তের কি বায়ান্ন এর মতই আমাদের রাজনৈতিক সম্পদ ?
বিশ্বের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে যে সব আন্দোলন জাতীয় চেতনা ও জন আকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনি, কেবল সেইসব আন্দোলনই গণতন্ত্রকে প্রকৃত অর্থে বিকাশ ও শানিত করেছে। জাতীয় চেতনা ভিত্তিক এইসব আন্দোলন দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য যেমন অতীব প্রয়োজন, সমাজ ও সংস্কৃতির মানবিক বিকাশের জন্য অপরিহার্য অংশ। শাহবাগের তরুণদের নবজাগরণ যে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক সম্পদ ও ভবিষ্যৎ পথ প্রদর্শক হিসাবে আবির্ভাব হল, এই বাস্তবতাটিকে স্বীকার না করলে আমাদের স্বভাবজাত অজ্ঞতাটাই প্রকাশ পাবে। রাজনৈতিক সম্পদ এই অর্থে যে ২০১৩ সালের এই চেতনা শক্তিটিই বাংলার ইতিহাসের পাতায় ১৯৫২ সালকে গৌরবময় ও সমৃদ্ধশালি করেছে। এই চেতনায় যে রাজনীতিটি আছে তা চলমান রাজনৈতিক চর্চার বাইরের এক নতুন শক্তি ও বেগবান অনুঘটক। এই দিকনির্দেশক রাজনৈতিক চেতনাটি যেমন ১৯৫২ সালেও আমাদের স্বাধীনতার পথ দেখিয়েছিল, তেমনি আজ ২০১৩ সালে এসে আহব্বান জানাচ্ছে প্রিয় জন্মভূমি থেকে ১৯৭১ সালের পরাজিত অপশক্তিকে নির্মূল করার জন্য। যারা এই চেতনার নির্মাতা তারা হল নতুন প্রজন্ম ,তরুণ সমাজ। এই সব আদর্শিক প্রেরনা ও চেতনার প্রতিফলন বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ঘটেছে। যা ছিল পূর্ববাংলার জনগণের সাংস্কৃতিক চেতনার বিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধের। বাঙ্গালি জাতির ইতিহাসের পটভূমিতে নতুন আরেকটি গর্ব ও মহাকাব্য যে ২০১৩ তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। বৈশিষ্ট্য গত বিচারে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রতিচ্ছবি হল ২০১৩ এর তরুণ প্রজন্মের মহাজাগরণ । কারন এই জন্য যে বায়ান্নতে যে অপশক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনটি হয়েছিল, তের তে এসেও কিন্তু সেই চেনা অপশক্তি। বায়ান্নের ন্যায় তেরতেও আমরা নতুন প্রজন্ম দায়িত্ব নিয়েছি এই অপশক্তিকে বিনাশ করার জন্য।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর পাকিস্তানের শাসকশ্রেণী উর্দুকে ইসলামের ভাষা হিসাবে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য রাষ্টভাষা করার জন্য অপচেষ্টা করে। করাচীর শিক্ষা সন্মেলনে উর্দুকে এক মাত্র রাষ্টভাষা করার সুপারিশটি ক্রোদ্ধ করে তুলে পূর্ব বাংলার ছাত্র সমাজকে। এই অন্যায় ও অগ্রহণযোগ্য চেষ্টাটির পিছনে ছিল মুলত দুটি কারন। প্রথমত বাংলা ভাষার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধংস করে দেওয়া, যেন বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কোনদিন মাথা উঁচু হয়ে দাড়াতে না পারে। দ্বিতীয় কারণটি ছিল অর্থনৈতিক । চাকুরি ও ব্যবসাতে যেন পূর্ব বাংলার জনগণ সুযোগ না পায় । তদানীন্তন পূর্ব-বাংলার জনগণ, বিশেষ করে ছাত্র সমাজ এই শাসক গোষ্ঠীর কু-মতলবটি বুঝতে পারে। তমদ্দিন মসলিশের সেক্রেটারি আবুল কাসেমের নেতৃত্বে সাধারন ছাত্ররা প্রথম এই অন্যায় ও অযোক্তিক সিদ্বান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালের ৮ই ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে মিছিল হয়েছিল তাও ছাত্রসমাজ ও সাধারন জনগণের অংশ গ্রহনের মধ্যে দিয়ে। তাদের একমাত্র দাবি ছিল যে বাংলাই, একমাত্র বাংলাই হবে পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্টভাষা। ১৯৪৭ সালের ১১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন কলেজের সাধারন ছাত্ররাই প্রথম ধর্মঘট আহব্বান করে। পাশাপাশি রাজনীতিবিদরাও সাধারন ছাত্রদের এই আন্দোলনে অংশগ্রহণে করে আন্দোলনকে আরও বেগবান করে। কিন্তু মুল চালিকা শক্তি ছিল সাধারন ছাত্র ও