ইউজার লগইন

রম্য রচনা-- ক্ষনিকের প্রেম

ক্ষণিকের প্রেম
--শাশ্বত স্বপন

একদিন বোনের বিয়ের কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে বাসে চড়ে বাড়ি ফিরছি। বাস প্রায় দেড় ঘন্টা সময়ে গুলিস্তান থেকে সবেমাত্র বুড়ীগঙ্গা ব্রীজ অতিক্রম করেছে। গুলিস্তান থেকে পোস্তগোলা আসতে গাড়ীর সে কি জ্যাম্! গরমে একেবারে সিদ্ধ হবার উপক্রম। যাই হোক, ব্রীজ পাড় হবার হু হু করে বাতাস বইছে গাড়ীর ভিতরে। আমি হা করে বাতাস গিলতে লাগলাম। সব যাত্রীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ছে নিজস্ব স্টাইলে। একজন যুবক বলল, যাক বাঁচা গেল! এক বৃদ্ধ বলল, বাপরে! কি অবস্থা হয়েছিল! --এ রকম বিভিন্ন দীর্ঘশ্বাসের পর সবাই নিরব হয়ে গেল। বাস যখন ক্রমাগত পথ অতিক্রম করে আবদুল্লাহপুর এসে থামল তখন এই বাসেই একটি সুন্দরী মেয়ে উঠল। হেলপার উচ্চ রবে চিৎকার করতে লাগল--‘এই যে, মহিলা সীট ছাড়েন, মহিলাকে বইতে দেন। মাওয়া লৌহজং...মাওয়া লৌহজং ...।’ গাড়ী ছেড়ে দিল। কে কার সীট ছাড়ে। গাড়ীতে বসার এক টুকরো জায়গা ছিল না। তাই মেয়েটিকে দাঁড়িয়ে থাকতে হল। গাড়ী ছাড়ার বেশ কিছু সময় পর তার চোখ মুখের অবস্থা দেখে আমার হৃদয়ে মায়ার স্রোত বয়ে গেল। মায়া লাগারই কথা। সুন্দর দেহের গঠন, ফর্সা মুখ, লম্বা নাক, কোন শিল্পীর তুলির আঁচড়ে আঁকা দু’টি চোখ, ভ্র“দু’টি...না থাক--ভ্রু, হাত-পা আর বুক এগুলোর গঠন আর বলব না--তাহলে আপনাদের প্রেমের জিহ্বায় জোয়ার এসে যাবে। বাহিরের প্রকৃতি যেন, আমি মেয়েটির মাঝে ফিরে পেলাম। তাই বাহিরে তাকিয়ে চোখে ধূলো-বালি না মাখিয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, আমাকে ভুল বুঝবেন না। আপনাদের মত রক্ত মাংসে গড়া আমার দেহ। সদ্য কলেজ ফেরত ছাত্র আমি। যে কলেজে ছিলাম--তাতে কোন ছাত্রী ছিল না। ‘সদ্য প্রেমের পুজারী যদি প্রেমের পূজা করতে গিয়ে প্রেমের দেবীর ছোঁয়া পায় তবে আর রক্ষা নেই--পারলে চরণে লুটিয়ে পড়ে।’ আমার অবস্থা ঠিক সে রকমই। না, না, চরণের এর চিন্তা করিনা--করি হৃদয়ের।
ভদ্রছেলে ভেবে মেয়েটি আড়চোখে আমার দিকে বেশ কিছুক্ষন ধরে তাকাচ্ছে। বোধ হয়, আমার সীটে বসতে চায়। হঠাৎ এমন করুন চোখে তাকাল আমার দিকে, আমি ঢোক গিলে ইংরেজী স্টাইলে বলতে শুরু করলাম--Listen to me, you sit down on my set. I am a young man... so have no problem. বুঝতে পারলাম না মেয়েটি আমাকে ‘চোখ টিপ’ দিল কিনা। আমার বাংলা উচ্চারণে কাঁচা ইংরেজী কথা শুনে আমার একাকী সীটে নিজেও বসল, আবার আমাকেও হাত ধরে টেনে বসাল। আর বাকী যাত্রীরা যে যা পারছে, বলছে। তবে খোলাখুলি নয়, চুপিচুপি। যেমন, এখন পাঠক-পাঠিকারা যা বলছেন--তাই-ই। পাশের ব্যক্তিতো পারলে আমার কান মলে দেয়¬--কিন্ত ঐ যে বাংরেজী স্টাইল...সব ঠিক হয়ে গেছে।
কি আর করব--ওর পাশেই, মানে দু’জনে এক সীটে বসলাম। মেয়েটি ব্যাপারটাকে এমনভাবে মেনে নিল যেন, ও স্ত্রী, আমি স্বামী; না, না, ও বোন, আমি ভাই। ধাৎ, বোধ হয় অন্য কিছু। আপাতত পাঠক-পাঠিকাকে অগ্রিম কিছু বলতে চাচ্ছি না। দেখা যাক, এরপর কি হয়--কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়? ও,যা বলছিলাম, ওর পাশে বসাবেই না কেন, আমি তো সবে মাত্র কলেজ ফেরত ছাত্র। আর বয়স, মেয়েটি আর কি ভাববে--সতের কিবা আঠার। এই বয়েসী ছেলেদের বাহ্যিক দৃষ্টিতে কিশোরই বলা যায়। কিন্তু মেয়েদের বেলায় কুড়ি হল আধাবুড়ী। অতএব ১৪/১৫ তো ভরা যৌবন। যাকগে এই ঐকিক হিসাবে আমি ওর ছোট ভাই । কিন্তু হৃদয় যে আমার প্রেমের স্রোতে দোল খাচ্ছে, মেয়েটি হয়তো একটু পড়েই বুঝতে পেরেছিল।

