলাম বিলায়, দিনে পড়া শুনায় ডুবে থাকে। টানা ৪ টা বছর গাধা খাটুনি খাটে। আজকে ছেলে জানালো ভলভোতে ডিজাইন ইন্জ্ঞিনিয়ার হিসেবে ঢুকেছে। কালকে থেকে অফিস শুরু করেছে। আর কোনো চিন্তা নাই বন্ধু। আমরা দুই বুড়ো বুড়ির কষ্টের দিন শেষ!"
আমি আফ্রিকান বন্ধুটির হাসি দেখতে থাকি, এ এক অদ্ভুত সুখের হাসি যেটা খুব বেশী দেখিনি জীবনে। যেদিন এসএসসির ফলাফল প্রকাশ হলো, বাবা আমাকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন। বুড়ো হয়ে বাবার কোলে উঠতে কেমন যেনো লজ্জা লাগছিলো। বাবার পাগলামোর কথা মনে পড়ছে আমার।
ফোন দিলাম ব হুদিন পর
: বাবা, কি করো?
: এত রাতে কি করবো? তাহাজ্জুদের নামাজের জন্য ওজু করলাম। নামাজে দাড়াবো।
: মা কি করে?
: কি আর করবে? বুড়ো বয়সে ভীমরতি ধরেছে। প্রতিদিন কোথা থেকে কোন মেয়ের ছবি আনে আর রাত ভর নিজের সাথে কথা বলে। বলে ছেলের বৌ করে আনবে। বোকা মেয়ে মানুষ যে ছেলে দেশে আর আসতে পারবে না, বিশ্বাস করে না।
: কিছু বলো না। সুখী থাকুক। তোমাদের ছবি দেখলাম গতকাল। তুমি লাঠি নিয়ে হাটা ধরলে কবে?
: আরে বলিস না, এই একটু কেটে গিয়েছিলো আরকি
মা ফোনের ওপাশে বাবার পিছে পিছে জোরে জোরে বলছে,"আমি বোকা মেয়ে মানুষ। ওজু করে মিথ্যা কথা বলো কেন? তোমার ছেলে এত করে হাসপাতালে যেতে বললো তাও যাও না। আমি তো বোকা মানুষ। হারামী পুলিশকে আমি অভিশাপ দিলাম......
বাবা একটা ধমক দিলো মাকে, আমাকে বললো,"আরে কিছু ভাবিস না। শোন, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে যে নতুন রাস্তা হয়েছে তার মোড়ে একটা ৩০ শতক জায়গা আছে। এক দাগে কেনা যাবে। তুই একটা মার্কেটের জায়গা দেখতে বলেছিলি। কথা বলবো?"
: তুমি কতদিন ধরে হাটতে পারো না?
: আরে পাগল, ও কিছু না। ঠিক হয়ে গেছে। বয়স হয়েছে।
: আমার কথা শোন। কালকে ব্যাংক থেকে ৪ লাখ টাকা ওঠাবা। সোজা এপোলো তে যাবা। বলবা কত লাগবে ঐ পা ঠিক করতে। যদি ঠিক করতে না পারে, তাহলে সিংগাপুরের ভিসার জন্য দাড়াবা। আমি কালকে একটা ছেলেকে পাঠাবো। তার হাতে পাসপোর্ট আর এক্সরে রিপোর্টগুলো দিবা।
: আহহা....কোনো দরকার নেই তো। আমি বলি কি, কাল পঙ্গুহাসপাতালে গিয়ে একটা সিরিয়াল নিয়ে...
: আমার কথা তুমি শুনবা কি শুনবা না?
: রাগ করতেছিস কেন? নে, তোর আম্মার সাথে কথা বল। তোর সাথে কথা না হলে এর জন্য আমাকে কতদিন কথা শুনতে হয় কে জানে?
মা ফোনটা ধরেই বলল,"বাবা, তার দিকে তাকাতে পারি না। রাতভর ঘুমায় না। এই বয়সে পুলিশের এমন অত্যাচার....(কাদতে থাকলো ডুকড়ে ডুকড়ে)......"
আফ্রিকান বন্ধুটির ফোন নম্বর রাখা হয়নি। ট্রেন স্টেশনে হঠাৎ করে দেখা, হঠাৎ করেই মিলিয়ে গেলো। দিয়ে গেলো এমন কিছু কথার ধুম্রজাল, নিজের ভেতরের সুপ্ত চেতনাকে জাগিয়ে দিলো। সবগুলো লোম দাড়িয়ে যায় এই ভেবে যে শত স হ্স্র আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয়ে যাওয়া ধ্বংসস্তুপ থেকেও শুরু করা যায় যুদ্ধ আর সেই যুদ্ধও বিজয় ছিনিয়ে আনে।
নিজের হাত দুটোকে মুষ্টি করে দেয়ালে আঘাত করতে থাকি, দেয়াল রক্তাক্ত হয়ে যায়। খুব দেখা দরকার সাদা রং লালের বিচ্ছুরন কতটা ফুটে উঠে।
আরেকটি সেই লেখা। খুব ভালো লাগলো। প্রিয়তে নিলাম।
ধন্যবাদ ভাই
বাবা ভাল হয়ে যান তাড়াতাড়ি এই শুভ কামনা
ধন্যবাদ।
বৃদ্ধ হয়েছেন। দোয়ার বাইরে আর কীইবা করতে পারি। যেটা করতে পারতাম তার জন্য দেশে যাওয়া দরকার। দেশে যাওয়ার কথা ভাবলেই আবারও আত্মকেন্দ্রিকতায় আক্রান্ত হই। কেসের ঝামেলা, বেকারত্ব, অস্হির রাজনীতি কত কিছু মাথায় আসে তখন!
মন্তব্য করুন