ধূলিময় জীবনের বৃত্তান্ত : যেভাবে মানুষ থেকে পশুতে রূপান্তরিত হয়েছিলাম
নগরজীবন ধূলিময়! শহরের অলমোস্ট সবখানে এখন নির্মাণ কাজ চলছে, আর ধূলা উড়ছে। দিন নেই, রাত নেই; সবসময়, সবখানে। এমন যদি আইন থাকতো যে, কোনো একটা নির্মাণ-সাইটে নির্দিষ্ট ভলিউমের চেয়ে বেশি ধূলা উদগীরণ করলে নির্ধারিত হারে জরিমানা গুণতে হবে; তাহলে বোধহয় এই অত্যাচারের হাত থেকে আমরা নগরবাসী সবাই একটা রেহাই পেতাম। যানজটের মতোই আরেকটা মহাসমস্যা হয়ে দাঁড়াতে যাচ্ছে ধূলার অত্যাচার।
আফতাবনগর জায়গাটা আমার বেশ প্রিয়। সুযোগ পেলেই যাই। নিরিবিলিতে সময়টা বেশ ভালো কাটে। উত্তপ্ত দুপুরে বিলের ঠান্ডা-কাকচোখ পানিতে পা ভিজাই। বিকেলে ঘাসের ওপর শুয়ে থাকি। একা একাই। সন্ধ্যায় প্রচুর মশা ছেঁকে ধরে। এলাকাটায় বদ্ধ পানি নেই তেমন একটা। তবুও প্রচুর মশা। পিন-পিন-পিন-পিন করতেই থাকে কানের কাছে এবং একই সময়ে অবধারিতভাবে ছয়-পাঁচটা বিষাক্ত হুলও ফোটে পাএর গোড়ালি কিংবা গালে। আমি তখন উঠে চলে আসি। জায়গাটা দিনের বেলাতেই সুন্দর শুধু। রাতে একটুও না। তবে এখানে আমার একটা ঘর থাকলে ভালো হতো। পারিপার্শ্বিক যন্ত্রণাগুলো মিনিমাইজ করে সেই ঘরে বসে প্রকৃতির স্পর্শ অনুভব করতে পারতাম। যতক্ষণ ইচ্ছে ততক্ষণ।
আমার প্রিয় বন্ধুদের তালিকায় উপরের দিকে থাকবে বোধহয় রাস্তার নাম। কারণ রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরেই আমার দিনের অধিকাংশ সময় কাটে। মাঝে মাঝে রাস্তার পাশে বস্তি দেখতে পাই। চিটচিটে-ময়লা কাপড়ের ওড়না প্যাচাঁনো মেয়েরা সেখানে থাকে। ছেলেরা বসে বসে দাঁত খুচায় আর মুখ খিচায়, সারাদিন।
ওদের হাতে কখনোই খুব বেশি টাকা থাকে না। মাসের শুরুতে হোক বা শেষে, কখনোই না। ওদের ছেলে-পিলেরা ভালো কোথাও পড়তে পারে না। ওরা নিজেরা পুষ্টিকর কিছু খেতে পারে না। ওদের সুন্দর কোনো স্বপ্ন নেই। দিনভর কেবল দুর্গন্ধ বয়ে বেড়ায়।
এই মানুষগুলোকে নিয়ে আমি মাঝে মাঝেই ভাবি। এরাও তো জীবন যাপন করছে। জীবনভর একই রকম থাকছে। তাহলে যে বলা হয়, দুঃখের পর সুখ আসে- সেই কথাটা কি ঠিক থাকলো?