প্রেমের প্রথম ভঙ্গীতে বলতে শুরু করলাম--‘আপনার খুব কষ্ট হয়েছে--এখনও হচ্ছে।’ মেয়েটি কোন উত্তর না দিয়ে মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে চেয়ে রইল। যেন, সে কিছুই শুনে নাই, কিছুই বুঝে নাই। আমি মেয়েটির দিকে আড়চোখে তাকালাম। কেমন যেন, চেনা চেনা মনে হচ্ছে। বন্ধু দেলোয়ারের প্রেমিকাকে একবার দেখেছিলাম। নাতো, এত বড় চুল ছিল না। হ্যাঁ, খুব সুন্দর ছিল, তবে চাহনী আর দেহের ঢেউ এত গভীর ছিল না। আমি ঝুকে ঝুকে বাঁকা চোখে ওকে দেখতে লাগলাম। নিজের মাথাটা কাত করে, আরো কাত করে। কি করব? মেয়েটি যে অন্য দিকে চেয়ে আছে। গভীরভাবে আর একটু দেখতেই সমবয়সী হিংসুটে একজন গড় গড় করে বলল, ‘কি হে ব্রাদার, কিছু আবিস্কার-টাবিস্কার করলেন নাকি?’ তার পাশে বসা আরেকজন বলল, ‘কি যে বলেন ভাই, চোখে চশমা, লম্বা চুল, কবি কবি ভাব--কিন্ত‘ কবিতার অভাব। তাইতো তার হয়েছে মহান স্বভাব।’ আমি হতভম্ব হয়ে মাথা নিচু করে ঢোক গিললাম। গাড়ীতে যে কতগুলো ইতর প্রাণী ছিল--তা আমার জানা ছিল না। তাহলে আগে ভাগেই সাবধান হতাম।

গাড়ী কুইচামারা থামতেই দেখি আমার এক স্কুল জীবনের বন্ধু রাজ্জাক বাসে উঠল। অনেক দিন পর দু’জনের দেখা হল। সামান্য দু’একটা আলাপ শেষে বন্ধু জিজ্ঞাসা করল, ‘তোর বোন নাকি? পাশের সীটের মানুষরূপী এক ইতর প্রাণী ‘হু’ করে শব্দ করল। আমি বন্ধুকে বললাম, ‘না’ মানে ...।’ বোনই বলতাম কিন্তু আরেকটি অসভ্য প্রাণীর খুব জোড়ালো ইচ্ছেকৃত কাশির শব্দ শুনে আমার কন্ঠ শুকিয়ে গেল। রাজ্জাক একটু মুচকী হাসল। পরের স্টপিজে রাজ্জাক নামতে নামতে বলল, আসি আরমান, আবার দেখা হবে। আমি লজ্জায় কিছুই বলতে পারলাম না ওকে। না জানি, বন্ধু কি ভেবেছে। আড়চোখে ইতর প্রাণীগুলির দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে রাখলাম অপরাধীর মত।
যাই হোক, বাস আরেক জায়গায় এসে থামল। জায়গাটির নাম মনে নেই। কিন্ত সে জায়গা থেকে যে পঁচা গন্ধের হাওয়া বইতে ছিল, সেটা মনে আছে। আমি রুমাল দিয়ে যেই নাক ঢাকতে চেষ্টা করেছি অমনি আরেক জন বলে উঠল, ‘আঃ কি সুন্দর গন্ধ--ভুলা যায় না!’ দুষ্টু ড্রাইভার সাথে সাথে অডিও চালু করল। হায়রে সেকি গান! --এ দুনিয়া পারি ভুলতে-- তোমায় কাছে পেলে...। এবার আমি মেয়েটার চোখের পানে তাকাতে চেষ্টা করছি। কি আশ্চর্য, সে হাসছে। তার আনন্দ লাগছে নাকি?
বাস শ্রীনগর এসে গেছে। চেয়ে দেখলাম সবাই অন্যমনস্ক। এই মুহুর্তে মেয়েটার চোখে তাকাতেই সে চোখ বন্ধ করে আমার গায়ে পড়ে গেল। আমি হাত দিয়ে উঠাতেই সে বলে উঠল, ‘সাবধান পড়ে যাবেন না যেন; এ পড়ে যাওয়া-যাওয়া রোগের কোন ঔষধ নেই।’ সে আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে নেমে গেল। বাসের সব যাত্রীরা--যারা শুনল সবাই উচ্চহাস্যে সাড়া দিল ওর কথা শুনে। বিশেষ করে ইতর প্রাণীগুলি। মেয়েটি যেন বুঝিয়ে দিল--মেয়েদের দুর্বল ভাবতে নেই, অপরিচিত মেয়েকে আপন ভেবে কাছে টানতে নেই।
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, সেই মুহুর্তে আমার ক্ষনিকের প্রেমের কি অবস্থা! ভুল বুঝবেন না; আত্মীয় ধরনের কোন বকা দেবেন না। আসলে এখনকার বয়সটাই ভুল করার বয়স, তাই না ?

পোস্টটি ৪ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

তানবীরা's picture


ঠিকাছে Big smile

বিষণ্ণ বাউন্ডুলে's picture


Big smile

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

শাশ্বত স্বপন's picture

নিজের সম্পর্কে

বাংলা সাহিত্য আমার খুব ভাল লাগে। আমি এখানে লেখতে চাই।