ইউজার লগইন

রম্য রচনা

রিপনের দুষ্টামী
--শাশ্বত স্বপন

রিপন ভীষণ দুষ্টু। ওর বয়স ৮ বৎসর। ওকে পাড়ার ছোট ছেলে-মেয়েরা ভীষণ ভয় পায়। অনেকে ওকে এড়িয়ে চলে। কথা নেই বার্তা নেই, চুলহীন মাথা দেখলেই টাক দেয়। আর বলে--
‘ওকল টাকি ভাউয়া ব্যাঙ
তর বাপের চারটা ঠেং
চুল কাটছ্- চুলে ধরছে বুঝি পাক
চুল পাকব না আর
এই দিলাম একটা টাক।’
ছেলেটি তো কেঁদে কেঁদে বাড়ী ফিরত। শুধু কি এই! কয়েকটা সমবয়সী ছেলে মিলে আলু ক্ষেত থেকে আলু চুরি করত আর তা পুড়ে খেত। সারাক্ষণ খুজঁত--কোথায় পেঁপে পেকেছে; শশা বড় হয়েছে; কুল পেকেছে; আম পেকেছে--সে স্থানে ডাংগুলি নতুবা গুলি খেলত আর সুযোগ বুঝে চুরি করত। সে সারাদিন মিথ্যা কথা বলত । এই ছোট ছেলে বাড়ীতে মা-বাবার কাছে কি মার যে খায়--তা বড়দের কাছেও কল্পনাতীত। মাঝে মাঝে মা বলত গন্ডারের চামড়া। উঠোনে মোরগ-মুরগী দেখলেই ঠ্যাং খুড়া করে দিত। লেখাপড়ায় সে এত ভাল যে বাড়ীর গৃহ শিক্ষক ওকে একমাসেও আলিফ অক্ষরটাও ভাল করে শিখাতে পারেনি। শিক্ষক হাত গুড়াতে দিত আলিফ--সে এটাকে এমনভাবে হাত গুড়াতো যে--ওটা হয় আম নয়তো আলু হয়ে গেছে। এ জন্য মারও খেত খুব। প্রায় সব পরীক্ষার একদিন আগে থেকে প্রচন্ড পেট ব্যথা হত। হায়রে! সেকি পেটব্যথা; যেন, পেটের ভিতর ‌‌‌'৯০ এর গণ আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। ডাক্তার কবিরাজ যখন দেখান হত, তখন তারা বলত ঢাকা নিয়ে বড় ডাক্তার দেখান। কোন মতে ডাক্তার ভিজিট না নিয়েই কেটে পড়ত। কবিরাজ তো সেদিন ভয়ে দৌড় দিতে গিয়ে তার ধুতিই প্রায় খুলে গিয়েছিল। পেরেকের আঁচড়ে তার মূল্যবান ধুতিটার বেশ খানিকটা ছিঁড়ে গিয়েছিল। যাই হোক, সদর থেকে ভাল ডাক্তার দেখানোর পর ডাক্তার চিন্তিত হয়ে বসল। সবাইকে রিপনের চারিত্রিক গুনাবলী জিজ্ঞাসা করল। উত্তর পাওয়ার পর বুঝা গেল সব দুষ্টামী এবং ছেলেটি পাকা অভিনেতা।
 তোমার তো খুব পেট ব্যথা, তাই না?
 হ--
 তোমাকে আর পরীক্ষা দিতে হবে না।
 আইচ্ছ স্যার--
 এখন ব্যথাটা একটু কমছে না?
 এট্টু এট্টু কমতাছে--
 পেটের ব্যথা হলে হাত-পাও ব্যথা করে। আচ্ছা, তোমার কি হাত পা ব্যথা করে?
রিপন বিপাকে পড়ল। বুঝল পেটে ব্যথা হলে হাতে-পায়েও ব্যথা হয়।
 হ, আত-পা ব্যতা করতাছে।
রিপন অভিনয় শুরু করল
 ওরে নানীরে--, ওরে মারে--, হাত-পা ব্যথা করে রে--
মা ও দাদীরা কাঁদতে শুরু করল। রিপন বোধ হয় আর বাঁচবে না । দাদা তো গতকাল থেকে তপজী জপতে শুরু করেছেন নাতির জন্য।
 মা, ও মা মরণের আগে আমারে আলু পোড়া আর আম আইন্না দেও আমি...
 দুষ্টু, দুষ্টামীর জায়গা পাওনা। গরম খুন্তি লনতো ওর পেট ছিদ্র করব। সবাই ধর ওকে-
 ওরে বাপওে আত পায়ে পেট ব্যতা করেরে। উঃ আঃ...
 পেটের ব্যথা হাতে পায়ে, এ্যা! জিহ্বা কেটে ফেলব। ধরেন, ওকে ইনজেক্শন দেব। সত্য কথা বল, ব্যথা আছে?
 ও ডাক্তারগো তুমি আমার মামা, তুমি আমার বাবা, আমারে ইনজেকশন দিও না। আমার পরীক্ষা দিতে যেন না হয়, তাইলে আমার সব ব্যথা কইমা যাইব। হ- কইমমা যাইব।
এই তো গেল পরীক্ষা না দেওয়ার ঘটনা।