সন্তান-সন্ততির ভালো পরিণতি কিন্তু এদের প্রথম চাওয়া নয়। দারিদ্রের কষাঘাতে আগাপাশতলা জর্জরিত এ মানুষগুলোর প্রথম চাওয়া হচ্ছে- নিজের অবস্থার উন্নতি। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করাতে চায়ও ওরা এই কারণে। যাতে ছেলেটা বা মেয়েটি বড় হয়ে, বিদ্যা-বুদ্ধি অর্জন করে; তাদের অবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে দেয়। ওদের ছেলেমেয়েরা একদিন ঠিকই বড় হয়। কিন্তু ওদের অবস্থার উন্নতি আর হয় না। হয় ছেলেমেয়েগুলো দারিদ্রের দুষ্টচক্রে আটকে যায়, নাহয় বাবা-মা'কে পরিত্যাগ করে। অর্থনৈতিক বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পেলেও, মুক্তি মেলে না সামাজিক বন্দিত্ব থেকে। তবে এখনো ওদের ৯৯ শতাংশই সাধারণত হার মানে অর্থনৈতিক বন্দিত্বর কাছে। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোই যেখানে আগের প্রজন্মের কাউকে ভরণ-পোষন করতে আজকাল পাচশ' বার চিন্তা করে, সেখানে গরীবদের দোষ দিয়ে কি লাভ? সামাজিক বন্দিত্ব নিয়ে মাথা ঘামানোর পর্যায়ে আসলে এখনো আমাদের নিম্নবিত্তরা পৌঁছায় নি। দীর্ঘ এ সমীকরণের ফলাফল- যেমন চলছিলো, তেমনই চলতে থাকে বস্তিবাসীদের জীবন। এর মানে তাহলে কি দাঁড়ালো, দুঃখের পর কি আসলেই সুখ আসে?
রাস্তায় ঘোরার সময় ওদেরকে দেখে দেখে আমি এসব ভাবি। একসময় আবার কেটেও পড়ি যেখানে দাঁড়িয়ে কথাগুলো ভাবছিলাম, সেখান থেকে। কারণ বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণের সুযোগ ওদের না থাকলেও, আমার আছে। সেজন্য আমাকে সময়ের সদ্ব্যহার করতে হয়। ভাবের ফিকিরে দিন পার করলে চলে না। পেটের ধান্দায় মনোযোগী হতে হয়।
মনোযোগে আবার চিড় ধরে, যখন আমি আবারো সমস্যাগ্রস্থ মানুষ দেখি। এরা বস্তিবাসীদের মতো সমস্যাগ্রস্থ নয়। এরা অন্যরকম। একেকজন একেকরকম। কয়েকটা উদাহরণ দিই। তাহলে বুঝতে পারবেন। কেউ হয়তো পুলিশের ধান্দাবাজির শিকার হয়েছে। পুলিশ তাকে ধরে এনে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে পুরে দিয়েছে। অপরাধ? মান্যবর পুলিশদেরকে চাঁদা না দেয়া। সরাসরি এই অভিযোগে তো আর ধরে নিয়ে আসার যায় না। তাই কোনো একটা মিথ্যা অভিযোগে ধরে এনেছে। এখন জেলখানার ভেতর সমঝোতা হচ্ছে। পুলিশকে টাকা দিয়ে সমস্যাগ্রস্থরা মুক্তি পাচ্ছে। ভূলুণ্ঠিত আত্মবিশ্বাসকে পদদলিত করে ফিরে যাচ্ছে পরিবার-পরিজনের কাছে। ‘কি ক্ষতি হতো আগেই পুলিশের সঙ্গে রফাটুকু করে নিলে। সেই তো মল খসালি, তবে কেন লোক হাসালি?’- আড়ে-ঠারে এসব কথা তাকে বোঝাতে চাইছে পাড়া-প্রতিবেশিরা।
