বঙ্গ ফ্রীল্যান্স বুদ্ধিজীবির বানিজ্যমেলা যাত্রা!
নামটা ধার করেছি মুনতাসীর মামুনের বই থেকে। বইটার নাম সবাই জানে- ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী। তার সেকেন্ড খন্ডে হরিপ্রভা তাকেদার গল্প আছে। হরিপ্রভা তাকেদা হলো ঢাকার প্রথম আধুনিক মহিলা। তার স্বামী উয়েমন তাকেদার ঢাকায় আসেন ভাগ্যের সন্ধানে, ১৯০৩ সালের দিকে খোলেন 'ইন্দোজাপানিজ সোপ ফ্যাক্টরী'। ঘনিষ্ঠতার সুত্র ধরে ১৯০৬ সালে তারা বিবাহ করেন। ১৯১২ সালে ব্যাবসা গুটিয়ে তাঁরা জাপান যাত্রা শুরু করেন। কোনো বঙ্গ মহিলার প্রথম জাপানী বিয়ে করে জাপান যাত্রা সেই প্রথম। ১৯১৫ সালে তিনি বইটা লিখেন নাম 'বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রা'। নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের দেখা করেন, জাপানের নানা শহরে ঘুরেন, শ্বশুর শ্বাশুরীর ও এলাকাবাসীর ব্যাপক আদর স্নেহ পান। তার বই পড়ে মুগ্ধ হয়েছেন কিশোর বয়সী অন্নদাশঙ্কর রায় থেকে বুদ্ধদেব বসু। একজন সাধারন বঙ্গমহিলা যিনি কিছুই দেখেন নি তার দুনিয়ার তার চোখে জাপান ও জাপানীদের সেই সময়ের সমাজ নিয়ে লেখতে পারা নিঃসন্দেহে অসাধারণ ব্যাপার। এশিয়ার বাইরে কিংবা এশিয়ার অন্য কোনো ভাষায় এরকম জাপান নিয়ে সম্পুর্ন কোনো বই বের হয়েছে কিনা তা গবেষনার বিষয়। ওয়াতানাবে নামের এক জাপানী জানাচ্ছেন জাপানীদের সেই সময়ের মন মানসিকতা নিয়ে এরকম বই সত্যি দুর্লভ!
যাক ১৯৭২ সালেই ভদ্রমহিলা মারা গেছেন, উনার কথা বাদ। চার বছর পরে আজ আমি বানিজ্যমেলায় গেলাম অনেকটা শখ করেই। শখের কারন কার মুখে জানি শুনছিলাম স্মারটেক্স ও টেক্সমার্টে খুব ছাড় চলতেছে, যদি একটা দুইটা পাঞ্জাবী কেনা যায়। আর ভাবলাম শীতে মানুষজন নাই, ঘুরে আসাও হবে। পুলকেরই আগ্রহ ছিল বেশী কিন্তু পুলক ডিগবাজী মারলো সবার আগে, আমি আর সাইফই গেলাম। ডাইরেক্ট রিকশা যায় মোহাম্মদপুর থেকে ভাড়া ৪০ টাকা চাইলো। চেনাজানা মানুষকে রিকশা ভাড়া দিতে আমার কোনো টেনশন নাই। গিয়ে দেখি রিকশা অনেক আগেই ছেড়ে দিতে হয়, তারপর হাটো আল্লাহর নামে। গাড়ী বা বাইক থাকলে প্রবলেম নাই যাওয়া যাবে আরো সামনে। লোকজনদের দেখলাম বাচ্চাকাচা কোলে নিয়ে রীতিমত রান নেয়ার মতো মুডে আছে। হাটতে হাটতে সাইফ আব্দুল্লাহ শুরু করলো বঙ্গদেশে গাড়ী থাকার উপকারীতা নিয়ে বয়ান। এইসব প্যানপ্যান শুনতেই শুনতেই গেটে আসলাম। ৩০ টাকা টিকেট। ৩০ টাকা করে ২ টা টিকেট আমার টাকাতেই কাটতে হলো। আমার মনে খালি ভাবনা ৬০ টাকা দিয়ে দুইদিনের চায়ের খরচ হয়ে যেত। লাইনে মানুষ নাই দেখে ভাবলাম, ভিতরে মানুষ নাই। কিন্তু ভেতরে দেখি মানুষ জনে লোকারন্য। হাটতে থাকলাম আমার উদ্দেশ্য পাঞ্জাবী তাই আমি আর সাইফ চক্করের উপরেই থাকলাম।
