তোমার ঘরের আলমারিটার ঝুলন-চাবি আমায় দেবে?
১.
বাংলাদেশ আর দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যকার শেষ দুইটা ম্যাচ দেখে মনে হলো, আমার ভেতরে ক্রিকেটের প্রতি আগে যে আকর্ষণটা ছিল, সেটা কমতে শুরু করেছে। আজকাল এত হেসেখেলে নিজের দেশকে জিততে দেখলেও সেই আনন্দে ফেটে পড়তে ইচ্ছে করে না, যেটা একসময় মোহাম্মদ রফিককে একটা ছক্কা পিটাতে দেখলে করতো। মুস্তাফিজ-সৌম্যদের চোখ ধাঁধানো বোলিং-ব্যাটিং দেখে সেই উত্তেজনা টের পাই না, যেটা একসময় অনিশ্চিত আফতাবকে ব্যাট হাতে মাঠে নামতে দেখলেই টের পেতাম। তবে নিজের কথা বাদ দিয়ে যদি ভাবি, তাহলে বলতে হবে- বাংলাদেশের খেলা দেখাটা এখন একটা শান্তির উপলক্ষ হয়ে গড়ে উঠেছে। পুড়ে যাওয়া ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাতাসে আমি কি কখনো খুব বেশি সুসংবাদ ভাসতে দেখেছি? রাজাকার কাদের মোল্লা আর কামারুজ্জামানের ফাঁসি এবং ক্রিকেট দলের উন্নতি ছাড়া?
২.
জীবনের ছোট ছোট সুখগুলোকে কখনোই অবহেলা করা উচিত না। একবার এক বর্ষণসিক্ত দুপুরে আমি আর এক হলুদ জামা পরা ডানাকাটা পরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন থেকে রিকশায় করে গাউসুল আজম মার্কেট পর্যন্ত গিয়েছিলাম। সে দিনটাও ছিল আজকের মতো ২রা শ্রাবণ। ছো্ট্ট সেই রিকশাভ্রমণের স্মৃতি আমার মস্তিষ্ক এত যত্ন করে সংরক্ষণ করেছে যে, এখনও যখনই ওই দিনের কথা মনে পড়ে আমি বৃষ্টির গন্ধ পাই। নিউমার্কেট থানার সামনের আমগাছগুলোর পাতা থেকে বৃষ্টির জল ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরতে দেখি। অথচ তারপর সেই পরীটার সাথে কতো-শতো রিকশাভ্রমণ করা হলো, সেদিনের স্মৃতিটার মতো করে মনে আর কোনো ছাপ পড়লো না। ইশ্ যদি জানতাম! তাহলে পুরোটা ভিডিও করে রাখতাম। যে ঘটনাটা আমি চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই, সেটা পৃথিবীর সবাইকে দেখিয়ে বলতে পারতাম, আমার জীবনের এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্মৃতি।
৩.
ইনসাইড আউট সিনেমায় খুব দারুণ করে দেখানো হয়েছে সুখ আর দুঃখ কিভাবে একে অপরের সাথে জড়িয়ে থাকে এবং কিভাবে একে অপরকে সাহায্য করে। আমরা যারা কোনোভাবেই নিজেদের অপরিসীম দুঃখকে মেনে নিতে পারি না, তাদের জানা দরকার- দুঃখরা আছে বলেই সুখগুলো এত উপভোগ্য। আমরা হোঁচট খাই উঠে দাঁড়ানো শেখার জন্য। যতো বেশি হোঁচট খাই, ততো বেশি আমরা শক্ত হয়ে দাঁড়াতে শিখি। ততো বেশি সামনের দিকে তাকাতে শিখি। সুখ-দুঃখের এই রসায়নটা অ্যামেইজিং, তাই না?
৪.