আবার রাজনীতিবিদদের ধান্দাবাজির শিকার মানুষও আছে। এরা আসলে প্রচুর সংখ্যায় আছে। আমি-আপনি আমরাও কোনো না কোনোভাবে এদের ধান্দাবাজির শিকার। এইসব রাজনীতিবিদদের শুভাকাঙ্খী কোনো এক বড়-সড় ধান্দাবাজ কোনো এক কালে বলে গিয়েছিলো, ‘জনগণ নাকি কখনো ভুল করে না।’ এই একটা ডাহা মিথ্যা কথাকে পুঁজি করে রাজনীতিবিদ নামের এক শ্রেণীর মৌলবাদী নরপশু বাংলাদেশে প্রত্যেকটা সাধারণ মানুষের ওপর অসুরিক তান্ডব চালাচ্ছে, আজ অনেক দিন ধরে। বেকুব জনগণ আজন্ম ভুল করছে আর ভুলের মাশুল দিচ্ছে। একবার তারা আওয়ামী লীগকে ভোট দিচ্ছে, একবার বিএনপি’কে দিচ্ছে। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।
তাই পরপর চারবার একই ভুল করার পরও আজ যখন কেউ আমাকে বলে, জনগণ কখনো ভুল করে না; তখন আমি তার দিকে ভালো করে তাকাই। সে কোন্ ধান্দায় কথাটা আমাকে বলছে বোঝার চেষ্টা করি। জনগণ যদি ভুল না-ই করতো, তাহলে কি এ দেশে হাসিনার পর খালেদা, তারপর আবার হাসিনা- এভাবে ক্ষমতার ক্রমবিন্যাস হতে পারতো?
আজ আমরা যে অবস্থায় আছি, তা গত বিএনপি’র শাসনামলের চেয়ে খারাপ অবস্থা। গত বিএনপি’র শাসনামলে ছিলাম, গত আওয়ামী লীগের চেয়ে খারাপ অবস্থায়। এই কি জনগণের ভুল না করার ফলাফল? আজকে শেয়ার বাজারের বিনিয়োগকারীরা একে একে আত্মাহুতি দিচ্ছে। দেশের সর্বত্র খুন-ছিনতাই-ডাকাতি বেড়েছে। শুধু তাই নয়, সর্বশ্রেণীর মানুষের মধ্যে অমনুষ্যত্ব বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। ডাক্তার রোগীকে মেরে ফেলছে ভুল ইঞ্জেকশন দিয়ে। তার প্রতিবাদ করতে গেলে হাসপাতালের দারোয়ানরা লাঞ্ছিত করছে মৃতের সন্তান ও আত্মীয়দেরকে।
ডাক্তারদের কথায় পরে আসি, আগে ঐ দারোয়ানদের দিকে তাকাই। ওরা কিন্তু নিম্ন আয়ের মানুষ। ক্রমাগত জীবনের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হওয়া জনগণ। ওরা পর্যন্ত আজ আর মানুষ নেই। জানোয়ারে বদলে গেছে। জিজ্ঞেস করলে বলবে, পেটের তাগিদে কাজটা করেছে। এই বিবেকগ্রাসী পেটের তাগিদ যদি কোনোদিন বুমেরাং হয়ে ওইসব দারোয়ান পরিবারের সদস্যদের ওপরেই আক্রমণ চালায়, তখন আর যে যাই করুক; আমি অন্তত শত অন্যায় হতে দেখলেও ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়াবো না।
আর ওই ডাক্তার সৈয়দ মোজাফফর আহমেদ তো মনুষ্যত্ব হারিয়েছে আরো আগেই। সে যখন গোপনে গোপনে দুই নম্বুরী করতো, তখনও পর্যন্ত হয়তো মানুষ ছিলো। চাকুরীতে পর্যাপ্ত সময় ও মনোযোগ দেবার পরে ল্যাবএইডে গিয়ে পার্টটাইম করতো কিংবা নিজের ব্যক্তিগত ক্লিনিকে ডাক্তারী করতো। কিন্তু সেই লোক যখন দেখলো, দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৪৮ ঘন্টায় আসামী ধরার ঘোষণা দিয়ে- পরে আবোল-তাবোল বকে, তখন তার সাহস বেড়ে যায়।
তারও আগে এই শ্রেণীর মানুষদের সাহস বাড়ার প্রক্রিয়াটা শুরু হয়, যখন তারা দেখে এ দেশে ডাক্তারদের কেউ গাল দিলে; পুরো ডাক্তার-সমাজ এক হয়ে তার বিরুদ্ধে লেগে পড়ে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের মানসিক সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে কুণ্ঠা হয় না স্বাচিপের ডাক্তার নামধারী গুন্ডাদের। তখনই খুনী মোজাফফর'দের সাহস বাড়া শুরু হয়, কারণ তারা বুঝতে পারে- জনগণ ভুল করে ফেলেছে।