আরেকদিন পাশের বাড়ীতে মিলাদ হবে। বাড়ীর বয়োজেষ্ঠা মহিলা, যাকে রিপন বড় চাচী বলে ডাকে। সেই মহিলা বিকেল বেলা রিপনকে বাড়ী থেকে ডেকে নিয়ে বলল, ‘তুই মসজিদ থিকা মৌলভী সাবরে ডাইককা লই আয়। কবি, মিলাদের বেভাক বেবস্তা অইয়া গ্যাছে।’ আচ্ছা--বলে সে মসজিদের দিকে ছুটল। দৌড়াতে দৌড়াতে মসজিদে গিয়ে তার প্রশ্রাব ধরে গেল। কি করা যায়। মসজিদের পায়খানাতে সে প্রশ্রাব করল। কাজ শেষ করে মৌলভী সাবকে ডাকতে গেল।

মিলাদ শেষ। চাচী রিপনকে ডাকল ‘ঐ তুই এই টাকা মৌলভী সাবকে দিয়ে আয়।’ চাচী ঘরের জানালা দিয়ে ঘোমটার ফাঁকে হুজুরকে দেখছে। রিপন মৌলভী সাবকে বলছে, ‘হুজুর বড় চাচী আপনেরে টেকা দিছে, নেন।’ মৌলভী সাব টুপিটা ঠিক করে লজ্জাবনত মস্তকে বলছে, ‘কি দরকার ছিল টাকার।’ চাচীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনারা আমার বড় আত্মীয় মানুষ; টাকার কি দরকার আছিল।’ রিপন মনে করেছে, টাকা বোধ হয় নেবে না। সে হুজুরের হাতে টাকা না দিয়ে নিজের পকেটে ভরতে গিয়ে দেখে, হুজুর দুই আঙ্গুলের মাঝে টাকাটা চেপে রেখেছে। রিপন টানছে অথচ আসছে না। হুজুর বলেই চলেছে,টাকা দিয়ে ছোট করলেন ভাবীসাব...। রিপন আর জোড় খাটাল না। টাকাটা ছেড়ে সে হুজুরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সে দেখল টাকাটা এখন হুজুরের হাতে মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে গেছে। হুজুর একটু দূরে যেতেই সে কষে একটা বকা দিল, ‘তর মায়রে বাপ।’ ওর সাথী ইদ্রিস বলল, ‘কি বকা দিলি? তুই তো হুজুরের দাদা অইয়া গেলি।’ রাগে ক্ষোভে রিপন ইদ্রিসকেও একই বকা দিল। তারপর দু’জনে গলাধরে চাচীর কাছে সব বলল। চাচী হাসতে লাগল রিপনের রাগ দেখে। রিপন দৌড়ে আবার মসজিদে গেল। মসজিদের পায়খানা ছিল মসজিদ থেকে কিছুটা দূরে। রিপন দেখল বদনাটা দান বাক্সের নিকটে। সে বদনাটা এনে উহাতে মলত্যাগ করে পানি ঢালল। তারপর কোথা থেকে একটা কুনো ব্যাঙ ধরে এনে বদনার ভিতরে রেখে ইট চাপা দিয়ে পায়খানার কাছে রেখে দিল। পরের দিন ভোর বেলা হুজুর পায়খানায় যাবার জন্য বদনা খুঁজে পাচ্ছে না। অবশেষে খুঁজতে খুঁজতে পায়খানার কাছে পায় । তার তখন ডেলিভারী কেইস। বদনার কাছে আসলে গন্ধ অনুভব করে। ভাবে, পায়খানা থেকে গন্ধ আসছে বোধ হয়। তিনি বদনার উপর ইট দেখে ভাবেন, কোন পাগল নয়তো দুষ্টু কোন ছেলে...। তিনি ইটটা সরিয়ে যেই বদনাটা মাজা পর্যন্ত উঠিয়েছেন হঠাৎ একটা ব্যাঙ লাফ দিয়ে তার মুখে উঠে যায়। মৌলভী সাব ভয় পেয়ে বদনাটা দূরে ফেলতে চাইলে উহার নলটা তার পাজ্ঞাবীর পকেটের কোনায় লেগে পাজ্ঞাবী এবং দেহের নিচের অংশ মলে ভরে যায়। যাই হোক, পরে ঘটনা সব জানাজানি হয়ে যায়। ঐ দিন গৃহ শিক্ষকের সামনে এক ঘন্টা কান ধরে রিপনকে থাকতে হয়েছিল এবং হুজুরের কাছে কান্নার্ত চোখে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল।