মিনিওনদের মধ্যে ববকে আমার সবচেয়ে বেশি কিউট লাগে। স্কারলেট যখন ঘুমপাড়ানি গল্পের ছলে মহারাণীর মুকুট চুরি করতে ব্যর্থ হলে ওদেরকে কি শাস্তি দেয়া হবে- সেটা শোনায়, তখন কেভিন আর স্টুয়ার্টের দাঁপ কপাটি লেগে গেলেও বব বিছানার একপাশে পড়ে পড়ে ঘুমায়। আর বাকিংহাম প্যালেসের বারান্দায় যখন কিং ববের অভিষেক হচ্ছিল, তখন এক দুবোর্ধ্য বক্তৃতা দিয়ে সে নিজের মাইক্রোফোনটা আস্তে করে বাইরে ফেলে দিলো। মানে, স্মার্টনেসের ডিপো একটা। আজকাল ম্যাকডোনাল্ডসে গেলে স্পিকার থেকে ভেসে আসে ববের কণ্ঠ, 'মাম্মা জিনা'। আর কোনো একটা অর্ডার পেলে ওদের যে কি খুশি। অনেকদিন পর একটা অ্যানিমেশন মুভি এত ভাল লাগলো। এর আগ পর্যন্ত ওয়াল-ই আর স্পিরিটেড অ্যাওয়ে আমার সবচেয়ে প্রিয় অ্যানিমেশন মুভি ছিল।
৫.
আমার এখানে আজ ঈদ হচ্ছে। যতোবার কথাটা মনে পড়ছে, ততোবার চোখের সামনে রাজনের ছোট্ট মুখটা ভেসে উঠছে। ছেলেটা হয়তো এবারের ঈদে পাওয়া সালামীর টাকা দিয়ে কি কি করবে, সব ঠিক করে রেখেছিল। বেঁচে থাকলে আজ সন্ধ্যায় নিশ্চই সে বন্ধুদের সাথে চাঁদ দেখতে বের হতো। ওর বয়সে ঈদ যে কতোটা আনন্দ আর উত্তেজনা নিয়ে জীবনে আসে, সেটা জানি খুব ভালো করেই। অথচ ছেলেটার জীবনে সেসবের কিছুই আসলো না। একপাল ইয়াবাখোরের মতো দেখতে নরপশু কি নিষ্ঠুর নির্মমতায় ছেলেটাকে পিটিয়ে মেরে ফেললো! রাজন এবং ওর মতো সব দুর্ভাগাদের কথা এমনভাবে মনে গেঁথে আছে যে, ঈদ নামের বিষয়টা ভেতরে ঢোকার কোনো সুযোগই পাচ্ছে না।
৬.
কোয়ালিটেটিভ-কোয়ান্টিটেটিভ রিসার্চের কাজ চলছে পুরোদমে। প্রায় সারাদিনই ডুবে থাকি ট্রান্সক্রিপ্ট, প্যারাফ্রেজিং, জেনারেলাইজেশন, রিডাকশন, ক্যাটেগরাইজেশন, ব্যাকটেস্টিং-এর মতো রষকষহীন ব্যাপারগুলোতে। মজার বিষয় হলো, কাজটা করতে খারাপ লাগছে না মোটেও। বরং কোথায় যেন এক ধরনের আগ্রহ টের পাচ্ছি। কখনো ভাবি নি, আমার পক্ষে দিনের মেজর সংখ্যক ঘন্টা অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার পেছনে ব্যায় করা সম্ভব হবে। চাইলেই সবকিছু থেকে খানিকের বিরতি নিয়ে রাস্তায় নেমে স্কেটিং শুরু করতে পারি। কফিভরা মগ হাতে খোলা আকাশের নিচে বসে চুটিয়ে এক পশলা আড্ডা দিয়ে আসাও কঠিন কিছু না। অথচ সেসবের কোনো কিছুতেই কেন যেন উৎসাহ পাচ্ছি না। সব ফোকাস গিয়ে একজোট হয়েছে আমার ডেস্কটপের রিসার্চ প্রজেক্ট নামের ফাইলটাতে। এলওএল।
৭.
