শখের সাংবাদিক
আমার আজন্ম লালিত স্বপ্ন ছিল সাংবাদিক হওয়া। সাংবাদিকতা তো আমার প্যাশন… তবে না, শুধু শখের সাংবাদিক নয়, এর ওপর পড়াশোনা করে একদম প্রফেশনাল সাংবাদিক হওয়া। আমার কাছের মানুষেরা সবাই জানেন তা। এখনো আমার বিভাগের সভাপতি ‘শ্যারল’ বা বন্ধু ‘কে’ ঠাট্টা করে বলেন, কি ইমন, শুরু করবে না কি আবার জার্নালিজমে পড়া? বয়স থাকলে মন্দ হত না। ডেভিড লেটারম্যান বল স্টেটেরই ছাত্র ছিলেন… প্রতিদিনই তাঁর নামে উৎসর্গীকৃত ডেভিড লেটারম্যান কমিউনিকেশন এন্ড মিডিয়া বিল্ডিং এর ভেতর দিয়ে হেঁটেই আমার বিভাগে যাই। সর্বাধুনিক প্রযুক্তি আর সুযোগ সুবিধা সমৃদ্ধ ল্যাব, রেডিও স্টেশন, টিভি স্টুডিও দেখে খুব লোভ হয় আবার বসে যাই সেখানে… যদিও জানি এই মাথা আর কিছুই নিতে পারবে না!
ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে পড়ে… মনে পড়ে এসএসসির ফল বেরুনোর সেই দিনটির কথা… বাসা ভর্তি শুভানুধ্যায়ীদের ভিড়ে ক্যামেরা আর নোটবুক হাতে কত সাংবাদিক… আমার স্বপ্নের ফেরিওয়ালারা… আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও?… আমার এক কথার উত্তর… আমি সাংবাদিকতার ওপর পড়াশোনা করতে চাই… মা পাশ থেকে লাগাল এক বিরাট ধমক… ও কী জানে? আপনারা লিখে দিয়েন ও ইংরেজিতে অনার্স পড়তে চায়… এটা মায়ের নিজের স্বপ্ন ছিল… যা হোক পরদিন কাজল আঙ্কেল ‘দৈনিক বার্তায়’ বক্স নিউজ করেছিলেন ‘ইমনের স্বপ্ন হয়তো কোনদিনই পূরণ হবে না’ এই শিরোনামে… সত্যি সেই স্বপ্ন পূরন হয়ও নি… এখনো পুরোন কাগজের ভিড়ে যখন সেই পেপার ক্লিপটির দিকে চোখ যায়, দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে চোখ দিয়ে। তারপরেও হাল ছাড়ি নি। এইচএসসির পর এক পিতৃবন্ধুর সাহায্যে খুব আকর্ষণীয় এক বৃত্তির সুযোগ পাই কুয়ালালামপুরে সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়াশোনার। আমার এসএসসি আর এইচএসসি ফলাফলেই তারা সন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু এবারও বাধ সাধলেন মা। আমি নাকি কুয়ালালামপুরে রাস্তায় গাড়ি চাপা পড়ব… আজকাল বছরে প্রায় বার দুই কুয়ালালামপুরে যাওয়া পড়ে… মাস খানেক করে থাকি… যতবার পথে হাঁটি মায়ের আশংকার কথা মনে হয়… বিপদ তো মানুষের জীবনে আসতেই পারে… কিন্তু তাই বলে এমন সুযোগ হাত ছাড়া??? আর ঢাকায় তো যাওয়াই চলবে না… ওখানে গেলে আমি শুধু পলিটিক্স করব… গুন্ডা হয়ে যাব… আমি বললাম যে না পড়ি, অন্তত ভর্তি পরীক্ষাটি দেই… হয়তো চান্সই পাব না… কিন্তু মা সেটুকু ঝুঁকি নিতেও রাজি ছিল না…
