পথ চলা
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষকতার শুরুটা ছিল স্বপ্নের মত। বিভাগ আমার প্রতি যে আস্থা রেখেছিল তার প্রতিদান দিতে পারব কি না সেই চিন্তায় সবসময় অস্থির থাকতাম। আমাকে প্রথমেই পড়াতে দেওয়া হল মাস্টার্সে Order Statistics. ক্লাসের সবাই বন্ধুস্থানীয়। আমার কোন কোন সহপাঠী যারা যে কোন কারণেই হোক না কেন একটি বছর খুঁইয়েছে, তারা আছে সেখানে। তাদের সাথে তুই তোকারি সম্পর্ক। আছে মামুন আপনের মত আপন জন। দু’ একজন বড় ভাইও আছে। ওরা ক্লাসে বলত স্যার, বাইরে ভাই বা দোস্ত। মহা ফ্যাসাদ। আমাদের বিভাগের অন্যতম কৃতী শিক্ষক প্রফেসর রেজাউল করিম মামুন (যাঁর একটি গ্রন্থ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় প্রকাশন Springer-Verlag থেকে প্রকাশিত হয়েছে) সেই যে আমাকে স্যার বলা আরম্ভ করল যা অদ্যাবধি বহাল আছে। প্রথম বর্ষে পড়াতে দেওয়া হল Probability. আমি ছাত্র থাকাকালীন এই কোর্সে ভাল করি নি, তাই কোর্স দেবার সময় মনোয়ার স্যার বললেন
তুই তো probability কিছুই জানস না, দেখ পড়াতে পড়াতে কিছু শিখতে পারস কি না।
এই কোর্স পড়াতেন খোদ মনোয়ার স্যার এবং আমাদের বিভাগের সর্বকালের অন্যতম সেরা শিক্ষক প্রফেসর এমাদউদ্দিন চৌধুরী। তাঁদের যায়গায় আমি? আমি তো প্রমাদ গুনলাম। কিন্তু মনোয়ার স্যারের কথার ওপর কথা বলবে কে? চমৎকার একটি ব্যাচ পেয়েছিলাম প্রথম বর্ষে। এদের মাঝে আব্দুল খালেক এখন বিভাগের শিক্ষক, ড নাসিম আছে বিভাগে, আবু ইউসুফ সরকার রিপন সুনামের সাথে কাজ করছে আইসিডিডিআরবিতে, হাফিজ পপুলেশন কাউন্সিলে। নুরুন্নবী পিয়াল অস্ট্রেলিয়াতে গবেষণারত… আরো অনেকেই সফল…
প্রথম দিন হাত পা নিশ্চয়ই কেঁপেছিল একটু। তবে বরাবরই তো চাপাবাজিতে পটু, প্রথমদিন তাই চাপাবাজি সম্বল করলাম। সেদিন আবার ক্লাসে হাজির হয়েছিল আমার ছোট ভাই রবিন। ও সে বছর ইংরেজিতে ভর্তি হয়েছে। ক্লাসে গেছে তামাশা দেখতে। প্রথমদিন, কেউ তো কাউকে চেনে না। ক্লাস শেষে ছেলেদের জিজ্ঞেস করেছে স্যারটা ভুয়া না কি? তবে সবাই নাকি উপভোগ করেছে আমার চাপাবাজি। বাসায় এসে রায় দিল, দাদা, ১০০ তে ১০০। ভরসা পাই কি করে, হাজার হোক মায়ের পেটের ভাই!