যাহোক, পূর্ণেন্দু পত্রীর 'অনেককেই তো অনেক দিলে' কবিতাটা একটু বড়। তবে প্রথম দু'লাইন পড়ার পর এটা থেকে বের হওয়া সম্ভব না। বিশ্বাস না হলে যে কেউ ট্রাই করে দেখতে পারেন,
"আমি ছাড়া অনেককেই তো অনেক
দিলে।
এর আকাশে ওর আকাশে
ওষ্ঠপুটের অনেক পাখি উড়িয়ে দিলে
পায়রাকে ধান খুটিতে দিলে খোয়াই
জুড়ে
বুকের দুটো পর্দাঢাকা জানলা খুলে
কতজনকে হাত-ডোবানো বৃষ্টি দিলে।
কত মুখের রোদের রেখা মুছিয়ে দিলে
নীল রুমালে।
আমি ছাড়া অনেককেই তো অনেক
দিলে।
চায়ের কাপে মিষ্টি দিলে হাসির
থেকে
নকশাকাটা কাঁচের গ্লাসে সরবতে সুখ
মিশিয়ে দিলে।
নখের আঁচড় কাটতে দিলে ডালিমবনে
দাঁতের ফাঁকে লাল সুপুরি ভাঙ্গতে
দিলে।
আমি ছাড়া অনেককেই তো অনেক
দিলে।
একটা জিনিস দাওনি কেবল কাউকে
তুমি
আলমারিটার ঝুলন চাবি।
শূন্যতাকে রঙীন করার সাম্পু সাবান
সায়া শাড়ীর ভাঁজের নিচে
একটা ছোটো কৌটো আছে।
তার ভিতরে ভোমরা থাকে।
সে ভোমরাটি সকল জানে
কোন্ হাসিতে রক্ত ঝরে ঠিক অবিকল
হাসির মতো
সে ভোমরাটি সকল জানে
কোন রুমালে কান্না এবং কোন আঁচলে
বুকের ক্ষত
দেয়ালজুড়ে বিকট ছায়া ভাবছো বুঝি
অন্য কারো?
কার ছায়াটি কিরূপ গাঢ় সে
ভোমরাটি সকল জানে।
আমায় কিছু লিখতে হবে
লিখতে গেলে ভোমরাটি চাই।
তোমার ঘরের আলমারিটার ঝুলন-চাবি
আমায় দেবে?"
৮.
সবশেষে, লাভ ইউ ব্যাক, প্লুটো। ইউ লুক গর্জিয়াস ইন দৌজ ফোটোজ।
---
নোট: লেখাটার শিরোনাম এবং কবিতার জন্য প্রিয় কবির প্রতি কৃতজ্ঞতা।
কবিতাটা দারুন।
খুব মুচমুচে দিনলিপি। একটা কনটেস্ট হোক শান্ত-মীর দিনলিপি
এই ব্লগে অ্যাকটিভ লোক আছে মোটে তিনটা। তার মধ্যে দুইজনরে আপনে কনটেস্টে ঢুকায় দিতে চাইতেছেন। একটা বিচারক প্যানেল বানাইতেও তো তিনজন লাগে। সেইটা কেমনে বানাবেন?
১। হারতে হারতে হারতে হারতে
জেতার আনন্দটুকু যে কি ভয়ানক সুন্দর,
আজকালকার পুলাপাইনগুলা বুঝবো না!
২। আহ..
৩ ও ৪। স্টিল ওয়েটিং!
'স্পিরিট' দেখসেন?
৫।
৬।------
৭। সুন্দর অনেক।
৮। কুন ছবি?
উপসংহার - আপ্নের এই লেখাগুলো চমৎকার লাগে পড়তে,
মনে হয় আপ্নের সাথে বসে বসে আড্ডা দিতেছি!
উপসংহারটা ভাল্লাগসে সবচাইতে, সেজন্য পাঁচ কেজি ফ্রেশ ধইন্যাপাতা
প্লুটোর তো অনেক ছবিই আছে, হার্টশেপওয়ালা প্রায় সবগুলাই আমার ভাল্লাগে। দেখলে মনে হয়, প্লুটো আমাদেরকে দুইহাত দিয়ে হার্ট বানায়া দেখাইতেসে। আপনের জন্য একটা ছবি এইখানে দিলাম, নাসার ওয়েবসাইট থেকে নেয়া---
স্পিরিট দেখছি। ভাল্লাগসে। তবে আমার প্রিয় তালিকায় সামনের দিকে নাই
ভাল থাইকেন। শুভেচ্ছা নিরন্তর।
প্লুটোর এই ব্যাপারটা জানতাম না, ভাল্লাগছে অনেক।
মন্তব্য করুন