চক্কর মারতে মারতে কিছু কিছু প্যাভিলিয়নে ঢুকি। সুন্দর মনোহর সব প্যাভেলিয়ন। ভালো টাকা পয়সা খরচ করতে হয়েছে। কিন্তু এত আলোর প্রতিযোগীতা আর মাইকে বিশ্রী সব আওয়াজে বিজ্ঞাপন শুনলেই গা জ্বালা করে। ইংলিশ,আরবী, হিন্দী নানা ভাষার গান থেকে মেরে দিয়ে নিজেদের পন্যের প্রসারের জিংগেল বানিয়েছেন, মাঝে মধ্যেই আমানত শাহ লুঙ্গী আর সবুজ ছায়া হাউজিং প্রকল্পের বিজ্ঞাপনের ভোকালে কেপে উঠি শব্দে। অবশ্য মানুষের এতে বয়েই গেলো, ফ্যামিলী নিয়ে আসা লোক কিংবা প্রেমিক প্রেমিকা এই দুই শ্রেনীর লোকে মেলায় ভর্তি। ঢূকবো না ঢূকবো না করেও ঢূকলাম ওয়াচের দোকানে, নাম ওম্যাক্স না ওমেগা। যেই ঘড়ি পছন্দ হয় তার দাম দেখি ১১ নয়তো ১৩ হাজার। সেলসম্যান সব মেয়ে তাদের সামনে আর কী বলবো? সাইফরে বললাম জলদি বিয়া কর তোর বিয়ের উপহারের ঘড়ি থেকে একটা মেরে দিয়েই ওমেক্সের স্বাদ মেটাতে হবে। শতরঞ্জীতে ঢূকলাম সব মেয়েদের আর বাসার আইটেম, ব্রাকের দোকানে ঢূকেও দেখি ইহাও মেয়েদের দখলে। নানা এলুমিনিয়াম আর মেলামাইনের দোকানে দেখলাম মহিলাদের সাম্রাজ্য, মেলায় আছে তিনচারটা হাজী নামধারী খাওয়ার দোকানে। এত হাজী বাংলাদেশে তা আমার আগে বুঝে আসে নাই। বানিজ্যমেলায় খাওয়া দাওয়ার দাম সমন্ধে জানি তাই সেই দিকে ঢুকার প্রশ্নই নাই। প্রানের প্যাভেলিয়নে গেলাম গিয়ে দেখি সব তো কিনতেই পাওয়া যায় মুদী দোকানে এখানে কি আর আছে কেনার? দেখলাম টয় ট্রেনের লাইন, থ্রিডি সিনেমা দেখার ছোট থিয়েটার। বুড়ো বুড়ো সব টিকেট কেটে লাইনে, সাইফরে বললাম এইজন্যেই বাংলাদেশের এই অবস্থা! ও জিগেষ করলো কেন ভাইয়া? আমি ছফা থেকে ধার করে ঝেড়ে দিলাম 'এই দেশে শিশুরা বড়দের মত হবার ভান করে আর বড়রা শিশুদের মত চ্যাংড়া সাজে'।
টেক্সমার্ট আর খুজে পাই না, বানিজ্যমেলায় বই মেলার মত কোনো ম্যাপ নাই যে কোন প্রকাশনী কোথায় তা জানা যাবে? শুধু গেটের কাছে একটা ম্যাপে প্যাভিলিয়ন নাম্বার দেয়া। কি আর করা অনেক খুজেও পাওয়া গেল না। পেলাম স্মারটেক্স, সেখানেও ছাড় কিন্তু সেইখানে যেসব কালারের কাপড় চোপড় তা দেখে মেজাজ খারাপ লাগলো। বানিজ্যমেলা উপলক্ষে তাদের গোডাউন খালি করে আনছে, একটাও পছন্দসই জিনিস নাই। সবাই বলে হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের অনেক কাটতি, পন্য হিসেবে অন্য প্রকাশ তো দূরে থাক কোনো ক্রিয়েটিভ কিছুই নাই মেলায়, কি আর করা, পায়ে ব্যাথা করছিল অযথা এত হাটলাম বলে। ৩০ টাকার টিকেটের মায়া ত্যাগ করে বের হয়ে গেলাম, গিয়ে দেখি আবারো লম্বা হাটা, তবে হাটার ক্লান্তিতেই পথ ভুল করলাম। আগারগাও দিয়ে না বের হয়ে চীন মৈত্রী দিয়ে বের হলাম। রিকশাওয়ালারা চায় গাজাখুরি ভাড়া আর সেখানে সবাই অপেক্ষায় আছে মিরপুরের বড় খেপের। কি আর করা দিলাম আবার আল্লাহর নামে হাটা লেগুনা রিকশা কিচ্ছু নাই, এলজিইডি বিল্ডিংয়ের ওদিকে এসে একটা চা খেলাম, হিন্দী চুলের চা বানাইছে দোকানদার। দুই চুমুক