‘ক্রিসেন্ট টাউন’- টরন্টোর বাংলাপাড়া
ইংরেজী ‘ক্রিসেন্ট’ শব্দটা উচ্চারিত হলেই প্রথম যে প্রতিমূর্তিটা চোখের সামনে ভেসে উঠে সেটি হচ্ছে ‘চাঁদ’। চান সুরুয নিয়ে গবেষনার ‘এস্ট্রনোমি’ থেকে তাই জানা যায়। আর প্রতীক বা চিত্রকলা তথা ‘আর্ট এন্ড সিম্বোলোজিম’ এ ক্রিসেন্ট হচ্ছে - আকৃতি। একটা বৃত্তকে দুটো ভাগ করে এক ভাগ সরিয়ে নিলে যে আকারটা ধারন করে সেটা হচ্ছে ‘ক্রিসেন্ট। বলা হয় ‘এস্ট্রোনোমি’ আসলে এখান থেকেই ক্রিসেন্ট শব্দটা ধার নিয়েছে।
‘ক্রিসেন্ট’ শব্দটা ইংরেজী হলেও এর উৎপত্তি ঘটেছে ল্যাটিন ‘crescere’ থেকে। ‘crescere’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে "to grow" অর্থ্যাত বেড়ে উঠা।এই এলাকাটার নাম ‘ক্রিসেন্ট টাউন’ কেন হলো,তার সঙ্গে আকৃতি কিংবা চাঁদের কোনো সম্পর্ক আছে কী না , তা অবশ্য খুঁজে পাওয়া যায় নি। তবে ক্রিসেন্ট টাউনের রুপান্তরের ইতিহাসটার দিকে তাকালে ল্যাটিন ক্রিয়াপদ অর্থে "to grow", শব্দটির যথার্থই প্রতিফলন পাওয়া যায়। ১৮৮৭ সালে প্রতিষ্ঠা পাবার পর থেকে ক্রিসেন্ট টাউন আক্ষরিক অর্থেই বিস্তৃত হয়েছে, কেবল বিস্তৃত হওয়াই নয়, ক্রিসেন্ট টাউন হয়ে উঠেছে নতুন আসা অভিবাসীদের নির্ভরযোগ্য একটা স্থান। নানা জাত আর সংস্কৃতির মিলনমেলায়ও ক্রিসেন্ট টাউন হয়ে গড়ে উঠেছে এক টুকরো ’বাংলাপাড়া’ হিসেবে।
কানাডার প্রথম বিখ্যাত শিল্পপতিদের একজন হার্ট ম্যাসির ছেলে ওয়ালটার ম্যাসি’র ‘ফারম’টাই যে একদিন সাংস্কৃতিক বৈচিত্রে ভাস্বর এক জনবসতি হয়ে উঠবে তা সম্ভবত তিনি নিজেও ভাবেন নি। ডজ রোড আর ভিক্টোরিয়া পার্ক এভিনিউর মধ্যবর্তীস্থানে ২৪০ একর জায়গা কিনে তিনি গড়ে তুলে ছিলেন বিশাল এক ফারম। নাগরিকদের তরতাজা মোরগ মুরগি,ডিম সরবরাহ ছাড়াও কানাডার প্রথম প্রক্রিয়াজাতকৃত দুধ এর উতপত্তিও হয় এখানেই। সিটি ডেইরি কোম্পানির চাহিদার দুধের সরবরাহ যেতো এখান থেকেই।ওয়ালটার ম্যাসির পারিবারিক পদবী ডেনটন অনুসারে সেই ফারমটির নামও হয়েছিলো ‘ডেনটন ফারম’।
১৯৩৩ সালে এসে সুসান ম্যাসি ডেনটনিয়া ফারম এর ৪০ একর জায়গা লিখে দেন ক্রিসেন্ট স্কুলকে।ম্যাসি পরিবারের এক সন্তান ওই স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলো বলে স্কুলটাকে পৃষ্ঠপোষকতা করতে এগিয়ে আসেন তারা। ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ক্রিসেন্ট স্কুলটা ছিলো। এরপরই জায়গাটা বিক্রি হয়ে যায় ডেপলারদের কাছে। তারা তৈরি করেন আজকের ক্রিসেন্ট টাউন নেইবারহুড।
ক্রিসেন্ট টাউন- নামটা উচ্চারিত হলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে এক টুকরো বাংলাদেশের ছবি। কানাডার বিভিন্ন শহরে এমনকি কানাডার বাইরেও টরন্টোর বাঙালি পাড়া হিসেবেই খ্যাতি পেয়েছে এই ক্রিসেন্ট টাউন। যদিও মোট জনসংখ্যার হিসেবে দক্ষিন এশিয়দের আবাসভুমি এই ক্রিসেন্ট টাউন, কিন্তু বাংলাভাষাভাষীদের সংখ্যাধিক্য হওয়ায় ‘বাংলা পাড়া’ নামটাকেও যুক্তিযুক্ত করে তুলেছে। স্ট্যাটিসটিক্স কানাডার পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ক্রিসেনট টাউনের মোট বাসিন্দাদের ১১.