কথার ভ্যালেনটাইনস পার্টি
শওগাত আলী সাগর
স্কুলের অফিসের ঠিক সামনের দরোজাটার কাছেই দাড়িয়ে আছি আমি।পাশ ফিরে তাকাতেই দেখি ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা লাইন ধরে হেটে যাচ্ছে। সবার সামনে ওটা কথা না? হ্যাঁ তাই তো। কিন্তু সে একবারও আমার দিকে তাকালো না। মনে হলো মাথাটা নীচু করে আমাকে না দেখার ভান করে হেটে চলে গেলো।
কথা সাধারনত এমনটি করে না। মাঝে মধ্যে আমি তাকে স্কুল থেকে নিতে আসি। ক্লাশ থেকে বের হয়েই সে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু আজ সে আমার দিকে ফিরে তাকালো না। অবশ্য এর একটা কারন হতে পারে,সে এখন স্কুলের মধ্যে আছে। একটা ক্লাশ থেকে নিজের ক্লাশে ফিরে যাচ্ছে। স্কুলে আবার বাচ্চাদের ব্যক্তিত্ববোধটা অনেক টনটনে হয়। বর্ণ’র সঙ্গেও এমন একটা ঘটনা ঘটেছিলো একবার। বর্ণ তখন কিন্টারগার্ডেনে পড়ে। সময়টা সামার। আমি যে স্কুল ছুটি হওয়ার অনেক আগেই চলে এসেছি সেটা মাথায় ছিলো না। স্কুলের মাঠে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে বর্ণকে ছুটাছুটি করতে দেখে আমি সেখানে গিয়ে দাড়াই। প্রথমটায় বর্ণ আমাকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করে। কিন্তু সে যে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে সেটা আমি বুঝে উঠতে পারিনি। ফলে বাচ্চাদের জটলাটার কাছে গিয়ে দাড়াই। এবার বর্ণ চোখেমুখে বিরক্তি এনে কাছে এসে ফিস পিস করে বলে- ‘তোমার এখানে আসা উচিত হয়নি বাবা। তোমার উচিত স্কুলের বাইরে গিয়ে দাড়িয়ে থাকা।‘ কথাটা ছুড়ে দিয়েই জটলার ভেতর হারিয়ে যায় বর্ণ। ততক্ষণে আমার খেয়াল হয়- মাঠের এই খেলাধূলাটা ওদের ক্লাশেরই অংশ। স্কুল এখনো ছুটি হয়নি।
আজও আমি এসেছি স্কুল আওয়ারেই বর্ণ এবং কথাকে বাসায় নিয়ে যেতে। কথামালার এই সময়ে বাসায় চলে যাওয়ার কোনো কারন নেই। ওর স্কুল শেষ হবে ৩টা ২০ এ। এখন বাজে সকাল ১১টা। স্কুল থেকে নিয়ে যেতে হবে আসলে বর্ণকে। ওর আজ ‘শেক্সপিয়র ইন একশন’ এর প্রোগ্রাম। থিয়েটার কোম্পানি থেকে বলে দেওয়া হয়েছে চারটার মধ্যে ওখানে পৌছুতে হবে। ডাউনটাউনে আমি পারতপক্ষে গাড়ি নিয়ে ঢুকি না। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যেতে ঘন্টা খানেক লেগে যাবে। সেই বিবেচনায় ৩টার মধ্যেই বাসা থেকে বেরুতে হবে। তবু আমরা ঠিক করলাম বর্ণকে লাঞ্চ ব্রেকেই বাসায় নিয়ে আসবো। আর বর্ণ চলে এলে কথার জন্যে দ্বিতীয় দফা স্কুলে যাওয়া কেন?
বর্ণ’র টিচারকে আগেই নোট দেওয়া ছিলো। ফলে অফিস থেকে মেসেজ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বর্ণকে অফিসে পাঠিয়ে দিলেন তার ক্লাশ টিচার। কিন্তু কথার বেলা ঘটলো বিপত্তি। কথার বদলে এক ভদ্রমহিলা এসে জানতে চাইলেন- কথা কি অসুস্থ?
- না তো!
- তা হলে তাকে বাড়ী নিয়ে যেতে চাইছো কেন?
