ইউজার লগইন

যাত্রা হল শুরু

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আমার সম্পর্ক কি?

মায়ের সাথে সন্তানের যে সম্পর্ক ঠিক তাই, এই বিশ্ববিদ্যালয়, পরিসংখ্যান বিভাগ আমাকে দু'হাত উজাড় করে দিয়েছে। বরং এই অধম সন্তানই পারেনি তার যথোপযুক্ত প্রতিদান দিতে।

’৯২ এর মে মাস, পাশ করেছি মাস তিনেক।বাবা অবসরে,গুরুতর অসুস্থ, প্রাণ সংশয়, ঘরে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই ভাই, বোনটা স্কুলে। দারিদ্র্যের কষাঘাত কাকে বলে তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। সমানে প্রাইভেট পড়াচ্ছি। কিন্তু কারো কাছ থেকেই পয়সা নিচ্ছি না, এটা যে আমার নীতি বিরুদ্ধ।

স্বপ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার। কিন্তু কবে নিয়োগ হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই।

হটাৎ করেই সিরাজগঞ্জে একটি এনজিওতে চাকরির আমন্ত্রণ পেলাম। ভালো বেতন, না করার মত অবস্থা নেই আমার। ৩১ মে, শুক্রবার, সিরাজগঞ্জ যাবার প্রস্তুতি হিসেবে সকালে কাজলা বাজারে গিয়েছি টুকিটাকি কিছু প্রয়োজনীয় কেনাকাটা সারতে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সবতো বাড়িতে থেকেই, বাইরে থাকার কোন অভিজ্ঞতা নেই। কিছুটা উদ্বিগ্ন, কিন্তু তার থেকে অনেক বেশি রোমাঞ্চিত।

হটাৎ মনোয়ার স্যারের সাথে দেখা, স্বভাবসুলভ বক্রোক্তি করলেন,'' সাত সকালে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াচ্ছিস?''
বললাম, ''স্যার কাল সিরাজগঞ্জ যাচ্ছি।''
'' কেন?''
'' চাকরির ব্যাপারে।'' একগাদা মানুষের সামনে স্যার পারেন তো আমাকে মারেন। ক্রোধে অগ্নিশর্মা। “তোরে লেখাপড়া শিখাইসি এনজিওতে চাকরি করার জন্য?” আমি কোনমত পালিয়ে বাঁচলাম।

বিকেলে টিনশেড স্কুলের মাঠে ছোটবেলার সাথীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এলাম। এনাম, আজাদ, তুষারের চোখে জল, কিন্তু বাস্তব তো এমনই নির্মম।

সন্ধ্যায় বাসায় ফিরতেই মা বললেন তোদের চেয়ারম্যান স্যার এসেছিলেন। একটা কাগজ রেখে গেছেন আর ওটা নিয়ে আজ রাতেই উনার সাথে দেখা করতে বলেছেন। আমাদের চেয়ারম্যান প্রফেসর কোরবান আলী স্যার। তিনি আসবেন আমাদের বাসায় এটা তো সপ্তাশর্য ঘটনা!!! কাগজটা হাতে নিয়ে দেখি স্যারের নিজের হাতে লেখা চাকরির আবেদনপত্র। বিভাগে এডহক ভিত্তিতে নিয়োগের আবেদন পত্র। স্যার আমার নামটি পর্যন্ত লিখে দিয়েছেন। স্বাক্ষরের জায়গাটি মার্ক করে দিয়েছেন। আমার কাজ কেবল সই করা।

আমি তো নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছি না। স্যার জামাতের শীর্ষস্থানীয় নেতা, আর আমি তো হাটে মাঠে ঘাটে রাজনীতি করা ছেলে। তখনও মুক্তিযুদ্ধ চর্চা কেন্দ্রের নির্বাচিত সভাপতি।

যা হোক, গেলাম স্যারের বাসায়, সেই প্রথম, সেই শেষ। স্যার বললেন তুমি ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যাচ্ছ শুনে হেডস্যার (মনোয়ার স্যারকে প্রায় সবাই ঐ নামেই ডাকতেন) খুব রাগ করছেন। এই ছুটির দিনেও আমাদের সবার সাথে যোগাযোগ করে ভিসির সাথে কথা বলে এই ব্যবস্থা করেছেন।

তুমি কাগজটা সই করে আমাকে দিয়ে যাও আর কাল সকালে এসে জয়েন কোর। আমার কাছে তখনো সব কিছু স্বপ্নের মত। এও কী সম্ভব!!! একটা চাকরির জন্য মানুষকে কত ছোটাছুটি করতে হয়!!!

