এই সবই তো সুন্দর, এ জীবনের আনন্দ, তার থেকে সুন্দর আমার মা!
'তোমাকে' ডাকটা এখানে খুব একটা খাটে না। কারন আমি আমার আম্মুকে 'আপনি' বলি আর বাবাকে বলি তুমি। এই অদ্ভুত ডাকের সিস্টেম অনেককে অবাক করে। অনেকে মা বাবা সবাইকে আপনে বলে ডাকে, অনেকে আবার দুইজনকেই তুমি করে ডাকে, কেউ কেউ আম্মুকে তুমি আর বাবাকে আপনি বলে। আমি হলাম উল্টো, আমরা দুই ভাই আম্মুকে আপনি বলে ডাকি। আর আব্বুকে তুমি। বছর পাঁচেক আগে ভাইয়া একবার ভাবছিলো আম্মুকে তুমি করে ডাকার। অভ্যাস নাই দেখি সিরিয়াস লজ্জা লাগে। মাঝেমাঝে ভাবি এত এত মানুষ আম্মুকে তুমি ডাকে কি করে? আবার আব্বুকে তুমি ডাকি,আপনে ডাকাই হয় না। আব্বু তাতে মন খারাপ করে বলে মনে হয় না। তবে এমন না যে আমি আব্বুর সাথে ফ্রি বেশী, বেসিক্যালি আমি আব্বু আম্মু কারো সাথেই ফ্রি বলতে যা বোঝায় তেমন কিছুই না। সব শেয়ার করি না ছোটবেলা থেকেই। কারন নিম্নমধ্যবিত্ত সংস্কারে ভরা মন আমার, ওতো শেয়ারের কি মধু তাই খুঁজে পাই না। এইটাই ভালো!
মা দিবস নিয়ে লেখার আদৌ কোনো কারন নাই। লিখছি কেন তাও জানি না। হয়তো ফেসবুকে সবার মা মা করা দেখে কিছুটা আবেগে আপ্লুত করেছে। কিন্তু তত আবেগ কই? চার মিনিট তো কথা বললাম দুপুরে। আম্মুর প্রশ্নের জবাব দেয়া শুধু, বুয়া আসছে? সকালে খাইছোস? দুপুরে কি রান্না? এখন কই? শরীর ভালো? গরম কেমন? আমি শুধু শেষ ত্রিশ সেকেন্ড বললাম আম্মু আজ তো দুনিয়া মা দিবস পালন করে। আম্মু শুনে বলে, আহারে তোর কি মন খারাপ আমি কাছে নাই বলে? আমি বলে উঠি, তা কেন হবে? উইশ করলাম এমনিতেই। ফোন রাখার পরে মনে মনে বললাম, মনে হয় সব সময় আপনি আমার কাছেই আছেন, কে বলে আপনি ভিন্ন শহরে। আপনার কোনো ছবি, কোনো কন্ঠস্বর আমার মোবাইলে নাই। কিন্তু সবসময়ই তো আপনি অন্তরের মানুষই, এরচেয়ে আপন, প্রয়োজনীয় কাছের মানুষ আর আছে কে? জামালপুর আর ঢাকার তেমন আর দুরত্বই বা কই এর কাছে? আসলে এইসব নতুন কথা না। সবাই মা কে ভালোবাসে, আমিও বাসি, এইসব কথা নানান সময় ব্লগেও লিখেছি। এই দিবসেই বা কেন লিখতে হবে? কারন আমার আম্মু আমার কাছে ৩৬৫ দিবসেই খুব স্পেশাল। মে মাসের এক রোদেলা দিনে তা নিয়ে আদিখ্যেতার মানে নাই জানি তাও লিখছি।
