‘আই লাভ ইউ ইনফিনিটি
শওগাত আলী সাগর
একটা অস্বস্থিকর থমথমে অবস্থা পুরো ঘরটায়। আমি সোফায় একপাশে বসে ‘ওয়ারবেবিস’ এ নিমগ্ন হবার চেষ্টা করছি। কিন্তু কিছুতেই যেন মগ্ন হতে পারছি না। বারবার মনোযোগ ছুটে যাচ্ছে। অথচ বইয়ের কাহিনীটা আজ দুপুরেও অক্টোপাসের মতো চেপে ধরেছিলো। সোফার অপরপ্রান্তে একটা পাজল বই নিয়ে পাতা উল্টাচ্ছে বর্ণমালা। আমি যতোটা সম্ভব চেহারাটাকে গম্ভীর রেখে আড়চোখে সেদিকে তাকাই। না। বর্ণরও যে খুব মনোযোগ আছে সেরকম মনে হচ্ছে না। সেও কেবল বইয়ের পাতা উল্টিয়ে যাচ্ছে। পাশের ঘরে সেরীন কম্পিউটারে মগ্ন।
শুক্রবারের সন্ধ্যাটায় যেন ঈদ নেমে আসে এই বাড়ীটায়। বিশেষ কোনো কারনে নয়। উইকএণ্ডের সন্ধ্যা বলেই হয়তোবা। আরো একটা কারন অবশ্য আছে। শনিবার স্কুল নেই। কাকডাকা ভোরে উঠে স্কুলে ছুটতে হবে না বলে এদিনটায় দ্রুত ঘুমুতে যাবার তাড়া থাকে না। ফলে বর্ণ এবং কথা দুজনেই রাত জাগতে পারে ইচ্ছেমতো। আজও সন্ধ্যাটা সেভাবেই শুরু হয়েছিলো। সন্ধ্যা বলি কেন? স্কুল থেকে ফিরেই দুবোনে খেলায় এতোটাই মগ্ন হয়ে উঠেলো যে অনেক চেষ্টা করেও ওদের খাবার টেবিলে আনা গেলো না।
- বর্ণ, খেতে আসো।
- আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু।– সোজা সাপ্টা জবাব তার।
আমি কৃত্রিম রাগ দেখাবার চেষ্টা করি। ‘পাঁচ মিনিটের মধ্যে খাবার টেবিলে দেখতে চাই তোমাকে।‘- কথা শেষ হবার আগেই কোমগে হাত দিয়ে চোখমুখ কটকটিয়ে সামনে দাড়ায় কথা।
- সি ইজ মাই ফ্রেণ্ড, বাবা। সি ইজ মাই বেষ্ট ফ্রেণ্ড।
- সো হোয়াট? – রেগে গিয়ে জবাব দেই।
- ডোন্ট বদার হার। - আমার চেয়েও রেগে গিয়ে জবাব দেয় সাড়ে ৪ বছরের কথামালা। তারপর তার চেয়ে তিন বছরের বর্ণ বর্ণকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদি গলায় বলেতে শুরু করে,’ ইউ আর মাই ফ্রেণ্ড,বর্ণ!’
আমি আর কথা বাড়াই না। কথা আসলে বাড়াতে পারি না। দুজনের দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকি। বর্ণ আর কথা জড়াজড়ি করে আবার খেলায় মত্ত হয়ে যায়।
আমি রেগে না গেলেও সেরীনের কাছে তারা অসহায়। এক চোখ রাঙানিতেই সুর সুর করে এসে টেবিলে বসে পড়ে দু বোন। কিন্তু কোথায় যেন একটা বিরক্তি,প্রতিবাদ টের পাই আমি।
খাবার টেবিল থেকে নেমেই আবার খেলায় মেতে উঠে দুজন। হাতে-মুখে লেগে থাকা এটো ভাত তরকারি শুকাতে থাকে। সেদিকে নজর দেওয়ার সময়ও তাদের নেই। দৌড়াদৌড়ি আর হৈ হুল্লোড়ে পুরো বাড়ীটাই যেন মাথায় তুলে নেবার যোগাড়।
কিন্তু খেলারওতো একটা শেষ থাকতে হবে।দু একবার ধমক লাগিয়ে ব্যর্থ হয়ে কঠিন হয়ে যায় সেরীন। বর্ণকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে কঠিন কন্ঠে ঘোষনা দেয়
- ১০ মিনিট সোফায় বসে থাকবে। এটা তোমার পানিশমেন্ট।‘
