একটা ছবির গল্প
শওগাত আলী সাগর
কাগজটার উপর চোখ পড়তেই দপ করে মেজাজটা বিগড়ে যায়। এক টুকরো সাদা কাগজের বুকের উপর রং পেন্সিল দিয়ে তৈরি করা বিচিত্রসব রেখাগুলোর উপর দিয়ে আমি বর্ণর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি। ওর চোখে মুখে দুষ্টুমি খেলা করে যায়। আমি রেগে গেলে মেয়েটি রাজ্যের দুষ্টুমি দিয়ে সেই রাগকে হালকা করে দেওয়ার চেষ্টা করে। এতে আমার রাগের মাত্রাটা উর্ধ্বমুখি হতে থাকলেও সেটা শেষ পর্যন্ত দপ করে নিভে যায়। এই বিষয়টা মেয়েটা জেনে গেছে বলেই হয়তো বা আমার রাগকে মোটেও পাত্তা দিতে চায় না সে।
- আমি তো একটা ছবিই আঁকলাম। দেখো, দেখে বলো ছবিটা কেমন হয়েছে।– আমার রাগটাকে একেবারেই পাত্তা না দিয়ে বলে যায় সে।
একটা ছবি আঁকানোর জন্য গত কয়েকদিন ধরেই আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও শহীদ দিবস উপলক্ষে শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে বাংলাদেশ সেন্টার। আয়োজকরা বারবার ফোন করে অনুরোধ করেছে বর্ণ-কথা দুজনেই যেন তাতে অংশ নেয়। প্রবাসের অনেক বাঙালি পরিবারের ছেলেমেয়েরাই বাংলা স্কুল, আর্ট স্কুলে যায়। ওদের সংঙ্গে প্রতিযোগিতায় টেকা বর্ণ- কথার কাজ নয়। তবু কমিউনিটির একটি প্রোগ্রাম,আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের স্মারক একটি অনুষ্ঠানে আমার মেয়েরা অংশ নেবে- সেটা আমি মনে প্রাণেই চাচ্ছিলাম। আর সে কারনেই গত ক’দিন ধরে চেষ্টা করছিলাম বর্ণ যেন শহীদ মিনারের ছবিটা একেঁ একেঁ হাতটা একটা পাকিয়ে নেয়। শহীদ মিনারের ছরি একটা প্রিন্ট আউট বের করে বর্ণর হাতে ধরিয়েও দিয়েছি যাতে ওটা দেখে দেখে ছবি আঁকার চেষ্টাটা সে করতে পারে। আমি যতোই চেষ্টা করি, বর্ণ যেন ততই বিষয়টা এড়িয়ে যেতে থাকে।
আমার চেষ্টায় কোনো কাজ হচ্ছে না দেখে এগিয়ে আসে সেরীন। বর্ণ- কথাকে নিয়ে বসে যায় গল্প বলায়।‘৫২ এর ভাষা আন্দোলনের পুরো কাহিনীটাই গল্পের মতো করে শুনিয়ে দেয় সেরীন। আশ্চর্য! চোখে মুখে রাজ্যের কৌতূহল নিয়ে, গভীর মনোযোগ দিয়েই সেই গল্পে ডুবে যায় বর্ণ। প্রশ্নের পর প্রশ্নবাণে ব্যতিব্যস্ত করে ফেলে সে। শহীদ মিনার কেমন করে এলো সেই গল্প শুনতে শুনতে কম্পিউটারের বাটন চাপে সে। নিজে নিজেই গুগল ইমেজে শহীদ মিনার লিখে সার্চ দেয়। পর্দায় ভেসে উঠা শহীদ মিনারের ছবিগুলোর দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। তারপর কাগজ আর পেন্সিল নিয়ে বসে যায়।
২. বর্ণ যে কাগজটি আমার সামনে ধরে রেখেছে সেখানে বাংলাদেশের শহীদ মিনার তো দূরের কথা কোনো মিনারই নেই। তাহলে এতো চেষ্টা তদবির করে কি ফল হলো?