আমি সকালে বিভাগে যাই নি, কখন যাব, কিভাবে যাব, কাকে কী বলব, এইসব সাত পাঁচ ভাবছি।

এমন সময় সকাল এগারটার দিকে শিক্ষক সমিতির সভাপতি আমিনুল হক বেগ স্যার এলেন বাসায়, সাথে কাদের ভুঁইয়া স্যার। বাবার সাথে দেখা করে বললেন যে ইমনকে আজকেই জয়েন করার জন্য চিঠি সই করেছিলেন ভিসি, কিন্তু এখন সামার ভ্যাকেশন চলছে, ছুটির মধ্যে জয়েন করা ভাল দেখায় না, তাই ও একমাস পর অর্থাৎ ১ জুলাই থেকে জয়েন করুক। কাদের ভুঁইয়া স্যার আমার হাতে এপয়েনমেন্ট লেটারটি দিলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় আশীর্বাদের হাত বুলিয়ে দিলেন।

আমরা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম। বেগ স্যার তাঁর ব্যাগ থেকে একটি খাম বের করে বাবার হাতে তুলে দিলেন।

'' কী এতে?''

ইমন যেহেতু একমাস পর জয়েন করবে তাই এটা ওর একমাসের বেতন,যেহেতু বেতন হিসেবে দেওয়া যাচ্ছে না তাই শিক্ষক-কল্যাণ তহবিল থেকে এটা দেওয়া হচ্ছে বাবাকে। বাবা তো হতভম্ব… দুই হাত জোড় করে বেগ স্যারকে বললেন ''আমার আজকের এই আনন্দটা কি আপনি এভাবে নষ্ট করে দিতে চান?''
বেগ স্যারও নাছোড়বান্দা। শেষ পর্যন্ত ভুঁইয়া স্যার ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন।

একটু হেসে বেগ স্যারকে বললেন আগেই না আপনাকে বলেছিলাম মোল্লা ভাইকে এটা দেওয়া যাবে না।

মা বলেছিলেন একটু মিষ্টি নিয়ে মনোয়ার স্যারের সাথে দেখা করতে। কিন্তু ঘাড়ে মাথা তো একটিই। সাধ করে বাঘের গলায় কে তা ঢোকায়???

বিভাগেই স্যারের সাথে দেখা করলাম। অন্য স্যারদের সাথেও দেখা করলাম। সবাই খুব খুশি। শ্রদ্ধেয় মরহুম মোস্তফা স্যার তো বাসায় এসে বাবার সাথে দেখাও করে গেলেন।

এলেন মনোয়ার স্যার, ম্যাডাম, রাজনীতির জটিল কুটিল খেলার কিছুই অনুভব করতে পারলাম না, অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্র ক্ষণ… ১ জুলাই, ১৯৯২… শুরু হল এক অন্যরকম পথ চলা…

পোস্টটি ১৫ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

রাসেল আশরাফ's picture


যাত্রা শুভ হোক ইমন দা। শুরু যেহেতু করেছেন শেষ কিন্তু করতে হবে।
আমরা বন্ধুতে স্বাগতম।
=============
অফট পিকঃ সবাইকে একটু জানিয়ে রাখি ইমন দা আমার মতো আরো অনেকের অনুপ্রেরণার উৎস। ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল।

ভাস্কর's picture


যখন সাংগঠনিক রাজনীতি করতাম তখন সংগঠনের রা.বি. শাখার বেশ কিছু কর্মকাণ্ডে কেন্দ্রীয় দায়িত্ব পালন করতে হইছে। তার অভিজ্ঞতায় জানি ইসলামী ছাত্র শিবিরের কর্মী খুনের মামলার প্রধান আসামী হইলেও শিক্ষক হওনের রেইসে চইলা আসছে ৯১ থেইকা ৯৬'এর প্রথম ভাগ পর্যন্ত। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের জামায়াতি শিক্ষক আপনেরে এমন যাইচা পইড়া শিক্ষক বানাইতে নামছে জানতে পাইরা একটু চমকাইলাম। এর পেছনের কারণ কি একাডেমিক রেজাল্ট? নাকি অন্য কিছু জানতে ইচ্ছা করতেছে...

হ্যাপি ব্লগিং!

রহমতউল্লাহ ইমন 's picture


জামাতিরা শক্তের ভক্ত, নরমের যম। দেখেন না, যুদ্ধপরাধীদের বিচার শুরুর আগেই কেমন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মেতে উঠল। আসলে আমাদের বিভাগের পুরো কতৃত্ব ছিল মনোয়ার স্যারের হাতে। আমার ধারনা উনি জানতেন যে চেষ্টা করেও আমার নিয়োগ ঠেকাতে পারবেন না। তাই গুড বুকে নাম তোলাই ভাল। কথা তো শেষ হয় নি এখনো। বিশ্ববিদ্যালয়ে কদর্যতার কত ঘটনার নীরব সাক্ষী আমি। একদিন তুলে ধরব সেসব। আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

রহমতউল্লাহ ইমন's picture


***********

রহমতউল্লাহ ইমন's picture


*******************৮

হাসান রায়হান's picture


ভালো লাগল আপনার চাকরি পাওয়ার কাহিনী।

সাঈদ's picture


অবিশ্বাস্য । ভালো লাগলো।

শওকত মাসুম's picture


ভাস্করদার প্রশ্নটা আমারও।
স্বাগতম এখানে

প্রিয়'s picture


ইস এরকম কোন ঘটনা যদি আমার লাইফেও ঘটতো!

