রহমতউল্লাহ ইমন'এর ব্লগ
অন্য ভুবন
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প-১২-ডি’র বাসার কোনার দিকের ঘর যাকে গেস্ট রুম বা সার্ভেন্টস রুম যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন, সেটাই ছিল আমার আসল আস্তানা। ১৯৭০ থেকে ২০০৮ জীবনের প্রায় পুরোটাই তো কাটিয়েছি ঐ বাসাতে… তার আবার সিংহ ভাগ সেই ‘বিখ্যাত’ ঘরে। বিখ্যাত বলছি এই কারণে যে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমদের বাসায় বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন গার্ডকে গুলি করে হত্যা করা হয়। নাজিম মাহমুদ তাঁর 'যখন ক্রীতদাস ৭১' গ্রন্থে এই ঘটনার উল্লেখ করেছেন। দীর্ঘদিন তাঁদের সৎকারের ব্যবস্থা না করে শুধু মৃতদেহের ওপর কিছু ওষুধ ছিটিয়ে রাখা হয়েছিল পচন রোধ করার জন্য। স্বাধীনতার পর আমরা যখন আবার সেই বাসায় ফিরে আসি তখন সারা ঘর জুড়ে বীভৎসতার চিহ্ন ছড়ানো। মৃতদেহগুলো সরিয়ে নিলেও মেঝেতে তাঁদের দেহের ছাপ স্পষ্ট। দেয়ালে মেঝেতে গুলিতে ছিদ্র হয়ে যাওয়া পলেস্তরা, রক্ত, মাংশ, দুর্গন্ধ। সেই স্মৃতিগুলো আমরা সযত্নে ধরে রাখতে সচেষ্ট ছিলাম বরাবর। ২০০৮ এ যখন এই বাড়ি ছেড়ে আসি তখনো সেই দাগ আর গুলির চিহ্নগুলো সেভাবেই রক্ষিত ছিল। যা হোক ’৭২ থেকেই আবার নতুন করে আমাদের জীবন সংগ্রামের শুরু। আমার নানীই প্রথম সাহস করে বাস করতে থাকেন সেই ঘরে… সারা রাত নামজ আর
আষাঢ়ে গপ্পোঃ অর্থ বিভ্রাট
এবার রাজশাহীতে যেয়ে দেখি আমার তিন বছর বয়সি ভাগ্নি আলোকিতা তেমন বাংলাই বলছে না… বলছে অনর্গল হিন্দি… মাত কর… মাঝে মাঝে এসে আমাকে ধমক দিচ্ছে খামোশ! টিভিতে ননস্টপ হিন্দি কার্টুন দেখার সুফল(?)। কী সাংঘাতিক অবস্থা!
শখের সাংবাদিক
আমার আজন্ম লালিত স্বপ্ন ছিল সাংবাদিক হওয়া। সাংবাদিকতা তো আমার প্যাশন… তবে না, শুধু শখের সাংবাদিক নয়, এর ওপর পড়াশোনা করে একদম প্রফেশনাল সাংবাদিক হওয়া। আমার কাছের মানুষেরা সবাই জানেন তা। এখনো আমার বিভাগের সভাপতি ‘শ্যারল’ বা বন্ধু ‘কে’ ঠাট্টা করে বলেন, কি ইমন, শুরু করবে না কি আবার জার্নালিজমে পড়া? বয়স থাকলে মন্দ হত না। ডেভিড লেটারম্যান বল স্টেটেরই ছাত্র ছিলেন… প্রতিদিনই তাঁর নামে উৎসর্গীকৃত ডেভিড লেটারম্যান কমিউনিকেশন এন্ড মিডিয়া বিল্ডিং এর ভেতর দিয়ে হেঁটেই আমার বিভাগে যাই। সর্বাধুনিক প্রযুক্তি আর সুযোগ সুবিধা সমৃদ্ধ ল্যাব, রেডিও স্টেশন, টিভি স্টুডিও দেখে খুব লোভ হয় আবার বসে যাই সেখানে… যদিও জানি এই মাথা আর কিছুই নিতে পারবে না!