এই দেশে আজ ছয় বছরের শিশুকে ধর্ষণ করে, হত্যা করে, সিরিঞ্জ দিয়ে তার শরীরের রক্ত বের করে নিয়ে যাচ্ছে দুবৃত্তরা। সাহসটা পাচ্ছে, কারণ এই দেশে কোনো প্রকৃত অপরাধীর বিচার নাই। আর প্রকৃত অপরাধী হচ্ছে তারা, যারা ক্ষমতার কাছাকাছি বাস করে। প্রয়োজনে ক্ষমতা ব্যবহার করার ক্ষমতা রাখে। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট এক ঝটকায় বাবা-মা-ভাই-বোন-আত্মীয়-স্বজন হারানো শেখ হাসিনা ২০১২-তে এসে একই ধরনের পারিবারিক হত্যাকান্ডের ঘটনা দেখে বলছেন, ‘মানুষের বেডরুমের নিরাপত্তা দেবার দায়িত্ব আমার না।’ এরপরেও কি কেউ বলবেন, জনগণ ভুল সিদ্ধান্ত নেয় না?
ফিরে আসি ধান্দাবাজদের হাতে নিগৃহীত মানুষদের গল্পে। জাতির বিবেকখ্যাত সাংবাদিক শ্রেণীর প্রতিনিধিদের হাতেও ধান্দাবাজির শিকার হওয়া মানুষ আছে। ওয়ারীতে মেইন রোডের ওপর এক বাড়িওয়ালাকে নিজের বাড়ি থেকে উৎখাত করেছে তিন সাংবাদিক। তারপর বছর বছর ধরে ভোগদখল করে চলেছে সেই সম্পত্তি। উক্ত বাড়িওয়ালা পুলিশ-কোর্ট-কাচারি-সংবাদ সম্মেলন করে বেড়াচ্ছেন। তার ছেলে-মেয়েরা কষ্টে-সৃষ্টে বড় হয়ে এখন বাপ-মা’কে ফেলে নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ছেলে-মেয়েদেরকে দোষ দেয়া যায় না। সবার নিজ নিজ পরিবার আছে। স্বপ্ন আছে। স্ত্রী-সন্তানদের কাছে বাঁধা সবাই। বাপ-দাদা'র ঝুল-কালিমাখা পৈত্রিক ভিটে উদ্ধারে মনোযোগী হওয়ার সময় তাদের নেই। সাহসও নেই। কারণ দখলদারেরা সমাজের এক ক্ষমতাশালী শ্রেণীর প্রতিনিধি। তাদের আছে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সচিব বা মাস্তান শ্রেণীর লোকজনদের সঙ্গে পরিচয়। কেবল বাড়ির মালিক বুড়ো-বুড়ির কারো সঙ্গে পরিচয় নেই। তারা চেনেন ভগবানকে। তাদের দৃষ্টি এখন ঊর্ধ্বপানে। ভগবানই যদি এখন কিছু করেন।
টাউট-বাটপারদের ধান্দাবাজির শিকার মানুষ আছে। একটা গ্রামের আলাভোলা ছেলেকে ‘অমুক প্রতিষ্ঠানে’ চাকুরী পাইয়ে দেবো বলে, পাঁচ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে চম্পট দিয়েছে আরেকটা গ্রামের ছেলে। প্রতারিত ছেলেটা চোখের জল ফেলছে। বাবার শেষ সম্বল বিঘাটাক জমি বিক্রি করে জোগাড় করা টাকার শোকে।
আরেক গ্রামের মেয়েকে দুবাই পাঠানোর কথা বলে টাকা নিয়ে ভারতে বিক্রি করে দিয়েছে আদম ব্যপারীরা। বৃদ্ধ বাবা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন আমার মুখের দিকে। সেই মুখে অব্যক্ত যন্ত্রণা। অনুচ্চারিত প্রশ্ন, ‘কেন আমিই? জীবনের প্রত্যেকটা ঘাটে মার খেয়ে খেয়ে তিন কাল এককালে এনে ঠেকানো এই আমিই কেন আবারো??’