দ্বিতীয় বর্ষে প্র্যক্টিক্যাল করাই রাজ্জাক স্যারের সাথে। স্যার খুব মেধাবী মানুষ, সঙ্গত কারণেই আমাকে মিডিওকার ভাবতেন। সম্ভবত আমার নিষ্ঠার কারণেই পরে কিছুটা প্রসন্ন হয়েছিলেন এবং এক পর্যায়ে পুরো ক্লাসের দায়িত্ব আমার ওপরেই ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমার সহকর্মী ড প্রভাষ, ড দিলীপ ছিল এই ব্যাচের ছাত্র। দায়িত্ব পড়ল তৃতীয় বর্ষে ব্যবহারিক ক্লাস নেবার। সেখানে অবশ্য পুরো দায়িত্বই আমার। শফিকুল ইসলাম সন্টু, ড মাহমুদুল আলম সেই ব্যাচের ছাত্র। এর কিছুদিন পর ঐ বর্ষের Stochastic Processes পড়ানোর দায়িত্বও পড়ে আমার ওপর। ব্যাপারটা এমন হয়ে দাঁড়ালো যে যেখানে যে কোর্স ফাঁকা হয় সেখানেই আমি। এক পর্যায়ে ক্লাসের পরিমাণ দাঁড়ালো সপ্তাহে ২৭ ঘন্টা! এখন তো দেখি ১২ ঘন্টা লোড পড়লেই অভিযোগের অন্ত নেই। সত্যি প্রাণান্ত অবস্থা। সিনিয়র স্যাররা পর্যন্ত একদিন মনোয়ার স্যারকে বললেন
ইমনের লোড খুব বেশি, একটু কমানোর দরকার।
স্যার বললেন, কেন? ও তো খালি খায় আর ঘুমায়। এখন শেখার সময়। কাজ করুক।
শুধু কি তাই। স্যার যখন তখন ডেকে পাঠাতেন। সিলেবাস, বইএর তালিকা, ক্যটালগ দেখে নতুন বইয়ের অর্ডার দেয়া। আজ যে বই আমেরিকা বা ইংল্যান্ডে প্রকাশিত হচ্ছে ৩/৪ মাসের মধ্যেই তাঁর সেই বই চাই। ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যেত তাঁর ঘরে। তার সাথে যুক্ত হয়েছিল উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখালেখির তাগিদ। তখন ইন্টারনেট তো দুরের কথা, কম্পিউটারই ছিল না বললে চলে। ভরসা আদ্যিকালের পুরনো কমনওয়েলথ ইয়ার বুক। একগাদা পয়সা খরচ করে ৩ টা চিঠি দিলে জবাব মেলে একটার। তাও আবার কখনো কখনো ৬ মাস পর অফিস থেকে জবাব আসে উনি ২ বছর আগে মারা গেছেন বা ৪ বছর আগে অন্য কোথাও চলে গেছেন। চিঠি না লিখে যে বলব লিখেছি সে উপায়ও ছিল না, প্রতিটি চিঠির ড্রাফট তাঁকে দেখাতে হত। স্যার যতক্ষণ বিভাগে থাকতেন ততক্ষণ আমার নিজের কোন কাজ হত না।
পিওনরা এসে বলত
স্যার, বড় স্যার সালাম দিসেন।
স্যারের সালাম ছিল আমার কাছে আতংকের অপর নাম।
এতগুলো ক্লাসের চাপ। ছাত্রজীবন তো পার করেছি ফাঁকি দিয়ে, বুঝি বা না বুঝি একরকম লিখে দিয়ে পরীক্ষা পাস, কিন্তু এভাবে তো পড়ানো চলে না। নিজে না বুঝলে বোঝাব কি করে? সকাল ৭ টা সাড়ে ৭ টায় বাসা থেকে বেরোতাম, ফিরতাম রাত ৯ টায় বা তারও পরে। আমার সাথে অন্য বিভাগে জয়েন করা বন্ধুরা ততদিনে ক্লাব কালচার রপ্ত করে ফেলেছে। ৫ টা বাজলেই ক্লাব, ক্যারাম, টেবল টেনিস, তাস, আড্ডা… আর ক্লাব আমার কাছে ধন্য আশা কুহকিনী… কোথায় গেল বিকেল বা সন্ধ্যার সেই টিনশেডের আড্ডা! বন্ধুরাও ভুল বুঝতে আরম্ভ করল… শালা, ভাব দেখাস? আর কেউ বুঝি মাস্টার হয় না? পরিস্থিতি এমন হল যে মা পর্যন্ত টিকটিকি লাগাল আমার পেছনে, সত্যি বিভাগে পড়াশনা করছি না গোপনে কোন মেয়ের সাথে প্রেম করছি। ছেলেকে মায়ের থেকে বেশি আর কে ই বা চেনে?
তবে আমার ছাত্রছাত্রীরা ঠিকই জানত আমি কোথায় কি করি। পিয়াল প্রায়ই আসত সন্ধ্যার পর। আমি কাজ করতাম, ও চুপ করে বসে থাকত। পরে বুঝেছিলাম রাত বিরোতে আমার যদি কোন অসুবিধা হয় এটা ভেবেই সে আসত। এর মাঝেই ঘটল এক মজার ঘটনা। একদিন রাতে আমার ছাত্রছাত্রীই বলি বা ছোট ভাইবোনই বলি, পিন্টু আর লাবনী আমার অফিসে এসে হাজির।
কি ব্যাপার, এত রাতে?
