আমি ভুলে যাই তুমি আমার নও
তোমার সঙ্গে নৌকায় চড়ে ঘুরতে ইচ্ছে করতেসে। আর ইচ্ছে করতেসে সর্ষে, মটরশুটি ও আলুক্ষেতের আইল ধরে ধরে হাঁটতে। তিনটা ফসল কি একই সময়ে ওঠে? জানি না। যদি না ওঠে তাহলে তো আমার ইচ্ছেটা অপূর্ণই থেকে যাবে আজীবন। তাও ই্চ্ছেটাকে ভালবাসি আমি। কারণ ইচ্ছেঘুড়ির পিঠে চড়ে যে তোমার একটু কাছ থেকে ঘুরে আসতে পারি কল্পনায়।
আমার একটা ছবির মতো সুন্দর গ্রাম আছে। সেখানে আছে শতফুটি একটা বড়ই গাছ। তাতে কষটা স্বাদের বড়ই ধরে। সেটা আমার দাদার কবরের পাশে জানো? ছোটবেলায় বাবা যখন তার বাবার কবর জিয়ারত করতেন, আমি তখন সেই বড়ই গাছের নিচে বড়ই কুড়াতাম। বড় হয়ে বাবার সঙ্গে আমিও দাঁড়িয়েছি কবর জিয়ারতে। আমাদের ওই বড়ই গাছ লাগোয়া কবরস্থানটায় বসন্তে কোকিলের ডাক শোনা যায় সারাদিন। এই বসন্তে একবার যদি তোমায় সেখানে নিয়ে যেতে পারতাম, আমার মনটা আনন্দে ভরে যেতো।
তবে আমার গ্রামে নদী নেই। আছে নদ। কি দারুণ না? তোমার সঙ্গে আকাবাঁকা সেই নদে নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়াবো। আমার অনেক দিনের সাধ। নদটায় অনেক বাঁক আছে। নৌকায় চড়ে হারিয়ে যাওয়া তাই সহজ খুবই। আমি যখন শরৎবাবুর শ্রীকান্ত পড়েছি, তখন বারবার আমার চোখের সামনে ঐ নদটাই ভেসে উঠেছে। শ্রীকান্ত উপন্যাসে আমার প্রিয় চরিত্র ছিলো ইন্দ্র। অনেকদিন এমন কোনো প্রিয় চরিত্রের দেখা পাই না উপন্যাসে। হয়তো এখন আর কোনো উপন্যাসের চরিত্রকে সেভাবে ভালবাসার মনটা বেঁচে নেই।
আমাদের ভুতুড়ে বাঁশঝাড়টা দাদুর অনেক শখের ছিলো। ছোটবেলায় দেখতাম সেই বাঁশঝাড়ের একপাশে রয়েছে একটা ছোট আকৃতির গোয়ালঘর। সেখানে দু'টো গরু থাকতো। একটা ইয়া বিশাল গামলা সেট করা ছিলো গোয়ালঘরটার সামনে। সেখানে ভুষি আর পানি মিশিয়ে খাবার দেয়া হতো গরু দু'টোকে। দু'টোই নাকি ছিলো গাইগরু। দুধ দেয়া যাদের প্রধান কাজ। একটা খড়ের গাদাও ছিলো। দৌড়ে গিয়ে সেটার ওপর ঝাপিয়ে পড়া ছিলো আমার একটা প্রিয় কাজ। তখন আমি বোধহয় ক্লাস থ্রি-ফোরে পড়ি। সে সময় আমরা গ্রামে গেলে একটা ধুমধাম শুরু হয়ে যেতো চারিদিকে। অনেক দূর থেকে মানুষ আসতো আমাদের বাড়িতে। আমাদেরকে দেখার জন্য।
এখন বাঁশঝাড়টা ঝড়ো কাকের মতো টিকে আছে কোনোমতে। তবে গোয়ালঘরটা নেই। সেখানে একটা স্যানিটারী ল্যাট্রিন উঠেছে। কালের আবর্তে আমরা গরীবও হয়ে পড়েছি অনেক। আগের মতো গ্রামে গেলেই হই হই রই রই পড়ে যায় না আর। আমার ছোটবেলার মার্বেল খেলার বন্ধু শুক্কুর আলী এখন পুরোদস্তুর ফ্যামিলি-ম্যান হয়ে গেছে। তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না, ওর ১২ বছর বয়সী একটা ছেলে আছে। ব্যটা নিশ্চই বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছিলো, কি বলো? হিহি শুধু কি মেয়েরাই বাল্যবিবাহের শিকার হয়? ছেলেরাও তো দেখি রেহাই পায় না।