- তুমি জানো আমি কি আঁকলাম? তোমার তো উচিত ছিলো ছবিটা ভালো করে দেখা।– বর্ণের কণ্ঠে এবার অনুযোগ।
- ছবিটা আমি দেখেছি মা। কিন্তু আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। আমাকে কি একটু বুঝিয়ে দেবে?- ভেতরের রাগটাকে চাপা দিয়েই আমি কৃত্রিম কৌতূহল দেখাই।
- এই ছবিটার নাম,’ইমাজিনারি ওয়ার্ল্ড’। ইউ ক্যান সে ‘বর্ণ’স ইমাজিনারি ওয়ার্ল্ড’।
- আমাকে একটু বুঝিয়ে দাও।
- উপরের দিকটায় তাকাও। এটা হচ্ছে আকাশ।
- কিন্তু তুমি তো সবুজ রং ব্যবহার করেছো? আকাশ তো কখনোই সবুজ হয় না। আকাশ হয় নীল।
- আমি সেটা জানি, কিন্তু আমি আকাশটাকে সবুজ করে দিলাম। কেন জানো? কথা,আমার ছোট বোন,ওর প্রিয় রঙ হচ্ছে সবুজ। আমি ওর জন্য আকাশের রঙটাকে সবুজ করে দিলাম। মাথার উপর বিশাল একটা সবুজ আকাশ- ভাবতে পারো বাবা? আর এই দিকটায় দেখো? আকাশ থেকে কিছু একটা ঝড়ে পড়ছে। এগুলো হচ্ছে স্নো। তুমি তো আবার বলবে স্নো কি কখনো নীল হয় নাকি! আমিও জানি, স্নো কখনোই নীল হয় না, সাদা তুলার মতো বরফ পড়ে। স্নো আমি খুবই পছন্দ করি বাবা। কিন্তু দেখো। আমার প্রিয় রঙ নীল। স্নো আমার খুবই প্রিয়। আই উইশ সাম ডে ব্লু স্নো উইল ফল।আমার সেই উইশটাকেই আমি এখানে একেঁ দিলাম।
টের পাই,আমার বিরক্তি,রাগটা ক্রমশ: কৌতূহলে রুপান্তরিত হচ্ছে। কিছুটা আনন্দেও কি?
-আর এই যে এই দিকটায় দেখো। এগুলো পাথর। পাথরের পাশে স্তুপ হয়ে আছে জমাট বরফ। আর তার ভেতর থেকে গজিয়ে উঠেছে এই গাছটা। আর এই গাছে দেখো কমলা রঙের একটা ফুল ফুটতে শুরু করেছে।
ছবিটার দিকে আমার মনোযোগ বাড়ছে- ব্যাপারটা সম্ভবত টের পেয়ে যায় বর্ণ। ফলে রীতিমতো মাষ্টারের ভূমিকায় নেমে পড়ে সে।
- দেখো, স্নো’র সময়টাতে কোনো গাছেই কোনো পাতা থাকে না, কোনো ফুল থাকে না। আমি অনেক ভেবেছি, সামারের অতো সুন্দর সুন্দর ফুলগুলো এখন নেই কেন! আমি খুব, খুবই চাই বাবা, প্রচণ্ড বরফ ঝড়ের মধ্যেইও সবুজ গাছ থাকবে, গাছে গাছে ফুল থাকবে। সেটা থাকে না বলেই আমি আমার ইমাজিনারি ওয়ার্ল্ডে বরফের ভেতর থেকে একটা গাছ, আর সেই গাছে ফুল ফুটিয়ে দিলাম। ইজ নট ইট কুল?
ছবিটার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকি আমি। তাকিয়ে আছে বর্ণও। কয়েকটা মুহূর্ত আমরা বাবা মেয়ে কেউই কোনো কথা বলি না। মাথার ভেতর নানা কিছু খেলতে থাকে। সাত বছরের একটা মেয়ের কল্পনার জগতকে উন্মোচিত করে দেয়ার প্রাণান্ত এই চেষ্টাটাকে আমি কিভাবে দেখবো?
- আর আমার ইমাজিনারি ওয়ার্ল্ডের মোষ্ট এক্সাইটিং থিং কি জানো? – ছবিটার উপর আরো বেশি ঝুকেঁ পড়ে কথাগুলো বলে যায় বর্ণ। আমি শুনছি কি শুনছি না, সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নাই। ‘লুক হেয়ার। সান এণ্ড মুন আর মিটিং ইচ আদার।‘
- কিন্তু...
- সান এণ্ড মুন কখনোই মিট করতে পারে না- সেটাই বলবে তো? আই নো দ্যাট। কিন্তু দেখো, সূর্যটা তার সবটুকু আলো চাঁদকে দিয়ে নিজে হারিয়ে যায়। সূর্যের সেই আলো দিয়ে চাঁদ নিজেকে উজ্জল করে তুলে। কিন্তু তাদের কখনোই দেখা হয় না। বাট দে আর ফ্রেণ্ডস। ইজ নট ইট?