জনগণ। সময়ের সাথে সাথে এই চেতনাটি আরও শানিত ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ২১ ফ্রেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায় রচিত হয়েছে সাধারন ছাত্রদের আত্নহুতির মধ্য দিয়েই। মূলত সাংস্কৃতিক চেতনা ছাড়াও এই আন্দোলনের রাজনৈতিক দিকটি ছিল দূরদৃষ্টি সম্পন্ন। এই ভাষা আন্দোলনেই কিভাবে শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়তে হয় তা বাঙ্গালীকে শিখিয়েছে। বলা যায় স্বাধীনতার বীজটি আমরা ১৯৫২ সালের ২১শে ফ্রেরুয়ারিতেই রূপণ করেছিলাম। যার চেতনায় ঝালাই হয়ে ধীরে ধীরে আমরা আরও মুক্তির স্বপ্নে বিভোর হলাম।
১৯৭১ সালের মুক্তির সংগ্রামসহ যে সব আন্দোলনের জন্ম হয়েছে তাঁর মূল নেতৃত্বে ছিল রাজনীতিবিদেরা। ছয়ষট্টি সালের বাঙ্গালির জাতীয়বাদি ছয়দফা আন্দোলনের মূল নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। পরবর্তীতে উনসত্তরের অসহযোগ আন্দোলনসহ স্বাধীনতামুখী সকল আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিল রাজনীতিবিদেরা। মূল নেতৃত্ব দিয়েছিল আওয়ামীলীগ। বঙ্গবন্ধুই ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের সর্বদলীয় মিটিংএ আবারও ছয়দফা মেনে নেওয়ার দাবি তুলেন। উনসত্তরের ৫ই ডিসেম্বর একটি জনসভায় পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলাদেশ নামে ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু। সত্তরের নির্বাচনে পর যখন পাক রাজনীতিবিদেরা বাংলার জনগণের কাছে শাসন ক্ষমতা হস্তান্তর করতে তালবাহানা করেছিল তখনই আন্দোলন দানা বাঁধে প্রকটভাবে। ১৯৭১ সালের মুক্তির সংগ্রামও আওয়ামিলিগের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। ছাত্রলীগসহ অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলি সহকারীর ভুমিকা পালন করে। স্বাধীনতার যুদ্ধেও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছাত্রলীগ সহ অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলি ঐতিহাসিক ভুমিকা রাখে। আর যারা এই মহান যুদ্ধের সময় নিজ দেশের জনগণকে হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ ও অগ্নি সংযোগ করে তার প্রত্যেকটি সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছিল জামায়েত-ইসলাম, বাংলাদেশ।
শাহবাগের এই আন্দোলন বহুমাত্রিক বিশ্লেষণের দাবী রাখে। এই আন্দোলনের আদর্শই বা কি? এই বিশুদ্ধ রাজনৈতিক আদর্শের উপাদানেই বা কি কি? প্রচলিত রাজনৈতিক ধারার বাইরে এটা কি কোন আলাদা নতুন শক্তি ? এই শক্তি কি ক্ষমতার রাজনীতিতে বিশ্বাসী? নাকি বাংলাদেশের চলমান জনবিমুখ রাজনীতিকে জনমুখী করার জন্য আদর্শিক প্রেরনার উৎস ?
শাহবাগের এই গণচেতনার ভিত্তি ১৯৭১। ক্ষয়হীন এই চেতনাটি ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় সুপ্ত অবস্থা থেকে আস্তে আস্তে আরও বেগবান, আর সতেজ ,আরও শানিত হয়ে ওঠে। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের স্হপতি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশেই স্বাধীনতার মূল চেতনাকে গলায় চেপে ধরা হয় ।এই ফাঁকে একাত্তরের পরাজিত শক্তিগুলি নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে পুনর্বাসনের কাজটি খুব দ্রুততার সহিত করে। বিশেষ করে সামরিক শাসক মেজর জিয়ার শাসন ব্যবস্হার সময় রাষ্টযন্ত্রকে স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তিগুলি ব্যবহার করে নগ্ন ভাবে। ১৯৭১ এর চেতনা বিরোধী আদর্শের মোড়কে সর্বস্তরে শুরু হয় পাকিস্তানিকরন। জিয়াই রাজনীতি করার সুযোগ দেন এইসব অপশক্তিকে যারা একাত্তরে এই দেশের সাধারন নিরীহ মানুষের রক্ত নিয়ে হুলি খেলেছে, চার লাখ মা-বোনদের ধর্ষন করেছে, লুণ্ঠন করেছে অনেকের ধন সম্পদ। স্বাধীনতার চেতনাকে এইভাবে পদে পদে ভুলন্ডিত করার হেয় কাজগুলি