আমি স্বপ্ন দেখি আমাদের জীবনের কোনো একটা আনন্দময় পর্যায় কাটবে ঐ গ্রামের বাড়িটার মাটির ঘরে। পাটির বিছানায়। যেখানে পল্লীবিদ্যূতের সংযোগ থাকলেও রাত আটটার পর কেরোসিনের হারিকেনই একমাত্র ভরসা এখনো। যেখানে সন্ধ্যার পর বাইরে ক্রমাগত শোনা যায় ঝি ঝি পোকার টানা আর্তনাদ। যেখানে রাতে টয়লেটে যেতে হলে ভুতের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য একজন করে সঙ্গী নিতে হয় সঙ্গে।
আমার এ স্বপ্নগুলো আসলে অলীক। পার্থ বড়ুয়ার গান আছে, আমি ভুলে যাই তুমি আমার নও। কেন যে আমি মাঝে মাঝেই এই অমোঘ সত্যটা ভুলে যাই, কে জানে। সেদিন কবিগুরু এসে আমায় কানে কানে বলে গেলেন; মনে রাখিস, জীবনের ধন কিছুই যাবে ফেলা--ধুলায় তাদের যত হোক অবহেলা।
আমি তাই তোমার স্মৃতিগুলোকে যত্ন করে সাজাই। আমার মনের গহীনে কুঠুরীমতো একটা গোপন জায়গায় সেগুলো লুকিয়ে রাখি। কেউ কোনোদিন সেই জায়গাটা ছুঁতে পারে না। সেখানে যে কেবল তোমারই ছোঁয়ার অধিকার। জানি, জীবনের বাকি দিনগুলো সেই জায়গাটা অস্পর্শিতই রয়ে যাবে। আমি একদিন গিয়ে শুয়ে পড়বো ঐ বড়ই গাছটার নিচে। সাজানো স্মৃতিগুলো সঙ্গে নিয়েই।
---
পোস্ট মেসবাহ ভাইজানকে উৎসর্গিত
শিরোনাম কৃতজ্ঞতা: পার্থ বড়ুয়া
আপনার লেখাটা পইড়া আমারো এই ধরণের কিছু একটা লিখতে ইচ্ছা করতেছে...
জনাব, এই পোস্টখানা পড়িয়া অতীব সম্মানীত বোধ করছি। এই রকম চমৎকার স্মৃতি কাতরময়,স্বপ্নময় লেখা- যা আমারে উৎসর্গ করিয়াছেন... আমার বিশেষ কিছু বলিবার নাই... কৃতজ্ঞতা জানাই। পরম করুনাময় আপনাকে সব সময় এই রকম লিখিবার তৌফিক দান করুন...
লেখাটা পড়লাম। তওমার লেখা যতবারই পড়ি ততবারই মনে হয়, নর্থ বেঙ্গলঠেকে ঘুরে এলাম। এত পরিচিত মনে হয়, সব কিছু যে কি বলব?!!
অনেক অনেক ভালো লাগল।
স্বপ্নচারীকে নিয়ে আপ্নার লেখাগুলা অন্যরকমেরই স্বাদের হয়,
অনেক মনভরানো খুশির আকাঙ্ক্ষা হোক না তা কল্পনাতেই, একটা হাহাকার, আর আগে থেকেই ধরে নেয়া এই কল্পনা কখনো বাস্তবে রুপ নেবে না - ভালোলাগার কল্পনার গুলোর সাথে এই নিশ্চিত হেরে যাওয়ার মিশেলটা করেন।
লেখাগুলা ভালো হয় বেশ আপনার লেখার গুনেই।
কোন সে মহান রমণী
আপনার সম্পর্কে কোনো একটি ধারণা করবো এটি ধরে নিতে নিতেই আপনি পিছলে যান! মজার ব্যাপার
আহা কি মধুর!
তোমার স্মৃতি যত্নে থাকুক
বইয়ের ভাঁজে
আলমারিতে
তোমার স্মৃতি যত্নে থাকুক
নৌকা ছইয়ে
নদের স্রোতে
আপনার লেখা পড়ে আপানাকে দেখতে ইচ্ছে করছে এখন
লেখা পড়ে ভালো লাগলো
বিষয়টা আমিও ভুলে যাই বার বার ।
এইতো মনে করাইয়া দিলেন আবার
খুব মায়াভরা একটা লেখা..
মন্তব্য করুন