মন চলে গেল আরও পেছনের জীবনে… তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি… তখনো রাজশাহী থেকে কোন দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশ হয় না… ঢাকার সাথে যোগাযোগ দুরুহ… ভোরে রওনা হলে সন্ধ্যায় বা রাতে পৌঁছুনো যেত। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলো এসে পৌঁছুত বিকেল, সন্ধ্যা, বা রাত্রিতে… কোন কোন দিন তো পরদিন সকালে হকারেরা এসে হাজির হত… টাটকা সংবাদের মজাই আলাদা… কিন্তু রাজশাহীবাসী সেই স্বাদ থেকে বঞ্চিত… আমি তো ভোরে নিয়মিত বিবিসি শুনতাম… ৬.৩০ থেকে ৬.৫০… তারপর আকাশবানী কলকাতা… ৬.৫০ থেকে ৭.০০… আর বাংলাদেশ বেতার ৭.০০ থেকে ৭.১০… কোন কোন দিন রেডিও অস্ট্রেলিয়া বা ডয়েস ভেলে… মাথায় বুদ্ধি এল প্রতিদিন সকালে এক পাতার হাতে লেখা কাগজ বের করলে কেমন হয়??? যা ভাবা, তাই কাজ… বন্ধুদের বললাম… সবাই সোৎসাহে রাজি… মূল দায়িত্ব আমার… রাজশাহীর খবর আমরা আগের রাতেই সংগ্রহ করে ফেলতাম… আমাদের স্কুলের বা রাবির কোন মজার সংবাদ… খেলার খবর… ক্যাম্পাস লীগ বা আন্তঃবিভাগ বা রাজশাহী স্টেডিয়ামের খবর যার দায়িত্ব পাপ্পু, মিলাল বা সোজনের… সেদিনের খেলার ফিক্সচার… বাংলাদেশ বেতারের খবর শুনতে শুনতেই স্ক্রিপ্ট তৈরি… ৭.১০ এ বন্ধুরা সব একসাথ… কয়েকজন বসে শেষবারের মত চোখ বুলিয়ে কিছু সংযোজন বিয়োজন করে হাতে হাতে লিখে ফেলা… তখন তো ফটোকপির নামই শুনি নি… আমি, পাপ্পু, মিলাল, সোজন… কোন কোন দিন টিয়াজও হাত লাগাত আমাদের সাথে… তারপর ছুটে পড়া সেগুলো বাসায় বাসায় বিলি করার জন্য… আমি দূর্বল মানুষ বলে আমার দায়িত্ব ছিল শুধু আমার ফ্ল্যাটে বিলি করার… বাকিরা সবাই নামকরা এথলিট… ওরা ছুটত ক্ষিপ্রগতিতে… ভোরে আবার স্কুলে যেতে হবে যে… কী প্রাণচাঞ্চল্য??? ক্যাম্পাসে বেশ সাড়া জাগিয়েছিল আমাদের এই হাতে লেখা সংবাদপত্র। আমরা কারো কাছে কোনদিন পয়সা চাই নি… যে যা দিত তাই নিতাম… অন্তত কাগজ কেনার পয়সাটা তো লাগত… অনেকে কিছুই দেয় নি, ঠাট্টাও করত… কিন্তু তাতে কি দমে আমাদের উদ্যম… অনেক সময় স্কুলের জন্য বরাদ্দ কাগজ ব্যবহার করে ফেলতাম… পাপ্পু বরাবর দরাজ দিল… ওই বেশি পয়সা দিত… কিন্তু আমার খুব খারাপ লাগত… আমারও তো একটা দায়িত্ব আছে… কিন্তু পয়সা??? তখন তো হাত খরচ বলে কিছু যে আছে তাই জানতাম না… বাসা থেকে টিফিন নিয়ে স্কুলে যেয়ে খেতাম… খুব জোর জবরদস্তি করে কোনদিন ৫ পয়সার পানির বা ১০ পয়সার দুধের(?) আইসক্রিম। বিলাসিতা বলতে এটুকুই… তাহলে??? এক বন্ধু বুদ্ধি দিল বাবার পকেট… সে কেবল ধুমপানে মুখেখড়ি দিয়েছে… অর্থের উৎস ওই একটাই… কিন্তু আমার বাবা যা অসহ্য… ভোরে উঠেই ক্লাসে যায়… বিকেলে বাজার… কোনদিন ক্লাবেই যায় না… পকেট সাফাই করব কিভাবে??? একদিন মোক্ষম সুযোগ এসে গেল… আমার ছুটি… বাবার বিভাগে ভাইভা… চলবে বিকেল পর্যন্ত… বাবা সারাজীবন পাঞ্জাবি পরা মানুষ… একদিনের জন্যেও তাকে শার্ট বা স্যুট পরতে দেখিনি… ঝুল পাঞ্জাবি… সেদিন খুব দরকার টাকার… কাগজ শেষ… ১/২ টাকা হলেই যথেষ্ট… সকাল থেকেই বাবার ঝুল পাঞ্জাবিটা খুব আকর্ষণ করছিল আমাকে… আশেপাশে ভাল করে দেখে নিলাম… কেউ নেই… নাহ, বাবার পকেটে কেবল কাগজ… আর কাগজ… অবশেষে হাতে এল ২ টি এক