বৃদ্ধ জানেন না মেয়ের খবর। কিন্তু আমি জানি। তার মেয়েটি এখন বিহারের এক পতিতালয়ে। জাতীয় মহিলা আইনজীবী সংস্থার সদস্যরা চেষ্টা করছেন তাকে ফিরিয়ে আনবার। কিন্তু ওকে ফিরিয়ে এনে লাভ কি? তারপর বৃদ্ধ বাবা যখন সবকিছু জানবেন, তখন কি আর নিজের মেয়েকে ফিরিয়ে নেবেন?
দুনিয়ার তাবত পেশাজীবীদের গীবত গাইলাম, নিজেরটা বলবো না? নিজের ধান্দাবাজির কথাও বলি। উল্লিখিত সমস্যাগ্রস্থ মানুষদের জন্য আমার কিছু করার আছে। যদিও সেটা যৎসামান্যই। কিন্তু সেটুকু কাজে গাফিলতি না দিয়ে আমি এক ঢিলে দুই পাখি মারি। মনটাকে সান্ত্বনা দিই। পেটটাকে সচল রাখার রসদ জোগাই। তবে নিজের প্রতি ঘৃণা আমার কমে না। এহেন চতুর-চৌর্যবৃত্তি বোধহয় আমার পক্ষেই করা সম্ভব। কারণ আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী নিয়েছি। আমার পেটে যে বিদ্যে আছে।
তাই বস্তির মানুষদের দুর্গন্ধ আক্ষরিক অর্থেই নাকে এসে ধাক্কা মারলে, আমি রাস্তায় একদলা থু থু ফেলে- কর্মস্থলের পানে ছুটি। সমস্যাগ্রস্থ মানুষদের সমস্যা নির্বিকার মুখে শুনে, বিড়ি টানতে টানতে গিয়ে বসি অফিসের টেবিলে। নিজের যতটুকু সামর্থ্যে কুলায়, ততটুকু এদের জন্য করি। তারপরে গাএ বাতাস লাগিয়ে-লাগিয়ে ঘুরি রাস্তায়। আমার মতো আরো কিছু লুম্পেন বন্ধু, সম-অবস্থানের অধিকারক'দের সঙ্গে বসে গ্যাজাই। কার্ড খেলি। চা খাই। শেখ হাসিনাকে গালি দেই, খালেদা জিয়ার বাপ-মা নিয়ে টানাটানি করি। পাড়া-প্রতিবেশিদের সব খারাপ অভ্যাসগুলো নিয়ে আলোচনা করি। সন্ধ্যেটা বেশ কেটে যায়।
রাতে বাসায় ঢুকে দু’গাল ভাত খেয়ে কম্পিউটারের সামনে বসি। আমি টের পাই, আমার ভেতরে বেড়ে উঠছে এক দানব। রক্তে মিশে গেছে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের শরীরে ঢুকে পড়া সেই রাসায়নিক তরল। যে কারণে মন বলে নরম কোনোকিছু আমার ভেতরে আর অবশিষ্ট নেই। বাইরে থেকে আমার শরীরটা চামড়ায় আবৃত দেখালেও, এগুলো আসলে আঁশ। আমার গাএ মানুষের গন্ধ বলে যারা ভুল করেন, তাদের বলতে চাই এটা আঁশটে গন্ধ। আমার নির্লিপ্ত চোখের ভেতর জ্বলছে ক্ষুধার আগুন। সর্বগ্রাসী এই ক্ষুধা আমাকে মানুষ থেকে জন্তুতে রূপান্তরিত করে ফেলেছে অনেক আগেই। কিন্তু আপনারা কেউ টের পান নি।