আমি ছোটবেলা থেকেই গাধা প্রকৃতির মানুষ। ছাত্র হিসেবেও, বুদ্ধি বিবেচনায়ও খুব একটা চৌকশ ছেলে ছিলাম না। তাই আম্মু আব্বু ভাইয়ার চিন্তা ছিল খুব আমাকে নিয়ে। আমি আদৌ জীবনে কিছু করতে পারবো কিনা? জীবনে আমি আসলেই কিছু করতে পারি নাই। তাও যা যতসামান্য অর্জন তার পুরোটাই মায়ের অবদান। ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত আমি এই লেভেলের দুষ্ট ছিলাম যে নিজ উদ্যোগে অন্য অসংখ্য বই পড়লেও আসল পড়া পড়তাম না। আম্মু ধরে বেঁধে কত মাইর দিয়ে পড়াতো, পড়া ধরতো, নিজ গরজে পড়া সম্পর্কিত যা কাজ সব কিছুই তদারকির ভেতরে রাখতো। এমন কি কৃষি শিক্ষার প্র্যাকটিক্যাল খাতার ছবিও একে দিছে। সবার ছবির মতো তা খুব অসাধারণ হতো না, কিন্তু এভারেজ নাম্বার নিয়ে তা চলে যেত। আর যা কাজ আছে এর বাইরে সবই আম্মুরই করতে হতো। আমি ভাব নিয়ে বলতাম নিজেকে অকর্মার ঢেকি। আসলেই আমি তাই। তাই আম্মুকে ছাড়া আমার কার্য উদ্ধারের আর কেউ ছিল না। তাই আম্মু যখন আমাকে মাঝেমধ্যে অসুস্থ হয়ে বলতো আমি তো শান্ত শেষ। আমার খুবই গভীর মন খারাপ হতো। আম্মুর কিছু হলে যাবার জায়গা কই আমার? আর এইসব ছাড়াও আমার আম্মুর মতো সামান্যও যদিও হতে পারতাম, তাহলে জীবনে আর বিসিএসের গেজেটের আশায় ঠেকে থাকতে হতো না। অনেক আগেই অনেক বেশী কিছু জীবনে করে ফেলতাম। আম্মু ছোট বেলা থেকেই আমাকে হুজুর বানানোর কত চেষ্টা করলো তাও হলাম কই? খালি ভাব নিয়ে পাঞ্জাবীটাই পড়ে থাকি এখন। শিশুবেলার দীর্ঘকাল আমার কেটেছে আরবী পড়তে পড়তে হুজুরের কাছে। বড় হয়েও কোরআন শরীফ সমানে পড়েছি হুজুরের তত্তাবাধানে কিন্তু মাওলানা আর হলাম কই? তাই সব মিলিয়েই বলাই যায় আমি সফল নই আর কিছুই হতে পারি নাই। ব্যর্থ দুর্বল মানুষেরাই অসহায়ের মতো ভালোবাসে আপন মানুষদের, আমিও তার ব্যাতিক্রম না।
আজ একটা কাজে আমার তেজকুনী পাড়া যেতে হলো। আধা ঘন্টার বেশি সময় ধরে হাঁটছি ঠিকানা খুঁজে পেতে, পাই নি। তাতে মেজাজটা খুবই চড়ে গিয়েছিল। তখন মনে হলো আম্মুর কথা, আম্মুর জনপ্রিয় ডায়লগ ছিল তোরে দিয়া হবে না এই কাজ! আসলেই আম্মু আমারে দিয়া তেমন কিছুই হবে না। তাও কি করবেন? আপনি অসাধারণ তাই আমার মতো গবেট সন্তানকে মেনে নিতেই হবে। সেই তেজকুনীপাড়ায় আর বিকেলে ধানমন্ডি যাবার উসিলায় ব্যাপক হাঁটছি। হাটতে হাটতে আম্মুকে নিয়ে ভাবছিলাম। আমার আম্মু কি চাইতো আমার কাছে? কথা শুনবো আর ভালো ছাত্র হবো, কোনোটাই হয় নাই। অথচ আমি আম্মুর কাছে যা চাইতাম সাধ্যে থাকলে তা পেয়ে গেছি। আমার ভাইয়া প্রথম প্রথম খুলনা থেকে