১০

মীর's picture


জামাতে টিচার বিএনপি'র আমলে মুক্তিযুদ্ধ চর্চা কেন্দ্রের সভাপতিকে বাসায় গিয়ে নিয়োগপত্র দিয়ে এসেছেন, শুনে খটকা লাগলো। এখন এটা একেবারেই যাকে বলে অচিন্ত্যনীয়!
যাক এবি'তে Welcome
ব্লগিং শুভ হোক। আপনি এখন কি শিক্ষক রাজনীতির সঙ্গে জড়িত?

১১

তানবীরা's picture


Welcome

আপনার গল্পের বাকি অংশটুকু জানতে আমরা সবাই অধীর

১২

রহমতউল্লাহ ইমন's picture


ভাস্কর, শওকত ও মীরকে অনেক ধন্যবাদ তাঁদের প্রশ্নের জন্য। আসলে মনে এমন প্রশ্ন না আসাটাই অস্বাভাবিক। জামাত-শিবির আসলেই গভীর জলের মাছ। সেই '৭১ এই যাদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার কথা ছিল তারা আজো এদেশে তাদের অবস্থান টিকিয়ে রেখেছ কিভাবে? এমনি নানা কূটকৌশলে। যে যাই বলুক, ওরা শক্তের ভক্ত, নরমের যম। যুদ্ধপরাধীদের বিচার শুরুর আলামত দেখেই তারা বংবন্ধুর স্তুতি আরম্ভ করে দিল, এটা নিশ্চয়ই আপনারা বিস্মৃত হন নি। আমাদের বিভাগে তখনো মনোয়ার স্যারের নিরঙ্কুশ কতৃত্ব। তারা জানত যে আমার বিরোধিতা করে তারা আমার নিয়োগে বাধা দিতে পারবে না। তাই গুড বুকে নাম লেখানোই ভাল। যা লিখেছি তা পথচলার সূচনাপর্ব, কিন্তু এই চলার পথ সবসময় মসৃণ ছিল না। নানা কদর্যতার শিকার হতে হয়েছে, সাক্ষী হতে হয়েছে, আসবে সেসব কথা। আমি অঙ্কের মানুষ, ভাষা নিয়ে কখনো কোন চর্চা করি নি। তারপরেও যেসব বন্ধু আমাদকে উতসাহ দিয়েছেন তাঁদের প্রতি রইল অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।

১৩

রহমতউল্লাহ ইমন's picture


আমি মন্তব্য করতে পারছি না কেন?

১৪

লীনা দিলরুবা's picture


Welcome

আপনার আরো গল্প শোনান।

১৫

রহমতউল্লাহ ইমন's picture


ভাস্কর, শওকত আর মীরকে অনেক ধন্যবাদ তাঁদের মন্তব্যের জন্য। আসলে আমার লেখা পড়ে মনে অমন প্রশ্নের উদয় না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। জামাতিরা গভীর জলের মাছ। সেই '৭১ এই তো তাদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার কথা ছিল, অথচ আজও তারা বহাল তবিয়তে টিকে আছে এমন নানা কূটকৌশল অবলম্বন করে। এরা শক্তের ভক্ত, নরমের যম। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার আভাস পেয়েই কেমন বঙ্গবন্ধুর স্তুতি আরম্ভ করে দিল। এখন আবার চুপ। আসলে তখনো আমাদের বিভাগে মনোয়ার স্যারের নিরঙ্কুশ কতৃত্ব। উনারা জানতেন যে বিরোধিতা করেও আমার নিয়োগ ঠেকিয়ে রাখা যাবে না, তাই গুডবুকে নাম রাখাই ভাল। যা লিখেছি তা তো পথ চলার শুরুর কথা। পথ চলতে গিয়ে পদে পদে নানা কদর্যতার শিকার হয়েছি, সাক্ষী থেকেছি, সময় পেলে একদিন লিখব সে সব কথা। আমি অঙ্কের মানুষ। কখনো সাহিত্য চর্চা করি নি, ভাষাজ্ঞানও খুব দুর্বল। তবু যে সব বন্ধু লেখা পড়ে মন্তব্য করেছেন, উৎসাহ যুগিয়েছেন, তাঁদের সবার প্রতি রইল আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা!

১৬

বিষণ্ণ বাউন্ডুলে's picture


অসংখ্য শুভকামনা।

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.