আমি আজকাল স্বজাতির দুঃখে আলোড়িত হই না। বরং মনে মনে খুশি হই। খেয়ে-পড়ে বাঁচার আরো খানিকটা সংস্থান জুটে গেল। মিলে গেল আড্ডায় চিবানোর খোরাক। খুশি হই তাই খুন-জখম-ধোঁকাবাজির খবর দেখলে। যত বেশি নৃশংসতা দেখি, তত বেশি আনন্দিত হই। আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ি, খুনের পর শত চেষ্টায়ও পুলিশ আসামীকে ধরতে না পারলে। দেশের আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি উচ্ছন্নে গেলে, আড্ডার টেবিলে আমার চোখ চকচক করে।
এই বিবর্তন আমাকে মনে করিয়ে দেয়, নগরজীবন ধূলিময়। রাস্তাঘাটের ধূলা গিয়ে জমেছে মানুষের মনের ভেতর। তাদের মনের নরম কুঠুরিগুলো বুজে গেছে। আমি বুঝতে পারি, কেন কেউ আমার জন্তুত্ব টের পায় না। কারণ আশপাশের সবাই, সব্বাই একই পরিণতি বরণ করেছে। কেউ একটু কম আর কেউ একটু বেশি, এই হচ্ছে তফাৎ।
ব্লাড ডায়মন্ড (২০০৬) মুভিতে বস্ বলেছিলো, ‘তখন আমি চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম ঈশ্বর এ জায়গা ছেড়ে চলে গেছেন অনেক আগেই।’ প্রিয় লিওনার্দো, তুমি সৌভাগ্যবান। কারণ তোমাকে শুধু একবার সিনেমায় সাজানো বুলিটি আওড়াতে হয়েছিলো। আমি হতভাগা। কারণ আমাকে কথাটা সত্য জেনে প্রতিদিন একবার করে বলতে হয়।
---
গরীব দেশের গরীব নাগরিক! কস্টতো এট্টু সহ্য করাই লাগে! আলাদিনের চেরাগ ছাড়া উপায় নাই কোনো।
সেই। আলাদীনের চেরাগই দরকার। আপনারে ধইন্যা। জয়িতা'পুর পিসি ঠিক কৈরা দেওনের লাইগা। ভালো থাইকেন ভাইজান।
দেশের বাইরে এসে প্রথম প্রথম রাস্তাঘাটে হাটার সময়, বাস বা ট্রেনে চড়লে খুব মন খারাপ হয়ে যেত, শুধু মনে হতো কবে আমরাও নিজের দেশে এমন সুযোগ সুবিধা পাবো, ইদানিং ভীষণ রাগ লাগে, হতাশা জাগে আমরা এমন মানুষদের হাতে দেশ চালানোর ভার দেই, যারা শুধু শোষণ করে আর সাধারণ মানুষগুলোকে ঠকিয়ে নিজেদের মেয়াদ শেষ করে ... এই চক্র থেকে আদৌ কখনো মুক্তি মিলবে কিনা কে জানে..
