নাম্ব সময়ের দিনলিপি
পহেলা বৈশাখ আর একুশে ফেব্রুয়ারিতে রাত ১০টার আগে ক্যাম্পাসে যেতে ভালো লাগে না। গিজগিজে ভিড় আর ধাক্কাধাক্কি-ঠেলাঠেলি। বিজয় দিবসে কখনো এত মানুষ ক্যাম্পাসে আসে না। তাই বিজয়ের দিনে আমার ক্যাম্পাসে টো টো করতে খুব ভালো লাগে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এবার বিজয় দিবসে (গতকাল) কয়েক লাখ মানুষ ক্যাম্পাসে হাজির হয়েছিলো কিন্তু সেই ভিড় দেখে খারাপ লাগে নি। কারণ কালকের ভিড়টা আজগুবি ছিলো না।
বিকেলের মাঝামাঝি সময়ে লাল আর সবুজ রং দেখতে দেখতে মাথা খারাপ হয়ে যাবার মুহুর্তে একবার আকাশী নীল রং চোখে পড়েছিলো। বহুদিন পর প্রিয় রংয়ের শাড়ি চোখে পড়লো। আবারও সেই ছিপছিপে লম্বা মেয়েটি। উবায়েদ ভাইয়ের দোকানে যাকে দেখেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম এবার ওর সাথে কয়েকটা কথা বলবো। অথচ ভিড় আমাদের দু'জনকে কাছাকাছি হতে দিলো না।
সন্ধ্যায় তুমুল বেগে সময় কাটছিলো। অসংখ্য কাজ সীমিত সময়ের ভেতর উঠিয়ে দেয়ার চাপ মাথায় নিয়ে সেই বেগ পোহাচ্ছিলাম। হঠাৎ মাথাটা ব্ল্যাঙ্ক হয়ে গেলো। ডেনমার্কের ইন্টার্নশীপটার কথা ছাড়া আর কিছুই তখন মনে পড়ছিলো না। আমি আর সজল গিয়েছিলাম সেখানে। এক মাসের জন্য। যদিও পরে ফিরবো-ফিরছি করতে করতে পার হয়েছে আরও এক মাস। দুই মাসের ডেনমার্ক সফরে আমাদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলো আনা। খুব ডানপিটে আর কাজের মেয়ে। আমরা ক্রনবর্গ দূর্গ পরিদর্শনে গিয়েছিলাম একসঙ্গে। কোপেনহেগেন থেকে ৪০ মিনিটের ট্রেন যাত্রা। ঠান্ডা বাতাস আর ঝড়ো হাওয়া থেকে বাঁচার জন্য সবাই উইন্ডব্রেকার চাপিয়ে নিয়েছি ওভারকোটের ওপর। শীতল হাওয়া তারপরও মাঝে মাঝেই অস্থি-মজ্জা পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছিলো। আর সে সময়কে সামাল দেয়ার জন্য ওভারকোটের বুক পকেটে ছিলো জ্যাক ড্যানিয়েলস্-এর স্টিলের ফ্লাক্স।
ক্রনবর্গ দূর্গে ঢুকেই মনে হলো ঝুপ করে চারপাশে আঁধার নেমে এসেছে। ফিরে গিয়েছি কয়েকশ' বছর পেছনের ওই সময়টায়, যখন রাজা ফ্রেডেরিখ তার রাণী সোফিকে নিয়ে বাস করতেন সেখানে। সেই দূর্গে একটা বিশাল ডান্সফ্লোর ছিলো। আমি আর আনা কিছুটা সময় নেচেছিলাম সেখানে। সজল ব্যস্ত ছিলো দূর্গের ইতিহাস আর খুঁটিনাটি তথ্য সংগ্রহে। আমরা দু'জন ব্যস্ত ছিলাম সেই সময়ের চাহিদা মেটাতে। ক্রনবর্গ দূর্গে আমাদের সময়টা দূর্দান্ত কেটেছিলো। আর বাইরে শোঁ শোঁ শব্দে তুষার ঝড় বয়ে যাচ্ছিলো। দূর্গ থেকে বের হয়ে সেদিন আমরা ফেরার রাস্তা খুঁজে পাই নি। সবকিছু তুষারে ঢেকে গিয়েছিলো।
এ পর্যন্ত ভাবতে ভাবতেই মাথার ইলেকট্রিসিটি ফিরে এলো এবং সবগুলো নিউরণ জ্বলে উঠলো একসাথে। আমি আবার ডুবে গেলাম কাজে। মাঝে মাঝে বন্ধু-বান্ধব পাশে এসে বসছে এবং চা-বিড়ি খাচ্ছে ও খাওয়াচ্ছে। আমি দেখছিও না কে এগিয়ে দিচ্ছে সিগারেটটা। দু' আঙুলের ফাঁকে সেটাকে ধরে সময়ের সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছি। চারদিকে হই-হল্লা, চিৎকার আর কথার তুবড়ি ছুটছিলো। মাঝে মাঝে একটা বিশ্রী ধরনের বেল বাজিয়ে কাস্টমারের বিল জানতে চাওয়া হচ্ছিলো।
একসময় সেই পরিবেশ থেকে মুক্তি পেলাম। আমার কাজ শেষ হয়ে হিম এসে পড়লো। সে এলে প্রথমেই ঢুকে পড়ে শরীরের ভেতরে। মিশে যেতে চায় রক্তের সাথে। আমি হালকা ঝাকুনি খেলাম। বিস্মিত হলাম ঠান্ডার মাত্রা দেখে।
নিজেকে বাঁচানোর জন্যই তারপর খড়ি আর ঝরাপাতা খুঁজতে যেতে হয়। আগুনটা জ্বলে জ্বলে একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ে যাওয়া পর্যন্ত শীত লাগতেই থাকে। তখন ভীষণ সংশয় জন্মায় নিজের ভেতর। অস্তিত্বটা কোথাও টিকে আছে কিনা নিশ্চিত হতে পারি না। ঠোঁট নাড়ানোর চেষ্টা করি কিন্তু শব্দ বের হয় না। চোখ খোলার চেষ্টা করি কিন্তু কোনো দৃশ্য ফোটে না। কেবল আবছা একটা আকাশী নীল অবয়ব সামনে ভাসে আর হেডফোনে বাজতে থাকে প্রিয় জর্জ রজার ওয়াটার্সের লেখা একটা গান। গানের লিরিকটা ছিলো অদ্ভুত আর মনে হচ্ছিলো এ যেন আমারই মনের কথা।
When I was a child
I caught a fleeting glimpse
Out of the corner of my eyeI turned to look but it was gone
I cannot put my finger on it now
The child is grown
The dream is gone
I Have become comfortably numb...
---
আহ! সিরাম নেশা লাগানো লেখা।
দারুণ!
লেখাটা সেরাম। এমন লেখা পড়তেও ভাল লাগে
বরাবরের মতোই দারুণ!!!
কেমন আছেন মীর? কেমন চলছে দিনকাল?
দারুণ!
জর্জ রজার ওয়াটার্সের গানটা শুনছি।
মন্তব্য করুন