আমি ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে থাকি। কথা’র ক্লাশ টিচার মিস সিগনার। উনি তাহলে কে? তাছাড়া কথাকে কেন নিয়ে যেতে চাই সে ব্যাখ্যা অফিসকেই দিতে হয়েছে। কিন্তু এই ভদ্রমহিলা......
- বাই দ্যা ওয়ে, আমি সাপ্লাই টিচার। মিস সিগনারের ক্লাশ নিচ্ছি।
তার মানে কথার ক্লাশ টিচার মিস সিগনার আজ স্কুলে নেই। তার পরিবর্তে ‘বদলি’ শিক্ষক এসেছেন ক্লাশ নিতে। এই ‘বদলি’ শিক্ষকের ধারনাটি চমতকার। এরা আসলে অস্থায়ী শিক্ষক কিন্তু শিক্ষাবোর্ডের তালিকাভূক্ত। কোনো স্কুলের নির্দিষ্ট কোনো শিক্ষক অনুপস্থিত থাকলে এই সব ‘বদলি’ শিক্ষকদের ডাক পড়ে। যেই স্কুল থেকে ডাক পড়ে সেখানেই তারা গিয়ে ক্লাশ নেন।
- কথা এখন মিউজিক ক্লাশে আছে । কিছুক্ষনের মধ্যেই ক্লাশটা শেষ হবে । সে পর্যন্ত তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। ভদ্রমহিলা কথাগুলো বলেই ক্লাশের দিকে হাটতে থাকেন।
বর্ণকে সাথে নিয়ে আমি কথার ক্লাশে গিয়ে দাড়াই। কিন্তু কথা আমার দিকে না তাকিয়ে মাথা নীচু করে বের হয়ে যায়। ‘বদলি শিক্ষক’ এসে জানিয়ে যান, কথা তার ব্যাকপ্যাক নিয়ে রেডি হতে গেছে। ও রেডি হলেই আমি ওকে নিয়ে যেতে পারবো।
বেশ খানিকটা পর আমার সামনে এসে দাড়ায়- কথা নয় বর্ণ। ‘বাবা, কথা ইজ স্যাড।‘
- কেন বাবা, কি হয়েছে?
এবার পেছন থেকে সামনে আসে কথা। দুচোখ বেয়ে তার জলের ধারা। মাথাটা নীচু রেখেই ফিস ফিস করে বলে ‘আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু গো হোম বাবা। আই ওয়ান্ট টু স্টে এট স্কুল।‘
আমি চোখ মুছে দিয়ে বুকে টেনে নিয়ে বলি- ঠিক আছে। তুমি যাবে না। কিন্তু কেন জানতে পারি কি?
- আই ওয়ান্না এটেন্ড দ্যা পার্টি এট স্কুল। দ্যাটস ফান বাবা।
ক্লাশে নানাধরনের পার্টি হয় স্কুলে। প্রতিটি বাচ্চার জন্মদিনেই ঘটা করে জন্মদিনের পার্টির আয়োজন করা হয় ক্লাশে। কবে কার জন্মদিন সেটা আগেভাগেই জানিয়ে দেওয়া হয়। ফলে প্রত্যেকেই কাগজ কেটে নিজেদের মতো করে ছবি একে নিজেদের নাম লিখে জন্মদিনের শুভেচ্ছা কার্ড বানায় বাচ্চারা। এই কাজগুলো হয় ক্লাশেই ক্লাশ টিচারের সহায়তায়। আজ কি তাহলে কারো জন্মদিন?
ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেয় বর্ণ। আজ ভ্যালেনটাইনস ডে পার্টি হবে ওদের ক্লাশে।কথা সেই পার্টিটা মিস করতে চায় না। সাড়ে ৪ বছরের কথা পড়ে জুনিয়র কিন্টারগার্টেনে। ওদের ক্লাশেও ভ্যালেনটাইনস পার্টি! আমি টিচারের দিকে তাকাতেই তিনি জানান, লাঞ্চ আওয়ারে তারা ‘কোকি পার্টি’করবেন বাচ্চাদের নিয়ে। নানা রঙের কোকি আনা হযেছে ক্লাশে। কথা নিজেও একটা কোকির গায়ে হার্টের ছবি একেছে। বাচ্চারা ফ্লোরে বসে কাগজ কেটে কেটে ভ্যালেনটাইনস ডে কার্ড বানাচ্ছে। প্রতিটি বাচ্চার নাম লেখা একটা কাগজ ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রত্যেকটা বাচ্চাকে। সেই কাগজ দেখে দেখে তারা কার্ডে নামও লিখছে নিজের হাতে।পুরো ক্লাশ জুড়ে বাচ্চাদের সে কি উতসাহ আর উত্তেজনা! সেই উত্তেজনা থেকে বঞ্চিত হতে চাইবে কেন কথা!