৯ শতাংশ বাংলাদেশি। তার পরপরই রয়েছে চাইনিজরা (৮ শতাংশ)। এই হিসাবটা অবশ্য ২০০৯ সালের। এর পরের আর কোনো হাল নাগাদ তথ্য স্ট্যাটিসটিক্স কানাডার কাছেও নাই। ৭ হাজার ৭৭০ জন অধিবাসীর তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষন করে এই উপসংহারে এসেছে স্ট্যাটিসটিক্স কানাডা। এখন অবশ্য ক্রিসেন্ট টাউনের জনসংখ্যা আরো অনেক বেশি। ইংরেজী কিংবা ফ্রেঞ্চ যাদের মাতৃভাষা, তাদের বাদ দিয়ে একক ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যাই এখানে সর্বাধিক।
তথ্য উপাত্ত ঘেটে জানা দেখা যায়, শুরুর দিকেও দু এক পরিবার বাঙালি ক্রিসেন্ট টাউনে থাকলেও মূলত: ১৯৯২ সাল তা তার পরবর্তী সময় থেকেই ক্রিসেন্ট টাউনে বাঙালিদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। অবকাঠামোগত সুবিধা বিবেচনায় প্রথমটায় বাঙালিরা এখানে অসতে শুরু করলেও পরবর্তীতে ‘বাঙালিরা ক্রিসেন্ট টাউনে থাকে’ – এমন একটা ধারনা ও প্রচারনা নতুন বাঙালি অভিবাসীকে ক্রিসেন্ট টাউনে বসতি গড়তে উতসাহী করে তুলে।সহজ এবং ২৪ ঘন্টার যোগযোগ ব্যবস্থা, লাগোয়া সাবওয়ে ও বাস যোগাযোগ, কম্পাউন্ডের মধ্যেই স্কুল এবং স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা নতুন আসা নাগরিকদের আকৃষ্ট করতে থাকে। এরই মাঝে ক্রিসেন্ট টাউন সংলগ্ন ডেনফোর্থ এলাকায় একটা দুটো বাংলাদেশি গ্রোসারি গড়ে উঠে। ফলে বাঙালিরা আরো বেশি ক্রিসেন্ট টাউনমুখী হয়ে উঠে।আর ক্রিসেন্ট টাউন ও সংলগ্ন এলাকায় বাঙালি অভিবাসীদের ভিড় ডেনফোর্থকে ঘিরে বাঙালির নিজস্ব বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে উঠাকে ত্বরান্বিত করেছে।
কালের পরিক্রমায় ক্রিসেন্ট টাউনকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। আলম পিয়া মিউজিকস্কুল,নান্দনিক ফাইন আর্টসসহ বেশ কয়েকটি সংগীত ও চিত্রশিল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে এই ক্রিসেন্ট টাউনে। দূরদূরান্ত থেকেও বাঙালি অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের ক্রিসেন্ট টাউনে নিয়ে আসেন বাংলা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে সন্তানদের পরিচিত করে তুলতে। ক্রিসেন্ট টাউন হেলথ সেন্টারেও এখন কয়েকজন বাঙালি চিকিতসক।ফলে নিজের ভাষায় স্বাস্থসমস্যা নিয়ে আলোচনা করে চিকিতসা সেবা নেওয়ার সুযোগটাও আরো বিস্তৃত হয়েছে।
ক্রিসেন্ট টাউনের ভেতর দিয়ে হেটে যেতে যেতে দুরের কোনো জানালা থেকে ভেসে আসা রবীন্দ্র সঙ্গীতের সূরে কিংবা পাশ দিয়ে হেটে যাওয়া কোনো নারী কিংবা পুরুষের অস্ফুট কণ্ঠ থেকে ছুটে আসা কোনো বাংলা গানের কলি এখন আর কাউকে চমকে দেয় না।বরং অস্ফুট বাংলা গানের কলি যেন ধীরে ধীরে ফুল হয়ে ফুটতে শুরু করেছে, মাঝে মধ্যে দরাজ গলার ‘আমি বাংলায় গান গাই’এর সূর যেন ক্রিসেন্ট টাউনের আকাশচুম্বী অট্টালিকার দেয়ালগুলোতে বাধা পেয়ে প্রতিধ্বনি করে ওঠে। ।
চমৎকার
নিয়মিত লেইখেন বস...