ভালোবাসার গণিত
ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় ভাবতাম ক্যালকুলাসটা ভালই জানি। ঐ ক্যালকুলাসে ৩৬ এই ভরসাতেই পরীক্ষার হলে ঢুকেছিলাম... না হলে Statics Dynamics খায় না মাথায় দেয় তাও জানতাম না... কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে নাসের স্যারের কাছে ‘Real Analysis’ পড়তে গিয়ে বুঝলাম Calculus এর ‘ক’ ও শিখি নি... বছরের অর্ধেক জুড়ে ফাংশান পড়াতে যেয়ে স্যারও হাফিয়ে উঠলেন, আর আমরা তো শেষ... যারা Function ই ঠিকমত বোঝে না তারা Analysis বুঝবে কি?
অপারেশন দুরমুজ
ব্রেকিং নিউজঃ ২২ মার্চের ফাইনালে যে সকল বঙ্গসন্তান(?) পাকিস্তানকে সমর্থন করিবেন তাহাদের নাম নিবন্ধন চলিতেছে। অতি সত্বর আপনার নাম নিবন্ধন করুন এবং নিবন্ধনপত্র সর্বদা সঙ্গে রাখুন। নিবন্ধিত ব্যক্তি ব্যতীত কাহারো পরিধানে পাকি জার্সি, চিবুকে পাকি আলপনা বা হাতে পাকি পতাকা থাকিলে 'দুরমুজ কমিটি' তাহাদিগকে কিঞ্চিত আপ্যায়ন করিবে। মূল আহার কি তাহা অপ্রকাশিত থাকিলেও প্রারম্ভিক উপাদান (স্টার্টার) হইল বস্ত্রহরণ পরবর্তীতে চুতরার পাতা লেপন সহ হালকা ধোলাই... স্টক সীমিত... আগে আসিলে আগে পাইবেন!
নাম বিভ্রাট
আমাদের বাসায় এক বুয়া কাজ করত, আমরা ডাকতাম বুবু, মা ডাকত জানেহারের মা বা সুলতানের মা। বিশ বছরেরও বেশি সে কাজ করেছে আমাদের বাসায় (গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ডে নাম ওঠার কথা!)। আমাদের ওপর সমানে খবরদারি করত, আমরা বলতাম মায়ের পিএস। এখন অনেক বয়স তার, তবে মাঝে মধ্যেই বাসায় আসে, আমাদের খোঁজ নেয়, সারাদিন থেকে মায়ের সাথে গল্প করে চলে যায়। এটা ২০০৪ সালের কথা। তখন আমি যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানার বল স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে নিয়োগ পেয়েছি। খবর পেয়ে সে এসেছে দেখা করতে। আমি বাসায় নেই। মাকে জিজ্ঞেস করছে,
......
আম্মা, ভাই নাকি বিদেশ যাছে? কতি?
আমেরিকা
আমেরিকায় কতি? বুশের বাড়ির কাছে নাখি? বুশকে মাইরতে পাইরবে না? (তার নাতির নাম আবার সাদ্দাম)
এবার আমার ছোট বোন লুম্বিনী বলছে যে,
না, দাদা যাবে ইন্ডিয়ানা, বুশের বাড়ির থেকে অনেক দূরে।
ইট পাটকেল
আমার ছোটবেলার বন্ধু রাজশাহীর কাজলার পিন্টু পেশায় রিকশাচালক। আমি যখন রাখাল বালক তখন পিন্টু আমার নিত্যসঙ্গী। একসংগে গরু চরানো, বাঁশি বাজানো, পার্কের কদম গাছ থেকে কদম ফুল পাড়া আরো কত না মজার স্মৃতি। যেদিন ওর কাছ থেকে শিস দিয়ে সিনেমার গান গাওয়া রপ্ত করলাম বাবা মার টনক নড়ল... আমি মাদ্রাসা ঘুরে গেলাম স্কুলে আর পিন্টু জীবিকার তাগিদে পা রাখল রিকশার প্যাডেলে। তারপর পেরিয়ে গেল কত বছর... কঠোর জীবন সংগ্রাম তার, কিন্তু... মুখে আমলিন সেই ছোটবেলার নিষ্পাপ হাসি। দেখা হলেই একগাল হেসে জিজ্ঞেস করবে
কেমুন আছেন ইমুন ভাই?