টাকার নোট… মিশন একমপ্লিশড ভাব নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই সামনেই দেখলাম মূর্তিমান যমদূত আমার মা… প্রথমে হাতের পাখা… তারপর বিছানা ঝাড় দেওয়া ঝাঁটা… না, শাস্তি সেখানেই শেষ হল না… এবার আমাকে ঢোকানো হল বেড রুমের পাশেই বক্স রুমে… যেখানে মাসের চাল ডাল আর বাক্স পেটরা থাকে… ছোট্ট একটা দম বন্ধ করা ঘর… তারপর মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধা হল আমার পা… আর হাত বাঁধা হল জানালার গ্রিলের সাথে… শাস্তি কঠোর হবার মূল কারণ আমার মাতুল কুলে তখন কেউ কেউ পয়সা চুরি করে সিগারেট খাওয়া শুরু করেছে… আর ‘নরনাং মাতুলক্রম’… সেই সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কাটল আমার বন্দী জীবন… না, কিছু খেতেও দেওয়া হয় নি… চোরের আবার ক্ষুৎ পিপাসা কি?… এমন কি বাথরুমেও যেতে দেওয়া হয় নি… সন্ধ্যায় বাবা বাসায় ফেরার পর মুক্তি মিলেছিল… তখন হাত পায়ে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে… দড়ির দাগে হাত কেটে রক্ত জমাট… পরদিন আর স্কুলেই যেতে পারি নি… বন্ধুদের কোনদিন এই কথা বলি নি… এবার রাজশাহীতে যেয়ে মা কে বললাম, মনে পড়ে সেই কথা… এক গাল হাসি হেসে বলল যে বদ ছিলি, এগুলো না করলি কি মানুষ হতি? এত কিছুর পরেও সেই শখের সাংবাদিকতা চালিয়ে গিয়েছি… পরে রাজশাহী থেকে সোনার দেশ বেরুল… এল দৈনিক বার্তা… আমাদের প্রয়োজন ফুরোল…
সাংবাদিক হবার স্বপ্ন অপূর্ণ থাকায় মা র ওপর মনে মনে কত যে রাগ করেছি… তার কোন ইয়ত্তা নেই। স্বপ্নভঙ্গের বেদনা কেবল সেই বোঝে যে এর ভেতর দিয়ে গিয়েছে… তবে এখন আমার সাংবাদিক বন্ধুদের দুরবস্থা দেখে মনে হয়, মা সেদিন হয়তো ঠিক কাজটিই করেছিল…
*আকাশবাণী
যখন মানুষ সৎ পুলিশ হবার স্বপ্ন দেখবে, শখ করে সৎ পুলিশ হবে...তখন হয়তো দিন পাল্টাবে............
~
মায়েরা এমন ই।।
===============
ইমনদা ব্লগে কী একটু নিয়মিত হওয়া যায়? পোস্ট দিয়ে চলে যান ব্লগারেরা কমেন্ট করে কিন্তু আপনার উত্তর পায় না। ব্যাপারটা কেমন জানি দেখায়। মাস্টররে উপদেশ দিলাম
রাসেল, আমি নিজেও লজ্জিত। এ কারণে।। কিন্তু পেশাটাই এমন যে এটুকু সময় বের করতেই হিমশিম অবস্থা!
পড়ে ভালো লাগলো।সাংবাদিকদের ভূমিকা সমাজের জন্য অপরিহায। http://www.daffodilvarsity.edu.bd/jmc/index.php
Journalists are the eyes of the general public. It is good that now a days studying journalism is available at private universities. Such as http://www.daffodilvarsity.edu.bd/jmc/index.php
মাকে রোজ সালাম করবেন, ঠিক কাজটি করার জন্য
প্যাশন কে পেশা বানানোর সৌভাগ্য আমাদের দেশে খুব কম মানুষেরই হয়।
লেখা ভাল হয়েছে। ভাল থাকুন, লিখতে থাকুন।
প্যাশন কে পেশা বানানোর সৌভাগ্য আমাদের দেশে খুব কম মানুষেরই হয়।
লেখা ভাল হয়েছে। ভাল থাকুন
ধন্যবাদ সবাইকে!
মন্তব্য করুন