সাথে এক/আধটা ছবিও জুড়ে দিলে পড়ার সাথে দেখাও হয়
ভাল থাইকেন
চেষ্টা তো করছি নিয়মিত লিখতে। আমি আবার প্রযুক্তিতে কাঁচা কী না, তবু চেষ্টা করবো লেখার সঙ্গে ছবি দিতে।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
অনবদ্য গদ্য। এই লেখাগুলোর সাথে দু-একটা ছবি জুড়ে দিলে ভিজ্যুয়ালাইজ করতে সুবিধা হয়। ভেবে দেখবেন।
অনেক ধন্যবাদ লেখাটা পড়ার জন্য। ছবি আপলোডটা শিখে ফেলতে হবে দেখছি। পরের লেখাগুলোর সঙ্গেই চেষ্টা করবো।
বরাবরের মতো মুগ্ধ।
মুগ্ধ হবার গুন আছে আপনার! অনেক ধন্যবাদ রাসেল। উতসাহ পাচ্ছি।
পাশাপাশি আরো একটা বিষয় জানাতে পারেন; এ দেশ থেকে কেউ যদি কানাডা গিয়ে ক্রিসেন্ট টাউন থেকে দূরে থাকতে চায়, তাহলে তাকে কি কি ঝামেলায় পড়তে হতে পারে।
আসলেই, এ দেশ থেকে কেউ কানাডা গিয়ে ক্রিসেন্ট টাউন কিংবা টরন্টো থেকে
দূরে থাকতে চাইলে তাকে কি কি ঝামেলায় পড়তে হতে পারে, সম্ভব হলে জানিয়েন।
~
ক্রিসেন্ট টাউন আসলে স্মৃতিকাতর আর নতুন আসা বাঙালিদের জন্য উপযোগি স্থান। তবে সবাই যে ক্রিসেন্ট টাউনেই থাকেন তা কিন্তু নয়। অনেকে কিছুদিন এখানে থেকে দূরে চলে যান, আবার অনেকে বাঙলা পাড়ার নামই শুনতে পারেন না।
তবে যারা চান, বাংলাদেশের আবহের মধ্যে থাকতে তাদের জন্য ক্রিসেন্ট টাউন বা পাশ্ববর্তী এলাকাই সবচেয়ে ভালো।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
ঝামেলার আসলে কিছু নাই। ক্রিসেন্ট টাউনের বাইরেও কিছু কিছু বাঙালি পাড়া হয়ে উঠছে আজকাল। ওই সব এলাকায়ও দু একটা বাঙালি গ্রোসারি হয়েছে। তবে দূরবর্তী এলাকাগুলোতে এমনিতে লোকবসতি কম থাকে, আবার নিজদেশের লোক পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। সবাই তো চায় বিশেষ করে যাদের বাচ্চা আছে তারা বাংলাদেশি পরিবার বেশি খুজেঁন, কারন তারা চান বাংলা সংস্কৃতি যেন তাদের বাচ্চাদেও স্র্শ করে।
অনেক ধন্যবাদ লেখাটা পড়ার জন্য।
ঝামেলার কিছু নেই। শুধু বাংলাদেশটাকে মিস করবেন প্রবলভাবে। আর যদি দেশ নিয়ে বাঙালিপনা নিয়ে কোনো সংবেদনশীলতা না থাকে তাহলে তো কথাই নেই। অনেকে তো মনেই করে বাঙালিদের মধ্যেই যদি থাকি তাহলে আর কানাডায় আসা কেন ?
ছবিও দিয়েন
যথা আজ্ঞে স্যার !
খুবই সুন্দর লাগলো বর্ণনা...
আর সবার মতো আমিও ছবি যুক্ত করার দাবী জানালাম।
আপনার লেখার কঠ্ঠিন ভক্ত হয়ে যাচ্ছি।
অতো কঠ্ঠিন হইয়েন না, এট্টু নরম থাইক্কেন ।
কত কি জানলাম...
ইষ্ট লন্ডন টাইপের ব্যাপার স্যাপার দেখা যাচ্ছে। ভালো লাগে পড়তে
মন্তব্য করুন