পিন্টু বলল ইমন ভাই, আমরা আজই বিয়ে করেছি। আপনিই প্রথম ব্যক্তি যার কাছে আমরা দোয়া চাইতে এসেছি।
আমি তো বিস্ময়ে অভিভূত! এই ভালবাসা, সম্মান আমি কোথায় রাখি? ওরা সাথে করে অনেক খাবার এনেছিল, অফিসে বসে সবাই মিলে মজা করে সেই খাবার খেলাম। ২০ বছর পর এবারে বিভাগের সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠানে পিন্টু-লাবনীর সাথে আবার দেখা… সাথে প্রজ্ঞা-প্রাঞ্জল নামের দুটি দেবশিশু! মনটা যে কী এক অনাস্বাদিত আনন্দে ভরে গেল তা ভাষায় প্রকাশ করার নয়।
কোন কোন সময় কাজের চাপ সত্যি গলায় ফাঁসের মত চেপে বসত। স্যারের ওপর রাগও হত প্রচন্ড, যদিও বুঝতাম উনি যাই করুন না কেন আমার মঙ্গলের জন্যেই করেন। এমনি এক সকালে কেবল ক্লাস থেকে ফিরেছি ঠিক তখনই আমাদের বিভাগের প্রবীণতম পিওন দিলবর ভাই এসে বললেন,
স্যার, বড় স্যার আপনাকে সালাম দিসেন।
কেমন লাগে? মনটা খিঁচড়ে গেল। উনাকে বললাম,
ঠিক আছে, স্যারকে গিয়ে বলেন আমি আসছি।
দিলবর ভাই কিন্তু দাঁড়িয়েই রইলেন। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
কিছু বলবেন?
দিলবর ভাই আমার খুব কাছে এসে বললেন,
স্যার, আপনার হাতটা একটু ধরি?
আমি তো হতবাক,
কেন?
উনি বললেন, স্যার আমি ৪০ বছর বড় স্যারের সাথে আছি, স্যারের বিয়েরও আগে থেকে। এমন ঘটনা আমি কোনদিন দেখিনি।
বললাম- কি?
উনি বললেন বড় স্যার আমাকে ডেকে বললেন, যা, আমার স্যারকে সালাম দে।
আপনার স্যার???
হ্যাঁ, ডিপার্টমেন্টে তো আমার একটাই স্যার, ইমন, যা ওকে আমার সালাম দে।
আমি স্থানুর মত দাঁড়িয়ে রইলাম। এও কি বিস্বাসযোগ্য!!! যার মুখে গালমন্দ ছাড়া কখনো ভাল কথা শুনি নি, এই কদিন আগেও যিনি আমাদের বিভাগে পরীক্ষা নিতে আসা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন এই বলে যে
‘এই গাধাটা কয়দিন আগে আমার ডিপার্টমেন্টে জয়েন করসে’
তাঁর মুখে এই কথা? দিলবর ভাই বানিয়ে বলছেন না তো? কিন্তু কেন বলবেন, এতে তার কী লাভ?
উনার সাথে হেঁটে এলাম। দিলবর ভাই আগে ঢুকলেন আমারই অনুরোধে।
স্যার বললেন, কি রে আমার স্যারেরে পাইলি?
আমি ঠিক তার পরপরই সালাম দিয়ে ঘরে ঢুকতেই স্যার রেগে অগ্নিশর্মা…
কাজ করতে ইচ্ছা করে না??? এইটুকু পথ আসতে এতক্ষণ লাগে??? কিসসু হইবো না তর জীবনে…
পরের পর্বের অপেক্ষায়।
==============
সাথে আশপাশ মানে রাজনীতি কু-নীতি নিয়েও আপনার মুল্যায়ন চাই ইমনদা
পড়েছি...
চলুক...
লেখাটা অনেক মজা করে পড়লাম
অনেক ভালো লেগেছে
পরের লেখার অপেক্ষাতে থাকলাম
পথচলার আগামী পর্বের অপেক্ষায়
ভালো লাগছে আপনার সিরিজ, পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম
পড়ছি...চলুক
~
আপনার ডিপার্টমেন্টের জামাত-শিবির-রাজাকারগুলার ব্যপারে কিছু বলুন।
মীর, আমার আগের লেখাতেই বলেছি যে জামাতিরা শক্তের ভক্ত, নরমের যম। আমার বিভাগে ওদের ক্ষমতা খুব কম থাকায় সামনাসামনি কিছু করতে সাহস পায় নি, যা করেছে নেপথ্যে। আসবে সেসব কথা পরে।
শেষ টা অনেক ভাল লাগলো পড়তে।
চলুক..
পরের পর্বের অপেক্ষায়।
মন্তব্য করুন