খেয়ে ফেলে দিলাম, দোকানদার কয় মামা আরেকটা বানায় দেই। আমি বললাম থাক আবার দুই চুমুক খেয়ে ফেলে দেয়ার ইচ্ছা নাই। বেচারা কষ্ট পেলো নিশ্চই, আবার হাটা দিলাম রিকশার দেখা নাই, আর দেখা পেলে ভাড়া চায় জাস্ট ডাবল, এডিবির অফিসের সামনে এক লেগুনা পেলাম তাতে ডাইরেক্ট শিয়া মসজিদ। বারেকের দোকানে এসে চা খেতে খেতে লোকজনরে হেব্বী বয়ান দিলাম বানিজ্য মেলা এবার খুব জমেছে। আর মনে মনে বললাম আবার চার পাঁচ বছরের মধ্যে যেনো বানিজ্যমেলার ধারে কাছেও না যাই। ফেসবুকে স্ট্যাটাস মেরে দিলাম বাংলাদেশের সব চাইতে বাজে জায়গা হলো বানিজ্য মেলা। ফেসবুকে আমার পেশা দেয়া ফ্রীল্যান্স বুদ্ধিজীবি কারন এইদেশে বুদ্ধিজীবির হাল হাকিকত দেখে আমি বিরক্ত, তাই নিজেই নিজের বুদ্ধিজীবিতার দায় ঘোষনা দিয়ে রেখেছি চার বছর আগে থেকেই!
ভাল লাগলো ফ্রীল্যান্স বুদ্ধিজীবির বয়ান
থ্যাঙ্কস ভাইয়া, আপনার নতুন লেখা কই?
"আমি ছফা থেকে ধার করে ঝেড়ে দিলাম 'এই দেশে শিশুরা বড়দের মত হবার ভান করে আর বড়রা শিশুদের মত চ্যাংড়া সাজে'।"
- হুম, এটা পৃথিবীর সব দেশেই কমবেশি হচ্ছে। যেমন, আমাদের দেশে আগে মনে করা হতো, চকলেট, আইসক্রিম শুধু ছোটদের খাবার। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলোতে দেখা যায়, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতাই সেসব আগ্রহে চুষছে/চাটছে। আবার "হ্যালোইন"-এর মত ভূতুড়ে উৎসবেও তাই হচ্ছে।
ছোটরা বড়দের মত ভাব ধরার চেষ্টা করাটা একটা সহজাত প্রবণতা বলে মনে হয় আমার। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে বড়রা ছোটদের মত সাজলে খারাপ লাগে না।
যাক্ আপনার লেখা পড়ে জানা গেল কিছু তথ্য। ধন্যবাদ আপনাকে।
ঠিকই বলছেন ভাইয়া, কিন্তু বড় দের ক্রমাগত চ্যাংড়ামি দেখতে বিরক্ত লাগে!
লেখেন না কেন ভাইয়া?
বাসায় আসলা না কেন?
আমিও গেছিলাম মঙ্গলবার ছুটির দিনে ইলমার পিড়াপিড়ীতে। হায়রে ভিড়। একটু ঘুরেই চলে আসছি।
শোন ভাইয়া, ভবিষ্যতে এই রাজ্যে তোমাকে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে আর এক নারী দেখবা কিনতেই আছে। সেগুলি বয়ে নিয়ে বাসায় ফিরবা।
রাত অনেক হয়ে গিয়েছিল, আসা উচিত ছিল
ইলমাদের জন্যই এই মেলা, টাকা খসানোর এক নিরুপম জায়গা!
দোয়া কইরেন আপু সেরকম কাচকলা সিদ্ধ মার্কা জীবন যেনো না হয়!
মেলায় গেলাম। ইরানী স্টলে জিরা কিনলাম ৬অও টাকা কেজি। কিন্তু মেমো দিল না। বললো মেমো দেই না। কাশ্মিরী শালের দোকানেও মেমো দেই না, বাচ্চাদের খেলনাতেও মেমো দেই না। আরতো কিছু কিনি নাই। এ কেমন কর ফাকির মেলা।
আপনি ঢাকায় আসলেন কবে আপু?
শোন ভাইয়া, ভবিষ্যতে এই রাজ্যে তোমাকে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে আর এক নারী দেখবা কিনতেই আছে। সেগুলি বয়ে নিয়ে বাসায় ফিরবা
দোয়া কইরেন, তেমন যেনো না হয়
মন্তব্য করুন