মুক্তির বাবা মারা যাবার পর সেই যে সে মনের দুঃখে দেশান্তরী হইলো, তারপর তার আর কোনো দেখাই পাইলো না বঙ্গবাসী।
সবাই সবার নিজের ধান্দাতে। কাউরে নিয়ে ভাবার সময় আছে কিন্তু কিছু করার সময় কই। দুনিয়াটা দিন দিন আজব মনে হচ্ছে।
এই কথাটা আমিও বলি, আজব লাগে আজকাল সবকিছু।
দারুণ লিখেছেন মীর। ধান্দাবাজদের এই দেশে ঈশ্বর কোথায় আছে জানা নেই। তবে ঈশ্বরের কৃপা সবসময়ই চাই।
দু:খের পর সুখ আসে- কথাটা সেই ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা হয়নি এখনও। কখনও হবে সেই আশা যে করি না তা না।
আশা ছাইড়া দেন গো আফামনি। দুঃখের পর এখন আর সুখ আসে না, আসে আরেকটা দুঃখ। তারপরে আসে আরো বড় আরেকটা দুঃখ। সবশেষে আসে করুণ মৃত্যূ। লাইফের সিস্টেমই এখন এইটা। সার্কেলও বলতে পারেন চাইলে।
এইটুকু আশা ছেড়ে দিলে তো কিছুই থাকে না আর।
কিছু কি আসলেই আছে আপনের? আমার বা আমাদের? এমনকি আমরা যে বঞ্চিত, সেই বোধটাও আজ সমাধিস্থ। অনেক গভীরে সমাধিস্থ। খুঁড়ে শেষ করতে পারবেন না চাইলে।
হ জানি জানি। এই ইমোটার মালিকানা কিনছেন আপনে। যতই বলি এইটা দিবেন্না, ততই এইটা বেশি বেশি দেন সেইজন্য।
এক্টা কথা বলি আপনাকে-- কোন মেয়ে নিজের প্রতি, অন্যের প্রতি অথবা ঈশ্বরের প্রতি অভিমানী হয়ে গভীর রাতে নির্জনে অঝোরে কাঁদে। যদি কখনও কান্নাটাকে লুকাতে হয়, আটকে রাখকে হয়..তাহলে গলার কাছে পাথরের মত কি একটা আটকে থাকে। জোর করেও সে হাসতে পারে না।
মীর, ব্যানারটা জোশ হইছে।
কান্না কি প্রতিদিন পায়? প্রতিদিন কান্না পাওয়া কিন্তু অসম্ভব একটা ব্যপার। তারপরও কান্নাসমস্যার সমাধান হচ্ছে- জীবনটাকে অজস্র ব্যস্ততার পরতে মুড়ে ফেলতে হবে। এক পরতের ওপর আরেক পরত, তার ওপরে আরেক পরত, এভাবে যতগুলো পারা যায়। যেন বর্তমানের দিকে তাকানোরই ফুসরত না মেলে অন্তত দুই-তিন বছর।
ভাল্লাগছে নাকি? তাইলে ওদেরকে বলেন লাইটটা বন্ধ করে দিতে। তারপর আমরা সবাই ডান্স করি। ঐ ডান্সটারে জানি কি বলে, হালকা চালে ঘুরে ঘুরে যে করে? সেইটা।
অসাধারণ বস। আপনার লেখা সবসময়ই পড়ি, ভাল লাগে। যদিও মন্তব্য করা হয়ে ওঠেনা।
আপনার বেশিরভাগ লেখা আমার কাছে পার্ফেক্ট ব্লগ বলে মনে হয়।
চলুক।
ধন্যবাদ বারী ভাই। তাই আলোচনা বেশিদূর টানা গেল না। আপনি ব্লগে রেজিস্ট্রেশন করে ফেলেন না কেন? তাহলে আমিও আপনার লেখা সম্পর্কে একটা আইডিয়া পাই। মন্তব্য পড়ে তো আপনার লেখার হাত ঝরঝরে বলে মনে হলো।
আর এই লেখাটা আসলে ব্লগের জন্য কিছু একটা লেখার তাড়না থেকে লিখি নি। একদিন অকারণেই এমএস ওয়ার্ড খুলে টাইপ করতে করতে একসময় দেখলাম এটার কংকাল বেরিয়ে এলো। যদিও শেষ বিচারে লেখাটা একটা ব্লগপোস্টই। কিন্তু এটার সঙ্গে বোধহয় ব্লগের চেয়েও বেশি কিছু মিশে আছে। অনেক ধূলা মিশে থাকতে পারে। মহানগরীর ধূলা।
আবারো ধন্যবাদ আপনাকে। অধমের ব্লগে পদার্পণের জন্য। আবারো অনুরোধ রইলো, রেজিঃ করে ফেলার। যাতে আপনার সঙ্গে আরো আলাপের সুযোগ হয়। শুভকামনা।
অবস্হা এখন এমন দাড়াইছে,
ব্লগে পর্যন্ত এমন সাহসী কিছু লিখতে বুকের পাটা লাগে।
আশা করি, আপনেরে কেউ ফাসাইয়া দিব না কোন না কোন ধান্দায়!