স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি মেনে নেয়নি। রাষ্টযন্ত্রের ক্ষমতার কাছে অসহায় ও অবহেলিত অবস্হায় তাদের হৃদয়ে রক্তকরন হলেও কোন প্রতিবাদ করার সুযোগ ছিল না। সেই থেকেই ২০১৩ সালের এই বহুমাত্রিক আদর্শিক রাজনৈতিক প্রতিবাদের বীজটি গণমানুষের মস্তিকের ভিতরে বিস্তার লাভ করতে থাকে। এই মতটির প্রতিফলন পাওয়া যায় বাংলানিউজ টুয়েন্টিফোর কে দেওয়া ইমরান এইচ সরকারের একটি সাক্ষাৎকারে । তিনি বলেন “দেশের প্রতিটি মানুষই হবে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের”। পরবর্তীতে সামরিক শাসক এরশাদের সময় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তিগুলি আরও সংঘটিত হয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে। কিন্তু গভীরভাবে খেয়াল করলে দেখবেন প্রেসিডেন্ট জিয়া ও এরশাদের শাসন আমলসহ ১৯৯১ সালের পরে থেকে আজো অবধি স্বাধীনতার বিরোধী অপশক্তিগুলি সামাজিকভাবে অবহেলিত। কারন এই দেশের সাধারন জনগণ এইসব অপরাধীদের কখনই ক্ষমা করে নাই। তাদের ঘৃণা সবসময়ই ছিল একাত্তরের এই মানুষরূপী জানোয়ারদের উপর। এমনকি ১৯৯১ সালের পর জামাত শিবির সাথে ক্ষমতার আঁতাতের রাজনীতিকে মানুষ ভালভাবে গ্রহণ করেনি। এই কমপ্রোমাইজিং রাজনীতি স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বেলিত গণ মানুষের আখাংকার বিপরীত তা আমাদের রাজনীতিবিদরা বুঝলেও শুধু ক্ষমতার জন্য আদর্শিক স্খলনও মেনে নিয়েছেন। এই রাজনৈতিক বিভ্রান্তির ফলে মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ লালনকারী সকল প্রজন্মই নতুন এক আপোষহীন স্বপ্নের অপেক্ষায় প্রহর ঘুনে। তারা নিশ্চিন্ত হতে চায় যেন গর্বের এই চেতনায় যেন আর কোন বিভ্রান্তি না থাকে। ইমরান এইচ সরকারের ও একই অভিমত। তিনি বলেন ‘ চেতনার জায়গা এমন থাকতে হবে যেখানে কোনো বিভ্রান্তি থাকবে না’। ২০০১ সালের বি,এন,পি-জামাত জোট সরকারে সময় স্বাধীনতার বিপক্ষের অপশক্তি জামাত-শিবির নেতাদের গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়ানোর মত নিন্দনীয় সিদ্ধান্ত সবচেয়ে বেশী আহত করে এই দেশের সর্বস্তরের জনগণকে। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত এই অপশক্তির উত্তানটি ঘৃনাভরে প্র্ত্যাখিত হয় ২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে। বিশেষ করে স্বাধীনতা প্রিয়, ইতিহাস সচেতন , বিশুদ্ধকারি ও অনুপ্রেরনাদায়ক তরুণ সমাজ ইতিহাসের দায় থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃ্ত্বদানকারী আওয়ামিলিগকে ক্ষমতায় বসায় মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার করবে এই শর্তে।
সাংগঠনিক কাঠামো ছাড়াই যে দলমত নির্বিশেষে কোন রাজনৈতিক আন্দোলনে সকল স্তরের জনসাধারণের বাধভাঙ্গা অংশগ্রহণ সম্ভব শাহবাগের তরুণরাই দেখিয়েছে। এই জাগরণ, এই চেতনা কিংবা এই দ্রোহ জাগিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের সকল গন মানুষকে। ১৯৫২ সালের ন্যায় এই আন্দোলনের আদর্শটি একটি চেতনা ভিত্তিক। আমরা যেমন বায়ান্ন সালের চেতনাকে ধারন করেই ১৯৭১ সালে পেয়েছি মহাকাব্যিক স্বাধীনতা , তেমনি ২০১৩ সালের এই তেজদিপ্ত আপোষহীন জাগরণটি এই দেশের সকল অন্যায় অবিচার, বৈষম্য ও অপশক্তি কে বিনাশ করে খুলবে নতুন দ্বার। এই জাগরণের এক মাত্র নায়ক হচ্ছে তরুণ সমাজ যারা কোন প্রচলিত রাজনীতিতে জড়িত নয়। এই তরুণদের উদ্দেশ্য যে শুধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার পর্যন্তই , তা নয়। এর লক্ষ্য বহুমাত্রিক। আস্তে আস্তে ঘুনে ধরা আমাদের চলমান রাজনৈতিক সমাজের প্রতিটি স্তরের আবর্জনাকে সরিয়ে দেশ ও জাতি গঠনের ভুমিকা রাখবে এতে সন্দেহ নেই। ইচ্ছে করলেই এই শক্তিকে উদ্দেশ্যবিহীন কিংবা বিনাশ করা যাবে না ।
নিভৃত স্বপ্নচারী , ধন্যবাদ
মন্তব্য করুন