চিঠি লিখতো। ঠিকানা লেখা থাকতো-- আম্মু কেয়ার অফ আব্বুর নাম। আমি বুঝতাম না তখন এখন বুঝি, মা ই তো আমাদের প্রথম ঠিকানা। এই পোষ্টে আরো অসংখ্য গল্প লেখা যায়, আমার জীবনে আম্মু কতটা স্পেশাল তা নিয়ে চর্বিত চর্বন করা যায়। কিন্তু তাতে লাভ কি? আম্মু তো আম্মুই। আর লিখতেও ইচ্ছা করছে না। কারন এতটুকু পর্যন্ত লিখতে বসেই চোখ পানিতে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, গলা শুকিয়ে যাচ্ছে কান্নায়। ব্লগে বলেই লিখলাম, সামনাসামনি এইসব কথা আমি কখনোই বলি না আম্মুকে। আম্মু জানে, কিভাবে জানি। ছোট বেলায় আমার সমন্ধে যে দু একটা ভালো কথা শুনতাম তার ভেতরে আম্মু বলতো 'আমার এই ছেলেটা এত মায়াময় হইছে। কারো জন্য মন খারাপে চোখের পানি এক নিমিষেই এসে যায়।' এখনো আমি তাই। মায়াময় ভালোবাসাবাসি ছাড়া আমার আর তেমন কোয়ালিটি নাই।
মা দিবস আমি পালন করি না। আম্মুকে এখন পর্যন্ত বলার মতো তেমন কিছু কোনোদিন উপহারও এমনিতেই দেই নাই। তবে ফেসবুকে এই দিনটা খুব সুইট একটা সময়। বন্ধু কিংবা বড় ভাই বোনদের মায়ের এত দারুন দারুন সব ছবি দেখে মুগ্ধ। মা দিবসের ব্যর্থতা কি? সত্যি যদি আমরা মধ্যবিত্তরা এত বেশী মা ভালোবেসে থাকি, তাহলে মায়েদের এত দুঃখ কেন? মেয়েদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির এই হাল কেন? কেন দুনিয়ার বুকে নারী নির্যাতনকারী দেশ হিসেবে অগ্রগন্য, কারন একটাই ভন্ডামী আমাদের রক্তের ভেতরে মিশে থাকা জিনিস! তাই ঘুরে ফিরে সেই ওয়ারফেইজের বিখ্যাত গানই, এ সবই তো সুন্দর, এ জীবনের আনন্দ, তার থেকেও সুন্দর আমার মা!
মা যখন অন্তরে সর্বদা বিরাজ করে তখন মাকে দিবসের কথা মনে করার দরকার নেই। কিন্তু মা যখন ওল্ড হোমে তখন? কিছু কিছু কুলাংগার যাদের মনে করিয়ে দিতে হয় তোমার একজন মা ছিল আছে। তাই এই দিবসে সবাই মাকে স্মরন করে বিশেষ স্মরন করে সেই কুপুত্র /কন্যাও করে। মা কে সম্মানিত করেই এই দিবস। মাকে মনে করবার জন্য নয়।
অনেক ইচ্ছে ছিলো "মা দিবসে" আম্মুকে নিয়ে কিছু লিখবো। কিন্তু টাইম আর পাইলাম কই। পরে নিজেরেই নিজে সান্ত্বনা দিলাম এই বলে যে, মা দিবস কি আর এক দিনই নাকি। মা দিবস হল প্রতিদিন। লিখবোনে কোন একদিন টাইম পেলে। তুমি লিখলা। দেখে ভালো লাগলো। লেখা ভালো হইসে।
প্রতিদিন মা দিবস
রোজ ভালবাসি কিনতু একদিন বিশেষ করে জানাতে সমস্যা কী?
<3
মন্তব্য করুন