সময়ের লাশ ৪ র্থ পর্ব
মনে পড়ে, আর একদিনের কথা। সেদিন পুকুরে এক ঘটি জল আনতে গিয়েছিলাম লক্ষ্মী পূজাটা সম্পন্ন করার জন্য। অনেকটা ইচ্ছে করেই গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি ও স্নান করছে। পায়ের কাপড়টুকু উঠিয়ে যেই ঘটিটা পানিতে ডুবিয়েছি অমনি সে বলতে আরম্ভ করল, আমি যাকে ভালোবাসি তার পা আমি কোনদিন দেখিনি। তার বুকে হেঁটেছি, শুয়েছি। একদিন হয়তো তার কোলে ঘুমিয়ে যেতে হবে। আমি বেশ লজ্জা পেয়েছিলাম। কোন কথা না বলেই সেদিনও চলে এলাম। ঘাটের সিঁড়ির চারটি ধাপ পার হতেই ও আমাকে পানি ছিটিয়ে দিল। বলল, ‘তুমি সুন্দর, আমার সেই প্রেমিকার মত--ঠিক প্রেমিকার মত!’ কে ওর প্রেমিকা? সেদিন বুঝতে পারিনি। অনেক পরে বুঝতে পেরেছি। আরেকদিন কোন এক কথা প্রসঙ্গে বাবাকে বলেছিল, ‘জানেন স্যার, এই বাংলার সবাইকে আমার বড় আপন মনে হয়। আমার তো মা-বাবা কেউ নেই। তাই এ দেশ, এই মাটিই আমার মা-বাবা।’ ওর সাথে কখনও কথা বলিনি। কেন? লজ্জা হয়? না, অন্য কিছু--আমি জানি না। আমাদের ব্যাপারটা মা-বাবা-রাম সবাই জেনে গেছে। তাই আমাকে প্রায়ই মায়ের বকা শুনতে হয়। সুমাদকেও একবার বকা শুনতে হয়েছে। একদিন দূর থেকে ওকে দেখেছিলাম। ও কাঁদছে। কেন কাঁদছে? কেন? সেদিন চিন্তায় চিন্তায় সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। শেষ রাতে ঘুমিয়ে গেলে স্বপ্নে দেখি সুমাদ আমাকে ছেড়ে দূরে, বহু দূরে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে চলে যাচ্ছে। আমি কাঁদছি। সেই স্বপ্ন থেকে আজও কাঁদছি। আমার কান্না বোধ হয়, মৃত্যুতেও শেষ হবে না। মা যে বলেছিল, যবন নাস্তিক ছেলেকে ভালোবেসেছি বলে ভগবান নরকে নিয়ে আমাকে কাঁদাবে। তবুও নরকে গিয়ে যেন, ওর দেখা পাই। কত চিঠি ও আমাকে দিয়েছিল--তা গুনে দেখিনি। যে কয়টা সংরক্ষণে ছিল--তা এই লেখনিতে সাজালাম। ধর্ম নিয়ে কথা উঠলে মাকে সুমাদ বলেছিল, ‘কাকীমা, আমি ও স্যার, আমরা কোন নির্দিষ্ট ধর্মের শিকলে বন্ধি নই; আমরা সকল ধর্মের উর্ধ্বে।’ মা অবশ্য রেগেছিল। সুমাদ গরু, কাছিম, শুকর, ছাগলের মাংস খেত; সামান্যও ঘৃনা হত না। আমি কোনদিন মাংস খাইনি, আজো খাই না। না খেতে খেতে এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।
ফেব্রুয়ারীর ২০ তারিখ। বিকাল বেলা রামকে নিয়ে ঘাটে গেছি জল আনতে। জল ভরে আমি সিঁড়ির উপর উঠে দেখি কৃষ্ণচুঁড়া গাছের গোড়ায় বসে অশ্রু ভরা নয়নে হাত-পা কাটছে। আমি ভয়ে ঝোপঝাড়ের পথ দিয়ে আসতেই সে পথ আটকাল। ‘কল্যাণী, তুমি কি আমাকে ভালবাস না?’ কোন কথা বললাম না। ভয় পেয়ে কাঁদতে লাগলাম। সুমাদ হাত কেটে রক্ত দিয়ে আমাকে সাজাতে লাগল। রাম দৌঁড়ে বাসায় চলে গেল। ঘটি পড়ে গেল হাত থেকে। ওর গলা জড়িয়ে ধরলাম তবুও কোন কথা বললাম না। মনে মনে বলেছিলাম, হ্যাঁ, আমি তোমাকে ভালবাসি। আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে লাগল সারা শরীরে। আমি আবেগের বশবর্তী হয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে লতা পাতার মাঝে শুয়ে পড়েছিলাম। রক্ত সিঁদুর দিয়ে কপালে টিপ দিল, চুলের সিঁথিতে রেখা একে দিল। আমি ওর বুকে আবেগ ভরা হৃদয়ে খানিকক্ষণ মুখ গুঁজে রইলাম। সেদিন সময়ের কাছে আবেগ আর জীবনের পরাজয় হয়েছিল। মা এসে আমাকে নিয়ে গেল। সুমাদকে বকে গেল। আজ বুঝতে পারছি সেদিন হয়তো আমার গর্ভেই জন্ম দিতে চেয়েছিল বিশ্ব কাঁপানো মহাবিদ্রোহীকে। আজ সব বুঝি, সব...। ২১ তারিখের বিকাল বেলা। একটা ছেলে আমাদের বাসায় এসে দরজায় নক করছে। মা দরজা খুলে দিল।
-- কি চাই ?
--কল্যাণী দিদি আছে ?
-- কেন ? তাকে কেন ?
--এই চিঠিটা তাকে...।
মা চিঠিটা খুলে পড়তে লাগলেন। সব উল্টা করে লেখা। অতএব, মা কিছুই বুঝলো না। আমার মুখের উপর ছুঁড়ে দিয়ে বলে গেলেন, তোকে কোলকাতা পাঠিয়ে দেব অজয়ের কাছে। অজয় আমার মেজো মামা। আমি আয়নার সাহায্য নিয়ে চিঠি পড়তে শুরু করলাম--কল্যাণী, অনেক কষ্ট নিয়ে পরপারে চলে যাচ্ছি। দুঃখ, একটি বার বললে না, আমি তোমায় ভালবাসি। আমি আবার আসব। তোমাদের স্বাধীনতার জন্য যুগে যুগে আমি অবতীর্ন হব এ ভারতবর্ষে। বিশ্বাস করো, আমি হিন্দু নই, আমি মুসলমান নই, আমি সকল ধর্মের উর্ধ্বে। আমি তোমাদের এ কুসংস্কার সমাজের কেউ নই। আমার জন্মও কেউ জানে না, মৃত লাশও কেউ পাবে না। আমি সময়--আমি ’৫২--আমি স্মৃতি। তোমাকে বাংলাদেশ ভেবে ভালবেসেছি, অন্য কিছু নয়। সময়ের উজানে এসেছি--সময়ের ভাটায় চলে যাচ্ছি। না, পরাজয় নয় বরং জয় তোমার-আমার। এদেশকে একদিন নারীরাই শাসন করবে, সেবা করবে। আমি হয়তো সময়ের দৃষ্টি দিয়ে দেখব। তবু থাক না হয়--দু’তীরে দু’টি মন। হে কল্যাণী আমার, ঠিকানা আমার--মুক্ত আকাশ; বিন্দু থেকে সিন্ধু--সিন্ধু থেকে আবার বিন্দু। চিরবিদায়...।’
চলবে
এই পর্ব এত্ত ছোট কেন? বিচ্ছেদের দিকে যাচ্ছে!!
মিহির সেনগুপ্তের- "উজানি খালের সোঁতা" পড়েছেন? পড়লে আপনার যে বেশ লাগবে বলাই বাহুল্য। ইতিহাস খুঁজতে এই লেখার আশ্রয় নিলাম না। কিন্তু চমৎকার কিছু কথা ঠিকই খুঁজে পেলাম।
সিরিজ চলুক।
লীনা, এটা আমার ১৯৯২-৯৩ সালের, অল্প বয়সের। শব্দ পরিবর্তন আর বানান ঠিক করা ছাড়া আর কিছু করি নাই। ১৯৯৫ থেকে জুন,২০১০ পর্যন্ত সাহিত্যের একটা শব্দও লিখি নাই।......। মোহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহক-- তার নামে তার লেখা কিছু নিয়েছি, রুপক থেকে বাস্তবে বের হবার জন্য....
মিহির সেনগুপ্তের- "উজানি খালের সোঁতা" কোথায় পাওয়া যাবে?
উজানি খালের সোঁতা- আজিজে পাবেন। কনকর্ডের মধ্যমায়ও পেতে পারেন। একদম না পেলে নীলক্ষেতের কল্লোলে খোঁজ করবেন (ওখানে দাম বেশি রাখবে, কিন্তু বাঘের চোখ চাইলেও এনে দিতে পারে তারা)।
ধন্যবাদ লীনা।
পড়ছি
মন্তব্য করুন