কথা ভুল বলেন নাই। আসলেই ভয় লাগে। বেহুদা আবার কুন গ্যাঞ্জামে পইড়া যাই।
আর গ্যাঞ্জামতো সব ম্যাংগোপাব্লিকের। মির্জা ফখরুল সারাদিন প্রেসক্লাবে বইসা শেখ হাসিনার গুণকীর্তন গাইলেও তার কিছু হবে না। কারণ তারে কিছু করলে যে নিজের দলেরই বিপদ। আর সাধারণ মানুষের কথায় একটু পান থেকে চুন খসলেই হইসে। সঙ্গে সঙ্গে মাইর!
ভাবতে ভাল্লাগতেসে। আমরা বোধহয় আবার একটা চূড়ান্ত পরিণতির দিকে আগাচ্ছি।
এতকিছু বলে আর লাভ নাই । এই দেশে থাক্তে হইলে সব গা সওয়া করে নিতে হবে
। অথবা সত্যিকার অর্থে কিছু করতে হবে ।
সত্যিকার অর্থে কিছু করতে হবে মানে কি? তিব্বতিদের মতো গায়ে আগুন লাগায়ে দৌঁড় দেবো? এতে কাজ হবে?
দারুন বলেছেন বস, স্যালুট অপনেরে। অনেকদিন বাদে একটা অন্যরকম লেখা বেরুলো অপনার কি-বোর্ড থেকে। এভাবেই বা ভাবে কয়জনে...
ভাবে সবাই। ব্রিটল বিস্কুট হাতে জনগণের আসলে ভাবতে ভাবতে যায় বেলা। যে কারণে ভাবনাগুলোর সাজানো প্রকাশ দেখলে সবাই খুশি হয়। কিন্তু এসব ছাড়া কি আসলেই আর কারো কিছু করার নাই ভাইজান?
জীবনযাপন টা দিন দিন অসহনীয় হয়ে উঠছে... কিন্তু কোন সমাধান ও নাই
(
আপনে কানতে চাইছিলেন। কিন্তু চোখ দিয়ে পানি বের হয় নাই। ওই ইমোটা কিন্তু একটা নোটিশেবল সমস্যা ব্রাদার।
একটা অদ্ভুত দেশের অদ্ভুত মানুষ আমরা। আমাদের সব-ই গায়ে সয়ে যায়।
সত্যিই কি মানুষ লীনা আপু? নাকি দেখতে শুনতে ভালো বাট সামথিং এলস্?
তাও আশা ছাইড়েন না মীর
তাহলে বিস্তারিত বলেন ভাইজান। আপনে জানেন, আমরা কেউ আশা ছাড়তে চাই না?
একটা যৌক্তিক আশাবাদী স্বপ্নের লোভে হন্য হয়ে আছি মাসুম ভাই। বিস্তারিত বলেন, কেন আশা ছাড়বো না?
কি আর করা !
সেটাই, কি আর করা।
মন্তব্য করুন