সেরীনের রাগের ডিগ্রীটা আমি টের পাই। বাংলাদেশের বাবা মায়েদের মতো যখন তখন চড় থাপ্পর মেরে দেওয়ার সুযোগ নাই এখানে। বাচ্চাদের গায়ে হাত তুললে আরেক বিপদ। স্কুল থেকেই বাচ্চাদের শিখিয়ে দেওয়া হয় বাবা মা গায়ে হাত তুললে সোজা ৯১১ কল করে দেবে। অনেক বাচ্চারা করেও সেটা। সেই ঝামেলা মেটানো অনেক কঠিন কাজ।আমি সতর্ক থাকি কোনোভাবেই যেন সেরীন বাচ্চাদের গায়ে হাত না তুলে। ফলে শাস্তির একটা ধরন সে বের করে নিয়েছে। নির্দিষ্ট একটা সময় সোফায় বা চেয়ারে বসিয়ে রাখা। আমি অবাক হই,এই শাস্তিটা ঘোষিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই মেয়েটা মাথা নীচু করে গিয়ে বসে পড়ে। লজ্জায় অপমানে চেহারাটা লাল হতে থাকে আর ফুস ফুস করতে থাকে।
আজও তার ব্যতিক্রম হয় না। সোফায় বসেই সেই ফুসতে থাকে। পাজলের বইটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে। এক পৃষ্ঠা থেকে আরেক পৃষ্ঠা। এই সুযোগে কথাকে সরিয়ে নেই আমি।একটা গল্পের বই পড়ে শুনানোর লোভটা সে কখনোই এড়াতে পারে না। আর বিছানায় নিয়ে বইটা শেষ করার পরই দীর্ঘ হাই তুলে বলতে শুরু করে- আই অ্যাম স্লিপি।
শাস্তির নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হবার পরও সোফায় বসে থাকে বর্ণ।‘টাইম ইজ ওভার, তুমি এখন উঠতে পারো’- কয়েকবার ঘোষনা দেবার পরও তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। টের পাই,আজকের শাস্তিটাকে সে ভীষন অপমান হিসেবেই নিয়েছে। কারো দিকে কোনো মনোযোগ না দিয়ে পাজল বইটাকে নিয়েই বসে থাকে সে।
সেই বসে থাকাটা আমাকে অস্বস্থিতে ফেলে দেয়। আমি সাধারনত ওদের সঙ্গে রাগারাগি করি না। এই কাজটা বরাবরই সেরীনের ভাগে। বরং সেরীন রেগে গেলে আমি টেনে আড়ালে নিয়ে আদর টাদর করে দেই। কিন্তু কেন জানি আজ আমিও খানিকটা নির্লিপ্ত থাকার চেষ্টা করি। আর সেটাই ভীষন নাড়িয়ে দেয় মেয়েটাকে।
-মাম্মা, আই ওয়ান্ট টু সে সামথিং’- হঠাতই নিরবতা ভাঙে বর্ণ।
- এখানে আসো, আমার কাছে এসে বলো।– পাশের রুম থেকেই জবাব দেয় সেরীন।
- আমি ওখানে যেতে চাই না। বাট আই ওয়ান্ট টু সে সামথিং।
- আমি শুনতে পাচ্ছি না, এখানে এসো।
না, নড়াচড়ার কোনো লক্ষণ নেই মেয়েটির। কিছুক্ষণ একইভাবে বসে থাকে সে। তারপর আবার গলায় বাড়ায়-
- আই ওয়ান্ট টু স্লিপ। বাট আই ক্যান্ট্।
আমরা কেউ কোনো জবাব দেই না। বার কয়েক একই কথা ছুড়ে দেয় সে। তারপর ছাদের দিকে তাকিয়ে আবারো বলে
- আই ওয়ান্ট টু স্লিপ। ক্যান বাবা হেল্প মি।
এবার আর আমার চুপ করে থাকা হয় না। আমি যতোটা সম্ভব গলাটা নরোম করে বলি
- এখানে এসে আমার পাশে সোফায় শুয়ে পড়ো।
- কিন্তু আমার ঘুম হবে না।
- আমি হেল্প করবো। তুমি শুয়ে পড়ো। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দেবো। দেখবে ঘুম চলে আসবে।
- হাউ ডু ইউ নো।
- আমি জানি মাম্মা। তুমি এসে শুয়ে পড়ো।দেখো কি হয়!
