পালাই পালাই
অস্থির, উদ্দাম, সিদ্ধান্তহীনতা, নিজেকে নিজের অপছন্দ, মনের বিরুদ্ধে পড়ালেখা সব মিলিয়ে ১৯৯৯ সালটা আমার জন্যে অদ্ভূত একটা সময়। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে হবে এই সংকল্প আমাকে এমন এক বিষয় পড়তে বাধ্য করলো যা পড়তে ভালো লাগে কিন্তু পরীক্ষার খাতায় আমার জন্যে আশানুরূপ নাম্বার যোগ বয়ে আনে না- সেই বিষয়ের নাম দর্শন।আমার মুখস্থ বিদ্যা বরাবরই শূন্যের কোঠায়। বন্ধুদের দেখেছি পাটীগণিত পর্যন্ত না বুঝলে মুখস্থ করে ফেলতে। আমি ব্যর্থ। না বুঝলে এক কলমও এগোতে পারি না। দর্শন পড়ি, ভালো লাগে পড়তে কিন্তু পরীক্ষার খাতায় আমি ২০ পৃষ্ঠা মুখস্থ উগড়ে আসতে পারি না। ফার্স্ট ইয়ারে আমার রেজাল্ট বলে দিচ্ছে আমি থার্ড ক্লাস নম্বর পেতে যাচ্ছি চলমান চার বছরে।সেই সম্ভাবনা পরবর্তীতে উৎপাটন করলেও ৯৯ সালে আমি আতংকে অস্থির।
কি করব কি করব না এমন ভাবার জন্যে আমার একটু একার সময় দরকার। ঢাকা শহরে থাকলে প্রাত্যহিক ব্যস্ততায় তা অসম্ভব। জুন মাস। প্রবল গরম, সাথে বৃষ্টিও মাঝে মাঝে আছে। এর মাঝে শুনলাম আব্বু অফিস ট্যুরে যাবে ১৯ তারিখে। খুলনা। আমি কখনো খুলনা যাইনি। খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল আর হার্ডবোর্ড মিল যেতে হবে আব্বুকে। আমাকে নিয়ে যেতে বললাম। ১৯ তারিখ সকালে বাসে করে রওনা দিলাম কোন বাস আমার খেয়াল নেই। শুধু মনে আছে অনেক সময় লাগলো খুলনা পৌঁছতে -সকালে রওয়ানা দিয়ে সন্ধ্যায় গিয়ে পৌঁছালাম। শহরটা দেখতে পেলাম না সন্ধ্যে হয়ে যাওয়াতে। কারখানার গাড়ী এসে আমাদের নিয়ে গেল গেস্ট হাউজে।
হায় কপাল...আমরা যাবার আগের দিন হরতাল কিংবা অন্য কিছু থাকাতে গেস্ট হাউজে কোন বাজার নেই, আমরা পেঁপেঁ ভাজি যা কারখানার বাউন্ডারির গাছে হয়েছে তা দিয়ে আর ডাল দিয়ে রাতের খাবার খেলাম।
চলছে বিশ্বকাপ, খেলা দেখতে দেখতে ১৯তারিখ রাতে ঘুমিয়ে গেলাম।
সকালে নাশতা খেলাম পেঁপেঁ ভাজি আর রুটি। খেয়ে বের হলাম আব্বুর সাথে। দুপুর পর্যন্ত আব্বু ফ্রি। তাই আমাকে নিয়ে বের হয়েছে রূপসা নদী দেখাবে বলে। আহা রূপসার কাছাকাছি যেতেই বৃষ্টি-ফেরীতে আমরা দাঁড়ানো নদীতে জলের টুপটাপ। এক এক ফোঁটা জল আরো বড় উৎসে হারিয়ে যাচ্ছে।আগের দিন আসার পথে পুরো রাস্তা শুধু সবুজের খেলা দেখেছি। এত সবুজ এ এলাকা। আরো সবুজের দিকে যাচ্ছি খান জাহান আলীর মাজারের দিকে যেতে যেতে। আব্বু মাজার জিয়ারত করবে। আমি মাজারের ভেতর ঢুকলাম না, বাইরে মানুষের কাজ কর্ম দেখতে লাগলাম। সে এক বিশাল দীঘি, তার ভেতর কুমীর। মোটামুটি রাজা বাদশাহর স্টাইলে দীঘির পাড়ে কুমীররা বসে আছে। কত বিচিত্র রকমের মানুষ মাথায় জটা লাল পোশাক নিয়ে আছে। একজন ভালো শাসক অনেক উন্নয়ন কাজ করেছেন, তার শেষ ঠিকানাকে মাজারে রূপান্তর, তা ঘিরে ব্যবসা-কি আসে যায়। বিশ্বাস তর্ক সব সাইডে রেখে স্থাপত্যশৈলী দেখায় মন দিলাম। এত কাছে এসেও ষাট গম্বুজ দেখতে পারলাম না। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে, আব্বু অফিসে যাবে।
দুপুরে পেঁপেঁ ভাজির সাথে কপালে আরেকটা আইটেম জুটলো ডিমভাজি। সন্ধ্যায় বয়রা গেলাম। বয়রা যেতে যেতে সিদ্ধান্ত নিলাম দর্শন পড়া আর সাহিত্য পড়া এক নয়। আমাকে ট্র্যাক চেঞ্জ করতে হবে।
২১ তারিখ সকালে শান্ত সমাহিত একটা ছিমছাম শহর দেখতে দেখতে আবার বাসে চড়ে বসলাম ঢাকা আসব বলে। আমার পালাই পালাই মন এত সংক্ষিপ্ত পলায়ন খুব কমই করেছে। কিছু না দেখে শুধু নিজেকে দেখে আমি ঢাকায় ঢুকে গেলাম সুন্দরবন খ্যাত এলাকার বুড়ি ছুয়েঁ।
সুখ স্মৃতি মনে করে করে লেখা বুঝিয়ে দেয় আগের মতই সুন্দর সময় কাটছে।
খুব ভাল লাগল লেখাটা।
সামছা আপু সময় এখন সন্তানে বন্দী মানুষের জীবন একটা সমন্বয়,মনের ভেতর ঘোরাঘুরি নিশিদিন...কত সহস্র ঘণ্টা কোথাও যাওয়া হয় না-অফিস বাসা বাসা অফিস, মনের কোণে অসহ্য এই শব্দের ফিসফিস নিয়ে না শোনার ভান করে চলাচল...
খান জাহান আলীর মাজারে আমার এক ভয়াবহ অভিগগতা আছে। আমি ওখানে সব ঘুরে ফিরে দেখছি, অভ্যাসবশত সালোয়ার কামিজ পরা, মাথায় কাপড় নাই। ওখানের খাদেম পারে নাই আমারে কুমীরের পুকুরে ফেলে দেয়।
(
একজন শাসক, আমাদের কাছে উপাসনার বিষয় হয়ে গেছেন মারা গিয়ে...বুঝলা না বিষয়টা!
মন্তব্য করুন