আমি কি বলবো ভেবে পাই না। আমার কিছু বলার জন্য অপেক্ষাও করে না বর্ণ।
- এনিওয়ে, দিস ইজ মাই ইমাজিনারি ওয়ার্ল্ড। আই থিংক দে শোড মিট সামটাইম। আমি তাই তাদের মিলিয়ে দিলাম।
আমার মাথা থেকে শহদি মিনারের ছবি আঁকার ভূতটা কোথায় যেন হারিয়ে যায়।
৩. ডেনফোর্থের বাংলাদেশ সেন্টারে যেন তীল ধারনের জায়গা নেই। অনেক দূর থেকেও সন্তানদের নিয়ে ছুটে এসেছেন অভিভাবকরা।সন্তানদের চেয়েও মায়েদের উদ্বেগটা যেন বেশি প্রতিযোগিতাটা নিয়ে। মা দের সরিয়ে নিতে আয়োজকদের হিমসিম খেতে হয়।
বর্ণ ও কথা দুজনকেই বসিয়ে দিয়ে আমি বাইরে চলে আসি। মাঝখানে একবার ভেতরে উকিঁ দেই। কথা আপন মনে সাদা কাগজে আঁকাআকিঁ করছে। ওর কাছে ছবি আঁকা মানেই হলো সাদা কাগজে সবক’টি রঙ একটু একটু করে ছুয়ে দেওয়া। বর্ণ কি কিছু আঁকছে? গভীর চিন্তামগ্ন হলো তাকে। দৃষ্টিটা কাগজের দিকে।
আঁকা আকিঁর সময় শেষ হলে বেরিয়ে আসে বর্ণ ও কথা। আমি অনেকটা ফিস ফিস করে বর্ণের কানের কাছে মুখ নিয়ে জানতে চাই, কি ছবি আঁকলে মাম্মা।
হঠাত দাড়িয়ে যায় বর্ণ। আমার চোখের দিকে সোজা তাকিয়ে বলে ‘বর্ণ’স ইমাজিনারি ওয়ার্ল্ড’। আমি চুপ হয়ে যাই। আমার মাথায় শহীদ মিনার ছোট্ট একটা ঢেউ তুলে হারিয়ে যায়।
- তুমি কি জানো আমার ইমাজিনারি ওয়ার্ল্ডে কি আছে?
- আমি মাথা নাড়ি, না তো মা।
- আমি বাংলাদেশের পতাকাটা আঁকলাম। সেই পতাকার উপর অনেক রক্ত।ওই যে হিরোগুলো, যারা বাংলা ভাষার জন্য মরে গেলো, তাদের রক্তটা আমি বাংলাদেশের পতাকার উপর ছড়িয়ে দিলাম। ওই হিরোগুলোর রক্ত থেকেই তো বাংলাদেশের পতাকাটর জন্ম হলো। না কি বলো বাবা।
আমি খানিকক্ষণ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকি। তারপর জড়িয়ে ধরি। কেন জানি আমার গলাটা ভারি হয়ে আসে। আমি আর কিছুই বলতে পারি না্ ।
জয় হোক বর্ণর ! অনেক অনেক আদর তার জন্য
ধন্যবাদ আপনাকে
আপনার লেখা পড়ে আমারও গলাটা ভারী হয়ে আসলো।
সেটা কি লেখার জন্য, না কি ঘটনার জন্য!
.... আর কিছু বলার নাই। আপনার কন্যাকে অনেক অনেক আদর।
ধন্যবাদ আপনাকে
কি বলবো ... বুঝতেছি না ... মাঝে মাঝে কিছুটা সময় আসে যখন কিছুই বলা যায় না
হুমমমমম
লেখাটা পড়ে সত্যিই অদ্ভুতরকমের বোধ হলো। বাচ্চাটার ইমেজিনেশন কি দারুন!
ভাইয়া, আপ্নের মেয়েটাকে নিয়ে আমারি গর্ব হচ্ছে, বড় হলেও চিন্তাধারা ওর এমনি স্পষ্ট থাকুক!
ভাবি আমাদের দেশের বাচ্চাদের কল্পনার জগৎ নিয়ে কেন কথা বলে না, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সমস্যা? নাকি আমাদের? বাবা-মার?
কথা আর বর্ণর জন্য অনেক অনেক আদর ও শুভকামনা..ওদের গল্পের বই ধরিয়ে দেন..
আপনার পিচ্চি দুইটার গল্প যখনই পড়ি আলাদা একটা আনন্দ পাই। একটা ভরসা পাই। আমাদের আগামী প্রজন্মের প্রতি আশাবাদী হয়ে উঠি...
লেখা পড়ে কেন জানি আমার চোখে পানি আসলো, আমি বর্ণকে দেখি নি কিন্তু কেন যেন আমি ওকে দেখতে পেলাম আমার ইমাজিনারী ওয়ার্ল্ডে। , খুব সুইট আর টেলেন্টেড মেয়ে।
গড ব্লেস!
...উদ্ভাসিত হোক ‘বর্ণ’স ইমাজিনারি ওয়ার্ল্ড’
~
মন্তব্য করুন