তার শয়তানির আর একটা দিক হচ্ছে কোন কিছু চুরি করে এনে বন্ধুদের সাথে
খাওয়ার সময় সে অন্য বন্ধুদের মাঝে ঝগড়ার সৃষ্টি করে ফেলত । ফলে সে নিজে বেশী করে খেতে পারত। আবার কোন এক বন্ধুর সাথে একত্রে কোন কিছু খাওয়ার সময় ঐ বন্ধু যেন তার চেয়ে অনেক কম খায় তাই সে চালাকি করত এরকম--
 ঐ নুরু, তোর দাদী তোরে মেলা আদর করত নারে?
 হ, খুব আদর করত। রাইতে দাদীর লগেই আমি থাকতাম। ভোর আযানের শুম দাদী আমারে উডাইয়া দিত ।
এদিকে রিপন খেয়েই চলেছে। আর নুরু দাদীর কথা বলছে আর কাঁদছে।
--আইচ্ছ নুরু, তোর দাদী কি অইয়া মরল ?
নুরু দাদীর মৃত্যুর ঘটনা বলছে আর রিপন এতক্ষণে খাবার প্রায় শেষই করে ফেলেছে।
 আঃ নুরু সব শেষ অইয়া গেলতো। খা--
 থাক, আমার ভাল্ লাগতাছেনা। তুই খা--

আবার কখনও কখনও ঝগড়াও লেগে যেত কারো সাথে। যেমন--
 কিরে আমি কতা কইতাছি আর তুই সবদি শেষ কইরা হালাইলি।
 আঃ আমার মনে আছিল না। খাড়, পাল বাড়ী থিকা পাউপপা চুরি করে তরে বেশী দিমু।
 দুঃ শালা, তুই পেটুক--
টাস করে রনি হয়তো একটা চড় বসায়ে দিল রিপনের গায়ে। যদি রিপন ওর সাথে মারামারিতে পেরে উঠতে ব্যর্থ হলে সে রনির ছোট ভাই-বোনকে মারবে অথবা ওদের বাড়ীর ফুলগাছ থেকে শুরু করে যে কোন ক্ষতি সে করবে। এমনি টক, স্বাদ, মিষ্টি এই রিপন। হাজার মন্দ হলেও তার বিধবা বোনের দুঃখ সে বুঝে। তার পোষা কুকুরটাকে দিনে একবার হলেও চুমো দেবে। সপ্তাহে একবার গোসল করাবে। খুব ভোরে সে ঘুম থেকে উঠবে। সারাদিন পাড়াময় ঘুরে বেড়াবে। সন্ধ্যা হলে কোন রকমে গৃহশিক্ষকের কাছ থেকে বিদায় নিতে পারলে দাদীর গলা ধরে শুয়ে থাকবে। একেবারে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় সে। তখন তার মুখ থেকে বুঝাই যায়না--এটা সেই রিপন--যে রিপন...।

পোস্টটি ৫ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

রায়েহাত শুভ's picture


এবিতে স্বাগতম...

শাশ্বত স্বপন's picture


ধন্যবাদ

নিভৃত স্বপ্নচারী's picture


Welcome টু এবি

বিষণ্ণ বাউন্ডুলে's picture


লিখতে থাকুন, পড়তে থাকি।

এবি তে সুস্বাগত ।

ভাল থাকুন।

টুটুল's picture


স্বাগতম এবিতে Smile

তানবীরা's picture


Welcome বানান!!!!!!

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

শাশ্বত স্বপন's picture

নিজের সম্পর্কে

বাংলা সাহিত্য আমার খুব ভাল লাগে। আমি এখানে লেখতে চাই।