মাথাটা নীচু করে আমার পাশে এসে শুয়ে পড়ে বর্ণ। আমি তার পিঠে হাত বুলিয়ে দেই। মাথায় হাত চালাতে থাকি। মুখটা কানের কাছে নিয়ে ফিস ফিস করে বলি ‘উই লাভ ইউ মাম্মা।‘
বর্ণ’র শ্বাস দীর্ঘ হতে থাকে । টের পাই ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটি। মাথার নীচে একটা বালিশ গুজে দিয়ে হাত থেকে পাজলের বইটা সরিয়ে নেই। আর অমনি টুপ করে এক টুকরো কাগজ পড়ে যায় সোফার উপর। কাগজটা চোখের সামনে মেলে ধরতেই চোখ ভিজে আসে আমার।
‘আই ডিডন’ট লাইক দ্যা ওয়ে ইউ বোথ বিহেভ উইথ মি। স্টিল ইউ আর দ্যা বেষ্ট বাবা এণ্ড মা ইন দ্যা হোল ওয়ার্ল্ড। আই লাভ ইউ ইনফিনিটি।‘
- বর্ণ।
স্বাগতম আমরা বন্ধুতে...
ধন্যবাদ আপনাকে।
এ বি তে স্বাগতম । খুবই ভাল লেখা, হৃদয় ছূঁয়ে যায় । বর্ণ আর কথা জন্য আদর !
লেখাটা পড়ার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে। ।। বর্ণ কথাকে আদর পৌছেঁ দিলাম। । ভালো থাকবেন।
অসাধারণ লেখা...
খুবই আটপৌড়ে জীবনের কথা। ধন্যবাদ মতামতের জন্য। অনুপ্রানিতবোধ করছি
স্বাগতম..
এক্কেবারে প্রবাস-জীবন-ঘনিষ্ট লেখা
আরো লেখা চাই..
~
চেষ্টা করবো আরো লিখতে। অনুপ্রানিত বোধ করছি আপনাদের মতামতে । অনেক ধন্যবাদ।
আপনার জন্য তো ভাল হলো। কানাডায় মারা নিষেধ। তাইলে সেরীন নিশ্চই আর আগের মতো মারতে পারে না।
বর্ণমালা আর কথামালাকে আদর
আপনারা যা শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছেন, সেটা কি অতো সহজে ভুলতে পারে! কাজেই বুঝতেইতো পারছেন।
হাহাহাহাহহা ,
এবিতে স্বাগতম।
বর্ণ আর কথাকে আদর।
আর লেখা সম্পর্কে বলবো আপনার আরো লেখা নিয়মিত পড়তে চাই।
অনেক ধন্যবাদ । এই সব প্যাচাল পড়তে যদি বিরক্তবোধ না করেন, তাহলে তো লিখতেই পারি।
স্বাগতম এবিতে। গল্প ভেবেছিলাম প্রথমে পরে দেখি জীবনকথা।
জীবনকথাও ভালো লাগলো।
গল্প লেখার সাধ হয়, কিন্তু সেটা পেরে উঠি না তাই জীবনের গল্পই বলার চেষ্টা আরকি। ভালো লেগেছে শুনে অনুপ্রাণিত বোধ করছি। ধন্যবাদ আপনাকে
সেরীন - কানাডা মানে কি? নতুন দেশ?
লেখা খুব ভাল লাগল
আপনার ঘ্রাণশক্তি তো দেখছি খুবই প্রখর। । আপনার অনুমান সঠিক।
ধন্যবাদ লেখাটা পড়ার জন্য।
এবিতে স্বাগতম।
সুইট মেয়ে আপনার...
ভাবীকেও এবিতে নিয়ে আসেন
পথ প্রদর্শক তো আপনিই। এখন ফ্যামিলিসুদ্ধ চান? কঠিন অবস্থা! ধন্যবাদ , এমন সুন্দর একটি জায়গায় নিয়ে আসার জন্য।
স্বাগতম এবি তে ।
ধন্যবাদ আপনাকে।
বাহ্ চমৎকার মেয়ে দুটি আপনার। স্বাগতম এ বি তে। ভাল থাকুন।
সব বাচ্চারাই কিন্তু চমতকার। ধন্যবাদ আপনাকে।
বাহ বাহ ঝাক্কাস্্ ..... বর্ণমালা আর কথামালার জন্য অনেক আদর....
এ বি তে স্বাগত.........
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
বর্ণ আর কথার জন্য অনেক অনেক আদর...
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
আপনার শুরুর সুর অসাধারণ লাগল, নিয়মিত গাইবেন কিন্তু।
ভাল থাকুন। অনেক ভাল। সবসময়।
বর্ণ আর কথার জন্য অনেক অনেক আদর...
একে তো বাউণ্ডেলে, তাও আবার বিষন্ন। আপনার কানেও সুরটা চলে গেছে। উপায় নাই দেখছি। ঠিক আছে। মাঝে মধ্যে বেসুরো গলায় সুর ভাজার চেষ্টা করবো।।
অনেক ধন্যবাদ উষ্ণ অভ্যর্থনার জন্য।
মন্তব্য করুন