কতদিন বলেছি আরে আমরা তো ছোটবেলার বন্ধু, আপনি বল কেন? এ কথায় দারুন লজ্জিত সে। বলে
কী যে বুলেন? আপনে এখন কত থ বড় ষাঁড়!!! (যথার্থ)
আমার জোহা চাচা
আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে বেড়ে ওঠা মানুষ তাদের নিয়ে এই এক সমস্যা, নিজেরা যত ক্ষুদ্রই হই না কেন বড় মাপের মানুষদের নিয়মিত সান্নিধ্য পেয়ে, তাঁদের সাহচর্যে থেকে তাঁদেরও নামিয়ে আনি সাধারণ মানুষের স্তরে। তাঁরা হয়ে যান আমাদের পারিবারিক সদস্যের মতই। আমদের হাসান চাচা (প্রখ্যাত কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক) বা সনৎ কাকুর (বিশিষ্ট সাহিত্যিক সনৎ কুমার সাহা) চাইতে এই সত্য আর বেশি কেই বা জানেন?
পথ চলা - ২
গত পর্বের লেখা পড়ে আমার বেশ কিছু শুভানুধ্যায়ী প্রশ্ন করেছেন যে শিক্ষকতার শুরুতে আমাকে অতটা বেগ পেতে হল কেন? আমাকে তো তারা ভাল ছাত্র বলেই জানেন। আর জেনারেল এরশাদের কল্যাণে চার বছরকে আট বছর বানিয়ে ফেলায় লেখাপড়ার জন্য যথেষ্ট সময় পাই নি এমন অভিযোগ ধোপে টেকে না। তাহলে কেন এই দুরবস্থা?
সত্যি এটি একটি মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। তবে উত্তর খুব সহজ। পরিসংখ্যান মোটেই আমার পছন্দের বিষয় ছিল না। আমার আজন্ম লালিত স্বপ্ন ছিল সাংবাদিক হওয়া। এটা যে আমার কাছে কী একটা প্যাশন ছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। বাসায় সবাই এটা জানত। এমন কি এসএসসি তে যখন আমি মানবিক বিভাগ থেকে মেধা তালিকায় প্রথম হই, সেদিন যেসব সাংবাদিক আমার সাক্ষাতকার নিতে এসেছিলেন তাঁদেরও আমি বলেছিলাম,
আমি সাংবাদিকতায় লেখাপড়া করে সাংবাদিক হতে চাই।
পথ চলা
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষকতার শুরুটা ছিল স্বপ্নের মত। বিভাগ আমার প্রতি যে আস্থা রেখেছিল তার প্রতিদান দিতে পারব কি না সেই চিন্তায় সবসময় অস্থির থাকতাম। আমাকে প্রথমেই পড়াতে দেওয়া হল মাস্টার্সে Order Statistics. ক্লাসের সবাই বন্ধুস্থানীয়। আমার কোন কোন সহপাঠী যারা যে কোন কারণেই হোক না কেন একটি বছর খুঁইয়েছে, তারা আছে সেখানে। তাদের সাথে তুই তোকারি সম্পর্ক। আছে মামুন আপনের মত আপন জন। দু’ একজন বড় ভাইও আছে। ওরা ক্লাসে বলত স্যার, বাইরে ভাই বা দোস্ত। মহা ফ্যাসাদ। আমাদের বিভাগের অন্যতম কৃতী শিক্ষক প্রফেসর রেজাউল করিম মামুন (যাঁর একটি গ্রন্থ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় প্রকাশন Springer-Verlag থেকে প্রকাশিত হয়েছে) সেই যে আমাকে স্যার বলা আরম্ভ করল যা অদ্যাবধি বহাল আছে। প্রথম বর্ষে পড়াতে দেওয়া হল Probability. আমি ছাত্র থাকাকালীন এই কোর্সে ভাল করি নি, তাই কোর্স দেবার সময় মনোয়ার স্যার বললেন
যাত্রা হল শুরু
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আমার সম্পর্ক কি?
মায়ের সাথে সন্তানের যে সম্পর্ক ঠিক তাই, এই বিশ্ববিদ্যালয়, পরিসংখ্যান বিভাগ আমাকে দু'হাত উজাড় করে দিয়েছে। বরং এই অধম সন্তানই পারেনি তার যথোপযুক্ত প্রতিদান দিতে।
’৯২ এর মে মাস, পাশ করেছি মাস তিনেক।বাবা অবসরে,গুরুতর অসুস্থ, প্রাণ সংশয়, ঘরে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই ভাই, বোনটা স্কুলে। দারিদ্র্যের কষাঘাত কাকে বলে তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। সমানে প্রাইভেট পড়াচ্ছি। কিন্তু কারো কাছ থেকেই পয়সা নিচ্ছি না, এটা যে আমার নীতি বিরুদ্ধ।
স্বপ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার। কিন্তু কবে নিয়োগ হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই।