মোরশেদ শফিউল হাসানের লেখনীতে বেগম রোকেয়ার সময় ও সাহিত্যকে দেখা!
বড় অসময়ে এই পোষ্ট লিখতে বসলাম। কয়েল আছে বাসায় কিন্তু ম্যাচ নাই তাই বসে বসে রাত জেগে মশার কামড় খাচ্ছি, মন মেজাজের অবস্থাও ভালোনা তার ভিতরেই এই লেখাটা শুরু করার শখ হলো। যদিও মন মেজাজ খারাপ থাকার কথা না, যেমন ভালো দিন আমি আশা করি তেমন ভালো দিনই আজ আমি কাটালাম- খানা খাদ্যময় ও আড্ডাময় দিন চলে গেল ভালোই, কিন্তু গুলশান দুইয়ে গনজাগরন মঞ্চের উপর পুলিশের হামলার শিকার হলো তা নিয়ে মন বিক্ষিপ্ত। অবশ্য পুলিশ তো প্রতিদিনই কত মানুষকে মারে তা নিয়ে আমার চিন্তা হয় না, আমি নিজে গা বাচিয়ে চলা শিখে গেছি। কিন্তু নিজেদের সহযাত্রীরা এরকম বেদম মার খাবে তা দেখতে অসহ্য লাগছে। কিন্তু কি আর করা, আমাদের মন খারাপে কারো কিছু যায় আসে না। অলরেডি দলকানারা ত্যানার ছবক নিয়ে বসে গেছে আর ছাগুরা হাতে তালি দিচ্ছে, ভালোই তো- ভালো না!
যাই হোক মোরশেদ শফিউল হাসানের বইটা নিয়ে কথা বলি। এই বইটা কিনে ফেলি হুট করেই নিউমার্কেটে। বন্ধুকে নিয়ে গিয়েছিলাম তাকে বই কিনে দিব বলে, যেয়ে দেখি বই নাই, বেহুদা রিকশা ভাড়া দিয়ে অহেতুক অবরোধে আগমন। তখন দেখলাম এই বইটা, আহমদ ছফার কোনো এক প্রবন্ধে এই বই নিয়ে আলাপ পড়েছিলাম তা মাথায় রেখেই বইটা কিনে ফেলে। বন্ধুকে কিনে দেই ইংরেজী ফিকশন!
বইটা সেকেন্ড এডিশনের চতুর্থ মুদ্রন এবং ভুমিকাতেই লেখক জানাচ্ছেন যে ছফা সাহেবের অনুপ্রেরনা ও অব্যাহত তাগিদ এবং আগ্রহানুকুল্যেই বইটি লেখা। তারপরেই আসছে বাংলা একাডেমীর জনাব শামসুজ্জামান খানের নাম। যতদুর মনে পড়ে ছফা সাহেব বলেছিলেন এই বইটা অত্যন্ত উন্নতমানের কাজ, কিন্তু সরকার এত বেগম রোকেয়ার শত তম জন্মবার্ষিকী নিয়ে অনুষ্ঠান ও সাড়ম্বরের ভেতরেও বইটার স্থান হলো না কোনো। আমার কাছে এই বইয়ের সবচেয়ে বড় শক্তি এর সহজ্যবোধ্যতা। মান্নান সৈয়দের বইটাও পড়ছি বেগম রোকেয়া নিয়ে, তা নিয়ে পড়ে লেখার ইচ্ছা আছে। কিন্তু এই বইটা তার তুলনায় অনেক বেশী প্রাঞ্জল। বইটার শুরুই হয়েছে ইতিহাস সুত্র ও সময়পট দিয়ে। বেগম রোকেয়া যেই সময়কার মানুষ তখনকার সমাজ ও ইতিহাস নিয়ে আলোকপাত রয়েছে এতে। সেইখান থেকে জানা যায় সেই সময়ের অনেক বিদ্বান জনহিতৈষী লোকই নারী শিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে কাজ করেছেন। তবে রোকেয়াই ব্যাতিক্রম শুধু মুসলমান হিসেবেই না, প্রথম- সর্ব ভারতে নারী হিসাবেও। শিক্ষাব্রত ও আত্মপ্রস্তুতিতে সেই জানা কথাগুলাই বলা নতুন করে। তবে লেখক অতি সহজ ভাবে এতে বেগম রোকেয়ার বেড়ে উঠার নানান কিছু নিয়ে বর্ননা করেছেন। এবং সেখানে তিনি বেগম রোকেয়ার নানা সময়ে বলা যাওয়া উপলব্ধি গুলোকেও তুলে এনেছেন। পরের চ্যাপ্টার সাহিত্য চর্চার পটভুমিতে বেগম রোকেয়া ও তার বোন করিমুন্নেসার সাহিত্য শুরু ও সেই সময়কার মুসলিম লেখকদের হালহাকিকতের হদিস দিচ্ছেন।
এরপর থেকেই বেগম রোকেয়ার সাহিত্য আলোচনা রচনা পরিচিতি দিয়ে শুরু। মতিচুরের দুই খন্ড নিয়ে বর্ননা, সুলতানাস ড্রীম নিয়ে কিছু কথা, তারপর পদ্মরাগ ও অবরোধবাসিনী নিয়ে বিস্তারিত বর্ননা, পুস্তকাকারে ও অপ্রকাশিত প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনা শেষে ছোট করে অনান্য ছোটগল্প ও রসরচনা ও কবিতা নিয়ে কিছু কথা, এতেই বই শেষ। রচনা পরিচিতিটাই এই বইয়ের প্রান। অত্যন্ত ঋজু ভাষায় সমালোচকের দৃষ্টিতে রোকেয়ার রচনা গুলো নিয়ে নিজের মতামত দিয়েছেন এবং সেই সুযোগে অনেক রচনার শ্রেষ্ঠাংশ কোটেশন হিসেবে ইউস করেছেন। আমার সব চেয়ে ভালো লেগেছে 'অলংকার না ব্যাজ অফ স্লেবারী' আর 'অবরোধ-বাসিনী' নিয়ে পড়তে। সুলতানাস ড্রীম লেখার প্রেক্ষাপট কিংবা পুস্তকাকারে অপ্রকাশিত প্রবন্ধের আলোচনাটাও যুক্তি গ্রাহ্য ভাবে উপস্থাপন করেছেন। এইসব লেখা লেখার পরে বেগম রোকেয়া কেমন সব সমালোচনার শিকার হয়েছিলেন তারও কিছু নমুনা দিয়েছেন বইতে। ভুলেই তো গেলাম বইতে খুব সুন্দর ভাবে বেগম রোকেয়ার কিছু সীমাবদ্ধতা ও অসংগতি নিয়েও কথা আছে। কিন্তু তা পড়লে মনে হবে এইসব সীমাবদ্ধতা গুলো বেগম রোকেয়ার অসাধারণ সব যোগ্যতা।
কোনো ভাবেই বেগম রোকেয়ার অসাধারণত্বের কোনো সীমা নাই। নিজে পর্দা মেনে তিনি ধর্মগ্রন্থ থেকে শুরু করে সমাজের প্রচলিত সব অনাচারের ও বৈষম্যের বিরুদ্ধেই কলম ধরেছেন। বইটার ভুমিকায় লেখা আছে বেগম রোকেয়া কে নিয়ে লেখকের প্রাথমিক প্রয়াস। সেই প্রয়াসে তিনি শত ভাগ সফল কারন আমার মনেই বেগম রোকেয়ার সব রচনা পড়ার প্রয়োজনীয়তা তিনি অনুধাবন করাতে পেরেছেন। একজন লেখক ও চিন্তাবিদ হিসেবে বেগম রোকেয়া যে মুক্ত মানসিকতা, সাহস, যুক্তিবাদ, মননশীলতা ও বিজ্ঞান দৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন, তাঁর সমকালে কিংবা ভবিষ্যত কালেও বিরল। নিজের সময়ে তিনি একজন নিঃসঙ্গ অনেক এগিয়ে থাকা আধুনিক আলোকিত মানুষ, যে সমাধিকারের কথা তিনি বলেছেন- ৮০-৯০ বছর পর অনেক এগিয়ে গেলেও আমাদের তাই নিয়েই কথা বলতে হয়। এই বইটা পড়লে চেনাজানা বেগম রোকেয়াকে নতুন ভাবে পাওয়া যাবে। বইটার দামও কম, কমিশন বাদ দিলে ১২০ টাকা। নিউমার্কেটে আপ ডাউন রিকশা ভাড়াও এখন সেই টাকাতে হয় না। তাই বইটা সবার পড়া জরুরী। আমি অবশ্য এখন পড়ছি মান্নান সৈয়দের লেখা বইটি সেটা আরো তথ্যবহুল ও ইন্টারেস্টিং কিন্ত তাতে সহজবোধ্যতা ও প্রানবন্ত বর্ননার বড় অভাব। সেইটা নিয়েও লিখবো আরেকদিন!
আজ এই ব্লগের আরেক প্রিয় মানুষ জেবীন আপুর জন্মদিন। উনাকে লাখো লাখো শুভেচ্ছা। ভালো থাকেন, সুস্থ থাকেন, মন যা চায় তেমন করেই দিন গুলো যাক!
নামঃ বেগম রোকেয়া সময় ও সাহিত্য
লেখকঃ মোরশেদ শফিউল হাসান
দামঃ ১৫০ টাকা
প্রকাশক মাওলা ব্রাদার্স
এই তথ্যটা যাচাইয়ের দাবী রাখে। ঠাকুর বাড়ির মেয়েরা এর আগে থেকেই পড়াশোনা নাটক গান বাজনা শুরু করেছিলেন হয়তো --- Brahmmyo Society এর মেয়েদের রীতিমত School ছিল
আমি মনে হয় বোঝাতে পারি নি,পড়াশুনা গানবাজনা তো হয়েছেই আগে কিন্তু নারী শিক্ষা ও সমাধিকার নিয়ে ভুমিকা রাখায় তা নিয়ে সোচ্চার হয়ে সংঘবদ্ধ হবার আহবান এই ভারত মহাদেশে নারী হিসেবে বেগম রোকেয়াই প্রথম!
তোমার বইয়ের আলোচনা বরাবরই খুব ভাল হয়। এটাও ব্যতিক্রম নয়। বইটা পড়ার ইচ্ছে হচ্ছে।
সামনে দেখা হলে নিয়ে যায়েন বইটা
বইটি পরিচিত করে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।
সুযোগ পেলে বইটি সংগ্রহ করার ইচ্ছে আছে
ধন্যবাদ ভাইয়া!
বই নিয়ে তোমার লেখা পড়লে বইটা পড়ার ইচ্ছা হয় সবসময়ই। এমন দিন আসছে কিছুই ভালো লাগে না। কিছুই করি না। তবু হয়ত কখনো পড়ব।
তোমার পড়া চলুক, লেখাও।
আচ্ছা আপু, ভালো থাকবেন!
বইএর আলোচনা বরাবরই প্রশংসার দাবীদার।
থ্যাঙ্কস এ লট রুনা আপু!
মন্তব্য করুন