সাড়ে ১১টায় সেই পার্টিটা শেষ হবে।
আমার অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।
কতো সুন্দর নিয়ম-কানুন! শুভকামনা বাচ্চাদের জন্য...
হ্যাঁ, ছোট ছোট বাচ্চারা কতো কিছু শিখে নিচ্ছে। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
সুন্দর নিয়ম....
বাচ্চাদের জন্য অনেক অনেক ভালবাসা
আপনাকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ। উসকে দিয়েছিলেন তো। এখন এইসব গল্প কাহিনী হজম করতে হবে।
বর্ণ আর কথার জন্য অনেক ভালবাসা... ওরা মানুষ হোক জীবনে...
অাপনােকও ধন্যবাদ েমসবাহ ভাই। ভােলা থাকেবন।
আপনার লেখা পড়লে আমিকেন জানি পিচ্চি দুইটাকে চোখের সামনে দেখতে পাই।
ওদের জন্য অনেক আদর।
অাপনার অনুভূিত শক্তি প্রবল বলে। ভালোবাসার ক্ষমতাটাও অনেক বেশি সে জন্য। ধন্যবাদ আপনাকে রাসেল।
দুইটাকেই অনেক আদর
আপনারে ....
মাসুম ভাইরে আপনি ডট ডট দিলেন?
মাসুমের জন্য ডট না, জায়গাটা ফাকা রাখলাম যাতে ....
কথা ও বর্ণ - দুজনকেই অনেক আদর। মিষ্টি একটা পোষ্টের জন্য আপনাকে
ধন্যবাদ আপনাকেও।
আহা!
হুমমম!!!!!!!!!!!!!!
টরন্টোতে আমার ভাগ্নির স্কুলের কান্ডকীর্তি কিছুদিন দেখার সৌভাগ্য হইছিলো, সেগুলি আমাদের দূরতম স্বপ্নের সাথেও মিলে না। কথা ও বর্ণ ভাল থাকুক, উপভোগ করুক।
~
আবার টরন্টো এলে আওয়াজ দিয়েন। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
বর্ণ আর কথার জন্য অনেক ভালবাসা..
নিয়মিত লিখবেন যেন ওঁদের নিয়ে। ভাল থাকুন।
তাইতো শুরু করলাম। কখন না আবার বিরক্ত হয়ে যান। ধন্যবাদ আপনাকে।
পড়তে পড়তে মনে হইতেছিলো সামনে ছলছলে চোখে কথাকে দেখতে পাচ্ছি... অনেক আদর পিচ্চি দুইটার জন্য...
ধন্যবাদ আপনাকেও
বর্ণ আর কথার জন্য অনেক শুভকামনা।। ওরা দু'জনেই
বড় হোক ভালো হোক
চাঁদ সূর্যের আলো হোক
মায়াভরা আশির্বাদ! ধন্যবাদ আপনাকেও
বর্ণ ও কথার জন্য অনেক শুভকামনা।
আমারো সেম অবস্থা। ডে কেয়ারে একটু আগে পৌঁছে গেলে মেয়ে রাগ করে, কেন আগে এলাম ও আরো খেলতে চায়। আর প্রতিদিন ডে কেয়ারে যে শিল্প কর্ম বানায় তা দিয়েতো আমার বাসা সয়লাব, ফেলে কুলাতে পারি না, যাকে বলে। কিন্তু কতো সামান্য জিনিস থেকে যে এরা কতো কি বানানো শিখায়, বলার মতো না।
স্কুল মিস দেয়ার কথাতো ভাবতেই পারে না, স্কুল আর সাথে বান্ধবীদের আকর্ষন
ওদের দেখে ভাবি আমাদের ছোটবেলা কেমন পানসে ছিল
মন্তব্য করুন